শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে ত্রিপুরার জনগণ প্রস্তুত

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দিনের ত্রিপুরা সফরে ১১ জানুয়ারি আগরতলা আসছেন। ত্রিপুরার সব অংশের জনগণ বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত। বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিপুরার জনগণের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সম্পর্ক। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ক্ষমতালোভী কংগ্রেস দল এবং মুসলিম লীগের নেতাদের গোপন রফায় দেশ ভাগের ফলে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বলি হয়ে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ থেকে হাজার হাজার মানুষ ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়। স্বভাবতই ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের শেকড় বাংলাদেশ।


১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের সময় ত্রিপুরার সে সময়কার জনসংখ্যার প্রায় সমানসংখ্যক বাংলাদেশি শরণার্থীকে এ রাজ্যের উপজাতি-অউপজাতি অধিবাসী পরম মমতায় স্থান দিয়েছে। একই পরিবারের সদস্যের মতো ত্রিপুরার অধিবাসী এবং বাংলাদেশের শরণার্থীরা সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়েছে। মূলত ত্রিপুরাকে ঘাঁটি করে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা স্বদেশকে মুক্ত করতে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই চালিয়েছেন। প্রতিহিংসা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজধানী আগরতলাসহ ত্রিপুরার বিভিন্ন স্থানে গুলি বর্ষণ করে অনেককে হতাহত করেছিল। ভারতের জনগণ এবং সেনাবাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে। প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে ত্রিপুরার জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের আত্মীয়তার বন্ধন আরো সুদৃঢ় হয়েছিল।
কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং বাংলাদেশে তাদের অনুচররা মেনে নিতে পারেনি। বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের পুরোধা শেখ মুজিবুর রহমানকে সাম্রাজ্যবাদী চক্রের ষড়যন্ত্রীরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করে। শেখ মুজিবুর রহমানের দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা সে সময় জার্মানিতে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে সংঘটিত এই মর্মান্তিক ঘটনার পর পাকিস্তানি ঐতিহ্যের অনুসারী হয়ে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একাংশের অফিসার গণতন্ত্র ও সংবিধান পদদলিত করে রাষ্ট্রক্ষমতা অবৈধভাবে দখল করেন। তাঁদের মদদে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিরোধী ইসলামী মৌলবাদী শক্তিগুলো রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুনর্বাসন পায়।
কুখ্যাত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বাংলাদেশের সামরিক জান্তা এবং ইসলামী মৌলবাদী শক্তিগুলোর সহায়তায় ব্যাপকভাবে ভারতবিরোধী কার্যকলাপ চালাতে শুরু করে। ত্রিপুরাসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর উপজাতি যুবকদের একাংশকে বিভ্রান্ত করে সিআইএ এবং আইএসআই বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্লোগান তোলায় এবং অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে সন্ত্রাস ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ চালাতে সব রকম সহায়তা দেয়। সিআইএর ষড়যন্ত্রের মূল লক্ষ্য উত্তর-পূর্ব ভারতকে বিচ্ছিন্ন করা, ভারতের একতা ও সংহতি দুর্বল করা। সিআইএ-আইএসআই মদদপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসবাদীরা বাংলাদেশকে নিরাপদ ঘাঁটি করে গত তিন দশকে ত্রিপুরার বামপন্থী-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বহু নেতা-কর্মী, নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে বহু নিরীহ মানুষ, নিরাপত্তা বাহিনীর বহু অফিসার ও জওয়ানকে নৃশংস কায়দায় হত্যা করেছে। উন্নয়ন স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তেমনি আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম ইত্যাদি রাজ্যেও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ব্যাপক হত্যালীলা চালিয়ে আসছে।
আন্তর্জাতিক ইসলামী সন্ত্রাসবাদীরা বাংলাদেশকে ঘাঁটি করে ভারতের রাজধানী দিলি্লসহ বিভিন্ন স্থানে বহু সন্ত্রাসমূলক আক্রমণ সংঘটিত করেছে।
বাংলাদেশকে ঘাঁটি করে ত্রিপুরা ও ভারতের অন্যান্য স্থানে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ সংঘটিত হওয়ার ঘটনাবলিতে দুই দেশের জনগণের মধ্যে এবং সরকারি পর্যায়ে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সন্ত্রাসবাদীদের অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য ভারতকে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করতে হয়।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণ ১৯৯০ সালে সামরিক জান্তার শাসনের অবসান ঘটায়। ফের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কিংবদন্তি নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে উদ্যোগী হন। বিশেষ করে ২০০৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সার্বিক সহযোগিতার সম্পর্ক প্রসারে অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ভারতবিরোধী বৈরী কার্যকলাপ চালানোর জন্য ব্যবহৃত হতে দেওয়া হবে না।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের ফলে সবচেয়ে জটিল সমস্যায় পড়ে ত্রিপুরার জনগণ। ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ত্রিপুরার সড়ক, রেল ও জনপথে যোগাযোগ ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গ দিয়ে। কিন্তু দেশ ভাগের ফলে ত্রিপুরা ভৌগোলিক দিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। উদ্বাস্তু আগমনে জনসংখ্যার ভারসাম্য পরিবর্তিত হওয়ায় নানা জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়। পরিকাঠামোর অভাবে উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
ভৌগোলিক অবরুদ্ধ অবস্থা কাটাতে ত্রিপুরা সরকার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য যাত্রী ও পণ্য চলাচলে ট্রানজিট সুবিধা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, বিনিয়োগ, পর্যটন, সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পারস্পরিক আদান-প্রদান বাড়াতে অনেক সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছে। এসব কার্যকর হলে দুই দেশই লাভবান হবে। দুই দেশের জনগণের মৈত্রী ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক সুদৃঢ় হবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রিপুরা সফর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এবং বিশেষ করে ত্রিপুরা-বাংলাদেশ সম্পর্ক সুনিবিড় করতে এবং সহমর্মিতার মনোভাব নিয়ে পরস্পরকে সহযোগিতায় নিঃসন্দেহে মাইলফলক স্থাপন করবে।
[ত্রিপুরার দৈনিক 'ডেইলি দেশের কথা'য় ১০ জানুয়ারি প্রকাশিত সম্পাদকীয়]

No comments

Powered by Blogger.