রঙ্গব্যঙ্গ-এমপি বাহারের কাল্পনিক সাক্ষাৎকার by মোস্তফা কামাল

কুমিল্লা সদর আসনের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। তিনি কুমিল্লার একজন বড় গডফাদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। কুমিল্লায় তাঁর রাজত্ব নিয়ে নানা কথাবার্তা শোনা যায়। এ বিষয়ে তাঁর নিজের উপলব্ধি কী তা আমরা জানার চেষ্টা করতে পারি। তবে তাঁর বক্তব্যগুলো অবশ্যই কাল্পনিক। ধরুন, আমি বিনা নোটিশে বাহার সাহেবের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। তাঁর বাড়ির ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখা গেল, তাঁকে ঘিরে মাস্তান টাইপের কিছু লোক বসে আছে।


আমি কথা বলব কি বলব না তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি স্রেফ কাঁচুমাচু করছিলাম। তিনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর জানতে চাইলেন, আপনি কেডা?
আমি পত্রিকায় কাজ করি।
পত্রিকায় কাজ করেন? মানে সোম্বাদিক?
সোম্বাদিক না, সাংবাদিক।
ওই একই কথা। আমি কী বলি জানেন?
কী বলেন?
আমি বলি সাংঘাতিক। সত্যি ভাই, আপনারা জিনিস বটে!
সাংবাদিকদের ওপর আপনি চটে আছেন বোধ হয়!
এ সময় একজন কোমর থেকে বিস্তল বের করে আমার মাথায় তাক করে বলল, এই! নেতার সঙ্গে কথা বলতে হলে হিসাব করে বলবেন! আমার কথা বুঝতে পারছেন? নাকি বোঝেন নাই?
আমি ভয়ে রীতিমতো আঁতকে উঠলাম। নরম গলায় বললাম, জি, বুঝেছি।
আরেকজন দরাজ গলায় বলল, কী বুঝেছেন?
আমি শুকনো গলায় বললাম, আপনাদের কথা বুঝতে পারছি।
এইবার ইন্টারভ্যু নেন।
আমি তাদের ধমক খেয়ে চুপসে গেলাম। যেসব প্রশ্ন করব বলে মাথায় নিয়েছিলাম, সেগুলো আর ডিস্কে নেই। সব ডিলিট হয়ে গেছে। মাথার ওপর ফ্যান চললেও টের পাচ্ছি না। গরমে শরীর ভিজে একাকার। এর মধ্যে পিস্তল হাতে লোকটি কর্কশ কণ্ঠে বলল, কই, প্রশ্ন করছেন না?
কী প্রশ্ন করব, ভুলে গেছি। আমি অন্য সময় আসি?
অন্য সময় কেন আসবেন? আপনাকে আমাদের সামনেই ইন্টারভ্যু নিতে হবে।
বাহার সাহেব বললেন, প্রশ্ন করেন। অসুবিধা নাই। ওরা আমার নিজের লোক। তবে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করবেন না। তাহলে কিন্তু এখান থেকে হেঁটে যাইতে পারবেন না।
আমি মহা বিপাকে পড়ে গেলাম। সত্যি সত্যি আমার মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে। কী প্রশ্ন করলে তিনি মাইন্ড করবেন আর কী প্রশ্ন করলে করবেন তা বুঝতে পারছিলাম না। নানা দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর সন্ত্রাসী গোচের লোকদের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম, আপনার এলাকার কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা কথা শোনা যায়।
কাজকর্ম করলে তো কথা শোনা যাবেই। আমি কি বসে থাকার লোক নাকি? উন্নয়নের জোয়ারে কুমিল্লাকে মোটামুটি ভাসিয়ে দিয়েছি। বুঝতে পারছেন?
কিন্তু সবাই তো বলছে, আপনার লোকেরা চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিতে জড়িত।
সবাই বলে মানে? কে, একটা নাম বলেন। তার কল্লা ফেলে দেব।
জি!
আপনি নাম বলেন, তার কল্লা ফেলে দেব।
আপনার মুখে এই কথা! এই কথা তো বরিশালের লোকেরা বলে! কুমিল্লার লোকেরাও কি কল্লা ফালায়?
আরে আমরা তো এক দেশেরই মানুষ! আচ্ছা, আপনি নাম বলেন।
আপনার বন্ধু আফজাল খান তো বললেন, বাহারের অপকর্মের প্রভাব শুধু কুমিল্লা না, অন্যান্য অঞ্চলেও পড়বে।
ও তো আমার চিরশত্রু। ও আমার বিরুদ্ধে বলবে_এটাই তো স্বাভাবিক। আমি এমপি, এটা তার সহ্য হয় না। বুঝতে পারছেন। একসময় তার দাপটে কুমিল্লার মানুষ ঘুমাতে পারত না। এখন মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে।
আপনার লোকেরা নাকি ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাদেরও মেরে হাত-পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে দিয়েছে।
ওরা ছাত্রলীগ-যুবলীগ করে এ কথা আপনাকে কে বলল? ওদের ভয়েই তো মানুষ ঘুমাতে পারত না। তাই আমার লোকেরা ওদের হাত-পা ভেঙে দিয়েছে। এখন মানুষ শান্তিতে আছে।
আপনার বিরুদ্ধে কথা বললেই নাকি আপনার ক্যাডার বাহিনী মারধর করে!
এই যে আপনি উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করছেন, আপনাকে কি আমার লোকেরা মারধর করছে? করছে না। আর আমার ক্যাডার বাহিনী বলে কিছু নেই। এরা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী।
তাই? তাহলে আবার আফজাল খানের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। তিনি বলেছেন, বাহারের সঙ্গে যাঁরা আছেন তাঁরা আওয়ামী লীগ করেন না, তাঁরা করেন বাহার লীগ।
বাহার সাহেব দম ফাটিয়ে হাসলেন। তারপর বললেন, অন্তত এ কারণে আফজালকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। কি বলেন? বাহার লীগ! আইডিয়াটা চমৎকার।
কুমিল্লার অন্য এমপিরাও আপনার বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছেন। আপনার কর্মকে সবাই অপকর্ম বলে উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে যদি কিছু বলেন।
ঈর্ষা, বুঝলেন! সব ঈর্ষা। আমার কাজের কারণে সবার ভাবমূর্তি ম্লান হয়ে গেছে। সে কারণে তারা উন্মাদ হয়ে আমার বিরুদ্ধে আবোলতাবোল বলছে। ওসব উন্মাদের কথায় কান দেবেন না।
আরেকটা অভিযোগ এসেছে আপনার আত্মীয়করণের বিরুদ্ধে। বলা হয়েছে, কুমিল্লার ঠিকাদারি কাজ নাকি আপনার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বণ্টন করেছেন?
বাহার সাহেব জবাব দেওয়ার আগেই একজন বলল, মিথ্যা কথা! ডাহা মিথ্যা কথা!
বাহার সাহেব বললেন, ব্যাপারটা আমি বুঝিয়ে বলছি। ব্যাপারটাকে আপনি আত্মীয়স্বজন হিসেবে দেখছেন কেন? যোগ্যতা অনুুযায়ী তাদের কাজ দেওয়া হচ্ছে। যোগ্য লোকেরা কাজ পেলে অসুবিধা কী?
জি না, অসুবিধা নেই। কিন্তু তারা যে যোগ্য এটা কি প্রমাণিত?
অবশ্যই প্রমাণিত।
তাদের যোগ্যতার সনদ কে দিল?
আবার কে দেবে! আমি দিয়েছি।
এ সময় একদল লোক এসে বলল, লিডার, বালুমহালে সমস্যা হয়েছে। আপনার যেতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে বাহার সাহেবের ক্যাডার বাহিনীর একজন চিৎকার দিয়ে উঠল, কে সমস্যা করছে? একদম ভুঁড়ি ফালাইয়া দিব! এই চল তোরা!
তারপর বাহার সাহেবের নেতৃত্বে সবাই বালুমহালের দিকে ছুটে গেল।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.