ইসিতে নতুন নিয়োগ-সমঝোতা, না অগণতান্ত্রিক পন্থা? by বদিউল আলম মজুমদার
আমাদের মাননীয় সিইসি ও অন্য দুই কমিশনারের মেয়াদ আগামী মাসের প্রথমার্ধেই শেষ হবে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সবার মতামতের ভিত্তিতে যাতে পরবর্তী সিইসি এবং অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ দেওয়া যায়, সে লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে ডেকেছেন। এই প্রথমবারের মত এধরণের উদ্যোগ নেওয়া হলো। আমরা আনন্দিত যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি রাষ্ট্রপতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে সংলাপে অংশ নিতে রাজি হয়েছে।
এ উদ্যোগের জন্য রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানাই। নিঃসন্দেহে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন অপরিহার্য। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন এর আর্থিক স্বাধীনতা ও স্বাধীন সচিবালয়। ইতিমধ্যে কমিশনের স্বাধীন সচিবালয় বহুলাংশে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর আর্থিক স্বাধীনতা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি। কমিশনের সব ব্যয় এখনো সংযুক্ত তহবিলের দায়যুক্ত ব্যয়ে পরিণত হয়নি। এ ছাড়া যেকোনো প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করবে কি না, তা অনেকাংশেই নির্ভর করে যোগ্য ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিরা ওই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত কি না। উপরন্তু কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্যও প্রয়োজন সৎ, দক্ষ ও সাহসী ব্যক্তিদের এখানে নিয়োগ প্রদান।
রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপকালে সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্যে কমিশন গত বছর একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রস্তাব করে। বিএনপি সেই সংলাপে অংশগ্রহণ করেনি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও প্রস্তাবটির প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেনি। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বর্তমান সংলাপে অংশগ্রহণকারী কিছু দল একই প্রস্তাব উত্থাপন করেছে।
নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের জন্য অনুসন্ধান বা বাছাই কমিটির কোনো বিকল্প নেই, যার জন্য সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে নির্দেশিত একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে। তবে বাছাই কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দিলেই নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা নিয়োগ পান না। বাছাই কমিটি ব্যবহার করে নিয়োগ প্রদান করা সত্ত্বেও আমাদের অনেক সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীনদের প্রতি অনুগত ব্যক্তিরাই অতীতে নিয়োগ পেয়েছেন। এ ছাড়া অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদেরও এ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমান সরকারের আমলেই ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত এক অধ্যাপককে মানবাধিকার কমিশনে নিয়োগ প্রদান করা এবং প্রতিবাদের মুখে পরবর্তী সময়ে তড়িঘড়ি করে, যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ না করেই তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। তাই বাছাই কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে অনুসন্ধান কমিটি গঠনকালে সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের বাইরে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্বও নিশ্চিত করতে হবে। কমিটিকেও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। যাদের নিয়োগের জন্য বিবেচনা করা হবে, তাদের নাম কমিটিকে প্রকাশ করতে হবে, যাতে তাদের উপযুক্ততা নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে পারে। এ ছাড়া কমিটিকে প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে শুধু একজনের নাম সুপারিশ করতে হবে এবং রাষ্ট্রপতির সুপারিশ করা কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ প্রদানের ব্যাপারে আপত্তি থাকলে তিনি কারণসহ তা লিখিতভাবে কমিটিকে জানাবেন এবং নতুন নাম আহ্বান করবেন।
প্রসঙ্গত, গুঞ্জন শোনা যায়, বর্তমান সরকার বিদ্যমান নির্বাচন কমিশনকেই পুনর্নিয়োগ দেওয়ার কথা ভাবছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত হবে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সংবিধানের ১১৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এমন কোন ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের অন্য কোনো কর্মে নিয়োগ পাওয়ার অযোগ্য এবং শুধু অন্য দুই কমিশনারদের মধ্য থেকে একজনকে সিইসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনারদের মধ্য থেকে সিইসি পদে নিয়োগ ব্যতীত আমাদের সংবিধান সিইসি ও কমিশনারদের এক টার্মের মেয়াদ সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করলেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত হবে না। কারণ, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কমিশন একটি পক্ষমাত্র। অন্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষগুলো হলো—প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং রাজনৈতিক দল ও তাদের মনোনীত প্রার্থী। অতীতের অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় যে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষ না হলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় না। এ কারণেই দলীয় সরকারের অধীনে অতীতের সব নির্বাচনেই ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। পক্ষান্তরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনেই বিরোধী দল ক্রমাগতভাবে আরও বেশি আসন নিয়ে জিতেছে। তাই অন্তত সীমিত টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো নির্বাচনকালীন এক ধরনের নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া পক্ষপাতহীন নির্বাচন আশা করা যায় না।
আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের এক সর্বাত্মক আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ১৯৯৬ সালে আমাদের সংবিধানে সংযোজিত হলেও দুর্ভাগ্যবশত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গত জুন মাসে তা বাতিল করে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা না হলে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ইতিমধ্যে আগামী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তিত হওয়া ইস্যুতে সমঝোতা না হলে আগামী নির্বাচনই অনিশ্চিত হয়ে পড়তে এবং আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আবারও খাদে পড়ে যেতে পারে। তাই এ বিষয়টিও সংলাপের এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি ইতিমধ্যেই কয়েকটি দল রাষ্ট্রপতির কাছে রেখেছে, যা আমরাও সমর্থন করি। প্রসঙ্গত, গত মে মাসে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত ‘বিশেষ সংসদীয় কমিটি’র আহ্বানে সাড়া দিয়ে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা প্রায় সমস্বরে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি অব্যাহত রাখার পক্ষে মত দেন।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিনভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রথমত, তারা নির্বাচন প্রভাবিত করতে পারে—এমন পদে অধিষ্ঠিত প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিয়ে ওই সব পদে অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ প্রদান করেছে। দ্বিতীয়ত, তারা একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, যাতে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। তৃতীয়ত, তারা সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের নির্দেশনা অনুযায়ী শর্তহীনভাবে নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করেছে। এ ছাড়া সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির বিধান থাকার ফলেই ২০০৭-০৮ সালে সামরিক শাসন এড়ানো সম্ভব হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। তা সত্ত্বেও বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বিলুপ্ত করে। এ ব্যাপারে সরকার গত মে মাসে ঘোষিত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতিকে ভবিষ্যতের জন্য অবৈধ (prospectively void) ঘোষণা করে দেওয়া একটি সংক্ষিপ্ত আদেশকে যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করে; যদিও আদালত রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে আরও দুই মেয়াদের জন্য এ ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখার পক্ষে পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন। এ ছাড়া আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো লেখা হয়নি।
এটি সুস্পষ্ট যে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখতে হলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে হবে। কারণ, সুষ্ঠু নির্বাচন গণতান্ত্রিক শাসনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। তাই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন তথা গণতন্ত্রের স্বার্থে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে। একই সঙ্গে পরিবর্তিত রূপে হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত হবে না কারণ, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ও তাদের মনোনীত প্রার্থীরাই এর পথে পর্বতপ্রমাণ বাধা। তারাই মনোনয়ন-বাণিজ্যে লিপ্ত হয়, টাকা দিয়ে ভোট কেনে, প্রতিপক্ষকে হুমকি দেয়, ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসতে বাধা দেয় ইত্যাদি। তাই নির্বাচনকে এসবের প্রভাবমুক্ত রাখতে হলে রাজনৈতিক দলের সংস্কার জরুরি। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি আচরণবিধি মেনে চলার লক্ষ্যে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে।
দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মতে, অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত গত চারটি নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দিন দিন অকার্যকর হয়েছে—যার অন্যতম কারণ হলো দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, অপশাসন, দলীয়করণ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুরবস্থা, অকার্যকর সংসদ ইত্যাদি। অকার্যকর ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না বরং তা ভেঙে পড়তে বাধ্য। তাই রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত রাখতে হলে এ ব্যাপারেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সমঝোতার প্রয়োজন। অর্থাৎ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং সত্যিকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরবর্তী সরকারের করণীয় সম্পর্কেও আমাদের মতৈক্যে পৌঁছানো আজ জরুরি। সুতরাং জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সার্বিক বিষয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। এ বিষয়েও রাষ্ট্রপতির অনুঘটকের ভূমিকা পালন আবশ্যক। তাই সংশ্লিষ্ট সবার অংশগ্রহণে সার্বিক বিষয়ে সমঝোতার লক্ষ্যে একটি ‘জাতীয় সনদ’ তৈরির উদ্যোগ নিতে আমরা রাষ্ট্রপতিকে বিনীতভাবে অনুরোধ জানাই।
পরিশেষে, অতীতের সংলাপের অভিজ্ঞতা আমাদের ইতিবাচক নয়। জলিল-মান্নান ভূঁইয়া সংলাপ ছিল সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ১৯৯৫ সালের স্যার নিনিয়ান স্টিফেনসের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত সংলাপও সফলতার পরিবর্তে তিক্ততাই সৃষ্টি করেছে। এসব ব্যর্থতার ফসলই ২০০৭-০৮ সালের সেনাসমর্থিত অগণতান্ত্রিক সরকার এবং ওই দুই বছরের দুঃখময় ঘটনাবলি। তাই লুকোচুরি খেলার বা সমস্যাকে কার্পেটের নিচে ঢেকে রেখে চলমান সংলাপকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করার কোনো অবকাশ নেই। কারণ, ব্যর্থতার পরিণতি হবে অগণতান্ত্রিক পন্থা, যার মাশুল শুধু রাজনীতিবিদদেরই নয়, পুরো জাতিকেই গুনতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপকালে সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্যে কমিশন গত বছর একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রস্তাব করে। বিএনপি সেই সংলাপে অংশগ্রহণ করেনি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও প্রস্তাবটির প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেনি। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বর্তমান সংলাপে অংশগ্রহণকারী কিছু দল একই প্রস্তাব উত্থাপন করেছে।
নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের জন্য অনুসন্ধান বা বাছাই কমিটির কোনো বিকল্প নেই, যার জন্য সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে নির্দেশিত একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে। তবে বাছাই কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দিলেই নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা নিয়োগ পান না। বাছাই কমিটি ব্যবহার করে নিয়োগ প্রদান করা সত্ত্বেও আমাদের অনেক সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীনদের প্রতি অনুগত ব্যক্তিরাই অতীতে নিয়োগ পেয়েছেন। এ ছাড়া অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদেরও এ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমান সরকারের আমলেই ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত এক অধ্যাপককে মানবাধিকার কমিশনে নিয়োগ প্রদান করা এবং প্রতিবাদের মুখে পরবর্তী সময়ে তড়িঘড়ি করে, যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ না করেই তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। তাই বাছাই কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে অনুসন্ধান কমিটি গঠনকালে সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের বাইরে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্বও নিশ্চিত করতে হবে। কমিটিকেও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। যাদের নিয়োগের জন্য বিবেচনা করা হবে, তাদের নাম কমিটিকে প্রকাশ করতে হবে, যাতে তাদের উপযুক্ততা নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে পারে। এ ছাড়া কমিটিকে প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে শুধু একজনের নাম সুপারিশ করতে হবে এবং রাষ্ট্রপতির সুপারিশ করা কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ প্রদানের ব্যাপারে আপত্তি থাকলে তিনি কারণসহ তা লিখিতভাবে কমিটিকে জানাবেন এবং নতুন নাম আহ্বান করবেন।
প্রসঙ্গত, গুঞ্জন শোনা যায়, বর্তমান সরকার বিদ্যমান নির্বাচন কমিশনকেই পুনর্নিয়োগ দেওয়ার কথা ভাবছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত হবে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সংবিধানের ১১৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এমন কোন ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের অন্য কোনো কর্মে নিয়োগ পাওয়ার অযোগ্য এবং শুধু অন্য দুই কমিশনারদের মধ্য থেকে একজনকে সিইসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনারদের মধ্য থেকে সিইসি পদে নিয়োগ ব্যতীত আমাদের সংবিধান সিইসি ও কমিশনারদের এক টার্মের মেয়াদ সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করলেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত হবে না। কারণ, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কমিশন একটি পক্ষমাত্র। অন্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষগুলো হলো—প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং রাজনৈতিক দল ও তাদের মনোনীত প্রার্থী। অতীতের অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় যে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষ না হলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় না। এ কারণেই দলীয় সরকারের অধীনে অতীতের সব নির্বাচনেই ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। পক্ষান্তরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনেই বিরোধী দল ক্রমাগতভাবে আরও বেশি আসন নিয়ে জিতেছে। তাই অন্তত সীমিত টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো নির্বাচনকালীন এক ধরনের নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া পক্ষপাতহীন নির্বাচন আশা করা যায় না।
আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের এক সর্বাত্মক আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ১৯৯৬ সালে আমাদের সংবিধানে সংযোজিত হলেও দুর্ভাগ্যবশত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গত জুন মাসে তা বাতিল করে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা না হলে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ইতিমধ্যে আগামী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তিত হওয়া ইস্যুতে সমঝোতা না হলে আগামী নির্বাচনই অনিশ্চিত হয়ে পড়তে এবং আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আবারও খাদে পড়ে যেতে পারে। তাই এ বিষয়টিও সংলাপের এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি ইতিমধ্যেই কয়েকটি দল রাষ্ট্রপতির কাছে রেখেছে, যা আমরাও সমর্থন করি। প্রসঙ্গত, গত মে মাসে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত ‘বিশেষ সংসদীয় কমিটি’র আহ্বানে সাড়া দিয়ে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা প্রায় সমস্বরে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি অব্যাহত রাখার পক্ষে মত দেন।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিনভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রথমত, তারা নির্বাচন প্রভাবিত করতে পারে—এমন পদে অধিষ্ঠিত প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিয়ে ওই সব পদে অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ প্রদান করেছে। দ্বিতীয়ত, তারা একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, যাতে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। তৃতীয়ত, তারা সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের নির্দেশনা অনুযায়ী শর্তহীনভাবে নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করেছে। এ ছাড়া সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির বিধান থাকার ফলেই ২০০৭-০৮ সালে সামরিক শাসন এড়ানো সম্ভব হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। তা সত্ত্বেও বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বিলুপ্ত করে। এ ব্যাপারে সরকার গত মে মাসে ঘোষিত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতিকে ভবিষ্যতের জন্য অবৈধ (prospectively void) ঘোষণা করে দেওয়া একটি সংক্ষিপ্ত আদেশকে যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করে; যদিও আদালত রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে আরও দুই মেয়াদের জন্য এ ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখার পক্ষে পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন। এ ছাড়া আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো লেখা হয়নি।
এটি সুস্পষ্ট যে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখতে হলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে হবে। কারণ, সুষ্ঠু নির্বাচন গণতান্ত্রিক শাসনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। তাই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন তথা গণতন্ত্রের স্বার্থে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে। একই সঙ্গে পরিবর্তিত রূপে হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত হবে না কারণ, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ও তাদের মনোনীত প্রার্থীরাই এর পথে পর্বতপ্রমাণ বাধা। তারাই মনোনয়ন-বাণিজ্যে লিপ্ত হয়, টাকা দিয়ে ভোট কেনে, প্রতিপক্ষকে হুমকি দেয়, ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসতে বাধা দেয় ইত্যাদি। তাই নির্বাচনকে এসবের প্রভাবমুক্ত রাখতে হলে রাজনৈতিক দলের সংস্কার জরুরি। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি আচরণবিধি মেনে চলার লক্ষ্যে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে।
দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মতে, অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত গত চারটি নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দিন দিন অকার্যকর হয়েছে—যার অন্যতম কারণ হলো দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, অপশাসন, দলীয়করণ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুরবস্থা, অকার্যকর সংসদ ইত্যাদি। অকার্যকর ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না বরং তা ভেঙে পড়তে বাধ্য। তাই রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত রাখতে হলে এ ব্যাপারেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সমঝোতার প্রয়োজন। অর্থাৎ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং সত্যিকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরবর্তী সরকারের করণীয় সম্পর্কেও আমাদের মতৈক্যে পৌঁছানো আজ জরুরি। সুতরাং জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সার্বিক বিষয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। এ বিষয়েও রাষ্ট্রপতির অনুঘটকের ভূমিকা পালন আবশ্যক। তাই সংশ্লিষ্ট সবার অংশগ্রহণে সার্বিক বিষয়ে সমঝোতার লক্ষ্যে একটি ‘জাতীয় সনদ’ তৈরির উদ্যোগ নিতে আমরা রাষ্ট্রপতিকে বিনীতভাবে অনুরোধ জানাই।
পরিশেষে, অতীতের সংলাপের অভিজ্ঞতা আমাদের ইতিবাচক নয়। জলিল-মান্নান ভূঁইয়া সংলাপ ছিল সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ১৯৯৫ সালের স্যার নিনিয়ান স্টিফেনসের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত সংলাপও সফলতার পরিবর্তে তিক্ততাই সৃষ্টি করেছে। এসব ব্যর্থতার ফসলই ২০০৭-০৮ সালের সেনাসমর্থিত অগণতান্ত্রিক সরকার এবং ওই দুই বছরের দুঃখময় ঘটনাবলি। তাই লুকোচুরি খেলার বা সমস্যাকে কার্পেটের নিচে ঢেকে রেখে চলমান সংলাপকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করার কোনো অবকাশ নেই। কারণ, ব্যর্থতার পরিণতি হবে অগণতান্ত্রিক পন্থা, যার মাশুল শুধু রাজনীতিবিদদেরই নয়, পুরো জাতিকেই গুনতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments