অটোগ্রাফ শিকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী! by মাহবুব মিঠু
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সংবাদপত্রগুলোতে, গত কয়েকদিন ধরে বেশ চমৎকার চমৎকার লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। লেখাগুলোতে সুন্দরভাবে চলে এসেছে বাঁধের অন্যায্যতা, ভারতের আগ্রাসনবাদী চরিত্র, বাঁধের প্রভাবে বাংলাদেশের ক্ষতির প্রসঙ্গগুলো। সাথে সাথে এটাও আলোচিত হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে ভারতের সঙ্গে ঘটে যাওয়া কূটনৈতিক বিপর্যয়গুলোর কথা। বাংলানিউজে আমারও একটা লেখা প্রকাশিত হয় সম্প্রতি।
গুরুত্ব এবং সাম্প্রতিক ঘটনা হিসেবে টিপাইমূখ এখন আলোচনার তুঙ্গে। কিন্তু ভারতের সাথে টিপাইমুখ ছাড়াও আরো অনেক দেনা পাওনার ক্ষেত্রে আমরা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে ফেলেছি ইতিমধ্যে। এ ধরনের একের পর এক দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেবার পেছনে অন্যান্য আরো বিষয়ের মতো কাজ করছে আমাদের কূটনৈতিক দেউলিয়াপনা। বাংলাদেশের সেই কূটনৈতিক প্রচেষ্টার স্বরূপটা সামাজিক কিছু ঘটনা দিয়ে ব্যাখ্যার চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশে বুয়া কালচার সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি। ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল রেখে অনেকটা সময় পার হলেও এখনো বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের মানুষেরা বুয়াদের উপরে নির্ভরশীল। কিছুটা টাকার গরমে বাবুয়ানা এবং কিছুটা বাস্তবতার জন্যই মানুষদের বুয়ার উপরে নির্ভর করতেই হয়। তবে অনেকের মতো আমিও প্রত্যক্ষ করেছি বুয়াদের অবস্থানের এবং দরকষাকষির বিবর্তনগুলো। ছোটবেলায় বুয়াদের দেখেছি বাড়ি-বাড়ি ঘুরে কাজ পেতে কতো না ধর্না দিতে। অনেকেতো শুধু পেটেভাতে থাকতে পারলেই খুশি ছিল। কেউ কেউ মজুরি পেলেও সেটা ছিল খুবই সামান্য।
কাজ টিকিয়ে রাখতে এবং প্রাপ্য মজুরি ঠিকঠাক পেতে বুয়াদের ভিতরে এক রকমের কূটনৈতিক তৎপরতা কাজ করতো। বাড়ির মালিককে খুশী রাখতে, নিজের গাছের লেবুটা, এই একটু সব্জি, এটা সেটা এনে সম্পর্কটা ভাল রাখার চেষ্টায় কমতি ছিল না। তারপরেও মাস শেষে পাওনা টাকা পেতে কতোই না কসরত করতে হতো। ওদিকে বুয়াদের অসহায়ত্বের সুযোগে বাড়ির মালিকেরা তাদের দিয়ে চুক্তির বাইরেও বিভিন্ন কাজ করিয়ে নিত। সে কি পরাধীনতা! নিজের ঘামের টাকার রোজগার নিতেও কাহাতক হয়রানি, তেল মারা।
একটা সময় গরীব কৃষকরাও এরকম পেরেশানির শিকার হতো ভূমির মালিক কর্তৃক। রোদে পুড়ে, না খেয়ে, শরীরের ঘাম ঝরিয়ে ফলানো ফসল নিজ ঘাড়ে করে মালিকের বাড়ির উঠোন পর্যন্ত পৌঁছানো তার কাজ। এরপর দেখা যেত ভূমি মালিকের গড়িমসি তার প্রাপ্য ফসলের ভাগ দিতে। মাঝে মাঝে পুরোটা পেতও না। সেকি হুজুর হুজুরই না করতে হতো! কারণ পরের বছর বর্গা জমি না পেলে না খেয়ে মরতে হবে! চাষের জমি পাবার কূটনীতিতে তাকেও খেতের এটা ওটা মালিককে দিয়ে খুশী রাখতে হতো। এমনকি মালিকের বউয়ের অনুরোধে কৃষকের বউকে নিজ সংসারের কাজ ফেলে ফাই ফরমায়েশও খাটতে হতো মাঝে মাঝে। চাষের মৌসুমের আগে আগে জমির মালিকদের ছিল পোয়াবারো। সংসারের টুকটাক কাজ এমনকি হাট থেকে বাজারটা পর্যন্ত বয়ে আনার চিন্তা ছিল না। বর্গাচাষী আছে না! ভাল জমি পেতে হলে একটু আধটু সেবা যত্ন তো করতেই হবে। সে যুগও পাল্টেছে। এখন উল্টো জমির মালিক পারলে বর্গাচাষীর মাথায় ছাতা ধরে। এদিক ওদিক তাকিয়ে পারলে পায়ে তেল মালিশও করে দেয়।
এই পরিবর্তনগুলো এমনি এমনি হয়নি। বাজারের চাহিদা যোগানের সূত্রের সাথে সাথে তাদের সচেতনাতাও বেড়েছে। তারা প্রাপ্য এবং দানের মধ্যে পার্থক্যটা বেশ বুঝে। প্রাপ্য বঞ্চিত হলে কি করতে হবে তাও জানা। মালিকও বুঝেছে, লুটপাটের জামানা শেষ। সেয়ানা হয়েছে বঞ্চিতরা। বুয়া না পেলে সংসারের কি হাল হবে কিংবা বর্গাচাষী না পেলে জমি যে বছরের পর বছর পরে থেকে জঙ্গল গজিয়ে চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়বে, তারা সেটা ঢের বুঝেছে। সব হারানোরা ঠেকে ঠেকে এখন ঠেকাতে শিখেছে। তারা নিজেদের চাহিদা বাড়িয়েছে, বাড়িয়েছে প্রাপ্য বুঝে নেবার সক্ষমতা। এখন তারা লেবু দেয় না, বরং প্রতি ঈদে জামাইসহ আন্ডাবাচ্চার নতুন কাপড় বোনাস হিসেবে আদায় করে নেয়। বর্গাচাষীরা জমির মালিকের বাড়িতে চাষ মৌসুমের আগে এসে পড়ে থাকে না। বরং রাতের অন্ধকারে জমির মালিক যায় গাঁটে অগ্রিম টাকা গুঁজে চাষীকে ম্যানেজ করতে।
বুয়া এবং বর্গাচাষীরা আধুনিক বাজারের চাহিদা-যোগান তত্ত্বের কৌশলী ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নিতে শিখলেও আমাদের শিক্ষিত রাজনীতিবিদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় স্বাধীনতার ৪০ বছর কাটিয়েও আজো নিজের প্রাপ্য বুঝে না পেয়ে বরং আগের কালের বুয়াদের কায়দায় গাছের লেবু দেবার মতো প্রতিবেশীকে ট্রানজিট, এটা ওটা ফ্রি দেবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। আমাদের প্রাপ্য আন্তর্জাতিক নদীর অধিকার পেতেও দীপু মণিরা দিদির কাছে গিয়ে এবং প্রধানমন্ত্রী ইলিশ শাড়ির উপঢৌকন পাঠিয়েও আদায় করতে পারছেন না।
আজকাল বুয়াদের ক্ষমতা বাড়লেও প্রতিবেশীর কাছে আমাদের গুরুত্ব বাড়েনি। বুয়ারা তাদের কাজের চাহিদা বাড়িয়ে মালিকদের ঠেকিয়ে দিলেও একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদেরকে এখনো সেই সন্মানের আসনে বসাতে পারিনি। বুয়ারা এখন মালিকদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায় কিন্তু আমরা এখনো নাকের দড়ির টানে ঘুরে চলেছি।
সরকার তার মেয়াদের অর্ধেক লাইন অতিক্রম করে তিন বছরে পা রেখেছে। কিন্তু আমাদের সদা হাস্যমুখী পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মণির কূটনৈতিক অর্জন শুন্য বললেও ভুল বলা হবে, বরং সেটা মাইনাসের দিকে। ভারতমুখী কূটনীতির চাপে আমরা অনেক বন্ধুকে না হারালেও সম্পর্কের হানি ঘটিয়েছি। চীন সফরে গিয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির দালাইলামার সংগে সাক্ষাৎ চীনের সংগে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। ভূমিকম্পের সময় পৃথিবীর কোনও দেশ জাপান থেকে তাদের দূতাবাস সরিয়ে না নিলেও একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সেটা করে সেখানেও ঝামেলা পাকিয়েছে। মুসলিম বিশ্বের সংগে সম্পর্ক উন্নয়ন করে শ্রমবাজারেরও বিস্তৃতি ঘটাতে পারেনি বরং তার অবনতি ঘটিয়েছে। সারা বিশ্বের বন্ধুত্বকে ভারতকেন্দ্রিক করে ফেলায় চতুর ভারতও সে সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে হরদম। বন্ধুহীন বাংলাদেশের কাছ থেকে এক তরফা অনেক আবদার মেটালেও অভিন্ন নদীর উপরে বাঁধ নির্মাণে ওরা আমাদের আপত্তিকে পাত্তা দিচ্ছে না।
নিজ দেশের গুণী ব্যক্তি ডঃ ইউনূসকে ব্যক্তিগত আক্রোশে চটিয়ে দিয়েও বাংলাদেশের কম ক্ষতি হয়নি। ড. ইউনুস ধোয়া তুলসী পাতা নন। মাইক্রো ক্রেডিটের নামে অনেক অনিয়ম হতেই পারে, তার সঠিক আইনগত সমাধানও আছে। তিনি যতো যাই করুন না কেন, তার কাজে বাংলাদেশের যথেষ্ট উন্নতিও সাধিত হয়েছে। যে দেশের রাজনীতিকরা কোটিপতি হয়ে ক্ষমতায় আসে তাদের মুখে ড. ইউনূসের অতোটুকু বিষয় নিয়ে এতো বড় বাড়াবাড়ি বেমানান।
ব্যক্তিগত জীবনে ভাল মানুষ হিসেবে পরিচিত আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার প্রফেশনের বাইরে রাষ্ট্রীয় নতুন দায়িত্বে যথেষ্ট ব্যর্থতা দেখিয়ে দেশকে অনেকভাবে বঞ্চিত করে ফেলেছেন। যে কোনও দায়িত্বে শুধু ভাল মানুষ হলেই চলে না, সেই সাথে তাকে দক্ষ, চৌকসও হতে হয়। রাষ্ট্রীয় টাকা এবং সুযোগ ব্যবহার করে রেকর্ড সংখ্যকবার বিদেশ সফর করে তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা বেড়েছে সে কথা ঠিক। কিন্তু সেই তুলনায় অর্জন অতি সামান্য। সরকারি টাকায় বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে অনেকে যেমন শপিংএ ব্যস্ত থাকেন, উনি তেমন ব্যস্ত থাকেন বিশ্বের বড় বড় নেতা নেত্রীর সংগে ছবি তোলায়। তিনি নাকি রাষ্ট্রীয় সফরের সময় একটা ব্যক্তিগত ক্যামেরা সাথে রাখেন। এটা শুধু তার নিজের ছবি তোলার কাজে ব্যবহৃত হয়। এমনকি তিনি অটোগ্রাফ নিতেও বেশ খানিকটা রাষ্ট্রীয় কাজের সময় ব্যয় করে ফেলেন। এভাবে অটোগ্রায় সংগ্রহ (বিশ্বে একমাত্র অটোগ্রাফশিকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে গিনেস বুকে নামা তোলার দাবি তোলা যেতে পারে) এবং ছবি তোলার আনন্দে বিভোর থাকলে সেই সব বিশিষ্ট ব্যক্তির বিপক্ষে কূটনৈতিক টেবিলে দেশের স্বার্থ বাগিয়ে আনবেন কিভাবে?
দীপু মণির ব্যক্তিগত ছবির এ্যালবাম বিখ্যাত লোকদের সাথে তোলা ছবিতে সমৃদ্ধ হলেও দেশের স্বার্থের ঝোলা পুরোটাই বলতে গেলে ফাঁকা। ছবি তোলার হবি এবং একমুখী ভারতকেন্দ্রিক বন্ধুত্বের কূটনীতি থেকে সরে এসে সকল প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং বিশ্বের অন্যান্য বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের দিকেও বন্ধুত্বের হাত সম্প্রসারিত করতে হবে।
সবশেষে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মমতার সংগে দেখা করে শুধু প্রতিশ্রুতির বাণী নিয়ে ফিরে এসেছেন। ভোটের রাজনীতিতে মমতার একগুঁয়েমিপনা তাকে এগিয়ে নিলেও আমাদের নুয়ে পড়া কূটনীতি সরকারি দলের জনপ্রিয়তায় কতোটুকু প্রভাব ফেলবে সেটা সম্প্রতি করা কূলদীপ নায়ারের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়। পশ্চিমবঙ্গে মমতার সংগে দেখা করতে গিয়ে দীপু মনি মূলতঃ নিজে ছোট হয়ে এসে বড় করে এলেন তাকে। এ কেমন কূটনীতি?
বাংলাদেশে বুয়া কালচার সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি। ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল রেখে অনেকটা সময় পার হলেও এখনো বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের মানুষেরা বুয়াদের উপরে নির্ভরশীল। কিছুটা টাকার গরমে বাবুয়ানা এবং কিছুটা বাস্তবতার জন্যই মানুষদের বুয়ার উপরে নির্ভর করতেই হয়। তবে অনেকের মতো আমিও প্রত্যক্ষ করেছি বুয়াদের অবস্থানের এবং দরকষাকষির বিবর্তনগুলো। ছোটবেলায় বুয়াদের দেখেছি বাড়ি-বাড়ি ঘুরে কাজ পেতে কতো না ধর্না দিতে। অনেকেতো শুধু পেটেভাতে থাকতে পারলেই খুশি ছিল। কেউ কেউ মজুরি পেলেও সেটা ছিল খুবই সামান্য।
কাজ টিকিয়ে রাখতে এবং প্রাপ্য মজুরি ঠিকঠাক পেতে বুয়াদের ভিতরে এক রকমের কূটনৈতিক তৎপরতা কাজ করতো। বাড়ির মালিককে খুশী রাখতে, নিজের গাছের লেবুটা, এই একটু সব্জি, এটা সেটা এনে সম্পর্কটা ভাল রাখার চেষ্টায় কমতি ছিল না। তারপরেও মাস শেষে পাওনা টাকা পেতে কতোই না কসরত করতে হতো। ওদিকে বুয়াদের অসহায়ত্বের সুযোগে বাড়ির মালিকেরা তাদের দিয়ে চুক্তির বাইরেও বিভিন্ন কাজ করিয়ে নিত। সে কি পরাধীনতা! নিজের ঘামের টাকার রোজগার নিতেও কাহাতক হয়রানি, তেল মারা।
একটা সময় গরীব কৃষকরাও এরকম পেরেশানির শিকার হতো ভূমির মালিক কর্তৃক। রোদে পুড়ে, না খেয়ে, শরীরের ঘাম ঝরিয়ে ফলানো ফসল নিজ ঘাড়ে করে মালিকের বাড়ির উঠোন পর্যন্ত পৌঁছানো তার কাজ। এরপর দেখা যেত ভূমি মালিকের গড়িমসি তার প্রাপ্য ফসলের ভাগ দিতে। মাঝে মাঝে পুরোটা পেতও না। সেকি হুজুর হুজুরই না করতে হতো! কারণ পরের বছর বর্গা জমি না পেলে না খেয়ে মরতে হবে! চাষের জমি পাবার কূটনীতিতে তাকেও খেতের এটা ওটা মালিককে দিয়ে খুশী রাখতে হতো। এমনকি মালিকের বউয়ের অনুরোধে কৃষকের বউকে নিজ সংসারের কাজ ফেলে ফাই ফরমায়েশও খাটতে হতো মাঝে মাঝে। চাষের মৌসুমের আগে আগে জমির মালিকদের ছিল পোয়াবারো। সংসারের টুকটাক কাজ এমনকি হাট থেকে বাজারটা পর্যন্ত বয়ে আনার চিন্তা ছিল না। বর্গাচাষী আছে না! ভাল জমি পেতে হলে একটু আধটু সেবা যত্ন তো করতেই হবে। সে যুগও পাল্টেছে। এখন উল্টো জমির মালিক পারলে বর্গাচাষীর মাথায় ছাতা ধরে। এদিক ওদিক তাকিয়ে পারলে পায়ে তেল মালিশও করে দেয়।
এই পরিবর্তনগুলো এমনি এমনি হয়নি। বাজারের চাহিদা যোগানের সূত্রের সাথে সাথে তাদের সচেতনাতাও বেড়েছে। তারা প্রাপ্য এবং দানের মধ্যে পার্থক্যটা বেশ বুঝে। প্রাপ্য বঞ্চিত হলে কি করতে হবে তাও জানা। মালিকও বুঝেছে, লুটপাটের জামানা শেষ। সেয়ানা হয়েছে বঞ্চিতরা। বুয়া না পেলে সংসারের কি হাল হবে কিংবা বর্গাচাষী না পেলে জমি যে বছরের পর বছর পরে থেকে জঙ্গল গজিয়ে চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়বে, তারা সেটা ঢের বুঝেছে। সব হারানোরা ঠেকে ঠেকে এখন ঠেকাতে শিখেছে। তারা নিজেদের চাহিদা বাড়িয়েছে, বাড়িয়েছে প্রাপ্য বুঝে নেবার সক্ষমতা। এখন তারা লেবু দেয় না, বরং প্রতি ঈদে জামাইসহ আন্ডাবাচ্চার নতুন কাপড় বোনাস হিসেবে আদায় করে নেয়। বর্গাচাষীরা জমির মালিকের বাড়িতে চাষ মৌসুমের আগে এসে পড়ে থাকে না। বরং রাতের অন্ধকারে জমির মালিক যায় গাঁটে অগ্রিম টাকা গুঁজে চাষীকে ম্যানেজ করতে।
বুয়া এবং বর্গাচাষীরা আধুনিক বাজারের চাহিদা-যোগান তত্ত্বের কৌশলী ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নিতে শিখলেও আমাদের শিক্ষিত রাজনীতিবিদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় স্বাধীনতার ৪০ বছর কাটিয়েও আজো নিজের প্রাপ্য বুঝে না পেয়ে বরং আগের কালের বুয়াদের কায়দায় গাছের লেবু দেবার মতো প্রতিবেশীকে ট্রানজিট, এটা ওটা ফ্রি দেবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। আমাদের প্রাপ্য আন্তর্জাতিক নদীর অধিকার পেতেও দীপু মণিরা দিদির কাছে গিয়ে এবং প্রধানমন্ত্রী ইলিশ শাড়ির উপঢৌকন পাঠিয়েও আদায় করতে পারছেন না।
আজকাল বুয়াদের ক্ষমতা বাড়লেও প্রতিবেশীর কাছে আমাদের গুরুত্ব বাড়েনি। বুয়ারা তাদের কাজের চাহিদা বাড়িয়ে মালিকদের ঠেকিয়ে দিলেও একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদেরকে এখনো সেই সন্মানের আসনে বসাতে পারিনি। বুয়ারা এখন মালিকদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায় কিন্তু আমরা এখনো নাকের দড়ির টানে ঘুরে চলেছি।
সরকার তার মেয়াদের অর্ধেক লাইন অতিক্রম করে তিন বছরে পা রেখেছে। কিন্তু আমাদের সদা হাস্যমুখী পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মণির কূটনৈতিক অর্জন শুন্য বললেও ভুল বলা হবে, বরং সেটা মাইনাসের দিকে। ভারতমুখী কূটনীতির চাপে আমরা অনেক বন্ধুকে না হারালেও সম্পর্কের হানি ঘটিয়েছি। চীন সফরে গিয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির দালাইলামার সংগে সাক্ষাৎ চীনের সংগে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। ভূমিকম্পের সময় পৃথিবীর কোনও দেশ জাপান থেকে তাদের দূতাবাস সরিয়ে না নিলেও একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সেটা করে সেখানেও ঝামেলা পাকিয়েছে। মুসলিম বিশ্বের সংগে সম্পর্ক উন্নয়ন করে শ্রমবাজারেরও বিস্তৃতি ঘটাতে পারেনি বরং তার অবনতি ঘটিয়েছে। সারা বিশ্বের বন্ধুত্বকে ভারতকেন্দ্রিক করে ফেলায় চতুর ভারতও সে সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে হরদম। বন্ধুহীন বাংলাদেশের কাছ থেকে এক তরফা অনেক আবদার মেটালেও অভিন্ন নদীর উপরে বাঁধ নির্মাণে ওরা আমাদের আপত্তিকে পাত্তা দিচ্ছে না।
নিজ দেশের গুণী ব্যক্তি ডঃ ইউনূসকে ব্যক্তিগত আক্রোশে চটিয়ে দিয়েও বাংলাদেশের কম ক্ষতি হয়নি। ড. ইউনুস ধোয়া তুলসী পাতা নন। মাইক্রো ক্রেডিটের নামে অনেক অনিয়ম হতেই পারে, তার সঠিক আইনগত সমাধানও আছে। তিনি যতো যাই করুন না কেন, তার কাজে বাংলাদেশের যথেষ্ট উন্নতিও সাধিত হয়েছে। যে দেশের রাজনীতিকরা কোটিপতি হয়ে ক্ষমতায় আসে তাদের মুখে ড. ইউনূসের অতোটুকু বিষয় নিয়ে এতো বড় বাড়াবাড়ি বেমানান।
ব্যক্তিগত জীবনে ভাল মানুষ হিসেবে পরিচিত আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার প্রফেশনের বাইরে রাষ্ট্রীয় নতুন দায়িত্বে যথেষ্ট ব্যর্থতা দেখিয়ে দেশকে অনেকভাবে বঞ্চিত করে ফেলেছেন। যে কোনও দায়িত্বে শুধু ভাল মানুষ হলেই চলে না, সেই সাথে তাকে দক্ষ, চৌকসও হতে হয়। রাষ্ট্রীয় টাকা এবং সুযোগ ব্যবহার করে রেকর্ড সংখ্যকবার বিদেশ সফর করে তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা বেড়েছে সে কথা ঠিক। কিন্তু সেই তুলনায় অর্জন অতি সামান্য। সরকারি টাকায় বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে অনেকে যেমন শপিংএ ব্যস্ত থাকেন, উনি তেমন ব্যস্ত থাকেন বিশ্বের বড় বড় নেতা নেত্রীর সংগে ছবি তোলায়। তিনি নাকি রাষ্ট্রীয় সফরের সময় একটা ব্যক্তিগত ক্যামেরা সাথে রাখেন। এটা শুধু তার নিজের ছবি তোলার কাজে ব্যবহৃত হয়। এমনকি তিনি অটোগ্রাফ নিতেও বেশ খানিকটা রাষ্ট্রীয় কাজের সময় ব্যয় করে ফেলেন। এভাবে অটোগ্রায় সংগ্রহ (বিশ্বে একমাত্র অটোগ্রাফশিকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে গিনেস বুকে নামা তোলার দাবি তোলা যেতে পারে) এবং ছবি তোলার আনন্দে বিভোর থাকলে সেই সব বিশিষ্ট ব্যক্তির বিপক্ষে কূটনৈতিক টেবিলে দেশের স্বার্থ বাগিয়ে আনবেন কিভাবে?
দীপু মণির ব্যক্তিগত ছবির এ্যালবাম বিখ্যাত লোকদের সাথে তোলা ছবিতে সমৃদ্ধ হলেও দেশের স্বার্থের ঝোলা পুরোটাই বলতে গেলে ফাঁকা। ছবি তোলার হবি এবং একমুখী ভারতকেন্দ্রিক বন্ধুত্বের কূটনীতি থেকে সরে এসে সকল প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং বিশ্বের অন্যান্য বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের দিকেও বন্ধুত্বের হাত সম্প্রসারিত করতে হবে।
সবশেষে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মমতার সংগে দেখা করে শুধু প্রতিশ্রুতির বাণী নিয়ে ফিরে এসেছেন। ভোটের রাজনীতিতে মমতার একগুঁয়েমিপনা তাকে এগিয়ে নিলেও আমাদের নুয়ে পড়া কূটনীতি সরকারি দলের জনপ্রিয়তায় কতোটুকু প্রভাব ফেলবে সেটা সম্প্রতি করা কূলদীপ নায়ারের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়। পশ্চিমবঙ্গে মমতার সংগে দেখা করতে গিয়ে দীপু মনি মূলতঃ নিজে ছোট হয়ে এসে বড় করে এলেন তাকে। এ কেমন কূটনীতি?
No comments