চীনা কার্ড কি বাড়তি সুবিধা দেবে?-কূটনীতি by সুভাষ সাহা
দক্ষিণ এশিয়ায় চীন তার অবস্থানকে আরও উন্নীত করতে চায়। বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আরও এক ধাপ এগিয়ে চীনকে সার্কের পর্যবেক্ষক স্ট্যাটাস থেকে সরাসরি দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার পূর্ণাঙ্গ সদস্য করার পক্ষপাতী। অবশ্য খালেদা জিয়ার এই প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে সার্কের গঠনতন্ত্রও সংশোধন করতে হবে। তখন পূর্ণাঙ্গ সদস্য হওয়ার মানদণ্ডও পাল্টে যাবে।
খালেদা জিয়া কেন আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমারকে বাদ দিয়ে চীনকে সার্কের পূর্ণাঙ্গ সদস্য করতে চাইলেন তা বুঝনেওয়ালাদের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তিনি সার্কে ভারতের কাউন্টার ওয়েট হিসেবে আরেক জায়ান্ট অর্থনৈতিক শক্তি চীনকে দক্ষিণ এশিয়ার 'হেলম অব অ্যাফেয়ার্সে' কার্যকরভাবে জড়িত করতে চান। এতে তার দলের ভারত বিরোধিতার নীতি দ্বিপক্ষীয় পর্যায় থেকে আঞ্চলিক স্তরে দীর্ঘমেয়াদে উন্নীত হবে বলে তিনি তার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের পরামর্শদাতাদের কাছ থেকে পরামর্শ পেয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু এতে আখেরে তিনি নিজে, তার দল ও বাংলাদেশ যুগপৎভাবে উপকৃত হবে তো?
সম্প্রতি মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত সপ্তদশ সার্ক সম্মেলনে তুরস্ককে সংস্থার অবজারভার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হওয়ায় সংস্থাটির সদস্য কলেবর নয়টি থেকে দশটিতে উন্নীত হয়েছে। ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মিয়ানমার, অস্ট্রেলিয়া, ইরান, মরিশাস ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সার্কে অবজারভার স্ট্যাটাস লাভ করে। আরও গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও সংস্থা সার্কের অবজারভার স্ট্যাটাস পেতে চায় বলে সার্ক সচিবালয় থেকেই জানানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো, সার্ক সদস্য দেশগুলোর মধ্যে এখনও যখন বাণিজ্যের পরিমাণ উল্লেখ করার মতো নয়, তখন বিশ্বের তাবৎ গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও সংস্থা এর অবজারভার স্ট্যাটাস পেতে এত আগ্রহ দেখাচ্ছে কেন? যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ইইউর মতো শক্তিধররা সার্কে অবদান রাখতেই-বা এগিয়ে এলো কেন?
গত পাঁচ বছরে সার্ক আঞ্চলিক সংস্থা হিসেবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখার মতো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক ইন্টিগ্রেশন ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। দক্ষিণ এশিয়া মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (সাফটা) প্রতিষ্ঠা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এর প্রভাব আগামী দিনগুলোতে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বাইরে তথা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও অনুভূত হবে। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ইন্টিগ্রেশন প্রক্রিয়া জোরদার করা গেলে অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বে অগ্রগণ্য অর্থনৈতিক গ্রুপিং হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। সোশ্যাল চার্টার স্বাক্ষর করা, সন্ত্রাসবাদের ওপর এডিশনাল প্রটোকল স্বাক্ষর, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, নারীর ক্ষমতায়ন, তরুণদের সংগঠিত করা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ইত্যাদি বিষয়ে সার্কের সিদ্ধান্ত ও গৃহীত পদক্ষেপ অঞ্চলটির স্থিতিশীলতা এবং জনগণের সার্বিক অধিকার ও মানোন্নয়নে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখবে। তবে অবকাঠামো উন্নয়ন, কানেকটিভিটি, জ্বালানি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আলোচনা এবং পদক্ষেপ বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিশালী দেশ ও সংস্থাকে সার্কের সঙ্গে সহযোগিতা গড়ে তোলায় আগ্রহী করে থাকবে। এসব দেশ ও সংস্থা সার্কের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে আশাবাদী হওয়ার কারণেই তারা এতে সম্পৃক্ত হয়েছে, হচ্ছে।
চীনের ক্ষেত্রে অবশ্য সার্কের আবেদনটি অনেক বেশি। তারা সংস্থাটির উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে চায়। তাই ২০০৫ সালে সদস্য হওয়ার পরপরই তারা সার্কের সঙ্গে নানামুখী সংযোগ গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এই তো গত ২৬-২৭ জুলাই চীনা ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিস ও ইউনান একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্স 'চীন-সার্ক :টুওয়ার্ডস এ বেটার আন্ডারস্ট্যান্ডিং থ্রু এনহান্সড পিপল টু পিপল এক্সচেঞ্জ' শীর্ষক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের আয়োজন করে। ইউনান প্রদেশের কুনমিঙে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সার্কভুক্ত দেশ ও চীনের ৪০ জন বিদ্বজ্জন ও সরকারি কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেন। সেখানে কোনো কোনো আলোচক '৮-১' ডায়ালগ মেকানিজমের মাধ্যমে চীন ও সার্কের প্র্যাকটিক্যাল সহযোগিতা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব তুলে ধরেন। আসলে এ ধরনের সহযোগিতার উদাহরণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সহযোগিতা সংস্থা আসিয়ানেই রয়েছে। বাইরের তিনটি দেশকে নিয়ে 'আসিয়ান+৩' রয়েছে। তিনটি দেশের সঙ্গে আসিয়ানের বিশেষ সম্পর্ককেই এটা নির্দেশ করে। চীনও সার্কে প্রাথমিকভাবে এ ধরনের একটি বিশেষ মর্যাদা চায়। আর এ ধরনের অবস্থান চীনের চাওয়াটা অসঙ্গতও নয়। কারণ ভারত, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানের রয়েছে চীনের সীমান্ত। এদের সঙ্গে রয়েছে চীনের ঐতিহাসিক সম্পর্কও। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক, উন্নয়নগত, এমনকি কোনো কোনো দেশের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যের পরিমাণ আগামী কয়েক বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়াবে। তাই সার্কের ইন্টিগ্রেশন ঘটলে আর তাতে চীন সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পারলে সম্প্রসারিত বাজারের সুবিধাটা নিশ্চিতভাবে বাইরের শক্তি হিসেবে চীন অন্যদের থেকে অনেক বেশি পাবে। কিন্তু সার্কে চীনের এ ধরনের একটি প্রভাবদায়ী ভূমিকা কি ভারত অত সহজে মেনে নেবে? তদুপরি এখনও যখন সার্কে অবজারভারদের ভূমিকা নির্ধারণ নিয়ে সংস্থাটি মাথা ঘামাচ্ছে তখন অঞ্চলবহির্ভূত কোনো দেশকে পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ দেওয়ার প্রস্তাবটি ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়া নয়! আর যেহেতু সার্কে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণই নিয়ম, তাই ভারতের সম্মতি ব্যতিরেকে চীনকে সার্কে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে দেওয়া সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে অবশ্যই সার্কের সব সদস্য দেশকে একমত হতে হবে।
আমার মনে হয়, চীনের উদ্দেশ্য কী সে সম্পর্কে ভারত নিশ্চিত হতে চাইবে আগে। চীন দক্ষিণ এশিয়ায় কি উন্নয়নের ড্রাইভিং ফোর্স হিসেবেই কাজ করবে, নাকি এর সুবাদে অর্জিত রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে অপরাপর দেশকে ভারতের বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকানোর কাজে লাগাবে_ সে ব্যাপারে নয়াদিলি্ল নিশ্চিত হতে চাইবে।
উল্লেখ করা যায়, দিলি্ল দক্ষিণ এশিয়াকে তার স্বাভাবিক প্রভাব বলয় বলে মনে করে। চীনও তো এই অঞ্চলকে তার নিরাপত্তা স্বার্থসংশ্লিষ্ট মনে করতে পারে। আর সেটা মনে করাটা একেবারে অযৌক্তিক হবে না। চীনের কতিপয় সীমান্তবর্তী অঞ্চল যেমন, জিনজিয়াং, তিব্বত ও ইউনান নিরাপত্তা পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ বিধায় দক্ষিণ এশিয়া বেইজিংয়ের কাছ থেকে বিশেষ দৃষ্টি পাচ্ছে। তাছাড়া চীন তার সব আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী অঞ্চলকেই প্রতিবেশীদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ গড়ে তোলার জন্য বলেছে। সেটা রাশিয়ার দূরপ্রাচ্য হোক, কোরীয় উপদ্বীপ হোক বা ইন্দোচীন, মিয়ানমার, নেপাল বা মধ্য এশিয়া হোক_ চীনের সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলো এখন সীমান্তের ওপারের অঞ্চলগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সংযোগ গড়ে তুলছে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চীনের ইউনান প্রদেশ মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও যোগাযোগ সংযোগ গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছে। তিব্বতে আঞ্চলিক সরকার তার সীমান্তবর্তী নেপাল, ভুটান ও ভারতের সনি্নহিত অঞ্চলের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। একইভাবে তারা আফগানিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলছে। অনেক স্থানেই তারা রেল ও রোড সংযোগ গড়ে তোলার মাধ্যমে সম্পর্ককে স্থায়ী রূপ দিতে চাচ্ছে।
কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চীনা প্রচেষ্টা ভারতের সম্মতি ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এটা বেইজিংকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে। আর ভারতকেও উপলব্ধি করতে হবে, চীনের মতো বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তির সহযোগিতা পেলে সার্ক তরতর করে অর্থনৈতিক উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে। তবে তার আগে অবশ্যই চীনকে প্রমাণ করতে হবে যে, সে দক্ষিণ এশিয়ায় বিরাজমান বিরোধ নিরসনের সহায়ক শক্তি, উস্কানিদাতা নয়।
এ ছাড়াও চীনের সঙ্গে বিশ্বের পহেলা নম্বরের শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তেতো হয়ে পড়ার কারণে এবং উভয় শক্তি দ্রুত পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করার কারণে বেইজিংকে নিয়ে এখনই অতি উৎসাহ প্রদর্শন ওয়াশিংটনের উষ্মার কারণ হতে পারে। তাছাড়া ওয়াশিংটন দক্ষিণ এশীয় ইন্টেগ্রেশনে ইতিমধ্যে কার্যকরভাবে অবদান রাখছে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে গড়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক। চীনকে ঘিরে ধরার যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে তারা ভারতকেও শামিল করতে চাইছে। এমন একটি পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে বিদেশ প্রসঙ্গে আরও ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণই সমীচীন। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সার্কে চীনের বৃহত্তর ভূমিকা (পূর্ণ সদস্যপদ নয়) পালনের বিষয়টি আটকাবে না, যদি ভারত তাতে সায় দেয়।
তাই খালেদা জিয়ার আগ বাড়িয়ে চীনকে সার্কের পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ দেওয়ার বক্তব্য তার নিজের, দলের এবং দেশের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেটা বড়দের দরকষাকষির ওপর নির্ভর করছে, তার ব্যাপারে আমাদের ছোটদের খুব কমই করার রয়েছে, তাই নয় কি? অবশ্য দূতিয়ালির কাজে ব্যবহৃত হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু খালেদা জিয়া তো নিরপেক্ষ কোনো অবস্থান নেননি। তিনি সুস্পষ্টভাবেই একটি পক্ষ নিয়েছেন।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
subashsaha@gmail.com
সম্প্রতি মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত সপ্তদশ সার্ক সম্মেলনে তুরস্ককে সংস্থার অবজারভার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হওয়ায় সংস্থাটির সদস্য কলেবর নয়টি থেকে দশটিতে উন্নীত হয়েছে। ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মিয়ানমার, অস্ট্রেলিয়া, ইরান, মরিশাস ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সার্কে অবজারভার স্ট্যাটাস লাভ করে। আরও গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও সংস্থা সার্কের অবজারভার স্ট্যাটাস পেতে চায় বলে সার্ক সচিবালয় থেকেই জানানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো, সার্ক সদস্য দেশগুলোর মধ্যে এখনও যখন বাণিজ্যের পরিমাণ উল্লেখ করার মতো নয়, তখন বিশ্বের তাবৎ গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও সংস্থা এর অবজারভার স্ট্যাটাস পেতে এত আগ্রহ দেখাচ্ছে কেন? যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ইইউর মতো শক্তিধররা সার্কে অবদান রাখতেই-বা এগিয়ে এলো কেন?
গত পাঁচ বছরে সার্ক আঞ্চলিক সংস্থা হিসেবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখার মতো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক ইন্টিগ্রেশন ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। দক্ষিণ এশিয়া মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (সাফটা) প্রতিষ্ঠা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এর প্রভাব আগামী দিনগুলোতে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বাইরে তথা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও অনুভূত হবে। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ইন্টিগ্রেশন প্রক্রিয়া জোরদার করা গেলে অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বে অগ্রগণ্য অর্থনৈতিক গ্রুপিং হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। সোশ্যাল চার্টার স্বাক্ষর করা, সন্ত্রাসবাদের ওপর এডিশনাল প্রটোকল স্বাক্ষর, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, নারীর ক্ষমতায়ন, তরুণদের সংগঠিত করা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ইত্যাদি বিষয়ে সার্কের সিদ্ধান্ত ও গৃহীত পদক্ষেপ অঞ্চলটির স্থিতিশীলতা এবং জনগণের সার্বিক অধিকার ও মানোন্নয়নে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখবে। তবে অবকাঠামো উন্নয়ন, কানেকটিভিটি, জ্বালানি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আলোচনা এবং পদক্ষেপ বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিশালী দেশ ও সংস্থাকে সার্কের সঙ্গে সহযোগিতা গড়ে তোলায় আগ্রহী করে থাকবে। এসব দেশ ও সংস্থা সার্কের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে আশাবাদী হওয়ার কারণেই তারা এতে সম্পৃক্ত হয়েছে, হচ্ছে।
চীনের ক্ষেত্রে অবশ্য সার্কের আবেদনটি অনেক বেশি। তারা সংস্থাটির উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে চায়। তাই ২০০৫ সালে সদস্য হওয়ার পরপরই তারা সার্কের সঙ্গে নানামুখী সংযোগ গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এই তো গত ২৬-২৭ জুলাই চীনা ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিস ও ইউনান একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্স 'চীন-সার্ক :টুওয়ার্ডস এ বেটার আন্ডারস্ট্যান্ডিং থ্রু এনহান্সড পিপল টু পিপল এক্সচেঞ্জ' শীর্ষক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের আয়োজন করে। ইউনান প্রদেশের কুনমিঙে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সার্কভুক্ত দেশ ও চীনের ৪০ জন বিদ্বজ্জন ও সরকারি কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেন। সেখানে কোনো কোনো আলোচক '৮-১' ডায়ালগ মেকানিজমের মাধ্যমে চীন ও সার্কের প্র্যাকটিক্যাল সহযোগিতা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব তুলে ধরেন। আসলে এ ধরনের সহযোগিতার উদাহরণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সহযোগিতা সংস্থা আসিয়ানেই রয়েছে। বাইরের তিনটি দেশকে নিয়ে 'আসিয়ান+৩' রয়েছে। তিনটি দেশের সঙ্গে আসিয়ানের বিশেষ সম্পর্ককেই এটা নির্দেশ করে। চীনও সার্কে প্রাথমিকভাবে এ ধরনের একটি বিশেষ মর্যাদা চায়। আর এ ধরনের অবস্থান চীনের চাওয়াটা অসঙ্গতও নয়। কারণ ভারত, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানের রয়েছে চীনের সীমান্ত। এদের সঙ্গে রয়েছে চীনের ঐতিহাসিক সম্পর্কও। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক, উন্নয়নগত, এমনকি কোনো কোনো দেশের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যের পরিমাণ আগামী কয়েক বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়াবে। তাই সার্কের ইন্টিগ্রেশন ঘটলে আর তাতে চীন সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পারলে সম্প্রসারিত বাজারের সুবিধাটা নিশ্চিতভাবে বাইরের শক্তি হিসেবে চীন অন্যদের থেকে অনেক বেশি পাবে। কিন্তু সার্কে চীনের এ ধরনের একটি প্রভাবদায়ী ভূমিকা কি ভারত অত সহজে মেনে নেবে? তদুপরি এখনও যখন সার্কে অবজারভারদের ভূমিকা নির্ধারণ নিয়ে সংস্থাটি মাথা ঘামাচ্ছে তখন অঞ্চলবহির্ভূত কোনো দেশকে পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ দেওয়ার প্রস্তাবটি ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়া নয়! আর যেহেতু সার্কে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণই নিয়ম, তাই ভারতের সম্মতি ব্যতিরেকে চীনকে সার্কে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে দেওয়া সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে অবশ্যই সার্কের সব সদস্য দেশকে একমত হতে হবে।
আমার মনে হয়, চীনের উদ্দেশ্য কী সে সম্পর্কে ভারত নিশ্চিত হতে চাইবে আগে। চীন দক্ষিণ এশিয়ায় কি উন্নয়নের ড্রাইভিং ফোর্স হিসেবেই কাজ করবে, নাকি এর সুবাদে অর্জিত রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে অপরাপর দেশকে ভারতের বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকানোর কাজে লাগাবে_ সে ব্যাপারে নয়াদিলি্ল নিশ্চিত হতে চাইবে।
উল্লেখ করা যায়, দিলি্ল দক্ষিণ এশিয়াকে তার স্বাভাবিক প্রভাব বলয় বলে মনে করে। চীনও তো এই অঞ্চলকে তার নিরাপত্তা স্বার্থসংশ্লিষ্ট মনে করতে পারে। আর সেটা মনে করাটা একেবারে অযৌক্তিক হবে না। চীনের কতিপয় সীমান্তবর্তী অঞ্চল যেমন, জিনজিয়াং, তিব্বত ও ইউনান নিরাপত্তা পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ বিধায় দক্ষিণ এশিয়া বেইজিংয়ের কাছ থেকে বিশেষ দৃষ্টি পাচ্ছে। তাছাড়া চীন তার সব আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী অঞ্চলকেই প্রতিবেশীদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ গড়ে তোলার জন্য বলেছে। সেটা রাশিয়ার দূরপ্রাচ্য হোক, কোরীয় উপদ্বীপ হোক বা ইন্দোচীন, মিয়ানমার, নেপাল বা মধ্য এশিয়া হোক_ চীনের সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলো এখন সীমান্তের ওপারের অঞ্চলগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সংযোগ গড়ে তুলছে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চীনের ইউনান প্রদেশ মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও যোগাযোগ সংযোগ গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছে। তিব্বতে আঞ্চলিক সরকার তার সীমান্তবর্তী নেপাল, ভুটান ও ভারতের সনি্নহিত অঞ্চলের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। একইভাবে তারা আফগানিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলছে। অনেক স্থানেই তারা রেল ও রোড সংযোগ গড়ে তোলার মাধ্যমে সম্পর্ককে স্থায়ী রূপ দিতে চাচ্ছে।
কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চীনা প্রচেষ্টা ভারতের সম্মতি ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এটা বেইজিংকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে। আর ভারতকেও উপলব্ধি করতে হবে, চীনের মতো বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তির সহযোগিতা পেলে সার্ক তরতর করে অর্থনৈতিক উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে। তবে তার আগে অবশ্যই চীনকে প্রমাণ করতে হবে যে, সে দক্ষিণ এশিয়ায় বিরাজমান বিরোধ নিরসনের সহায়ক শক্তি, উস্কানিদাতা নয়।
এ ছাড়াও চীনের সঙ্গে বিশ্বের পহেলা নম্বরের শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তেতো হয়ে পড়ার কারণে এবং উভয় শক্তি দ্রুত পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করার কারণে বেইজিংকে নিয়ে এখনই অতি উৎসাহ প্রদর্শন ওয়াশিংটনের উষ্মার কারণ হতে পারে। তাছাড়া ওয়াশিংটন দক্ষিণ এশীয় ইন্টেগ্রেশনে ইতিমধ্যে কার্যকরভাবে অবদান রাখছে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে গড়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক। চীনকে ঘিরে ধরার যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে তারা ভারতকেও শামিল করতে চাইছে। এমন একটি পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে বিদেশ প্রসঙ্গে আরও ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণই সমীচীন। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সার্কে চীনের বৃহত্তর ভূমিকা (পূর্ণ সদস্যপদ নয়) পালনের বিষয়টি আটকাবে না, যদি ভারত তাতে সায় দেয়।
তাই খালেদা জিয়ার আগ বাড়িয়ে চীনকে সার্কের পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ দেওয়ার বক্তব্য তার নিজের, দলের এবং দেশের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেটা বড়দের দরকষাকষির ওপর নির্ভর করছে, তার ব্যাপারে আমাদের ছোটদের খুব কমই করার রয়েছে, তাই নয় কি? অবশ্য দূতিয়ালির কাজে ব্যবহৃত হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু খালেদা জিয়া তো নিরপেক্ষ কোনো অবস্থান নেননি। তিনি সুস্পষ্টভাবেই একটি পক্ষ নিয়েছেন।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
subashsaha@gmail.com
No comments