রিপোর্ট জমা আজ: সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নই চ্যালেঞ্জ
সেপ্টেম্বরে গঠিত ৬টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন ড. আলী রীয়াজ। এরমধ্যে বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনে ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত সময় নিয়েছে। বাকি চারটি কমিশন তাদের সংস্কার প্রস্তাব আজ প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তুলে দেবেন। এরপর সেগুলো নিয়ে সংস্কার কমিশনের সদস্য ও কয়েকজন উপদেষ্টাসহ প্রধান উপদেষ্টা আলোচনা করবেন বলে জানা গেছে।
গত ৯ই জানুয়ারি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সংস্কার অবশ্যই লাগবে। কিন্তু সেই সংস্কারটা হচ্ছে যে এর পেছনে যে শক্তিটা লাগবে সেটা হচ্ছে নির্বাচিত পার্লামেন্ট, নির্বাচিত সরকার। এটা ছাড়া সংস্কারকে কখনো লেজিটেমেসি দিতে পারবো না আমরা। এটা ফ্যাসিস্টরা পারবে। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহসহ ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বিভিন্ন প্রোগ্রামে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে আগে আওয়ামী লীগের বিচার ও সংস্কার কাজ শেষ করতে হবে। তারপর নির্বাচন। জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও সংস্কার চায়। এমতাবস্থায় কতোটুকু সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকার করতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এমতাবস্থায় সরকারের উপদেষ্টাদের বক্তব্যে সংস্কার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। সরকারের শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, সংস্কার পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে আপনারা সবাই আমাদের পাশে থাকবেন। যথাসাধ্য চেষ্টা করে যে সংস্কারের পরিকল্পনা আছে, সেটুকু এগিয়ে নিয়ে আমরা বিদায় নেবো। ৪ঠা আগস্ট রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য রিজওয়ান খায়ের বলেন, সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অঙ্গীকার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গত ৫৩ বছরে অনেক কিছু ঘটেছে, কিন্তু সংস্কার সম্ভব হয়নি রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে। আমলাতন্ত্র তখনই সংস্কার হবে, যখন এটি ধাক্কা খাবে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর বা ভারতে সংস্কার হয়েছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণে। আমাদের সংস্কার প্রতিবেদনে যাই থাকুক, রাজনৈতিক ঐকমত্য না হলে প্রতিবেদনটি এক টুকরা কাগজ ব্যতীত আর কিছুই হবে না। এটাই বাস্তবতা। সংস্কার দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া। আমাদের শুরু করতে হবে। পরবর্তী ধাপগুলো বর্তমান সরকার করবে না কি রাজনৈতিক সরকার করবে, সে ঐকমত্যটা গুরুত্বপূর্ণ। একই অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের আরেক সদস্য খোন্দকার মোহাম্মদ আমিনুর রহমান বলেন, জনপ্রশাসন সংস্কারে এর আগেও ১৭টি কমিশন হয়েছে, তাতে কোনো কাজ হয়নি। আমরা চেষ্টা করছি, আমাদের কমিশনের পরিণতিও যেন একই রকম না হয়।
এদিকে সংস্কার কমিশনগুলো অনেকগুলো বিষয়ে সরকারকে সুপারিশ করতে যাচ্ছে। ন্যূনতম ভোটার উপস্থিতি ছাড়া নির্বাচন বাতিলসহ বেশকিছু সুপারিশ করছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। এই কমিশনের সদস্যরা জানান, নির্বাচন সংস্কার কমিশন ব্যালট পেপারে না ভোট বিকল্পের পুনঃপ্রবর্তন এবং নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটের সুপারিশ করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে নারীদের আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করার পক্ষে সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে-নির্বাচন কমিশনার ও তাদের প্রধান নিয়োগের জন্য আইন সংশোধন, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করা, বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগের তিন ইসির বিচার করা, জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) এর অধীনে ইসির ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ইসিকে আরও জবাবদিহিমূলক করা। প্রার্থীদের তাদের হলফনামায় বিদেশে থাকা সম্পদ প্রকাশ করতে এবং হলফনামায় দেয়া তথ্য যাচাই বাধ্যতামূলক করার সুপারিশও করেছে সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া আগে স্থানীয় নির্বাচন করার বিষয়টিও সুপারিশে রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে কমিশনের এক সদস্য। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদসহ একগুচ্ছ সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই কমিশনের খসড়া প্রস্তাব অনুযায়ী, সংসদের নিম্ন্নকক্ষে আসন থাকবে ৪০০টি। আর নির্বাচন হবে বর্তমান পদ্ধতিতে। এর মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে, তারা নির্বাচিত হবেন সরাসরি ভোটে। আর উচ্চকক্ষে আসন থাকবে ১০৫টি। সংসদের এই দুই কক্ষ মিলিয়ে মোট আসন হবে ৫০৫টি। এ ছাড়া সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র ঠেকাতে বা এক ব্যক্তির হাতে যাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে না যায়, সেজন্য ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে আরও কিছু সুপারিশ করবে এই কমিশন। এর বাইরে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সর্বনিম্ন বয়স ২৫ বছর থেকে কমিয়ে ২১ বছর করারও সুপারিশ করা হবে। এ ছাড়া দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকা, স্থানীয় সরকার কমিশন, দুদক ও মানবাধিকার কমিশনকে সাংবিধানিক সংস্থা করা, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার সুপারিশও করা হচ্ছে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সূত্র জানায়, তাদের সুপারিশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেসব সদস্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয় তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ওপরও জোর দেবে কমিশন। কমিশন ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারার অধীনে রিমান্ডে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে আচরণের বিষয়ে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুসরণ করে একটি নির্দেশিকা তৈরির প্রস্তাব দেবে। এই নির্দেশিকায় থাকবে: সন্দেহভাজন কাউকে গ্রেপ্তারের পর তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে হবে এবং অভিযানে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। গ্রেপ্তারের কারণ রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করতে হবে। গ্রেপ্তারের এক ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের আত্মীয়দের জানাতে হবে। আটককৃতদের একজন আইনজীবী বা আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ থাকতে হবে। রিমান্ডের সময় একটি স্বচ্ছ কাঁচের দেয়ালযুক্ত কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। একজন আইনজীবী বা আত্মীয় এই কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। অন্যদিকে দুদকের সর্বোচ্চ পদ কমিশনের চেয়ারম্যান ও দু’জন কমিশনারের নিয়োগ নিয়ে সব সময় রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করেছে। দলীয় এবং দলীয় আনুগত্য থাকা ব্যক্তিদের ওই সব পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সংস্কার কমিশন এমন সুপারিশ করবে, যাতে নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকে এবং সংকট সৃষ্টি না হয়। দুদক আইন অনুযায়ী একজন চেয়ারম্যান ও দু’জন কমিশনার নিয়ে কমিশন। সুপারিশ করা হবে পাঁচ সদস্যের কমিশন করার জন্য। কমিশনের সার্বিক কার্যক্রম আমলাতন্ত্রের হাতে জিম্মি আছে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে। এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হচ্ছে।
No comments