বাজেট ঘাটতি মেটানো হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ঋণ দিয়ে by জাকির হোসেন

লতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে ৬০ শতাংশ অর্থ ঋণ হিসেবে নেওয়ার কথা দেশ থেকে। অন্যদিকে ৪০ শতাংশ অর্থ বিদেশ থেকে ঋণ ও অনুদান হিসেবে আসার কথা। অর্থবছর শেষ হতে এখনও ৬ মাস বাকি। তবে বর্তমান বাস্তবতা বাজেট প্রাক্কলনের অনেক দূরে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বাজেটের ঘাটতি মেটাতে ৯৬ শতাংশ অর্থই দেশ থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এর সিংহভাগ আবার নেওয়া হয়েছে ব্যাংক থেকে।


এর ফলে একদিকে দেশের আর্থিক খাতের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে সরকারের সুদ ব্যয় বাড়ছে। সব মিলিয়ে বাজেট ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশে বাজেট ব্যয় সবসময় আয়ের চেয়ে বেশি। সরকার রাজস্ব আয় থেকে খরচ করার পর বাকি অর্থ দেশ ও বিদেশ থেকে ঋণ করে। বিদেশ থেকে কিছু অনুদানও পাওয়া যায়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনুদানের পরিমাণ নগণ্য। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণের ব্যয় বৈদেশিক উৎসের তুলনায় অনেক বেশি। এ কারণে সরকার বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নে বেশি গুরুত্ব দেয়। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তব্যে ঘাটতি অর্থায়নে স্বল্প সুদ ও সহজ শর্তের বৈদেশিক ঋণের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছিলেন। এ ছাড়া বর্তমান সরকারের আমলে প্রণীত সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইনেও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরে অক্টোবর পর্যন্ত সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে ঋণ করেছে ১৬ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নিয়েছে ১৫ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়ন করা হয়েছে মাত্র ৬০২ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ১৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে (মূলত সঞ্চয়পত্র) ১ হাজার ৫৬ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামগ্রিকভাবে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ২৭ হাজার ২০৮ কোটি এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১৭ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত সমকালকে বলেন, মূলত প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতার অভাবে বৈদেশিক অর্থায়ন পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া দাতার অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে ক্রয় প্রক্রিয়া, সুশাসন প্রভৃতি ইস্যুতে আগের তুলনায় বেশি কঠোর হয়েছে। এ কারণে অর্থ ছাড়ে দেরি হচ্ছে। পাইপলাইনে প্রায় ১৩শ' কোটি ডলার আটকে আছে। বৈদেশিক সহায়তা কমে যাওয়ায় সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে। অন্যদিকে ডলারের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়ে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। এসবের প্রভাবে মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, অদক্ষতার পাশাপাশি সরকারের এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা বৈদেশিক ঋণ প্রাপ্তি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। সমকালকে তিনি বলেন, অসঙ্গত কারণে পদ্মা সেতু ও মেট্রো রেল প্রকল্পে অর্থায়ন আটকে আছে। বৈদেশিক সহায়তা না পাওয়ায় টাকা খরচ বেড়ে গেছে। আর্থিক খাতে বিশেষত ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যে পড়েছে।
গত সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক প্রতিবেদনে টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ার জন্য বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান কমে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের নিট প্রাপ্তি চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে খুব কম থাকায় বৈদেশিক মুদ্রা সংস্থানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে টাকার মূল্যমানের অবচয় ঘটিয়েছে। বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের স্বাভাবিক ধারা পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতকে সরকারি ঋণভারগ্রস্ত করার বিকল্পও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিরূপণ করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.