আনে আপেলবোম-দখলের আন্দোলন এবং গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা

ত সপ্তাহে লন্ডনে সেন্ট পল ক্যাথিড্রালের সামনে 'লন্ডন স্টক এঙ্চেঞ্জ দখল করো' নামে যে বিক্ষোভ হয়েছে, তা বারবার ঘটতে দেখা খুব সহজ বিষয় নয়। এর সব কিছুই ছিল সম্পূর্ণ ব্রিটেনের মতো করেই। জনগণ রাস্তার পাশে নাশতা বানিয়ে খেয়েছে। তারা ওয়াল স্ট্রিট প্রতিবাদকে তুলে ধরেছে। লন্ডনের এই প্রতিবাদকারীরা এমনকি মানবকণ্ঠকে মাইক হিসেবে ব্যবহার করেছে, যেটা নিউ ইয়র্কের জুকোতি পার্কে করা হয়েছিল।


বক্তা যা বলেন, তা সামনের সারির জনতা চিৎকার করে রিপিট করে, যাতে পেছনে থাকা অন্যরা শুনতে পায়। অথচ লন্ডনে মেগাফোন বা মাইক্রোফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ নয়। গার্ডিয়ান অনলাইন ভিডিওতে দেখা যেতে পারে জনগণের সেই স্লোগানগুলো :
'আমাদের একটি পদক্ষেপ দরকার' (সামনের জনগণ বলছে, আমাদের একটি পদক্ষেপ দরকার!)।
'এই সমাবেশ ডাকার একটি উদ্দেশ্য ছিল' (এই সমাবেশ ডাকার একটি উদ্দেশ্য ছিল!)
'আমরা জানি যে আপনারা সেখানে' (আমরা জানি যে আপনারা সেখানে!)
'আপনাদের সঙ্গে আমাদের সহমত রয়েছে।' (আপনাদের সঙ্গে আমাদের সহমত রয়েছে!)
অনুসরণ না করেও এর সঙ্গে মিলে যায় মন্টি পাইথনের (ব্রিটেনের একটি কমেডি গ্রুপ) ছবি 'লাইফ অব ব্রায়ান'। সেখানে ব্রায়ান জনগণের উদ্দেশে উচ্চ স্বরে বলছে, 'তোমরা সবাই স্বতন্ত্র ব্যক্তি!'
সমাবেশের লোকেরা রিপিট করে বলছে, 'আমরা সবাই স্বতন্ত্র ব্যক্তি!'
আমার আমেরিকান শ্রুতিতে এই ঘটনাবলিকে ব্রিটেনের এবং মন্টি পাইথনের ছবির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে হয়েছে। কিন্তু এ ঘটনা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয় : অপরিহার্যভাবে এই দখলের আন্দোলন স্পেনে প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল গত বসন্তে, যা ইউরোপে 'দেশীয়' হিসেবে পরিচিত। এ আন্দোলন একেক স্থানে একেক রকম জাতীয় চরিত্র ধারণ করে। 'টোকিও দখল করো' মিছিলকারীরা পরমাণু ইস্যুতে স্লোগান দেয়। 'সিডনি দখল করো' আন্দোলন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কারণ একজন মুখপাত্র যেমন স্বীকার করেছেন, 'আমাদের অস্ট্রেলিয়ায় সংকটের গভীরতা নেই।' রোমে ঐতিহাসিকভাবেই উগ্র রাজনীতি সহিংসতার সীমায় পেঁৗছে যায়। সেখানে মিছিল ইতিমধ্যেই দাঙ্গার রূপ নিয়েছে। সে কারণে কোটি কোটি ডলারের ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
অবশ্যই এ আন্তর্জাতিক প্রতিবাদে তাদের মধ্যে বিশেষ কোনো সাদৃশ্য নেই, বিশ্বায়নবিরোধী আন্দোলনে একের সঙ্গে অন্যের যেমনটি সাদৃশ্য দেখা গেছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিগত অভাব রয়েছে, অনেকটা অসংগঠিত এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহাবস্থান তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। নিউ ইয়র্কে মিছিলকারীরা উচ্চ স্বরে স্লোগান দিয়েছে, 'এটাই হলো গণতন্ত্রের চেহারা।' কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা গণতন্ত্রের চেহারা নয়। এটা হলো বাকস্বাধীনতার চেহারা। গণতন্ত্র অনেক বেশি বোরিং। গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন হয় প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন, রাজনৈতিক দল, আইন ও বিচারব্যবস্থা। গণতন্ত্র অনেকটা বিবর্ণ, তার জন্য সময়ক্ষেপণকারী কর্মকাণ্ড প্রয়োজন হয়, যার কোনোটিই সেন্ট পল ক্যাথিড্রালের সামনের অবস্থান অথবা প্যারিসের রঙে সেন্ট মার্টিনের সামনে স্লোগান দেওয়া নয়।
তার পরও এক হিসেবে আন্তর্জাতিক এই দখল আন্দোলনের ব্যর্থতা একটি আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় : বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট এবং এর সমাধান দুটোই রয়েছে স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিকদের হাতের বাইরে। কয়েক বছর আগে আমি প্রথম গ্রিসের দাঙ্গার সময় লিখেছিলাম, কেউ ক্ষমতাহীন নেতাদের সমর্থন করে না। কেউ এমন কোনো ব্যক্তিকে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে কোনো যুক্তি দেখতে পায় না যিনি নিউ ইয়র্ক, ব্রাসেলস ও বেইজিংয়ের মতো আরো একটি অর্থনৈতিক যন্ত্রণাকে রুখতে পারবেন না। আপনি যদি আপনার দেশের ঋণগ্রস্ত ব্যাংকের কারণে বাজেট ঘাটতির পদক্ষেপ দেখে হতাশ হন, তাহলে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে সেভিলের মেয়রকে অভিযোগ করাটা যৌক্তিক নয়।
কোনো ঐক্যবদ্ধ প্রোগ্রাম ছাড়া আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ আন্দোলনটি কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি একটি গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি, যার পরিষ্কার কোনো সমাধান নেই। গণতন্ত্র আইনের শাসনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। গণতন্ত্র কার্যকর হয় একটি স্বতন্ত্র সীমান্তের ভেতরে জনগণের জন্য যারা নিজেদের একটি জাতি বলে মনে করে। বৈশ্বিক সম্প্রদায় দিয়ে একটি জাতীয় গণতন্ত্র হয় না এবং একটি জাতির গণতন্ত্র নির্দেশ দিতে পারে না বিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক উদ্ধার তহবিলের।
বিষয়টি মিসরের তাহরির স্কয়ারের মতো নয়, যাদের সঙ্গে নিউ ইয়র্ক ও লন্ডনের প্রতিবাদকারীরা নিজেদের তুলনা করছে। আমাদের পশ্চিমা বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই গণতন্ত্র এমনভাবে তৈরি যেখানে জনগণের রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তারা বিশ্বের রাজনৈতিক পরিবর্তনে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারে না। অথবা তাদের সীমান্তের বাইরে অন্য দেশে যা ঘটছে সেসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যদিও আমি এখনো অর্থনীতি ও আর্থিক লাভের বিশ্বায়নে বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করি উন্মুক্ত সীমান্ত, অবাধ যাতায়াত ও অবাধ বাণিজ্যে। কিন্তু বিশ্বায়ন পরিষ্কারভাবেই পশ্চিমের গণতন্ত্রের বৈধতাকে খাটো করতে শুরু করেছে।
বৈশ্বিক কর্মীরা যদি সচেতন না হন তাহলে এই আরো মন্দ অবস্থার সৃষ্টি হবে। লন্ডনের প্রতিবাদকারীরা স্লোগান দেয়, আমাদের একটি পদক্ষেপ প্রয়োজন! ঠিক আছে, তাদের তো ইতিমধ্যেই একটি পদক্ষেপ রয়েছে। তার নাম ব্রিটিশ রাজনৈতিক সিস্টেম। তারা যদি না জানে যে এই সিস্টেমকে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে, তাহলে তারাই এটাকে আরো দুর্বল করে ফেলবে।
লেখক : পুলিৎজারপ্রাপ্ত মার্কিন সাংবাদিক ও কলামিস্ট
১৮ অক্টোবর ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত নিবন্ধ।
অনুবাদ : মহসীন হাবিব


No comments

Powered by Blogger.