সোনা কি আসলেই সোনার হরিণ? by আবু এন এম ওয়াহিদ
গত ১০ বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বেড়েছে পাঁচ গুণেরও বেশি। কয়েক সপ্তাহ আগে আউন্সপ্রতি সোনার দাম উঠেছিল এক হাজার ৯০০ ডলারের মতো। এই মুহূর্তে এর বাজারমূল্য আছে এক হাজার ৬৫০ ডলার। যখন এই লেখা কাগজে ছাপা হবে, তখন সোনার দাম আরো বেশি হতে পারে, আবার কমতেও পারে। দুনিয়াজোড়া বর্তমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার কারণে অনেকে বলছেন, বছর শেষ হওয়ার আগেই সোনার দাম দুই হাজার ৫০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
আবার কারো কারো মতে, সোনার বাজারে বর্তমান 'বুল মার্কেট' (চাঙ্গাভাব) শেষ হওয়ার আগেই প্রতি আউন্সের দাম পাঁচ হাজার ডলারেও গিয়ে ঠেকতে পারে। এ পরিস্থিতিতে সোনা আর সোনার বাজার নিয়ে আজকাল বেশ লেখালেখি হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে, তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়ও স্বর্ণবিষয়ক দু-একটি লেখা ইদানীং আমার নজরে এসেছে। এ ব্যাপারে আলোচনা, সমালোচনা, লেখালেখি_যা-ই হোক, সোনার ভবিষ্যৎ নিয়ে আরো চিন্তাভাবনা ও বোঝাবুঝির অবকাশ এখনো রয়ে গেছে।
আমাদের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক জীবনে খাওয়া-পরা, চলাফেরা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকারখানা ইত্যাদিতে সোনার ব্যবহার খুবই কম। যেটুকু ব্যবহৃত হয়, তার ৭৮ শতাংশই অলংকার হিসেবে নারীর সাজসজ্জা ও রূপচর্চায়। বাকি সোনার ব্যবহার হয় স্যুভেনির হিসেবে সোনার পাত, বার কিংবা কয়েনের কালেকশনে; সেলফোন, কম্পিউটার এবং ইলেকট্রনিক অন্যান্য পণ্য তৈরিতে। দাঁত বাঁধাই এবং দাঁতের ক্যাভিটি ফিলিংয়ে সোনার ব্যবহার আছে। কিছু রোগ নির্ণয় এবং রোগের চিকিৎসায়ও সোনা ব্যবহার করা হয়। রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস ও ল্যাগোপথালমস নামক রোগের চিকিৎসায় সোনার বিশেষ ব্যবহার আছে। কোনো কোনো জটিল রোগ নির্ণয়ে বিশেষ ধরনের তেজস্ক্রিয় সোনা কাজে লাগানো হয়। আধুনিক শল্যচিকিৎসার যন্ত্রপাতিতে অল্পস্বল্প সোনা ব্যবহৃত হয়। শিল্পকারখানায় গ্লাস তৈরিতেও সোনা লাগে। অত্যন্ত পাতলা সোনার পাত দালানকোঠা নির্মাণেও ব্যবহার করা হয়। পরিশেষে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলাধুলা এবং শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য কৃতী নারী-পুরুষদের সোনার পদক দিয়েও মূল্যায়ন করা হয়।
স্বর্ণ আবিষ্কার এবং এর ব্যবহার শুরু হয়েছে ছয় হাজার বছর আগে। তখন থেকে এ পর্যন্ত খনি থেকে আনুমানিক এক লাখ ৬৫ হাজার টন স্বর্ণ উত্তোলন করা হয়েছে। পরিমাণের দিক দিয়ে স্বর্ণ পৃথিবীতে খুব একটা বেশি নেই। স্বর্ণের দুষ্প্রাপ্যতা এবং স্বল্পতাই এর উচ্চমূল্যের অন্যতম অন্তর্নিহিত কারণ। সোনার যত ব্যবহারের কথা এখানে আলোচনা করেছি, তার মধ্যে এর অন্যতম ব্যবহার হয়ে থাকে বিনিয়োগজগতে। বিনিয়োগকারীরা প্রতিদিন সোনা কেনাবেচা করেন তাঁদের বিনিয়োগ পোর্টফোলিওর ব্যালান্স ও ডাইভার্সিফিকেশনের জন্য। বর্তমানে বড় বড় ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর দৃষ্টিতে পৃথিবীর কোনো কোনো বিশেষ অঞ্চল অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি অস্থির ও ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ঝুঁকির মুখে নিজ নিজ বিনিয়োগ নিরাপদ রাখার জন্য তাঁরা তাঁদের বিনিয়োগ পোর্টফোলিওতে স্টক, সরকারি বন্ড, করপোরেট বন্ড, ট্রেজারি বিল, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের শেয়ার, নগদ টাকা ইত্যাদির সঙ্গে স্বর্ণকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে রাখেন। সাধারণত স্টক বন্ড এবং অন্যান্য আর্থিক অ্যাসেটের মূল্যমান যেদিকে যায়, স্বর্ণের মূল্যমান তার বিপরীত দিকে যায়। স্টক, বন্ড ইত্যাদি ইনটেঞ্জিবল অ্যাসেট, কিন্তু স্বর্ণ একটি টেঞ্জিবল অ্যাসেট। যত দিন আন্তর্জাতিক বাজারে বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি থাকবে, তত দিন বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে সোনার চাহিদা থাকবেই থাকবে। পোর্টফোলিও ডাইভার্সিফিকেশনে সোনা তাই একান্তই প্রয়োজনীয়।
পোর্টফোলিওতে কম্পানি শেয়ার বা ইক্যুইটির মূল্য নির্ভর করে কম্পানি আর্নিংস ও গ্রোথ পটেনশিয়ালের ওপর। বন্ডের দাম নির্ভর করে তার নিরাপত্তা, ইল্ড এবং প্রতিযোগী অন্য অ্যাসেটের রিটার্নের ওপর। কিন্তু সোনার দাম এগুলোর ওপর নির্ভর করে না; সোনার দাম নির্ভর করে এর চাহিদা ও সরবরাহ, মুদ্রা বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতি, চলমান সুদের হার, যুদ্ধ, মহামারি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদির ওপর। এবং এগুলো ফিন্যানশিয়াল অ্যাসেটের মূল্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। তাই অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বে স্বর্ণের গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
অন্যদিকে সোনাকে যাঁরা 'সোনার হরিণ' মনে করেন, তাঁদের কথা ঠিক এর উল্টো। তাঁদের মতে, সোনার দাম বাড়ার কোনোই কারণ নেই। বরং এর দাম অচিরেই এমনভাবে কমতে পারে যে সোনার মজুদদাররা সর্বস্বান্ত হয়ে বুক চাপড়াবে আর হায় হায় করবে। তাঁদের যুক্তি, সোনা আমাদের কাছে কোনো প্রয়োজনীয় বস্তু নয়। এটা যতই মূল্যবান হোক, দেখতে যতই সুন্দর হোক, আমরা সোনা খেতেও পারি না, পরতেও পারি না। আর শিল্পকারখানায় এর উপযোগিতা লোহা-লক্কড়ের চেয়েও কম। তাঁরা আরো বলছেন, গত ১০-১২ বছরে স্বর্ণের প্রকৃত চাহিদা দুনিয়াজোড়া কমেছে ১৮ শতাংশ। তথাপি এর দাম যেটুকু বেড়েছে, তা কেবলই স্পেকুলেটরদের স্পেকুলেশনের কারণে; এর আসল ব্যবহার এবং প্রকৃত চাহিদার জন্য নয়। এখন সোনার বাজারে যা হচ্ছে, তা শুধুই বাব্ল। যখনই বাব্ল বার্স্ট করবে, তখনই সোনার মজুদদাররা বুঝবেন, সোনা আসলেই 'সোনার হরিণ'।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
আমাদের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক জীবনে খাওয়া-পরা, চলাফেরা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকারখানা ইত্যাদিতে সোনার ব্যবহার খুবই কম। যেটুকু ব্যবহৃত হয়, তার ৭৮ শতাংশই অলংকার হিসেবে নারীর সাজসজ্জা ও রূপচর্চায়। বাকি সোনার ব্যবহার হয় স্যুভেনির হিসেবে সোনার পাত, বার কিংবা কয়েনের কালেকশনে; সেলফোন, কম্পিউটার এবং ইলেকট্রনিক অন্যান্য পণ্য তৈরিতে। দাঁত বাঁধাই এবং দাঁতের ক্যাভিটি ফিলিংয়ে সোনার ব্যবহার আছে। কিছু রোগ নির্ণয় এবং রোগের চিকিৎসায়ও সোনা ব্যবহার করা হয়। রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস ও ল্যাগোপথালমস নামক রোগের চিকিৎসায় সোনার বিশেষ ব্যবহার আছে। কোনো কোনো জটিল রোগ নির্ণয়ে বিশেষ ধরনের তেজস্ক্রিয় সোনা কাজে লাগানো হয়। আধুনিক শল্যচিকিৎসার যন্ত্রপাতিতে অল্পস্বল্প সোনা ব্যবহৃত হয়। শিল্পকারখানায় গ্লাস তৈরিতেও সোনা লাগে। অত্যন্ত পাতলা সোনার পাত দালানকোঠা নির্মাণেও ব্যবহার করা হয়। পরিশেষে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলাধুলা এবং শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য কৃতী নারী-পুরুষদের সোনার পদক দিয়েও মূল্যায়ন করা হয়।
স্বর্ণ আবিষ্কার এবং এর ব্যবহার শুরু হয়েছে ছয় হাজার বছর আগে। তখন থেকে এ পর্যন্ত খনি থেকে আনুমানিক এক লাখ ৬৫ হাজার টন স্বর্ণ উত্তোলন করা হয়েছে। পরিমাণের দিক দিয়ে স্বর্ণ পৃথিবীতে খুব একটা বেশি নেই। স্বর্ণের দুষ্প্রাপ্যতা এবং স্বল্পতাই এর উচ্চমূল্যের অন্যতম অন্তর্নিহিত কারণ। সোনার যত ব্যবহারের কথা এখানে আলোচনা করেছি, তার মধ্যে এর অন্যতম ব্যবহার হয়ে থাকে বিনিয়োগজগতে। বিনিয়োগকারীরা প্রতিদিন সোনা কেনাবেচা করেন তাঁদের বিনিয়োগ পোর্টফোলিওর ব্যালান্স ও ডাইভার্সিফিকেশনের জন্য। বর্তমানে বড় বড় ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর দৃষ্টিতে পৃথিবীর কোনো কোনো বিশেষ অঞ্চল অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি অস্থির ও ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ঝুঁকির মুখে নিজ নিজ বিনিয়োগ নিরাপদ রাখার জন্য তাঁরা তাঁদের বিনিয়োগ পোর্টফোলিওতে স্টক, সরকারি বন্ড, করপোরেট বন্ড, ট্রেজারি বিল, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের শেয়ার, নগদ টাকা ইত্যাদির সঙ্গে স্বর্ণকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে রাখেন। সাধারণত স্টক বন্ড এবং অন্যান্য আর্থিক অ্যাসেটের মূল্যমান যেদিকে যায়, স্বর্ণের মূল্যমান তার বিপরীত দিকে যায়। স্টক, বন্ড ইত্যাদি ইনটেঞ্জিবল অ্যাসেট, কিন্তু স্বর্ণ একটি টেঞ্জিবল অ্যাসেট। যত দিন আন্তর্জাতিক বাজারে বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি থাকবে, তত দিন বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে সোনার চাহিদা থাকবেই থাকবে। পোর্টফোলিও ডাইভার্সিফিকেশনে সোনা তাই একান্তই প্রয়োজনীয়।
পোর্টফোলিওতে কম্পানি শেয়ার বা ইক্যুইটির মূল্য নির্ভর করে কম্পানি আর্নিংস ও গ্রোথ পটেনশিয়ালের ওপর। বন্ডের দাম নির্ভর করে তার নিরাপত্তা, ইল্ড এবং প্রতিযোগী অন্য অ্যাসেটের রিটার্নের ওপর। কিন্তু সোনার দাম এগুলোর ওপর নির্ভর করে না; সোনার দাম নির্ভর করে এর চাহিদা ও সরবরাহ, মুদ্রা বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতি, চলমান সুদের হার, যুদ্ধ, মহামারি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদির ওপর। এবং এগুলো ফিন্যানশিয়াল অ্যাসেটের মূল্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। তাই অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বে স্বর্ণের গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
অন্যদিকে সোনাকে যাঁরা 'সোনার হরিণ' মনে করেন, তাঁদের কথা ঠিক এর উল্টো। তাঁদের মতে, সোনার দাম বাড়ার কোনোই কারণ নেই। বরং এর দাম অচিরেই এমনভাবে কমতে পারে যে সোনার মজুদদাররা সর্বস্বান্ত হয়ে বুক চাপড়াবে আর হায় হায় করবে। তাঁদের যুক্তি, সোনা আমাদের কাছে কোনো প্রয়োজনীয় বস্তু নয়। এটা যতই মূল্যবান হোক, দেখতে যতই সুন্দর হোক, আমরা সোনা খেতেও পারি না, পরতেও পারি না। আর শিল্পকারখানায় এর উপযোগিতা লোহা-লক্কড়ের চেয়েও কম। তাঁরা আরো বলছেন, গত ১০-১২ বছরে স্বর্ণের প্রকৃত চাহিদা দুনিয়াজোড়া কমেছে ১৮ শতাংশ। তথাপি এর দাম যেটুকু বেড়েছে, তা কেবলই স্পেকুলেটরদের স্পেকুলেশনের কারণে; এর আসল ব্যবহার এবং প্রকৃত চাহিদার জন্য নয়। এখন সোনার বাজারে যা হচ্ছে, তা শুধুই বাব্ল। যখনই বাব্ল বার্স্ট করবে, তখনই সোনার মজুদদাররা বুঝবেন, সোনা আসলেই 'সোনার হরিণ'।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
No comments