নিখিল ভদ্র : একজন শব্দ-কারিগরের না মানা অন্ধকার! by মাহবুবুর রহমান ভূইয়া

রাস্তা পার হওয়ার সময় বিআরটিসির একটি বাস কালের কণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার নিখিল ভদ্রকে ধাক্কা দিলে তিনি রাস্তায় পড়ে যান। এরপর চালক যাত্রীভর্তি বাসটি না থামিয়ে তাঁর পায়ের ওপর দিয়েই সব পাষণ্ডতাকে হার মানিয়ে র্নিবিঘ্নে চলে যায়। এই ছোট খবরটি আজ আর ছোট নয়; দেশের প্রত্যেকটি সচেতন মানুষকে আবারও নতুন করে রাষ্ট্রের পুরনো ব্যর্থতার কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল।


সাংবাদিক নিখিল ভদ্র এখন এক পা হারিয়ে পঙ্গু হাসপাতালের আইসিইউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। পা হারানোর বিনিময়ে জীবন রক্ষা করে এই শব্দ-কারিগর এখন পঙ্গুত্ব নামক নতুন শব্দটির সঙ্গে অহর্নিশ বসবাস করবেন। শব্দটা তাঁর জীবনের সঙ্গে দিনে দিনে সব অনিচ্ছার দেয়াল ডিঙিয়ে জোর করে বুকের গহিনের সুখজমিনের দখল নেবে; চাষবাস করবে 'দুঃখ' নামক অপ্রিয় যন্ত্রণার। হৃদয়ের রক্তক্ষরণে উর্বর হয়ে উঠবে আবাদি ফসল। ফলন দেবে আকাশব্যাপী অন্ধকার। আমাদের হাজারো সান্ত্বনা, আশার বাণী, প্রতিশ্রুতি, সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত সমবেদনা, সুবিচারের দাবিতে মানববন্ধন কিংবা প্রতিবাদলিপি রাষ্ট্রযন্ত্রের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে একদিন সৃষ্টি হবে আশাহত আরেক অন্ধকার। এভাবেই ক্ষণ থেকে দিন, দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর, তারপর সারা জীবন কেটে যাবে তাঁর এই অপরিপূর্ণতার অন্ধকারে। সময়ের ব্যবধানে নিখিল ভদ্র একদিন দুই হাতে দুঃখ ঠেলে দিলেও এই পঙ্গুত্বকে আজীবন ঠেলবেন কিভাবে? আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র কি এর সঠিক উত্তর দিতে পারবে?
প্রত্যাশাচ্যুত অন্ধকারসদৃশ এই প্রশ্নের অন্তঃস্থ মর্মব্যথা আমাদের বুকের গহিনে এক দিনে জমাট বেঁধে ওঠেনি; তা অনেক দিনের। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্বজন হারানোর ক্ষত থেকে সৃষ্ট 'নিরাপদ সড়ক চাই' সংগঠনের মাধ্যমে স্বজন হারানোদের প্রতিবাদের যে ঢেউ উঠেছিল, হালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত প্রখ্যাত সাংবাদিক মিশুক মুনীর, বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের স্বজনদের ছুঁয়ে আজ বাংলার সব বিবেকবান মানুষের ভেতরে সেই প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়েছে। কিন্তু কেবলই প্রতিবাদ। কয়েক দিন প্রচারমাধ্যম সরগরম করে তুললেও রাষ্ট্রযন্ত্রের কঠিন হিয়ার ভেতরটা স্পর্শ করে না। যদি করত, তাহলে কি আর চট্টগ্রামে ২০০৩ সালে যে দ্রুতগামী হিউম্যান হলারের ধাক্কায় ১১ তরতাজা কিশোর ক্রিকেটারের মৃত্যু হয়েছিল; সেই চালকের মাত্র তিন বছরের কারাদণ্ড হতো? তাও আবার সেই চালক এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। দুর্বল আইনের ফাঁকফোকর দিয়েই বেরিয়ে আসে ঘাতকরা। এখন সময় এসেছে প্রত্যাশা আর আশ্বাস নামক মরীচিকা ধরার নিরন্তর পথচলা থামিয়ে এই দুর্বল আইনটির আমূল পরিবর্তন এবং তার সঠিক প্রয়োগের।
জানা যায়, গত ১৫ বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। আহত হয় অসংখ্য। সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্রতিবছর দেশের ক্ষতি হচ্ছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার, যা জিডিপির ২ শতাংশ। প্রকাশিত তথ্য থেকে জানতে পারি, দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট রাজধানীর ২০০ ইন্টারসেকশনের ৫১টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংস্থার হিসাবে, রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে একজনের প্রাণহানি ঘটছে। ৬১ শতাংশ ক্ষেত্রে চালকের কারণেই প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। রাস্তায় চলাচলে আইন অমান্য করার জন্য কঠিন শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা করা এবং বিদ্যমান আইনের সংশোধন, জেব্রাক্রসিং ও ফুটওভার ব্রিজ ছাড়া রাস্তা পারাপার নিষিদ্ধ, দুর্ঘটনা রোধে চালক ও পথচারীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করে পথচারীদের চলার উপযোগী করা, মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন তুলে দেওয়া, পরীক্ষা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান বন্ধ করার মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত স্বজন হারানোর ঘটনা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। বাংলাদেশে বর্তমানে এক-তৃতীয়াংশের বেশি চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই কিংবা অনেকাংশ ভুয়া লাইসেন্সধারী। অনেক সময় ভুয়া লাইসেন্সটাও তাদের থাকে না; থাকে না গাড়ি চালানোর প্রাথমিক ধারণাটুকুও; তার পরও হয়ে যায় চালক। তাও আবার সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিআরটিসির গাড়িগুলোর।
যেকোনো আধুনিক শহরে মোট আয়তনের নূ্যনতম ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকার কথা, কিন্তু ঢাকা শহরে রাস্তার পরিমাণ মাত্র ৯ শতাংশ। ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব বিশ্বের যেকোনো শহরের চেয়ে বেশি। তাই প্রয়োজন সমন্বিত ও আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা। দেখা যায়, বিশ্বের খুব কম শহরের চারপাশে নদী আছে। যেসব শহরে নেই, সেগুলো হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করে সুষ্ঠু ও নির্বিঘ্ন চলাচলের প্রয়োজনে কৃত্রিম লেক তৈরি করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ঢাকার চারপাশে নদী থাকা সত্ত্বেও আমরা তা কাজে লাগাতে পারছি না। অন্যদিকে রাজধানী ঢাকায় ৪৪টি ফুটওভার ব্রিজ অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে এবং আরো ২৫টি ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে। যাত্রীরা যাতে ওভারব্রিজ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়, সে জন্য জানুয়ারি থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা অবগত হয়েছি, পাঠ্য বইয়ে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে যাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করা হবে, যাতে তারা পথ পারাপারে ওভারপাস ব্যবহার করে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সরকারের এই উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে কিছুটা হলেও দুর্ঘটনা নামক পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানা যাবে। তবে এর পাশাপাশি প্রয়োজন বর্তমান ও ভবিষ্যতে যারা এ পেশায় আসবে, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। কারণ প্রশিক্ষণ তাদের তিনটি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের সুযোগ করে দেবে : এক. গাড়ি চালানো অবস্থায় বিবিধ ট্রাফিক সিগন্যাল এবং বিদ্যমান আইন সম্পর্কে সচেতন হওয়া। দুই. গাড়ি চালানোর যাবতীয় কলাকৌশল এবং প্রাথমিক ত্রুটিগুলো নির্ণয় ও সমাধান করার সক্ষমতা। তিন. তাদের চিন্তাচেতনা ও আচার-ব্যবহারের কিছুটা পরিবর্তন সাধন। প্রশিক্ষণের ভাষায় আমরা এই তিনটিকে বলি থ্রি লার্নিং ডোমেইন। প্রশিক্ষণ দ্বারা এই তিন ক্ষেত্রের পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব। সরকারকে স্বজন হারানোর কিংবা বেঁচে যাওয়া পঙ্গু মানুষগুলোর বুকের গহিনের ব্যথাটা অনুভব করতে হবে। ক্ষোভগুলো জমাট বেঁধে দ্রোহের ভাষা হয়ে ওঠার আগেই তার সুষ্ঠু সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। শুধু রাজনীতিবিদদের আশ্বাস নামক কোরামিন ইনজেকশনটি এখন আর কাজে আসছে না। সব আশ্বাসই সময়ের ব্যবধানে ঝাপসা হয়ে যায়; যায় অবিশ্বাসের অন্ধকারে। যেমন_মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর সরকারের উচিত ছিল দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্তু নিখিল ভদ্রের পঙ্গুত্ব আবার আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তোলে।
লেখক : প্রশিক্ষক ও সমাজকর্মী

No comments

Powered by Blogger.