সময়ের প্রতিধ্বনি-সেতুখেকো মন্ত্রী, নাকি বিশ্বব্যাংকের নয়া ষড়যন্ত্র! by মোস্তফা কামাল
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে র্যাবের হাতে আটক হয়েছিলেন বনখেকো ওসমান গনি। বন খেয়ে ধনকুবের হয়েছিলেন তিনি। টাকা রাখার জায়গা না পেয়ে তিনি তোশক ও বালিশের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর অন্যায়ের পরিমাণ এতটই বেড়ে গিয়েছিল যে প্রকৃতিও তাঁকে ক্ষমা করেনি। প্রকৃতি তাঁকে ধরিয়ে দিয়েছে আইনের হাতে। দেশের মানুষ দেখেছে একজন বনখেকো ওসমান গনিকে।
এবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে আমরা পেয়েছি সেতুখেকো যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে। পুরো পদ্মা সেতুই গিলে খাওয়ার সব আয়োজন পাকা হয়েছিল; কিন্তু বিশ্বব্যাংক ঝামেলা পাকিয়েছে। বেরিয়ে গেছে থলের বিড়াল। অবস্থা এমন হয়েছে, সেতুটি এখন মন্ত্রীর গলায় আটকে গেছে। তিনি এখন গিলতেও পারছেন না, আবার বেরও করতে পারছেন না। বেরসিক বিশ্বব্যাংক মন্ত্রীর গায়ে দুর্নীতির সিল মেরে দিয়েছে। এখন তিনি যতই বলবেন, 'আমি দুর্নীতি করি নাই', এ কথা কেউ আর বিশ্বাস করবে না।
অথচ সব কিছু ঠিকঠাকমতোই চলছিল। এই সরকারের মেয়াদকালে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল। এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে কাজ শুরু করা যাবে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। যদিও সরকারের তরফ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতুর কাজ শিগগিরই শুরু হবে। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিশ্বব্যাংক। সেই বিশ্বব্যাংকই সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আবুল হোসেনের দুর্নীতির বিষয়টি সুরাহা না হলে বিশ্বব্যাংক অর্থ দেবে না। এ বিষয়টি নিয়ে কয়েক মাস ধরে গণমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেদন এসেছে। এর মধ্যে অবশ্য সরকার ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের দিক থেকে ষড়যন্ত্র আছে কি না জানি না। বিশ্বব্যাংক কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই ক্ষমতাসীন সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ করবে বলে মনে হয় না। নিশ্চয়ই তাদের কাছে কিছু তথ্যপ্রমাণ রয়েছে এবং সরকারকে তারা তা দিয়েছে। তবে মন্ত্রী তথা সরকারের বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ করার নেপথ্যে নিশ্চয়ই কোনো কারণ রয়েছে। আমরা সে বিষয় নিয়ে পরে আলোচনা করছি। তার আগে বলে নিই বিশ্বব্যাংকের শর্তারোপ প্রসঙ্গে। আমরা দেখে আসছিলাম, বিশ্বব্যাংক ঋণ দেওয়ার আগেই নানা শর্ত দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারকে। এর মধ্যে উদ্বেগজনক হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের মতামতের বাইরে কিছুই করা যাবে না, এ রকম ধরনের একটা শর্ত। বিশ্বব্যাংক যেভাবে চাইবে, সেভাবেই করতে হবে। অন্যথায় বিশ্বব্যাংক ঝামেলা করবে। এ নিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের মতবিরোধ চলছিল। সেই খবরও পত্রিকায় এসেছে। আবার ভালো শর্তও আছে; যেমন_বিশ্বব্যাংক বলেছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের দুর্নীতি হতে পারবে না। এই শর্তকে কে না সমর্থন করবে?
তবে একটি কথা না বললেই নয়। দুর্নীতি যেকোনো প্রকল্পে হতে পারে। অতীতে দুর্নীতির কারণে অনেক বড় বড় প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এমনও দেখা গেছে, সেতুর অর্ধেক কাজ হওয়ার পর তা আর হয়নি। রাস্তার ক্ষেত্রেও একই ধরনের উদাহরণ আছে। সরকারি লোকদের ঘুষ দিয়ে কন্ট্রাক্টর টাকা তুলে নিয়েছেন, প্রকল্পের কাজ আর এগোয়নি। একই স্থানে ডিসিদের পুকুর কাটা আর পুকুর ভরাটের গল্প তো বাস্তব জীবন থেকেই নেওয়া। আমরা প্রতিনিয়ত হাড়ে হাড়ে তা টের পাচ্ছি।
এই দুর্নীতির ধরন আবার একেক দেশে একেক রকম। কোনো কোনো দেশে নিম্নস্তরে দুর্নীতি হয়, উচ্চস্তরে হয় না। আবার কোনো কোনো দেশে উচ্চস্তরে হয়, নিম্নস্তরে হয় না। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের দেশে সর্বস্তরে দুর্নীতি হয়। দুর্নীতির মাত্রা এতটাই বেশি যে কোনো কাজই ঘুষ ছাড়া করা সম্ভব হয় না। সরকারি অফিস-আদালতের দরজা-জানালা, টেবিল-চেয়ারকেও ঘুষ দিতে হয়। দুর্নীতির কারণেই অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এত পিছিয়ে আছে। বিগত ৪০ বছরে দুর্নীতির মাত্রা যদি অর্ধেকও কম থাকত, তাহলে এই দেশ সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ার অবস্থানে অনায়াসে চলে যেত। উন্নত দেশগুলো দুর্নীতি কমানোর কৌশল হিসেবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমপর্যায়ে নিয়ে গেছে। ফলে সর্বস্তরে দুর্নীতির মাত্রা কম। আমাদের দেশে দুর্নীতি কমানোর কোনো উদ্যোগই নেই। ফলে এর মাত্রা লাগামহীনভাবে বাড়ছে।
দক্ষিণাঞ্চলের স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের নানা তৎপরতা হয়েছে। অতীতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সরকারের আমলেও প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় এবং বলা হয়, বর্তমান সরকারের মেয়াদকালেই সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। অথচ শুরুতেই এত বড় বিপত্তি কেন ঘটল? বিশ্বব্যাংক কেন সরাসরি প্রচারমাধ্যমে মন্ত্রীর দুর্নীতির তথ্য আগাম ফাঁস করল? বিশ্বব্যাংক কি আগে সরকারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিল? সরকারকে কি ব্যবস্থা নিতে বলেছিল? যদি না বলে থাকে, তাহলে আগেভাগে মিডিয়ায় তথ্য ফাঁস করাটা দুরভিসন্ধিমূলক।
আমরা জেনেছি, সাত-আট মাস আগেই বিশ্বব্যাংক সরকারকে যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির বিষয়ে অবহিত করেছিল। তার পরও সরকার কেন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি? যোগাযোগমন্ত্রী কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীর দোহাই দিচ্ছেন। তিনি জোর গলায় এও বলছেন, তিনি কোনো দুর্নীতি করেননি। আবার বলছেন, দুর্নীতির অভিযোগে তিনি পদত্যাগ করবেন না। আবার বলছেন, পদত্যাগের বিষয়টি তাঁর হাতে নেই। তাহলে কি তিনি পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিয়ে রেখেছেন? তিনি তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি? একজন মানুষের জন্য এত বড় একটা সেতু প্রকল্প আটকে যাবে? বিষয়টিকে সরকার কি প্রেস্টিজ ইস্যু বলে মনে করছে? কিন্তু সরকার কি উপলব্ধি করতে পারছে, এই সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারলে সরকারের ভাবমূর্তি কোথায় চলে যাবে? নাকি সরকার কোনো ফাঁদে পা দিয়েছে?
দেশের মানুষ জানে, যোগাযোগমন্ত্রী একজন ব্যবসায়ী। তিনি সাঁকো ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার। অবশ্য মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে তিনি প্রতিষ্ঠানটির এমডির পদ থেকে পতদ্যাগ করেন। সাঁকোর পরিচালকরা তাঁর পরিবারের সদস্য এবং এমডি পদটি কাউকে দেওয়া হয়নি। আসলে মন্ত্রী এমডির পদ ছাড়লেও কাজ ছাড়েননি বলে মনে হয়। আবুল হোসেনের আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল, তিনি ব্যবসা করবেন, নাকি মন্ত্রী হবেন। মন্ত্রীর পদে থেকে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজ করা অন্যায়, অনৈতিক।
বিশ্বব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে একটি জাতীয় দৈনিক সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, 'পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য ঘুষ বা কমিশন চেয়েছেন সৈয়দ আবুল হোসেনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সাঁকো ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিরা। মন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে অর্থ চাওয়া হয়েছে। কমিশন দিলে কাজ পেতে যোগাযোগমন্ত্রী নিজেই সহায়তা করবেন বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।'
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, 'সাঁকোকে কমিশন এজেন্ট করার জন্য মন্ত্রী আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে চাপ দিয়েছেন। এ জন্য তিনি ভয়ভীতিও দেখিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক বিস্তারিত তদন্ত করে এসব তথ্য সরকারকে দিয়েছে।' বিশ্বব্যাংক এও বলে দিয়েছে, 'পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থ পেতে হলে বাংলাদেশকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় পদ্মা সেতুতে অর্থ ছাড় করা হবে না।' তার মানে বিশ্বব্যাংক সরকারকে আগে থেকেই বিষয়টি জানিয়েছে। কিন্তু সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কেন নেয়নি সেই রহস্যও আমাদের অজানা।
অতীতে ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখার জন্য আবুল হোসেন মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন। তিনি তখন লাল পাসপোর্টধারী হয়েও সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে ব্যবসায়িক কাজে বিদেশে গিয়েছিলেন। সেই অনৈতিক কাজের খেসারত দিতে হয়েছিল প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে। এবার তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছে বিশ্বব্যাংক।
আমরা এটা বলছি না যে বিশ্বব্যাংক ধোয়া তুলসীপাতা। বিশ্বব্যাংকের নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য ছিল বা আছে। সরকারকে জানানোর পর সিদ্ধান্তের জন্য বিশ্বব্যাংকের অপেক্ষা করা উচিত ছিল। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসে বিষয়টি সুরাহা করা যেত। তা না করে বিশ্বব্যাংক এক ধরনের গেম খেলেছে। অবশ্য বিশ্বব্যাপী বিশ্বব্যাংকের মতলবি কর্মকাণ্ডের হাজারো উদাহরণ আছে। আইএমএফের মতো বিশ্বব্যাংক দরিদ্র দেশগুলোকে ঋণ দিয়ে সরকারকে জনবিরোধী সব কাজ করতে বাধ্য করে। না করলেই সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে একধরনের ক্যাম্পেইন শুরু করে। তারই অংশ হিসেবে আবুল হোসেনের দুর্নীতির তথ্য আগাম ফাঁস করে দিয়েছে বলে কেউ কেউ বলছেন।
বিশ্বব্যাংকের ঋণ মানেই নানা শর্ত। সেই শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলেই তারা নানা বাহানা শুরু করে। অথচ জাপান স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় বিশাল অবদান রেখে আসছে। জাপানের এই সহায়তার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শর্ত ছিল না। এখনো তারা কোনো শর্ত দেয় না। আমাদের দেশটা ছোট। এর অর্থনীতির আকারও ছোট। আমাদের মতো দেশকে আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হতে হয়। আমরা অনেক সময়ই দেখেছি, বিশ্বব্যাংক গণতান্ত্রিক সরকারকে পছন্দ করে না। অগণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে কাজ করতেই বেশি উৎসাহ বোধ করে। কারণ গণতান্ত্রিক সরকারকে তারা বশে রাখতে পারে না। যা খুশি তা করাতে পারে না।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ নতুন নয়। অভিযোগ আছে, থাকবে; তার পরও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা নিয়ে আমাদের উন্নয়নকাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের কাজে যদি সততা ও স্বচ্ছতা থাকে, তাহলে শর্ত দিয়েও তারা কিছু করতে পারবে না। সমস্যা আমাদের নিজেদেরই, আমাদেরই এর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamal1970@hotmail.com
অথচ সব কিছু ঠিকঠাকমতোই চলছিল। এই সরকারের মেয়াদকালে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল। এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে কাজ শুরু করা যাবে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। যদিও সরকারের তরফ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতুর কাজ শিগগিরই শুরু হবে। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিশ্বব্যাংক। সেই বিশ্বব্যাংকই সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আবুল হোসেনের দুর্নীতির বিষয়টি সুরাহা না হলে বিশ্বব্যাংক অর্থ দেবে না। এ বিষয়টি নিয়ে কয়েক মাস ধরে গণমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেদন এসেছে। এর মধ্যে অবশ্য সরকার ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের দিক থেকে ষড়যন্ত্র আছে কি না জানি না। বিশ্বব্যাংক কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই ক্ষমতাসীন সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ করবে বলে মনে হয় না। নিশ্চয়ই তাদের কাছে কিছু তথ্যপ্রমাণ রয়েছে এবং সরকারকে তারা তা দিয়েছে। তবে মন্ত্রী তথা সরকারের বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ করার নেপথ্যে নিশ্চয়ই কোনো কারণ রয়েছে। আমরা সে বিষয় নিয়ে পরে আলোচনা করছি। তার আগে বলে নিই বিশ্বব্যাংকের শর্তারোপ প্রসঙ্গে। আমরা দেখে আসছিলাম, বিশ্বব্যাংক ঋণ দেওয়ার আগেই নানা শর্ত দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারকে। এর মধ্যে উদ্বেগজনক হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের মতামতের বাইরে কিছুই করা যাবে না, এ রকম ধরনের একটা শর্ত। বিশ্বব্যাংক যেভাবে চাইবে, সেভাবেই করতে হবে। অন্যথায় বিশ্বব্যাংক ঝামেলা করবে। এ নিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের মতবিরোধ চলছিল। সেই খবরও পত্রিকায় এসেছে। আবার ভালো শর্তও আছে; যেমন_বিশ্বব্যাংক বলেছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের দুর্নীতি হতে পারবে না। এই শর্তকে কে না সমর্থন করবে?
তবে একটি কথা না বললেই নয়। দুর্নীতি যেকোনো প্রকল্পে হতে পারে। অতীতে দুর্নীতির কারণে অনেক বড় বড় প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এমনও দেখা গেছে, সেতুর অর্ধেক কাজ হওয়ার পর তা আর হয়নি। রাস্তার ক্ষেত্রেও একই ধরনের উদাহরণ আছে। সরকারি লোকদের ঘুষ দিয়ে কন্ট্রাক্টর টাকা তুলে নিয়েছেন, প্রকল্পের কাজ আর এগোয়নি। একই স্থানে ডিসিদের পুকুর কাটা আর পুকুর ভরাটের গল্প তো বাস্তব জীবন থেকেই নেওয়া। আমরা প্রতিনিয়ত হাড়ে হাড়ে তা টের পাচ্ছি।
এই দুর্নীতির ধরন আবার একেক দেশে একেক রকম। কোনো কোনো দেশে নিম্নস্তরে দুর্নীতি হয়, উচ্চস্তরে হয় না। আবার কোনো কোনো দেশে উচ্চস্তরে হয়, নিম্নস্তরে হয় না। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের দেশে সর্বস্তরে দুর্নীতি হয়। দুর্নীতির মাত্রা এতটাই বেশি যে কোনো কাজই ঘুষ ছাড়া করা সম্ভব হয় না। সরকারি অফিস-আদালতের দরজা-জানালা, টেবিল-চেয়ারকেও ঘুষ দিতে হয়। দুর্নীতির কারণেই অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এত পিছিয়ে আছে। বিগত ৪০ বছরে দুর্নীতির মাত্রা যদি অর্ধেকও কম থাকত, তাহলে এই দেশ সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ার অবস্থানে অনায়াসে চলে যেত। উন্নত দেশগুলো দুর্নীতি কমানোর কৌশল হিসেবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমপর্যায়ে নিয়ে গেছে। ফলে সর্বস্তরে দুর্নীতির মাত্রা কম। আমাদের দেশে দুর্নীতি কমানোর কোনো উদ্যোগই নেই। ফলে এর মাত্রা লাগামহীনভাবে বাড়ছে।
দক্ষিণাঞ্চলের স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের নানা তৎপরতা হয়েছে। অতীতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সরকারের আমলেও প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় এবং বলা হয়, বর্তমান সরকারের মেয়াদকালেই সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। অথচ শুরুতেই এত বড় বিপত্তি কেন ঘটল? বিশ্বব্যাংক কেন সরাসরি প্রচারমাধ্যমে মন্ত্রীর দুর্নীতির তথ্য আগাম ফাঁস করল? বিশ্বব্যাংক কি আগে সরকারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিল? সরকারকে কি ব্যবস্থা নিতে বলেছিল? যদি না বলে থাকে, তাহলে আগেভাগে মিডিয়ায় তথ্য ফাঁস করাটা দুরভিসন্ধিমূলক।
আমরা জেনেছি, সাত-আট মাস আগেই বিশ্বব্যাংক সরকারকে যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির বিষয়ে অবহিত করেছিল। তার পরও সরকার কেন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি? যোগাযোগমন্ত্রী কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীর দোহাই দিচ্ছেন। তিনি জোর গলায় এও বলছেন, তিনি কোনো দুর্নীতি করেননি। আবার বলছেন, দুর্নীতির অভিযোগে তিনি পদত্যাগ করবেন না। আবার বলছেন, পদত্যাগের বিষয়টি তাঁর হাতে নেই। তাহলে কি তিনি পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিয়ে রেখেছেন? তিনি তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি? একজন মানুষের জন্য এত বড় একটা সেতু প্রকল্প আটকে যাবে? বিষয়টিকে সরকার কি প্রেস্টিজ ইস্যু বলে মনে করছে? কিন্তু সরকার কি উপলব্ধি করতে পারছে, এই সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারলে সরকারের ভাবমূর্তি কোথায় চলে যাবে? নাকি সরকার কোনো ফাঁদে পা দিয়েছে?
দেশের মানুষ জানে, যোগাযোগমন্ত্রী একজন ব্যবসায়ী। তিনি সাঁকো ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার। অবশ্য মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে তিনি প্রতিষ্ঠানটির এমডির পদ থেকে পতদ্যাগ করেন। সাঁকোর পরিচালকরা তাঁর পরিবারের সদস্য এবং এমডি পদটি কাউকে দেওয়া হয়নি। আসলে মন্ত্রী এমডির পদ ছাড়লেও কাজ ছাড়েননি বলে মনে হয়। আবুল হোসেনের আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল, তিনি ব্যবসা করবেন, নাকি মন্ত্রী হবেন। মন্ত্রীর পদে থেকে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজ করা অন্যায়, অনৈতিক।
বিশ্বব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে একটি জাতীয় দৈনিক সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, 'পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য ঘুষ বা কমিশন চেয়েছেন সৈয়দ আবুল হোসেনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সাঁকো ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিরা। মন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে অর্থ চাওয়া হয়েছে। কমিশন দিলে কাজ পেতে যোগাযোগমন্ত্রী নিজেই সহায়তা করবেন বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।'
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, 'সাঁকোকে কমিশন এজেন্ট করার জন্য মন্ত্রী আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে চাপ দিয়েছেন। এ জন্য তিনি ভয়ভীতিও দেখিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক বিস্তারিত তদন্ত করে এসব তথ্য সরকারকে দিয়েছে।' বিশ্বব্যাংক এও বলে দিয়েছে, 'পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থ পেতে হলে বাংলাদেশকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় পদ্মা সেতুতে অর্থ ছাড় করা হবে না।' তার মানে বিশ্বব্যাংক সরকারকে আগে থেকেই বিষয়টি জানিয়েছে। কিন্তু সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কেন নেয়নি সেই রহস্যও আমাদের অজানা।
অতীতে ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখার জন্য আবুল হোসেন মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন। তিনি তখন লাল পাসপোর্টধারী হয়েও সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে ব্যবসায়িক কাজে বিদেশে গিয়েছিলেন। সেই অনৈতিক কাজের খেসারত দিতে হয়েছিল প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে। এবার তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছে বিশ্বব্যাংক।
আমরা এটা বলছি না যে বিশ্বব্যাংক ধোয়া তুলসীপাতা। বিশ্বব্যাংকের নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য ছিল বা আছে। সরকারকে জানানোর পর সিদ্ধান্তের জন্য বিশ্বব্যাংকের অপেক্ষা করা উচিত ছিল। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসে বিষয়টি সুরাহা করা যেত। তা না করে বিশ্বব্যাংক এক ধরনের গেম খেলেছে। অবশ্য বিশ্বব্যাপী বিশ্বব্যাংকের মতলবি কর্মকাণ্ডের হাজারো উদাহরণ আছে। আইএমএফের মতো বিশ্বব্যাংক দরিদ্র দেশগুলোকে ঋণ দিয়ে সরকারকে জনবিরোধী সব কাজ করতে বাধ্য করে। না করলেই সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে একধরনের ক্যাম্পেইন শুরু করে। তারই অংশ হিসেবে আবুল হোসেনের দুর্নীতির তথ্য আগাম ফাঁস করে দিয়েছে বলে কেউ কেউ বলছেন।
বিশ্বব্যাংকের ঋণ মানেই নানা শর্ত। সেই শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলেই তারা নানা বাহানা শুরু করে। অথচ জাপান স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় বিশাল অবদান রেখে আসছে। জাপানের এই সহায়তার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শর্ত ছিল না। এখনো তারা কোনো শর্ত দেয় না। আমাদের দেশটা ছোট। এর অর্থনীতির আকারও ছোট। আমাদের মতো দেশকে আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হতে হয়। আমরা অনেক সময়ই দেখেছি, বিশ্বব্যাংক গণতান্ত্রিক সরকারকে পছন্দ করে না। অগণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে কাজ করতেই বেশি উৎসাহ বোধ করে। কারণ গণতান্ত্রিক সরকারকে তারা বশে রাখতে পারে না। যা খুশি তা করাতে পারে না।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ নতুন নয়। অভিযোগ আছে, থাকবে; তার পরও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা নিয়ে আমাদের উন্নয়নকাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের কাজে যদি সততা ও স্বচ্ছতা থাকে, তাহলে শর্ত দিয়েও তারা কিছু করতে পারবে না। সমস্যা আমাদের নিজেদেরই, আমাদেরই এর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamal1970@hotmail.com
No comments