ভিন্নমত-শেয়ারবাজারের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ এবং প্রসঙ্গ কথা by আবু আহমেদ

লীম-আজিজ_তাঁরা সবাই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী। তাঁদের ক্ষোভ হলো, এত প্রণোদনা সত্ত্বেও শেয়ারবাজারের মূল্যসূচক নিম্নমুখী কেন? তাঁরা এবং তাঁদের মতো অনেকেই প্রণোদনার প্যাকেজ আসছে শুনে কয়েক দিনের উঠতি বাজারে কিছু শেয়ার কিনেছেন। বিশেষ করে সরকারপ্রধান যখন চার ঘণ্টা সময় নিয়ে শেয়ারবাজারের আদ্যোপান্ত আলোচনা করলেন, তখন তাঁদের বিশ্বাস জন্মাল, এবার শেয়ারবাজারের অবশ্যই কিছু একটা হবে।


বাস্তব চিত্র হলো, প্রণোদনার প্যাকেজ আসবে শুনে আলীম-আজিজদের মতো অনেকেই আবার শেয়ার কেনা শুরু করেছিলেন; কিন্তু প্রণোদনা যখন প্রকাশ হয়ে পড়ল, বাজারটা তখন পড়ে গেল। এটা কেন হলো_সেই হিসাব তাঁরা মেলাতে পারছেন না। তাঁরা আমার মত জানতে চাইলেন। আমি তাঁদের বললাম, প্রণোদনার প্যাকেজটি খারাপ নয়। যেসব ঘোষিত নীতি এই প্যাকেজে বর্ণনা করা হয়েছে, সেগুলো যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে শেয়ারবাজারের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ভালো হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, সরকারের সর্বোচ্চ স্তরে এই বাজারের ইস্যুগুলো নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা হয়েছে। ওসব মিটিংয়ে রাজস্ব বোর্ডের লোক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের লোকজনও উপস্থিত ছিলেন। বোধ করি সবার লক্ষ্য একটাই, স্বল্পমেয়াদে কিভাবে বাজার স্থিতিশীল করতে সাহায্য করা যায়, আর দীর্ঘমেয়াদে এই বাজারের প্লেয়ারসদের কিভাবে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা যায়। প্লেয়ারস বলতে আমি আপনাদের বোঝাচ্ছি না, এ ক্ষেত্রে প্লেয়ারস হলো কম্পানিগুলো এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। কমপক্ষে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্যাকেজের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়েছে, সেই দুটি হলো কম্পানির বোর্ডে যাঁরা বসে আছেন, সম্মিলিতভাবে তাঁদের অবশ্যই ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে হবে। এ সিদ্ধান্ত এ জন্যই গুরুত্বপূর্ণ যে যাঁরা শেয়ার বেচে দিয়েছেন, তাঁদের দ্বারা কম্পানি চালিত হলে সে কম্পানি অবশ্যই ভালো করবে না। আর এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কম্পানিগুলোকে নিজেদের শেয়ার নিয়ে ব্যবসা করা থেকে বিরত রাখা যাবে। মনে রাখবেন, যেসব কম্পানি শেয়ার ব্যবসায় লিপ্ত, তাদের শেয়ার কিনে আপনারা কোনো দিনও সুবিধা করতে পারবেন না। আর অন্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো ফিন্যানশিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট হবে আগামী ছয় মাসের মধ্যে।
আজকে আপনারা যে শেয়ার কিনছেন, ওই শেয়ারের আর্থিক ভিত সম্পর্কে, যা সংশ্লিষ্ট কম্পানিগুলো বলে, ওগুলো কতটা ঠিক, তা কিভাবে বুঝলেন? আমাদের দেশে আর্থিক রিপোর্টিং, যা আপনারা এবং আমি অডিটরদের দিয়ে পেশকৃত অডিট রিপোর্টে পাই, তা মিথ্যায় ভরপুর। অডিটররা কার কাছে জবাবদিহি করে? কাগজ-কলমে জবাবদিহি কর্তৃপক্ষ একাধিক আছে বটে; কিন্তু বাস্তবে জবাবদিহির কোনো বালাই নেই। যে তথ্য আপনার দরকার, তা রিপোর্টে থাকে না। থাকলেও এমনভাবে পেশ করা হয়, যা পড়ে আপনারা বুঝবেন না। প্রস্তাবিত ফিন্যানশিয়াল অ্যাক্ট প্রণীত হলে, আশা করা যায়, অডিটর ও তাদের তৈরি আর্থিক বিবরণীকে একটা ছকের মধ্যে আনা যাবে, যা থেকে আপনারা কম্পানির ব্যবসার গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাবেন। শুধু অ্যাক্টই হবে না, একটা কাউন্সিলও হবে, যারা অডিট রিপোর্ট এবং অন্যান্য আর্থিক রিপোর্ট মানসম্মত হয়েছে কি না পরীক্ষা করবে। ওই আইনে বিধি ভঙ্গের জন্য শাস্তির ব্যবস্থাও থাকবে। আসলে আমরা শেয়ারবাজার চালু করে দিয়েছি অনেক অ্যাক্ট ও রেগুলেশন জারি না করেই। যার ফলে আমাদের শেয়ারবাজার চলে প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে নয়, গুজব ও শোনা কথার ভিত্তিতে।
শেয়ারবাজারের ব্যাধিগুলো যখন একবার শনাক্ত হয়েছে, তখন এর ওষুধও অবশ্যই আসবে। আসলে আমার মতো লোকরা এ ব্যাধিগুলোর বিষয়ে আগে থেকে জানত। কিন্তু আমাদের হাতে ক্ষমতা ছিল না। যাঁদের হাতে ক্ষমতা ছিল, তাঁরা সম্মিলিতভাবে ব্যাধিগুলো জানার কখনো চেষ্টা করেননি। এ ক্ষেত্রে রেগুলেটর এসইসির বড় ভূমিকা আছে বটে, তবে সব ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। যেমন অ্যাসেট ফিন্যানশিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্টের প্রয়োজনীয়তা এসইসি অনুভব করলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা ছাড়া ওই অ্যাক্ট পার্লামেন্টের মাধ্যমে পাস করিয়ে আনার কোনো ক্ষমতা এ সংস্থার নেই। আবার অর্থ মন্ত্রণালয় অন্য অনেক কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সরকারের জন্য বাজেট মেলানো। এসইসির ইস্যুগুলো অত গুরুত্ব দেওয়ার সময়ও তাদের হাতে নেই। আপনাদের কিছু লোক অতি বিক্ষোভ করার কারণে এবং সমাজের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এই বাজারের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় সরকারের বোধোদয় হয়েছে, যা এই বাজার সম্পর্কে কিছু একটা করা দরকার। সরকারের মধ্যে অনেক লোক আছেন, যাঁরা এই বাজারের গুরুত্বটাকেই স্বীকার করতে চান না। আর এ জন্যই তিন যুগের বেশি সময় এই বাজার চলে এলেও এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার হয়নি। তবে এটাও ঠিক, অনেক হয়েছে অতীতে। কিন্তু অনেক কিছু আবার বাকি ছিল। আশা করা যায়, ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে সেই ফাঁক পূরণ হবে। তবে শেয়ারবাজার এক দিনে বা এক সপ্তাহে বেড়ে যাবে_এমন আশা করবেন না। শেয়ার যে সস্তা হয়েছে, এ কথাই বা আপনাদের কে বলল? হ্যাঁ, কিছু শেয়ার কেনার মূল্যে এসেছে বটে, তবে অন্যগুলো?
তাই আমি আপনাদের অনুরোধ করব, টঙ্কি শেয়ার দিয়ে নিজেদের পোর্টফোলিওকে ভারী করবেন না। ২০১০ সালের নভেম্বরের শেয়ারবাজারকে ভুলে যেতে হবে। আমাদের অর্থনীতির বাস্তবতাও দেখতে হবে। অনেক বিনিয়োগকারী তো শেয়ারবাজার ছেড়ে চলে গেছেন। তাহলে শেয়ারবাজার উঠবে কিভাবে? সবাই বসে আছেন অন্যরা শেয়ারবাজারকে উঠিয়ে আনুক, তারপর তাঁরা প্রবেশ করবেন। এই অন্যরা কারা? ব্যাংক ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো? আর এ কারণেই দেখছেন শেয়ারবাজারের বর্তমান অস্থিরতা। এটা ঠিক, সব দেশেই কেলেঙ্কারির পরই সংস্কার আসে। আগে অনেকের টনক নড়ে না। একটা বড় ক্ষতি হয়ে গেলে তখন সবাই বলতে থাকে, হায় কী হলো, হায় কী হলো! আর হায় কী হলো থেকে আজকে এসেছে এই প্রণোদনা। ১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির পরও আমাদের শেয়ারবাজারে অনেক সংস্কার এসেছে। আজকে যে আপনারা Computer-aided trading দেখছেন, সেটাও এত তাড়াতাড়ি আসত না ১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারি না হলে। অন্য আর একটি স্টক এঙ্চেঞ্জ_চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জ কর্তৃক সংস্কারগুলো গ্রহণ করানো অনেক সহজ হয়েছে। আমাদের অর্থনীতি যদি ভালো যায়, তাহলে শেয়ারবাজারের জন্য সামনে সুদিন আছে। কারণ উন্নয়নের জন্য আজকে অনেকে এই রুটটি চিনে ফেলেছে। এই বাজার নিয়ে এখন পার্লামেন্টে কথা হয়। এই বাজার নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম হয়। এই বাজার নিয়ে উচ্চ মহলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিটিং হয়। সুতরাং এই বাজারকে এড়িয়ে যাওয়া এখন কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয়।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.