ওয়ান নিয়ে কেন এত আতঙ্ক?-রাজনীতি by ইমতিয়াজ আহমেদ

য়ান-ইলেভেন আসার পেছনে আরেকটি কারণ ছিল ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতি। গত তিন বছরে মহাজোট সরকারের শাসনামলে দুর্নীতির লাগাম যথাযথভাবে টেনে ধরা হয়েছে, সেটা জনগণ ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি চলছে বলে প্রচুর অভিযোগ সংবাদপত্রে নিয়মিত আসছে এবং এ কারণে পদ্মা সেতুর মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রকল্পের কাজও থেমে আছে।


এ অবস্থায় জনগণ কোনদিকে যাবে? যদি ফের পাঁচ বছর আগের মতো অঘটন ঘটে, তারা কি স্বাগত জানাবে?  আজ ১১ জানুয়ারি, ২০১২। ওয়ান-ইলেভেনের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। সে সময়ে রাজপথ ছিল অগি্নগর্ভ। ক্ষমতায় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যার নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। একই সঙ্গে তিনি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে। এর আগে যেসব তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে তাতে এ দায়িত্ব ছিল পৃথক ব্যক্তির হাতে। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিরপেক্ষ ছিলেন না বলে বিরোধীরা অভিযোগ করতে থাকে। নির্বাচন কমিশনও এমনভাবে কাজ করছে, যা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিরোধীদের বিবেচনায় 'বিএনপিকে সুবিধা করে দেওয়াই লক্ষ্য'। একের পর এক হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছিল। জানুয়ারির শেষ দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান ছিল অনিশ্চিত। বাংলাদেশের জনগণ ছিল চরমভাবে উদ্বিগ্ন। ঢাকাস্থ বিদেশি দূতাবাস-হাইকমিশনগুলোতে তার প্রভাব পড়ছিল। এমনই এক পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে বেতার-টিভিতে ভাষণ দিয়ে জানিয়ে দেন, দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে এবং তিনি আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদে থাকছেন না।
এভাবেই ওয়ান-ইলেভেন শব্দটি আমাদের রাজনৈতিক অভিধানে যুক্ত হয়। তবে তা যে পাঁচ বছর পরও টিকে থাকবে এবং বিশেষ অর্থবোধক হয়ে উঠবে, সেটা কিন্তু সে সময়ে ধারণা করা যায়নি। আর এখন তো ওয়ান-ইলেভেন রীতিমতো দিবসে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে জরুরি আইন আগেও জারি হয়েছে। সামরিক শাসন হয়েছে দুই দফায়। গণতন্ত্র বিভিন্ন সময়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছে। সরকারে এসেছে পরিবর্তন। এর সঙ্গেও দিনক্ষণ জড়িত রয়েছে। কিন্তু কোনো তারিখই ওয়ান-ইলেভেনের মতো পাকাপাকি স্থান করে নেয়নি। পাঁচ বছর পরও বারবার তা রেফারেন্স হয়ে উঠছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বিরোধীদের সমালোচনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার বিরোধীদলীয় নেত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, 'যারা এক-এগারোর সময় সফল হতে পারেনি, নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল, তারাই এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছে। আর তাদের সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেত্রী সুর মেলাচ্ছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে যে তারা আপনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে তার নিশ্চয়তা কী। বরং জেলেও যেতে হতে পারে। খাল কেটে কুমির আনার দরকার কী?'
এক-এগারো বা ওয়ান-ইলেভেন এসেছিল, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঠিকভাবে কাজ না করায়। ১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমান একটি সফল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ২০০১ সালে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিচারপতি লতিফুর রহমান। কিন্তু ২০০৭ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে সৃষ্টি হয় অনিশ্চয়তা। বিএনপি তাদের পছন্দের একজন প্রধান উপদেষ্টা পেতে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বয়সসীমা জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার সুবিধা কাজে লাগিয়ে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বাড়িয়ে নিয়েছে, আওয়ামী লীগের এ অভিযোগ অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। ওয়ান-ইলেভেন জরুরি আইন জারির মাধ্যমে এ সমস্যার এক ধরনের সমাধান হয়_ স্থগিত রাখা হয় নির্বাচন। কিন্তু ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর মহাজোট সরকারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যু নিয়ে নতুন করে বিতর্কের সূত্রপাত করেছে, এমনই অভিমত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের। সরকারের তিন বছর উপলক্ষে সমকাল এবং আরও কয়েকটি সংবাদপত্র দেশব্যাপী যে জরিপ পরিচালনা করেছে তাতেও দেখা যায়, সংবিধান থেকে এ ব্যবস্থা বাতিল করার সমর্থনে নেই বেশিরভাগ জনমত। বিরোধীরা কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে রাজপথে। তারা আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে চলেছে। এর ফলে নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে অনিশ্চয়তা। একই সঙ্গে ফের আতঙ্ক_ আবার কি ওয়ান-ইলেভেন?
ওয়ান-ইলেভেনের পর প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ সরে দাঁড়ালে তার স্থলাভিষিক্ত হন ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। তিনি এক সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রসহ দাতা দেশ ও গোষ্ঠীর তিনি পছন্দের লোক ছিলেন, এটা দ্রুতই স্পষ্ট হয়। তার পেছনে পূর্ণ সমর্থন জোগাচ্ছেন সে সময়ের সেনাবাহিনী প্রধান মইন উ আহমেদ, সেটাও দেশবাসী বুঝতে পারে। তিনিও এমন ধারণা গণমাধ্যমে প্রদত্ত অভিমতে এবং অন্যান্যভাবে দিতে চেয়েছেন। নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সদলবলে উপস্থিত থাকে এবং বিএনপি বর্জন করে।
ওয়ান-ইলেভেনের আগের দিনগুলো ছিল সংঘাতময়, সেটা বলেছি। জনগণ এমন অবস্থা অব্যাহত থাকুক, তা চায়নি। নতুন সরকার একটি নিরপেক্ষ ও আস্থাভাজন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পেরেছিল। তারা ছবিসহ নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্য আনুুমানিক দুই বছর সময় চায় এবং জনগণ তাকে যুক্তিযুক্ত মনে করে। এ কাজ সেনাবাহিনীর সার্বিক সহযোগিতায় নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করা সম্ভব হয়। পূর্ববর্তী তালিকায় এক কোটির বেশি ভুয়া ভোটার ছিল_ এমন অভিযোগেরও সত্যতা মেলে নতুন তালিকা তৈরি হওয়ার পর। সে সময়ে গঠিত নির্বাচন কমিশন এখনও কাজ করছে। সাধারণ নির্বাচন ছাড়াও তারা দেশব্যাপী উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছে। কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনও হয়েছে শান্তিপূর্ণ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আগামী মাসে শেষ হচ্ছে এবং এখন নতুন কমিশন কীভাবে কাদের নিয়ে গঠিত হবে, তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ।
ওয়ান-ইলেভেন সরকারের প্রথম দিকের অনেক পদক্ষেপকে জনগণ স্বাগত জানায়। তারা রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র সংশোধনের সুপারিশ করে এবং গণতান্ত্রিক পথে চলার কথা বলে। আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। নির্বাচনে যারা প্রার্থী হবে, তারা যেন তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সমর্থন নিয়ে আসে_ তার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। জনগণ এ বিষয়টিকে স্বাগত জানায়।
ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপও প্রশংসিত হতে থাকে। ক্ষমতায় থেকে যারা প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে, তার সবটা বৈধপথে ছিল না_ সেটা জনগণের কাছে অজানা ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ ধরনের কিছু ব্যক্তিকে সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেয়। এমন অনেকে সে সময়ে গ্রেফতার হন, যাদের বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ, যে কোনো সরকারের আমলেই মনে করা হতো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
তবে কথায় বলে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণ হয়ে ওঠে। এক সময়ে দেখা গেল, দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে এমন অনেককে আটক করা হচ্ছে কিংবা আটকের ভয় দেখানো হচ্ছে, যা যথার্থ হচ্ছে না। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিংবা নিছক সন্দেহবশতও অনেককে আটক করা হয়। অনেকের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায়েরও অভিযোগ উঠতে থাকে।
দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও বুমেরাং হয়। প্রথমদিকে বিষয়টি এসেছিল রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক ধারায় চলতে অনুপ্রাণিত করার জন্য। কিন্তু এতে দলে গণতন্ত্র আসবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় তো সৃষ্টি হয়ই, একই সঙ্গে দেশের গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত হতে পারে বলেও শঙ্কা তৈরি হয়।
এভাবে আমরা ওয়ান-ইলেভেনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিক দেখতে পাই। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পাঁচ বছর পরও এ আতঙ্ক থেকে যাওয়া। এর একটি কারণ রাজনৈতিক অঙ্গনে সাংঘর্ষিক অবস্থা চলতে থাকা। প্রধান দুটি দলের মধ্যে পারস্পরিক অসহিষ্ণু মনোভাব রয়ে গেছে এবং তা যত দিন যাচ্ছে বাড়ছে বলেই ধারণা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাদ দেওয়াকেও জনগণ ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। এ পদক্ষেপের যুক্তি হিসেবে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু সে রায়ও যথাযথ অনুসরণ করা হয়নি বলেই প্রতীয়মান হয়। অতীতে ক্ষমতাসীনরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি সমর্থন করেনি। এ ইস্যুটি মূলত বিরোধী দলের। কিন্তু জনগণ মনে করেছে, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য এ ধরনের পদ্ধতির প্রয়োজন রয়েছে। সংবিধান থেকে এ ব্যবস্থা বাতিল করায় জনগণ ফের রাজনৈতিক অঙ্গনে হানাহানির ভয় করছে। তদুপরি রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ইস্যুটি জনগণকে পীড়া দিচ্ছে। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি হতাশাব্যঞ্জক। এ জন্য কেবল দেশীয় কারণ দায়ী নয়, বিশ্বব্যাপী মন্দারও ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে সমস্যা সৃষ্টি করছে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্য।
ওয়ান-ইলেভেন আসার পেছনে আরেকটি কারণ ছিল ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতি। গত তিন বছরে মহাজোট সরকারের শাসনামলে দুর্নীতির লাগাম যথাযথভাবে টেনে ধরা হয়েছে, সেটা জনগণ ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি চলছে বলে প্রচুর অভিযোগ সংবাদপত্রে নিয়মিত আসছে এবং এ কারণে পদ্মা সেতুর মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রকল্পের কাজও থেমে আছে।
এ অবস্থায় জনগণ কোনদিকে যাবে? যদি ফের পাঁচ বছর আগের মতো অঘটন ঘটে, তারা কি স্বাগত জানাবে?
কার্ল মার্কস ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির কথা বলেছেন_ প্রথমবার তা ঘটে ট্র্যাজেডি এবং দ্বিতীয়বার প্রহসন হিসেবে। ফের যদি ওয়ান-ইলেভেন ঘটে, তাতে আমরা কোনটি দেখব?

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.