জন্মদিন-শুভ জন্মদিন! সায়মন
কুয়াশা-ঢাকা বিষণ্নতা কাটিয়ে রোদেলা দুপুরে শহরটা কেমন যেন ঝকঝক করে হেসে উঠল। দূর থেকে দেখে সায়মনের হাঁটার নিজস্ব ছন্দ থেমে গেল হঠাৎ। সোনারগাঁও হোটেলের করিডর। হাতটা চেপে, ধরে আসা গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘কত বছর পর?’ অন্য রকম শিহরণ নিয়ে উত্তর দিলাম, ‘প্রায় ১১ বছর।’ বাংলাদেশের এক পরিবর্তনের নির্মাতা সায়মন ড্রিং। আমরা যারা বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশনকর্মী, সায়মন আমাদের বন্ধু, আমাদের শিক্ষক।
আন্তর্জাতিক পুরস্কারজয়ী ব্রিটিশ সাংবাদিক, টেলিভিশন উপস্থাপক ও প্রযোজক সায়মন ড্রিং ১৯৪৫ সালের ১১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন ইংল্যান্ডের ফাকেনহাম নামক ছোট্ট শহরে। পেশাগত জীবনে ২২টি যুদ্ধ ও অভ্যুত্থান কাভার করেছেন। লন্ডনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, ‘রয়টার্স’-এর হয়ে সারা পৃথিবী ঘুরেছেন সাংবাদিক হিসেবে। বিবিসি টেলিভিশন ও রেডিওর সংবাদ এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে কাজ করেছেন প্রায় ২০ বছর। এ ছাড়া চলচ্চিত্র, আন্তর্জাতিক ইভেন্ট ও সংগীত বিষয়ে সায়মন ড্রিংয়ের রয়েছে ব্যাপক অভিজ্ঞতা।
১৯৬২ সাল, যখন সায়মনের বয়স ১৬ বছর, তখন বাড়ি থেকে পালিয়ে ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ঘুরতে বের হন। ১৯৬৩ সালে সায়মন প্রথম চাকরিজীবন শুরু করেন ব্যাংকক থেকে প্রকাশিতওয়ার্ল্ড নিউজপেপার-এ সম্পাদনা সহকারী (প্রুফ রিডার) হিসেবে। ১৯৬৪ সালে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমস-এর স্ট্রিংগার হিসেবে কাজ করেন লাওস থেকে। একই বছরে সায়মন ভিয়েতনাম যুদ্ধের কাভার করেন রয়টার্সের সাংবাদিক হিসেবে। তৎকালীন রয়টার্সের বয়সে সবচেয়ে ছোট বৈদেশিক সংবাদদাতা তিনি।
১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ডেইলি টেলিগ্রাফ এবং ‘বিবিসি টেলিভিশন’-এর হয়ে নিউজ কাভার করতে থাকেন নিয়মিত। তখন তাঁর বিচরণক্ষেত্র ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। তা ছাড়া আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে সংবাদ পাঠাতে থাকেন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের গণহত্যার ওপর প্রতিবেদন তাঁর খ্যাতি এনে দেয় বিশ্বজোড়া। সায়মন ড্রিং ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম বিদেশি সাংবাদিক, যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেন পাকিস্তানি বাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতন ও গণহত্যার কথা। তাঁর প্রতিবেদনের পরপরই সারা বিশ্ব জানতে থাকে বাংলাদেশের ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে। ইরানের শাহবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে সায়মন ড্রিং নন্দিত হয়েছিলেন এবং অর্জন করেছিলেন অনেক পুরস্কার।
সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে দুবার আহতও হয়েছিলেন। প্রথমবার ভিয়েতনামে এবং দ্বিতীয়বার সাইপ্রাসে তুর্কির আগ্রাসনে। বিবিসিতে কর্মরত অবস্থায় তিনি অনেকগুলো প্রামাণ্যচিত্র প্রযোজনা ও উপস্থাপনা করেন।
আশির দশকের শুরুর দিকে সায়মন ড্রিং বিবিসি ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিল্ম কোম্পানি খোলেন। সেখান থেকে বিবিসি ও পাবলিক ব্রডকাস্ট সার্ভিসের জন্য নির্মাণ করেন বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র। তা ছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও লাতিন আমেরিকার ওপর নির্মাণ করেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান। এসব প্রামাণ্যচিত্র বা অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, পরিচালক ও প্রযোজক ছিলেন তিনি নিজেই।
১৯৮৬ সালে সায়মন ড্রিং ফিরে আসেন লন্ডনে এবং সেখানে ডিজাইন করেন ‘স্পোর্ট এইড’ ও ‘দ্য রেস এসেইন্ট টাইম’ নামে দুটি আন্তর্জাতিক ইভেন্ট। ‘স্পোর্ট এইড’—ইভেন্ট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এবং অধিক মানুষের অংশগ্রহণের অনুষ্ঠান। বিশ্বব্যাপী ১২০টি দেশের প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। আর দ্বিতীয় ইভেন্টে ১৬০টি দেশের প্রায় ৫৫ মিলিয়ন মানুষ অংশগ্রহণ করে।
বিবিসি রেডিও ও টেলিভিশনে কাজ করার পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে লিখতে থাকেন তিনি।
১৯৯০ সালে নির্মাণ করেন অন দ্য রোড এগেইন নামে আট পর্বের একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান, যা বিবিসি ও ডিসকভারিতে দেখানো হয়। একই নামে বিবিসি থেকে প্রকাশিত হয় একটি বই।
বিবিসি রেডিও ফোরের জন্য নির্মাণ করেন ৪০ মিনিটের রিটার্ন দ্য রোলিং থান্ডার, যা ছিল তাঁর ২০ বছর পর ভিয়েতনামে ফিরে যাওয়ার স্মৃতি নিয়ে অনুষ্ঠান। হাইতিতে আমেরিকার আগ্রাসন নিয়ে ভুডু ডানসিংসহ আরও অনেক টেলিভিশন অনুষ্ঠান। তা ছাড়া সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানদের।
সায়মন ড্রিং অর্জন করেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এর মধ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করে পুরস্কার পান ‘রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার’, ইরান বিপ্লবের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করে অর্জন করেন ‘ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার’, ইরিত্রিয়া যুদ্ধের ওপর ‘ভ্যালিয়ান্ট ফর ট্রুথ’, কুর্দিদের বিরুদ্ধে তুরস্কের যুদ্ধের প্রতিবেদনের জন্য অর্জন করেন ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’, বসনিয়া যুদ্ধের প্রতিবেদনের জন্য ‘সনি’ এবং হাইতিতে আমেরিকান আগ্রাসনের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করে অর্জন করেন ‘নিউইয়র্ক ফেস্টিভ্যাল গ্র্যান্ড প্রাইজ’।
১৯৯৭ সালে বিবিসি ছেড়ে যোগ দেন বাংলাদেশের একুশে টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। সায়মন ড্রিং বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশনের আধুনিকতার অন্যতম রূপকার। ২০০২ সালে একুশে টেলিভিশন বন্ধ করে দেওয়ার পর ১ অক্টোবর সায়মন ড্রিংকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। ১৯৭১ সালেও তাঁকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক জোর করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।
পারভেজ চৌধুরী
১৯৬২ সাল, যখন সায়মনের বয়স ১৬ বছর, তখন বাড়ি থেকে পালিয়ে ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ঘুরতে বের হন। ১৯৬৩ সালে সায়মন প্রথম চাকরিজীবন শুরু করেন ব্যাংকক থেকে প্রকাশিতওয়ার্ল্ড নিউজপেপার-এ সম্পাদনা সহকারী (প্রুফ রিডার) হিসেবে। ১৯৬৪ সালে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমস-এর স্ট্রিংগার হিসেবে কাজ করেন লাওস থেকে। একই বছরে সায়মন ভিয়েতনাম যুদ্ধের কাভার করেন রয়টার্সের সাংবাদিক হিসেবে। তৎকালীন রয়টার্সের বয়সে সবচেয়ে ছোট বৈদেশিক সংবাদদাতা তিনি।
১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ডেইলি টেলিগ্রাফ এবং ‘বিবিসি টেলিভিশন’-এর হয়ে নিউজ কাভার করতে থাকেন নিয়মিত। তখন তাঁর বিচরণক্ষেত্র ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। তা ছাড়া আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে সংবাদ পাঠাতে থাকেন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের গণহত্যার ওপর প্রতিবেদন তাঁর খ্যাতি এনে দেয় বিশ্বজোড়া। সায়মন ড্রিং ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম বিদেশি সাংবাদিক, যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেন পাকিস্তানি বাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতন ও গণহত্যার কথা। তাঁর প্রতিবেদনের পরপরই সারা বিশ্ব জানতে থাকে বাংলাদেশের ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে। ইরানের শাহবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে সায়মন ড্রিং নন্দিত হয়েছিলেন এবং অর্জন করেছিলেন অনেক পুরস্কার।
সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে দুবার আহতও হয়েছিলেন। প্রথমবার ভিয়েতনামে এবং দ্বিতীয়বার সাইপ্রাসে তুর্কির আগ্রাসনে। বিবিসিতে কর্মরত অবস্থায় তিনি অনেকগুলো প্রামাণ্যচিত্র প্রযোজনা ও উপস্থাপনা করেন।
আশির দশকের শুরুর দিকে সায়মন ড্রিং বিবিসি ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিল্ম কোম্পানি খোলেন। সেখান থেকে বিবিসি ও পাবলিক ব্রডকাস্ট সার্ভিসের জন্য নির্মাণ করেন বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র। তা ছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও লাতিন আমেরিকার ওপর নির্মাণ করেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান। এসব প্রামাণ্যচিত্র বা অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, পরিচালক ও প্রযোজক ছিলেন তিনি নিজেই।
১৯৮৬ সালে সায়মন ড্রিং ফিরে আসেন লন্ডনে এবং সেখানে ডিজাইন করেন ‘স্পোর্ট এইড’ ও ‘দ্য রেস এসেইন্ট টাইম’ নামে দুটি আন্তর্জাতিক ইভেন্ট। ‘স্পোর্ট এইড’—ইভেন্ট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এবং অধিক মানুষের অংশগ্রহণের অনুষ্ঠান। বিশ্বব্যাপী ১২০টি দেশের প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। আর দ্বিতীয় ইভেন্টে ১৬০টি দেশের প্রায় ৫৫ মিলিয়ন মানুষ অংশগ্রহণ করে।
বিবিসি রেডিও ও টেলিভিশনে কাজ করার পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে লিখতে থাকেন তিনি।
১৯৯০ সালে নির্মাণ করেন অন দ্য রোড এগেইন নামে আট পর্বের একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান, যা বিবিসি ও ডিসকভারিতে দেখানো হয়। একই নামে বিবিসি থেকে প্রকাশিত হয় একটি বই।
বিবিসি রেডিও ফোরের জন্য নির্মাণ করেন ৪০ মিনিটের রিটার্ন দ্য রোলিং থান্ডার, যা ছিল তাঁর ২০ বছর পর ভিয়েতনামে ফিরে যাওয়ার স্মৃতি নিয়ে অনুষ্ঠান। হাইতিতে আমেরিকার আগ্রাসন নিয়ে ভুডু ডানসিংসহ আরও অনেক টেলিভিশন অনুষ্ঠান। তা ছাড়া সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানদের।
সায়মন ড্রিং অর্জন করেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এর মধ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করে পুরস্কার পান ‘রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার’, ইরান বিপ্লবের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করে অর্জন করেন ‘ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার’, ইরিত্রিয়া যুদ্ধের ওপর ‘ভ্যালিয়ান্ট ফর ট্রুথ’, কুর্দিদের বিরুদ্ধে তুরস্কের যুদ্ধের প্রতিবেদনের জন্য অর্জন করেন ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’, বসনিয়া যুদ্ধের প্রতিবেদনের জন্য ‘সনি’ এবং হাইতিতে আমেরিকান আগ্রাসনের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করে অর্জন করেন ‘নিউইয়র্ক ফেস্টিভ্যাল গ্র্যান্ড প্রাইজ’।
১৯৯৭ সালে বিবিসি ছেড়ে যোগ দেন বাংলাদেশের একুশে টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। সায়মন ড্রিং বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশনের আধুনিকতার অন্যতম রূপকার। ২০০২ সালে একুশে টেলিভিশন বন্ধ করে দেওয়ার পর ১ অক্টোবর সায়মন ড্রিংকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। ১৯৭১ সালেও তাঁকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক জোর করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।
পারভেজ চৌধুরী
No comments