জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার্থীদের চাপে ওই তিন ছাত্রকে আজীবন বহিষ্কার

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সাময়িকভাবে বহিষ্কৃত ছাত্রলীগের তিন কর্মীকে সারা জীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সোমবার ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ নিহত হওয়ার পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তাঁদের সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছিল।


গতকাল মঙ্গলবার উপ-রেজিস্ট্রার (শিক্ষা) আবুল কালাম আজাদ স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে যে তিনজনকে সারা জীবনের জন্য বহিষ্কারের তথ্য জানানো হয়েছে, তাঁরা হলেন: প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের খন্দকার আশিকুল ইসলাম, খান মো. রইস ও দর্শন বিভাগের একই ব্যাচের মো. রাশেদুল ইসলাম। এঁদের মধ্যে গত সোমবার পুলিশ জুবায়ের হত্যা মামলায় আশিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে।
জুবায়ের আহমেদকে গত রোববার স্নাতক চূড়ান্ত পর্বের শেষ পরীক্ষার পর হল থেকে বের হলে তুলে নিয়ে যান ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী। তাঁকে পিটিয়ে আধমরা করে তাঁরাই সাভারে হাসপাতালে ফেলে আসেন। সেখান থেকে রাতে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হলে সোমবার সকালে তিনি মারা যান।
আন্দোলনকারী একাধিক শিক্ষার্থী জানান, জুবায়ের মারা যাওয়ার পর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আজীবন বহিষ্কার, বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রের আধুনিকায়ন, প্রক্টর ও নিরাপত্তা কর্মকর্তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরে প্রশাসন হত্যাকারী বলে সন্দেহ করা হয়, এমন তিন ছাত্রকে সাময়িক বহিষ্কার করে।
কিন্তু দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এবং হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকেই প্রশাসনিক ভবনের সামনে জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন বিভাগের ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। সাড়ে ১০টার দিকে হাজার দেড়েক শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন। মিছিলটি পরে প্রশাসনিক ভবন চত্বরে ঢুকতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধাক্কাধাক্কি হয়। পরে পুলিশ সরে যায় এবং প্রশাসনিক ভবন চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
‘ছাত্রলীগের’ আলাদা মিছিল: একই সময় বিভিন্ন হলের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকা থেকে দলীয় স্লোগানসহ জুবায়ের হত্যার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন। মিছিল শেষে তাঁরাও প্রশাসনিক ভবনের সামনে সমাবেশ করেন।
আলাদা মিছিল করার বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ছাত্রলীগের নেতা দাবিদার শেখ শরিফুল ইসলাম বলেন, জুবায়েরের হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে মিছিল করা হয়েছে।Êতবে মিছিলটি ছাত্রলীগের ব্যানারে করা হয়নি বলে তিনি দাবি করেন।
শিক্ষক সমিতির একাত্মতা: একই দাবিতে বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার চত্বরে ‘সচেতন শিক্ষক সমাজ’-এর ব্যানারে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা। মানববন্ধন শেষে তাঁরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এ মামুন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বর্তমানে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর দায়ভার আমাদেরকেই বহন করতে হবে।’ তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ক্যাম্পাসের ভেতর ও বাইরে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের সহাবস্থান নিশ্চিত করে তাঁদের শিক্ষাজীবন স্বাভাবিক করার অনুরোধ করা হলেও কোনো পদক্ষেপই নেয়নি বর্তমান প্রশাসন।
প্রসঙ্গত, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের বিবদমান দুই পক্ষের নেতা-কর্মীদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি ভেঙে দিয়ে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। ওই কমিটির ২৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জনকে সারা জীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। ওই কমিটির প্রায় ১৫০ জন নেতা-কর্মী এখনো ক্যাম্পাসে আসতে পারেন না।
ইংরেজি বিভাগ: দুপুর ১২টার দিকে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিভাগের সামনে থেকে মৌন মিছিল করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন। বিভাগের শিক্ষক ফারজানা জেবিন খান বলেন, ‘জুবায়ের শুধু একজন ছাত্র ছিল না, সে আমাদের সন্তান ছিল। আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ বুঝতে হবে না। আমরা চাই আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা। যে শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন শেষ করে পরিবারের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার কথা, সেই শিক্ষার্থীকে বর্বরোচিতভাবে মেরে ফেলা হয়েছে।’
এরপর প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন মাসের জন্য বহিষ্কৃত তিন ছাত্রকে ছাত্রছাত্রীদের শৃঙ্খলা বিধিমালার ৪ ধারায় সারা জীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানানো হয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে সরে শহীদ মিনার চত্বরে যান এবং কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ঘোষণা অনুযায়ী, আজ দুপুর ১২টায় শোক র‌্যালি ও কালো ব্যাজ ধারণ করা হবে।
কাঠগড়ায় প্রশাসন: সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সমাজের অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রক্টর আরজু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখনই কোনো বিষয়ে অবগত হয়েছি, তখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। জুবায়েরের মৃত্যুর ঘটনাটি আমাদের ব্যথিত করেছে।’
উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবি অনুসারে যারা অপরাধ করেছে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গেও আলোচনা করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধেই দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দাবি: গতকাল প্রথম আলোয় পাঠানো এক প্রতিবাদপত্রে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ বলেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই, সংগঠনের কার্যক্রমও স্থগিত। ‘দেখো, তোমরা কার বুক খালি করেছ’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে ছাত্রলীগের দুই পক্ষ এবং স্থগিত কমিটির যে কথা বলা হয়েছে, তা ঠিক নয়। ছাত্রলীগের নামধারী বা লেবাসধারী কেউ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে তার দায় ছাত্রলীগ নিতে পারে না। এদের প্রতিহত করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তাদের ব্যর্থতার দায় ছাত্রলীগ কাঁধে নিতে পারে না। সংগঠনটি জুবায়েরের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছে।
পত্রে দাবি করা হয়, হামলাকারী, দুষ্কৃতকারী এবং গতকাল অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে উপাচার্যকে উদ্ধারকারী—এরা ছাত্রলীগের কেউ নয়। পত্রে তাদের নামের আগে ‘ছাত্রলীগ’ নাম ব্যবহার না করার জন্য অনুরোধ করা হয়।
প্রতিবেদকের বক্তব্য: প্রথম আলোর প্রতিবেদনে জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের কমিটি ও কার্যক্রম বন্ধ থাকার বিষয়টি স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে। বক্তব্যদানকারী নেতাদের পরিচয় দিতে স্থগিত কমিটির কথা উল্লেখ করতে হয়েছে। আর ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছাত্রলীগকে ‘উপাচার্য গ্রুপ’ বলে উল্লেখ করেছেন আগের কমিটির নেতারাই। প্রতিবেদনে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি-কার্যক্রম এবং বর্তমান প্রশাসনের বিষয়েও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.