মূল্যস্ফীতি অবদমনের সহায়ক কৃষিতে বিনিয়োগ ও ভর্তুকি by ড. জাহাঙ্গীর আলম

'বাড়ছে দাম অবিরাম/চালের ডালের তেলের নুনের/হাঁড়ির বাড়ির গাড়ির চুনের।/আলু মাঙ্গা বালু মাঙ্গা/কাপড় কিনতে লাগে দাঙ্গা উঠছে বাজার হু হু করে সব কিছুর_'/একটি কবিতার অংশ। তিয়াত্তর সালে পঠিত এই কবিতাটি। কবিকে আমি দেখিনি কখনো। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ও নেই। এখন নামটাও মনে পড়ছে না। তখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবৃত্তি প্রতিযোগিতার বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল কবিতাটি।


সম্ভবত ওই সময়ের পারিপার্শিক অবস্থার সঙ্গে কবিতার মর্মার্থের যথেষ্ট মিল থাকায় ছাত্রছাত্রীদের আবৃত্তির বিষয় হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল কবিতাটি। এরপর কেটে গেছে প্রায় ৩৮ বছর। তখন কবি নিত্যপণ্যের অবিরাম মূল্যবৃদ্ধির যে মূর্ছনা এঁকেছিলেন, আজও তা ম্লান হয়নি এতটুকু। এখনো সেই মূল্যস্ফীতির প্রতিচ্ছবি অম্লান। বাজারে ইদানীং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কেবল বাড়ছেই। হু হু করে বাড়ছে। সকালে-বিকেলে বাড়ছে। এ বাড়তির যেন আর শেষ নেই। ফলে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। তাতে চাপের মধ্যে পড়েছেন সীমিত আয়ের মানুষ। ব্যয়ের সঙ্গে তাঁরা ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে প্রতিনিয়তই কাটছাঁট করে চলছেন তাঁদের খাদ্যতালিকা। ফলে পুষ্টিহীনতা বাড়ছে, রোগব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে।
বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ১১ শতাংশের ওপর। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১৩ শতাংশ। এর প্রবৃদ্ধি শহর থেকে গ্রামে বেশি। অর্থাৎ এতে বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছে গ্রামের মানুষগুলো।
বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য ছিল মূল্যস্ফীতি কমানো। কোনোভাবেই একে ৫ শতাংশের বেশি উঠতে না দেওয়া। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে তা ৩-৪ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা সম্ভব হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তা কিছুটা বেশি। বাংলাদেশে এই হার অনেক বেশি।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের খাদ্যপণ্যের মধ্যে চালের অবস্থান শীর্ষে। এর মূল্যবৃদ্ধির হার খুব বেশি। ২০০৯ সালের জুন-জুলাই মাসে মোটা ও মাঝারি চালের বাজারদর ছিল প্রতি কেজি ২০-২৫ টাকা। ২০১১ সালের জুন-জুলাই মাসে তা ৩০-৩৫ টাকা এবং বর্তমানে প্রতি কেজি ৪০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চালের মূল্য বৃদ্ধি পায় সাধারণত সরবরাহ সংকটের জন্য। কিন্তু আমাদের হাতে এখন যে পরিসংখ্যান আছে, তাতে চালের কোনো সরবরাহ সংকট রয়েছে বলে মনে হয় না। ২০০৯-১০ সালে এ দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছিল তিন কোটি ৪১ লাখ মেট্রিক টন, আমদানি করা হয়েছিল ৩৪ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন। মোট সরবরাহ ছিল তিন কোটি ৭৫ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্য থেকে বীজ ও অপচয় বাবদ ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে ওই বছর খাদ্য হিসেবে মজুদ ছিল তিন কোটি ৩৮ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য। ২০১০-১১ সালে দেশীয় উৎপাদন ও বৈদেশিক আমদানি মিলে চালের মোট সরবরাহ ছিল প্রায় চার কোটি টন। এর মধ্যে ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে খাদ্য হিসেবে মজুদ ছিল তিন কোটি ৬০ লাখ টন। এ সময় ১৪ কোটি ২৩ লাখ মানুষের জন্য আমাদের খাদ্যের চাহিদা ছিল দুই কোটি ৬০ লাখ মেট্রিক টন। তাতে ২০০৯-১০ সালে ৭৮ লাখ টন ও ২০১০-১১ সালে প্রায় এক কোটি টন খাদ্যশস্যের উদ্বৃত্ত থাকার কথা, যা চালের বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য ছিল যথেষ্ট। এ সময় দেশের মোট জনসংখ্যা বাড়িয়ে ১৫ কোটি ধরে নিলেও তাতে বার্ষিক নিট খাদ্য চাহিদা মাত্র ১৩ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন বৃদ্ধি পায়, যা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। তাতেও পণ্যমূল্যে তেমন হেরফের হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে সেই স্থিতিশীলতা আমরা দেখিনি। এর জন্য আন্তর্জাতিক বাজারকেও পুরোপুরি দায়ী করা যায় না। আমাদের মোট খাদ্যশস্যপ্রাপ্তির মাত্র ১০ শতাংশ আমদানিনির্ভর। সে কারণে আন্তর্জাতিক বাজারদরের তেমন বেশি প্রভাব অভ্যন্তরীণ বাজারে থাকার কথা নয়।
চাল ছাড়া অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামও বাজারে আকাশচুম্বী। প্রকারভেদে ৪০ থেকে ৬০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া যায় না। তা ছাড়া টমেটো প্রতি কেজি ৮০ টাকা, পেঁয়াজ ৪০ টাকা, রসুন ৬৫ টাকা, কাঁচামরিচ ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা, ডাল ৯০ থেকে ১১০ টাকা এবং তেল এক লিটারের বোতল ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত এক বছরে তেলের দাম বেড়েছে ৪২ শতাংশ, আর চিনির দাম বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। মাছ, মুরগি, গরু ও খাসির মাংস_কোনোটাই সাম্প্রতিক দুর্মূল্যের ছোঁয়া থেকে মুক্ত নয়। গমের মূল্য বিশ্ববাজারে এখন কমে গেলেও বাংলাদেশে আটার দাম কমেনি। তবে আলুর দাম যথেষ্ট সহনীয়, প্রতি কেজি ২০ টাকা। কৃষকের উৎপাদন খরচের সঙ্গে সংরক্ষণ খরচ যোগ করা হলে এ দামে কৃষকের তেমন লাভ থাকে না। তেল ও গ্যাসের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষিজাত সব পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। সে তুলনায় পণ্যের বিক্রয়মূল্য সহনীয় রাখতে হলে কৃষকরা উৎপাদনের উৎসাহ হারাবেন। এ ক্ষেত্রে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার প্রধান উপায় হবে উৎপাদনের উপকরণে ভর্তুকি দিয়ে এবং কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে কৃষির সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করা। তাতে মূল্যস্ফীতি অবদমিত হবে, দারিদ্র্য হ্রাস পাবে।
বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ম্ভর বলে প্রথমে ঘোষণা দেওয়া হয় ২০০০ সালে। এর আগের বছর খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়েছিল ৫৪ লাখ ৯১ হাজার মেট্রিক টন। পরের বছর ২১ লাখ চার হাজার মেট্রিক টন আমদানি করা হয়। এ দুই বছর গড়ে আমদানি করা হয়েছিল বছরপ্রতি ৩৮ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য। সাম্প্রতিককালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশকে খাদ্য উৎপাদনের দিক থেকে উদ্বৃত্ত দেখানো হলেও আমদানি বাড়ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে আমদানি করা হয়েছিল ৩৪ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০১০-১১ সালে আমদানি করা হয় প্রায় ৫০ লাখ মেট্রিক টনের ওপরে। গত ১৯৯৯-২০০০ সালে সারা বিশ্বে গম ও চালের মূল্য তেমন নাগালের বাইরে ছিল না। তাই স্মরণকালের ভয়াবহতম বন্যার পরও তেমন নাভিশ্বাস ওঠেনি মানুষের জীবনে। এবার বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্য খুবই চড়া। এটাকে কাজে লাগাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ২০১০ সালে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, চীন ও জাপানের খারাপ আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন দারুণভাবে বিঘি্নত হয়। বিশ্বব্যাপী মোট খাদ্য আমদানি বেড়ে যায় দ্রুত। মজুদ হ্রাস পেতে থাকে। ফলে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায় খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্যস্তর। ২০০৭-০৮ সালের মূল্যবৃদ্ধির সূচককেও ছাড়িয়ে যায় ২০১০-১১ সালের মূল্যবদ্ধির সূচক। এর ধকল বাংলাদেশে এসে লেগেছে, ভবিষ্যতে আরো লাগবে।
অতিসম্প্রতি এ দেশে তেল ও গ্যাসের মূল্য উপর্যুপরি দুইবার বেড়েছে। তাতে কৃষির উৎপাদন খরচ, পণ্য পরিবহন খরচ ও জনপরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিম্ন আয়ের মানুষ। এর বিকল্প হতো প্রত্যক্ষ কর, যার বোঝা টানতে হতো সমাজের বিত্তবান মানুষগুলোকে। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না বলে তেল ও গ্যাসের দাম, এমনকি বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হচ্ছে। উদ্দেশ্য ভর্তুকি কমানো। বাংলাদেশ এখন এক নিদারুণ আর্থিক সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে আমাদের ভর্তুকির পরিমাণ ধরা ছিল ২০ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। এখন তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছে। এই বাড়তি টাকা আসবে কোত্থেকে? বিদেশি ঋণ আশানুরূপ পাওয়া যাচ্ছে না। রেমিট্যান্স কমছে। হ্রাস পাচ্ছে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ভারসাম্য। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে গেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। সরকার পরিচালনার ব্যয় নির্বাহের জন্য নগদ অর্থের প্রয়োজন মেটাতে বৃদ্ধি পাচ্ছে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ। এক হিসাবে প্রতিদিন সরকার ১০৫ কোটি টাকারও বেশি ঋণ নিচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে। তাতে তারল্য সংকট বাড়ছে ব্যাংকগুলোর। শেয়ারবাজারে ধস এবং ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকটের ফলে নিরুৎসাহ হচ্ছে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ। অন্যদিকে বাজারে টাকার প্রবাহ বৃদ্ধির কারণে এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন আশানুরূপ না হওয়ায় বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। এ পরিস্থিতিতে অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় ও ভর্তুকি কমিয়ে বিভিন্ন উৎপাদনশীল খাতে, বিশেষ করে কৃষি খাতে ব্যয় ও ভর্তুকি বাড়িয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে
আনা সম্ভব।
আমাদের বাস্তবতা হচ্ছে, কৃষকদের অনেক দূরে জেলা-উপজেলা শহরে গিয়ে বারবার ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে যাচ্ছে। তাতে তাঁদের হয়রানি বাড়ছে। শহর ছেড়ে গ্রামীণ এলাকায় প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে, বড় বাজারে ও গ্রোথ সেন্টারে ব্যাংকের শাখা খোলা ছাড়া কৃষকদের হয়রানি হ্রাস ও তাদের ব্যাংকমুখী করার কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। ব্যাংক যদি কৃষকদের কাছে চলে আসে, তাহলে সেটাই হবে মঙ্গলজনক এবং সবচেয়ে উত্তম কাজ। তাতে কৃষিঋণের প্রবাহ ও আদায় বৃদ্ধি পাবে। কষ্টার্জিত অর্থ ব্যাংকে গচ্ছিত রেখে নিশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারবে গ্রামের মানুষগুলো।
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেটের কারসাজি ও দুর্নীতি। এটি সবাই জানেন, এ সম্পর্কে কথাও বলেন এবং এ নিয়ে ভাবেন। কিন্তু এর কোনো সুরাহা হয় না।
কৃষিপণ্যসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের বাজারমূল্য নির্ধারণ, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অভ্যন্তরীণ বাজারে হস্তক্ষেপের নীতিমালা প্রণয়ন এবং এতদ্সংক্রান্ত সমীক্ষা ও গবেষণা পরিচালনা করার জন্য একটি মূল্য কমিশন গঠনের প্রস্তাব দীর্ঘদিনের। এটি বিবেচনায় আনা দরকার। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। আমাদের অনেক কাজই হয় অনুমাননির্ভর, সঠিক তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে নয়। এটি পরিহার করতে হবে। দেশের প্রচারমাধ্যমগুলোতে নিয়মিত প্রচার ও প্রকাশের ব্যবস্থা নিতে হবে নিত্যপণ্যের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারদর। তাতে মানুষের সচেতনতা বাড়বে। পণ্যমূল্যের ওঠানামা সম্পর্কে উৎপাদক, ক্রেতা ও বিক্রেতারা অবহিত থাকবেন।
আমাদের দেশে এখন দুটি সন্ত্রাস লক্ষণীয়। একটি মূল্য সন্ত্রাস। তাতে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে প্রতিনিয়ত। প্রয়োজনীয় ক্রয়ক্ষমতা না থাকায় খাদ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের মতে, তাতে লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। আরেকটি সন্ত্রাস কেড়ে নিচ্ছে বহু মানুষের মূল্যবান জীবন। বিচারবহির্ভূত হত্যা, খুন, গুম করে ফেলা। বাংলাদেশের বর্তমান বাজারে সব কিছুর দাম বেড়ে গেলেও মানুষগুলোর দাম একেবারেই বাড়ছে না। কবির ভাষায়_'কেবলই তার পড়ছে বাজার।' এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।

লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ

No comments

Powered by Blogger.