দর্পণে দেবেন ঘোষ by মুকুল দাস

কাউনিয়া ক্লাব রোডে যে বাড়িতে দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ ১৮৯০ সালের ২২ এপ্রিল জন্মেছিলেন সে বাড়ি নাজির বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। এর সঙ্গেই স্বাভাবিকভাবে এসে পড়ে নাজিরের পুল বৃত্তান্ত। দেবেন্দ্রনাথের ঠাকুরদা ছিলেন জেলা নাজির। চাকরি করতেন জজকোর্টে। তখন নাজিরের পুল বলতে কিছুই ছিল না। খাল পারাপারের জন্য ছিল বাঁশ নির্মিত সাঁকো। একদিন কোর্টে যাওয়ার মুখে নাজির সাহেব সেই বাঁশের সাঁকো পেরোতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেলেন।


ইংরেজ সাহেব ঘটনা শুনে পুল তৈরির ব্যবস্থা করলেন। নাজিরের নামানুসারেই পুলের নামকরণ নাজিরের পুল। সেই নাজিরের উত্তর পুরুষ দেবেন্দ্রনাথ, যিনি খ্যাতি অর্জন করেন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্রমে রুখে দাঁড়িয়ে। ছেলেবেলায় দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন জেদি স্বভাবের এবং তখন থেকেই নিরন্ন মানুষের প্রতি ছিল তার গভীর মমত্ববোধ। দেবেন্দ্রনাথ শিক্ষাজীবন শুরু করেন মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত প্রতিষ্ঠিত ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের সর্বত্র। বরিশালে এ ঢেউয়ের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কিশোর দেবেন্দ্রনাথকে। ব্রিটিশ সরকারের নির্যাতন ও দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনে শামিল হন তিনি। ১৯১৯ সালে বিপ্লবী আন্দোলনে আরও সক্রিয় হওয়ার জন্য দেবেন্দ্রনাথ কলকাতায় চলে যান। ১৯২৫ সালে বরিশালে ফিরে এসে প্রতিষ্ঠা করেন সূর্যকাণ্ড ব্যায়াম বিদ্যালয়। ১৯২৯ সালে কলকাতার কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হন তিনি। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার আসামি ও বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয় ১৯৩০ সালে। মুক্তি পেতে না পেতেই ১৯৩৩ সালে গ্রেফতার করে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হয়। ১৯৩৪ সালে জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে এবং তা বিলুপ্ত হওয়ার পক্ষে সাক্ষ্য দেন দেবেন্দ্রনাথ। এরপর আবার জেলে টানা বছর এবং মুক্তিলাভ ঘটে ব্রিটিশরাজ বিদায় নেওয়ার সময়ে। সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে বরিশাল জেলার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী ভূমিকা রাখায় তাকে পাকিস্তান সরকার নিরাপত্তা বন্দি হিসেবে আটক করে। ১৯৫২ সালে স্থানীয় ভাষা সংগ্রাম কমিটির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে দেবেন্দ্রনাথ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনেও শরিক হন দেবেন্দ্রনাথ। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় দেবেন্দ্রনাথকে দেশরক্ষা আইনে বন্দি করা হয়। এক বছর পরে মুক্তি পেয়ে দেবেন্দ্রনাথ বঙ্গবন্ধুর প্রণীত ছয় দফা বাস্তবায়নের আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর বাকশালে যোগ দেন এবং বরিশাল জেলা বাকশালের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। জীবনের শেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন লিটল ম্যাগ 'ধ্রুবতারায়'।
সেখানে তিনি ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের কথা বলেছেন। প্রিয় কাজ বৃক্ষরোপণ, কৃষি ও মৎস্য চাষ। প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে মহারাজা ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নাম উল্লেখ করেছেন। অপ্রিয় ও অপছন্দের বিষয় অলসতা ও নিষ্কর্মতা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সামাজিক সজ্জন হিসেবে সকলের আপনজন হয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ চিরতরে দূরে চলে গেলেও তার আদর্শ ও সততা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে তার প্রতি শ্রদ্ধা।

No comments

Powered by Blogger.