টিসিবি সক্রিয় হলেই কি বাজার স্থিতিশীল হবে-অর্থনীতি by মামুন রশীদ

দেশের অর্থনীতিবিদদের একাংশ, বিভিন্ন গণমাধ্যম ও নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ ইদানীংকালে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) আবার সক্রিয় করে তোলার ব্যাপারে সরব হয়ে উঠেছেন। বাজারে সাম্প্রতিককালে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও অস্থিরতার পরিস্থিতিতেই তারা সম্ভবত একটি শক্তিশালী টিসিবির পক্ষে কথা বলছেন। তবে আমার কাছে এটাকে এক ধরনের অবাস্তব প্রস্তাব বলেই মনে হয়।


সরকার, বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যেন এ ধরনের বক্তব্য শোনা ও হুকুম তামিল করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। আমরা শুনেছি, বাণিজ্যমন্ত্রী টিসিবির কর্মকর্তাদের আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ওঠানামার দিকে খেয়াল রেখে মৌলিক পণ্যগুলো আমদানির নির্দেশনা দিয়েছেন। বিশেষ করে ফলনের মৌসুমে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে তখন পণ্যসামগ্রী আমদানির জন্য টিসিবির কর্মকর্তাদের প্রতি তার তাগিদ দেওয়ার কথাও শোনা গেছে। এর ফলে দেশীয় বাজারে বিক্রেতা তথা ব্যবসায়ীরা তুলনামূলক কম দামে জিনিসপত্র বিক্রি করবেন এবং বাজারেও স্থিতিশীলতা আসতে পারে বলে তিনি আশা করেছেন। এটাকে একটি ভালো পরামর্শ বা সুপারিশই বলা যায়। একজন অর্থনীতির ছাত্র এবং ব্যাংকার হিসেবে বহু বছর ধরে ব্যাংকিং কার্যক্রম নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ও ব্যবসায় খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে আমিও এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছি। বারবারই আমার মনে একটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে_ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের টিসিবির মতো দীর্ঘদিন ধরে দৃশ্যত নিষ্ক্রিয় থাকা একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে সক্রিয় করে তুললেই কি বাজারে পণ্যমূল্যের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যাবে?
আমরা জানি, অর্থনীতির ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আরোপের যুগে সামগ্রিক আমদানি-রফতানি কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা ও পণ্যসামগ্রীর যথাযথ বিতরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশে দেশে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু আমরা তখন দেখেছি, কেবল তৎকালীন বা অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমানে রাশিয়া) ও চীনের মতো সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের দেশগুলোতেই এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে কার্যকর ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। এখনও অবশ্য একই ধরনের কয়েকটি দেশ ও অঞ্চলে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মোটামুটি ভালোভাবেই কাজ করে চলেছে। এখন বাংলাদেশেও যদি টিসিবির মতো একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে সেটি হবে মস্তকায় হাতি পালনের মতো এক বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের শামিল। কারণ দেশের বাণিজ্য দিন দিন বাড়ছে এবং ইতিমধ্যে অর্থের হিসাবে তা ৫ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। টিসিবিকে সক্রিয় করে আমদানি কার্যক্রমে নিয়োজিত করতে হলে এ জন্য বিপুল অঙ্কের বাজেটীয় বরাদ্দ অনিবার্য হয়ে উঠবে।
গত ২০১০-১১ অর্থবছরে টিসিবি সারাদেশে তার ২ হাজার ২৪৫ জন ডিলারের মাধ্যমে ১০ হাজার ১৩৫ টন ডাল, ২৭ হাজার ৭৮৫ টন সয়াবিন, ২ হাজার টন মটরশুঁটি এবং ২০ হাজার টন চিনি বিতরণ করে। এসব পণ্যের মোট মূল্যমান ছিল ৪৩০ কোটি টাকা। আমি নিশ্চিত যে, আমাদের পাঠকদের মধ্যে যাদের খাদ্যশস্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর আমদানি সম্পর্কে নূ্যনতম ধারণা আছে তারা টিসিবিকে সক্রিয় করার মাধ্যমে বাজার প্রভাবিত করার উদ্যোগকে টিপ অব দ্য আইস বার্গ বা মহাসমুদ্রে বরফ কল হিসেবে বিদ্রূপ করবেন। তাই আমি মনে করি, মাননীয় সাংসদরা জাতীয় সংসদে রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেকটা সমাজতান্ত্রিক শাসনের আদলে কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত টিসিবির মতো সংস্থা বাজার স্থিতিশীল করার ব্যাপারে তেমন কিছুই করতে পারবে না। অর্থাৎ পণ্যবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে এই সংস্থা ধারাবাহিকভাবেই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলবে।
আমরা শুনেছি, সরকার নিত্যপণ্য আমদানির জন্য ইতিমধ্যে টিসিবির জন্য স্বল্প সুদে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার জন্য ৬৯ কোটি টাকার ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। যদিও বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী আমার অর্থনীতিবিদ বন্ধুরা সব সময়ই এ ধরনের ভর্তুকি প্রথার বিরুদ্ধে। তবুই আমি বলব, আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে টিসিবিকে এ অঙ্কের অর্থ জোগাড় করে দেওয়াটাও ছিল খুবই কঠিন এক কাজ। এখন আমার প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি আমাদের এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন আছে? কিংবা এই উদ্যোগ কি আমাদের সাধারণ জনগণ অথবা রাস্তাঘাটে জীবনযাপনকারী হতদরিদ্র মানুষের জন্য আদৌ কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে? কারণ আমাদের যেখানে খাদ্যসামগ্রীসহ মোট ৭৫ হাজার কোটি টাকার নিত্যপণ্য আমদানি করতে হয়, সেখানে ডিলারদের মাধ্যমে টিসিবির ৪৩০ কোটি টাকার পণ্য সরবরাহটা খুবই নগণ্য এবং হাসি পাওয়ার মতো। এছাড়া যাতায়াতের খরচ বৃদ্ধির কারণে হোক কিংবা দারিদ্র্য কমার কারণেই হোক, বড় শহরগুলোর বিভিন্ন স্থানে ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রয়কারী ট্রাকগুলোর সামনেও ক্রেতাদের ভিড় বা উপস্থিতি দিন দিন কমে আসছে। লম্বা লাইন করে ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রির এই চিত্র আমাদের ১৯৭২ অথবা ১৯৭৪ সালের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বিবর্ণ সেই স্মৃতি এখন আর আমরা রোমন্থন করতে চাই না।
কেউ হয়তো যুক্তি দেখিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন, নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল করার দায়িত্ব পালন করা থেকে সরকার কি তাহলে বিরত থাকবে? এর জবাবে আমি বলব, অবশ্যই না। তবে আমাদের বন্ধুরা যদি সরকারকে অন্য কিছু দেশের মতো উৎপাদক ও ভোক্তা পর্যায়ে দামের সামঞ্জস্য নিশ্চিত করা ছাড়াই শাক-সবজি ও মাছের বাজারে স্থিতিশীলতা আনার কথা বলতে থাকেন তাহলে সেই পদক্ষেপ ভেস্তে বা বিফলে যেতে বাধ্য। আমি দৃঢ়ভাবেই মনে করি এবং দুঃখের সঙ্গে বলছি, এ দেশে টিসিবির মতো সংস্থা কিছুই করতে পারবে না। সরকার যদি চাল, গম, চিনি, বিভিন্ন ধরনের ডাল ও ভোজ্যতেল প্রভৃতি পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরাসরি ভূমিকা পালন করতে চায় তাহলে ভর্তুকির জন্য বড় অঙ্কের অর্থের জোগান নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মালিকানার আওতায় স্টোরেজ বা গুদামজাত করার সুবিধা তথা পণ্য সংরক্ষণাগার স্থাপন করতে হবে। এ ধরনের কার্যক্রমের ব্যবস্থাপনা দায়িত্ব সুচারুভাবে পালনের জন্য ভারতসহ আরও কিছু দেশের মতো একটি ফুড করপোরেশন বা খাদ্য সংস্থা গড়ে তুলতে হবে। সে ক্ষেত্রেও অবশ্য এমন দায়িত্ব পালন করা টিসিবিকে দিয়ে হবে না। তারপরও পদক্ষেপটি নেওয়া হলে ভর্তুকির পরিমাণ সীমা ছাড়িয়ে যাবে এবং জাতীয় স্থিতিপত্র বা ন্যাশনাল ব্যালান্স শিটে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একবিংশ শতকে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি অর্জনের এই সময়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনেক চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। এর চেয়ে বরং সরকারের ভেতরে ধীরে ধীরে সক্ষমতা বৃদ্ধি, রাজনীতিতে জবাবদিহিতা জোরদার ও দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সে সঙ্গে বন্ধ করতে হবে বিবেকবর্জিত ও অসাধু ব্যবসায়ীদের নিছক রাজনৈতিক স্বার্থে প্রশ্রয় প্রদান। তাহলে সরকার অনায়াসে এ ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি অর্জন করতে পারবে। এছাড়া মুদ্রানীতি ও আর্থিক পদক্ষেপগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও সাযুজ্য রাখতে পারলে সরকারের সফল হওয়ার সম্ভাবনা আরও জোরদার হবে।

মামুন রশীদ :ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
mamun1960@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.