নরেন্দ্র মোদির ক্রিকেট কূটনীতি by সিরাজুর রহমান
টেবিল
টেনিস খেলাকে পিংপং বলা হয়। এটা প্রায় সবাই জানেন। কিন্তু পিংপং খেলা বিংশ
শতাব্দীর শেষার্ধের বিশ্ব কূটনীতিতে কতখানি প্রভাব বিস্তার করে পশ্চিমের
অনেকেরই তা জানা নেই। অবশ্যি বিদগ্ধ ব্যক্তিদের জন্য এ বিষয়ে অনেক মূল্যবান
গ্রন্থ পাওয়া যায় বাজারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীনের জাতীয়তাবাদী কুয়োমিনটাংরা (কেএমটি) তাদের প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বে পশ্চিমা পক্ষকে সমর্থন করেছিল। বিনিময়ে মার্কিনিরা তাদের প্রচুর অস্ত্র সাহায্য দেয়। অন্য দিকে মাও জে দংয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে মূলত কেএমটির বিরুদ্ধে। এরা অস্ত্র সাহায্য পায় পূর্ব ইউরোপের নবগঠিত কমিউনিস্ট জোট সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে। কমিউনিস্টদের কাছে পরাজিত হয়ে চিয়াং কাইশেক তার কেএমটি বাহিনী নিয়ে ১৯৪৮ সালে চীনের মূল ভূমি ছেড়ে ফরমোজা (বর্তমানে তাইওয়ান) দ্বীপে চলে যেতে বাধ্য হন। ১৯৪৯ সালে মাওয়ের কমিউনিস্টরা বিশাল চীনা ভূখণ্ডে তাদের বিজয় ঘোষণা করে। গণচীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের ভবিষ্যতের জন্য চীনা-সোভিয়েত মৈত্রী ছিল বিরাট এক অশনিসঙ্কেত। কিন্তু এ চক্রে ভাঙন দূরের কথা, ফাটল ধরানোর কৌশল নিয়েও পশ্চিমা কূটনীতিকেরা হিমশিম খাচ্ছিলেন। তাদের জন্য সমাধান এলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, বলতে গেলে অলৌকিকভাবে। জাপানের নাগোয়াতে ৩১তম বিশ্ব টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতা হচ্ছিল ১৯৭১ সালের এপ্রিলে। এর আগে বহু মাস ধরে ওয়াশিংটন চীন-মার্কিন নেতাদের মধ্যে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে বহু চেষ্টা চালায়। এমনকি ১৯৭০ সালের নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের অনুরোধে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দূতিয়ালি করতে পিকিংয়ে (বেইজিং) গিয়েছিলেন। কিন্তু বলা হয়, পর্দার পেছনে জনৈক ব্রিটিশ কূটনীতিকের অকান্ত তৎপরতার ফলে ৬ এপ্রিল (১৯৭১) নাগোয়াতে উপস্থিত মার্কিন টেবিল টেনিস প্রতিনিধিদল হঠাৎ করে পিংপং খেলতে চীন সফরের আমন্ত্রণ পান। তারপর থেকে দু’দেশের মধ্যে অনেক পিংপং প্রতিযোগিতা চলে। পাশাপাশি কূটনীতিক যোগাযোগও ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করে। তারই পরিণতিতে দু’দেশের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় ১৯৯০ সালে।
এতগুলো কথা আর পুরনো ইতিহাস আমার মনে পড়ল গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি টেলিফোন বার্তায়। টেলিফোনের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে সরকারের দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ গোপনীয়তা অবলম্বন করা হচ্ছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এ কে এম শামিম চৌধুরীর বরাত দিয়ে দৈনিক মানবজমিন খবর দিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্য কামনা করেই নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনাকে এই টেলিফোন করেছেন। কিছুটা বিস্ময়ের কারণ অবশ্যই ঘটে এখানে। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ সর্বশ্রেষ্ঠ দল নয়, যদিও কোনো দিন সে মর্যাদা এরা পাবে আশা করে। তা ছাড়া এখনো বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে মোদির দেশ ভারত। মোদি নিশ্চয়ই আশা করবেন এবারেও তার দলই বিশ্ব বিজয়ী হবে। দ্বিতীয়ত, গত বছর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ সম্বন্ধে তার নীতি জানার জন্য বাংলাদেশের রাজনীতির মূল দুই পক্ষ গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে।
নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির চেয়ারপারসন অমিতা শাহ কিছু দিন আগে টেলিফোন করে শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক তার নিজের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ বেগম খালেদা জিয়ার খোঁজখবর নিয়েছিলেন। সেটাকে কেন্দ্র করে অবৈধ সরকার ও আওয়ামী লীগের ঈর্ষার যাতনা ও মর্মপীড়ার কথা কারো অজানা নেই। ভারতের খুঁটির জোরেই এ সরকার গদিতে এসেছে, গদিতে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকতে পারবে বলে আশা করছে। এমতাবস্থায় মোদি যদি শেখ হাসিনাকে সামান্যতম আশা-ভরসার কথাও শোনাতেন তাহলে সরকারে এবং শাসকদলে কী পরিমাণে উল্লাস ও লাফালাফি দেখা যেত, সহজেই কল্পনা করা যায়। উল্লাসের অভাব ইঙ্গিত বহন করে যে, শেখ হাসিনার উল্লসিত হওয়ার মতো কিছু নরেন্দ্র মোদি বলেননি। তাহলে কী বলেছেন তিনি? সত্যি সত্যি বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেট কাপে বিজয়ী হবে আশা করে শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করেননি তিনি। সে কারণেই ধারণা করা অপ্রত্যাশিত হবে না যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন দু’দেশের সম্পর্কের ব্যাপারে একটা ক্রিকেট কূটনীতির সূচনা হতে পারে।
আন্তর্জাতিক চাপ বেড়ে যাওয়া
কিছু বিশ্বাসযোগ্য পটভূমি ঘটেছে অতি সাম্প্রতিক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার ভারত সফরে নরেন্দ্র মোদির সাথে যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন, সেটা কিছু দিন আগেও আশা করা যেত না। তখনো জানা গিয়েছিল, দুই বিশ্ব নেতার মধ্যে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে (প্রকৃত) গণতন্ত্র চর্চা সম্বন্ধেও তারা একমত হয়েছিলেন। এ সফরের পরের কিছু দিনের ঘটনাবলি বিবর্তিত হচ্ছে নাটকীয়ভাবে এবং অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে। ওবামার ভারত ত্যাগের ২৪ ঘণ্টার মাথায় বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো রাতে বিনা নোটিশে বরখাস্ত করা হলো পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে। বাংলাদেশের মানুষের অবশ্যই মনে পড়বে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন তামাশায় শেখ হাসিনাকে নৈতিক সমর্থন দিতে এবং সেটা ‘হালাল’ নির্বাচন হয়েছে বলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে সার্টিফিকেট দিতে সুজাতা সিং ঢাকা এসেছিলেন। নরেন্দ্র মোদি সুজাতার স্থলে পররাষ্ট্র সচিব নিয়োগ করেছেন ওয়াশিংটনে ভারতের রাষ্ট্রদূত সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্করকে। প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে জয়শঙ্করের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
শেখ হাসিনার ক্ষমতার একটা শক্তিশালী খুঁটি ছিলেন ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ। তিনি রাষ্ট্রদূতদের সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লিতে গিয়ে বাংলাদেশে মুক্ত নির্বাচন ও গণতন্ত্রের দাবিতে বিএনপি ও ২০ দলের অবরোধ ও আনুষঙ্গিক হরতাল সম্বন্ধে পররাষ্ট্র দফতরের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেন। এ প্রতিবেদনে প্রকাশিত এবং সংক্ষিপ্ত বিবরণে যা পড়েছি, আমার বাস্তবসম্মত কিংবা অভ্রান্ত মূল্যায়ন মনে হয়নি। পঙ্কজ শরণ তার প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ২০ দলের দেড় মাসব্যাপী আন্দোলন, অবরোধ ও হরতালকে তেমন গুরুত্ব দেননি। তিনি আরো লিখেছেন যে, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ হাসিনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে। প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেছেন, সরকার এখনো জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রয়োজন বোধ করেনি। অথচ বিশ্ব মিডিয়ার প্রতিবেদন ইত্যাদিতে প্রমাণ হচ্ছে যে, দেশ সম্পূর্ণ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তা ছাড়া খুব সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং মহাসচিব বান কি মুনও এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী মোদির সাথে যোগাযোগ করে থাকতে পারেন। সম্ভবত তথাকথিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর (পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি) প্রধানেরা যে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় স্তরের নেতাদের মতো কথা বলছেন, হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন, বিদেশে সেটাকেও সরকারের অসহায়তার পরিচয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এসব খবর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কানে যায় না মনে করার কারণ নেই। তার পরেই জানা গেল যে, পঙ্কজ শরণ আর বাংলাদেশে থাকছেন না। তার স্থলে নতুন একজন হাইকমিশনারের নাম শিগগিরই ঘোষণা করা হবে।
ভারতের সম্যক উপলব্ধি?
শেখ হাসিনার সাথে নরেন্দ্র মোদির টেলিফোন সংলাপের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দিল্লি থেকে ঘোষণা আসে যে, নরেদ্র মোদি নতুন পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্করকে শিগগিরই ঢাকা সফরের নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারি ঘোষণায় অবশ্যি এ সফরকে সার্কের সদস্যদের সাথে যোগাযোগের অংশ বলে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এমনও কি হতে পারে না, বাংলাদেশ পরিস্থিতির একটি বাস্তব ও নির্ভরযোগ্য মূল্যায়নের জন্যই প্রধানমন্ত্রী মোদি পররাষ্ট্র সচিব জয়শঙ্করকে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছেন? এবং পররাষ্ট্র সচিবের সফরের কথা নিশ্চয়ই মোদি গত শুক্রবারের টেলিফোন সংলাপে শেখ হাসিনাকে জানিয়ে থাকবেন।
বাংলাদেশের সঙ্কট সম্বন্ধে নরেন্দ্র মোদির এই আপাত গুরুত্বেরও কিছু কারণ আছে মনে হয়। বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগীরা, এমনকি জাতিসঙ্ঘও ২০১৩ সাল থেকে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা এবং সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জোর তাগিদ দিয়ে আসছে। বহু দেশের মন্ত্রীদের মতো জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো এবং দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেসাই বিসওয়ালও পৃথক পৃথকভাবে বাংলাদেশে এসেছেন এবং সরকার কর্তৃক অপমানিত হয়ে ফিরে গেছেন।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তো সম্প্রতি নিশা দেসাইকে ‘দুই আনার মন্ত্রী‘ বলে হেনস্তা করেছেন। মনে হচ্ছে যে, সংশ্লিষ্ট বন্ধু দেশ ও সংস্থাগুলো এখন যুগপৎ ও ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের ওপর চাপ দেবে। ব্রিটিশ, মার্কিন, কানাডীয় এবং আরো কোনো কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতেরা বিগত ক’দিনে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে দেখা করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরো একটি প্রতিনিধিদল এখন ঢাকায় আছে এবং জানা গেছে যে, প্রধানমন্ত্রী আবারো মান-অভিমানের খেলা খেলছেন, বলছেন ইউরোপীয়দের সাথে দেখা করবেন না।
স্বদেশের চাপ ও প্রস্তুতি
এবার কিন্তু চাপ শুধু বিদেশীদের দিকে থেকেই আসছে না। নাগরিক সমাজ সংলাপ ও সমঝোতায় ভূমিকা রাখার জন্য কিছু প্রাজ্ঞ ও সম্মানিত ব্যক্তিকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে। সরকারের শুভ বুদ্ধির উদ্রেক হলে বিলম্ব না করেই কাজ শুরু করা তাদের পরিকল্পনা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার সংলাপের পথে বর্তমান সঙ্কট দূর করতে এগিয়ে না এলে তারা সরকারের সাথে অসহযোগিতা করবেন। বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীরা বিল পরিশোধ না করার হুমকি দিচ্ছেন। বিএনপি ও ২০ দলের জোট হুমকি দিয়েছে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা কিংবা তার কোনো ক্ষতি করা হলে তারা গান্ধীর স্টাইলে দেশব্যাপী আইন অমান্য ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করবে। বেশ কিছু দিন থেকে শোনা যাচ্ছিল, প্রবাসী শ্রমিকেরা সরকারের একগুঁয়েমির প্রতিবাদে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করতে সংগঠিত হচ্ছেন। এরা এখন প্রকাশ্য হুমকি দিয়েছেন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে খাবার ও দর্শনার্থী প্রবেশে বাধাদান এবং তার সাথে অন্যান্য ধরনের অপকর্ম বন্ধ না হলে রেমিট্যান্স দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ থেকে আরো কিছু কৌতূহলোদ্দীপক খবর শুনছি।
খালেদা জিয়া ও তার সহকর্মীদের উপবিষ্ট রাখার জন্য যারা প্রকৃত দায়ী তাদের বাড়িতে কাঁচা কিংবা রান্না করা খাবার যাওয়ার বিরুদ্ধে অবেরোধ আরোপের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে ভেতরে ভেতরে। ইংরেজি প্রবাদ বাক্য হচ্ছে ‘অ্যাভরি অ্যাকশান হ্যাজ ইটস রিঅ্যাকশান’। বাংলায় বলে ‘শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ’। ভাষা যা-ই হোক না কেন, জাতির দুশমনদের একদিন না একদিন উপযুক্ত শাস্তি পেতেই হবে।
(লন্ডন, ১৭.০২.১৫)
serajurrahman34@gmail.com
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীনের জাতীয়তাবাদী কুয়োমিনটাংরা (কেএমটি) তাদের প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বে পশ্চিমা পক্ষকে সমর্থন করেছিল। বিনিময়ে মার্কিনিরা তাদের প্রচুর অস্ত্র সাহায্য দেয়। অন্য দিকে মাও জে দংয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে মূলত কেএমটির বিরুদ্ধে। এরা অস্ত্র সাহায্য পায় পূর্ব ইউরোপের নবগঠিত কমিউনিস্ট জোট সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে। কমিউনিস্টদের কাছে পরাজিত হয়ে চিয়াং কাইশেক তার কেএমটি বাহিনী নিয়ে ১৯৪৮ সালে চীনের মূল ভূমি ছেড়ে ফরমোজা (বর্তমানে তাইওয়ান) দ্বীপে চলে যেতে বাধ্য হন। ১৯৪৯ সালে মাওয়ের কমিউনিস্টরা বিশাল চীনা ভূখণ্ডে তাদের বিজয় ঘোষণা করে। গণচীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের ভবিষ্যতের জন্য চীনা-সোভিয়েত মৈত্রী ছিল বিরাট এক অশনিসঙ্কেত। কিন্তু এ চক্রে ভাঙন দূরের কথা, ফাটল ধরানোর কৌশল নিয়েও পশ্চিমা কূটনীতিকেরা হিমশিম খাচ্ছিলেন। তাদের জন্য সমাধান এলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, বলতে গেলে অলৌকিকভাবে। জাপানের নাগোয়াতে ৩১তম বিশ্ব টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতা হচ্ছিল ১৯৭১ সালের এপ্রিলে। এর আগে বহু মাস ধরে ওয়াশিংটন চীন-মার্কিন নেতাদের মধ্যে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে বহু চেষ্টা চালায়। এমনকি ১৯৭০ সালের নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের অনুরোধে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দূতিয়ালি করতে পিকিংয়ে (বেইজিং) গিয়েছিলেন। কিন্তু বলা হয়, পর্দার পেছনে জনৈক ব্রিটিশ কূটনীতিকের অকান্ত তৎপরতার ফলে ৬ এপ্রিল (১৯৭১) নাগোয়াতে উপস্থিত মার্কিন টেবিল টেনিস প্রতিনিধিদল হঠাৎ করে পিংপং খেলতে চীন সফরের আমন্ত্রণ পান। তারপর থেকে দু’দেশের মধ্যে অনেক পিংপং প্রতিযোগিতা চলে। পাশাপাশি কূটনীতিক যোগাযোগও ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করে। তারই পরিণতিতে দু’দেশের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় ১৯৯০ সালে।
এতগুলো কথা আর পুরনো ইতিহাস আমার মনে পড়ল গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি টেলিফোন বার্তায়। টেলিফোনের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে সরকারের দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ গোপনীয়তা অবলম্বন করা হচ্ছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এ কে এম শামিম চৌধুরীর বরাত দিয়ে দৈনিক মানবজমিন খবর দিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্য কামনা করেই নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনাকে এই টেলিফোন করেছেন। কিছুটা বিস্ময়ের কারণ অবশ্যই ঘটে এখানে। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ সর্বশ্রেষ্ঠ দল নয়, যদিও কোনো দিন সে মর্যাদা এরা পাবে আশা করে। তা ছাড়া এখনো বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে মোদির দেশ ভারত। মোদি নিশ্চয়ই আশা করবেন এবারেও তার দলই বিশ্ব বিজয়ী হবে। দ্বিতীয়ত, গত বছর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ সম্বন্ধে তার নীতি জানার জন্য বাংলাদেশের রাজনীতির মূল দুই পক্ষ গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে।
নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির চেয়ারপারসন অমিতা শাহ কিছু দিন আগে টেলিফোন করে শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক তার নিজের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ বেগম খালেদা জিয়ার খোঁজখবর নিয়েছিলেন। সেটাকে কেন্দ্র করে অবৈধ সরকার ও আওয়ামী লীগের ঈর্ষার যাতনা ও মর্মপীড়ার কথা কারো অজানা নেই। ভারতের খুঁটির জোরেই এ সরকার গদিতে এসেছে, গদিতে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকতে পারবে বলে আশা করছে। এমতাবস্থায় মোদি যদি শেখ হাসিনাকে সামান্যতম আশা-ভরসার কথাও শোনাতেন তাহলে সরকারে এবং শাসকদলে কী পরিমাণে উল্লাস ও লাফালাফি দেখা যেত, সহজেই কল্পনা করা যায়। উল্লাসের অভাব ইঙ্গিত বহন করে যে, শেখ হাসিনার উল্লসিত হওয়ার মতো কিছু নরেন্দ্র মোদি বলেননি। তাহলে কী বলেছেন তিনি? সত্যি সত্যি বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেট কাপে বিজয়ী হবে আশা করে শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করেননি তিনি। সে কারণেই ধারণা করা অপ্রত্যাশিত হবে না যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন দু’দেশের সম্পর্কের ব্যাপারে একটা ক্রিকেট কূটনীতির সূচনা হতে পারে।
আন্তর্জাতিক চাপ বেড়ে যাওয়া
কিছু বিশ্বাসযোগ্য পটভূমি ঘটেছে অতি সাম্প্রতিক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার ভারত সফরে নরেন্দ্র মোদির সাথে যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন, সেটা কিছু দিন আগেও আশা করা যেত না। তখনো জানা গিয়েছিল, দুই বিশ্ব নেতার মধ্যে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে (প্রকৃত) গণতন্ত্র চর্চা সম্বন্ধেও তারা একমত হয়েছিলেন। এ সফরের পরের কিছু দিনের ঘটনাবলি বিবর্তিত হচ্ছে নাটকীয়ভাবে এবং অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে। ওবামার ভারত ত্যাগের ২৪ ঘণ্টার মাথায় বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো রাতে বিনা নোটিশে বরখাস্ত করা হলো পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে। বাংলাদেশের মানুষের অবশ্যই মনে পড়বে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন তামাশায় শেখ হাসিনাকে নৈতিক সমর্থন দিতে এবং সেটা ‘হালাল’ নির্বাচন হয়েছে বলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে সার্টিফিকেট দিতে সুজাতা সিং ঢাকা এসেছিলেন। নরেন্দ্র মোদি সুজাতার স্থলে পররাষ্ট্র সচিব নিয়োগ করেছেন ওয়াশিংটনে ভারতের রাষ্ট্রদূত সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্করকে। প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে জয়শঙ্করের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
শেখ হাসিনার ক্ষমতার একটা শক্তিশালী খুঁটি ছিলেন ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ। তিনি রাষ্ট্রদূতদের সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লিতে গিয়ে বাংলাদেশে মুক্ত নির্বাচন ও গণতন্ত্রের দাবিতে বিএনপি ও ২০ দলের অবরোধ ও আনুষঙ্গিক হরতাল সম্বন্ধে পররাষ্ট্র দফতরের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেন। এ প্রতিবেদনে প্রকাশিত এবং সংক্ষিপ্ত বিবরণে যা পড়েছি, আমার বাস্তবসম্মত কিংবা অভ্রান্ত মূল্যায়ন মনে হয়নি। পঙ্কজ শরণ তার প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ২০ দলের দেড় মাসব্যাপী আন্দোলন, অবরোধ ও হরতালকে তেমন গুরুত্ব দেননি। তিনি আরো লিখেছেন যে, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ হাসিনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে। প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেছেন, সরকার এখনো জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রয়োজন বোধ করেনি। অথচ বিশ্ব মিডিয়ার প্রতিবেদন ইত্যাদিতে প্রমাণ হচ্ছে যে, দেশ সম্পূর্ণ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তা ছাড়া খুব সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং মহাসচিব বান কি মুনও এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী মোদির সাথে যোগাযোগ করে থাকতে পারেন। সম্ভবত তথাকথিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর (পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি) প্রধানেরা যে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় স্তরের নেতাদের মতো কথা বলছেন, হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন, বিদেশে সেটাকেও সরকারের অসহায়তার পরিচয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এসব খবর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কানে যায় না মনে করার কারণ নেই। তার পরেই জানা গেল যে, পঙ্কজ শরণ আর বাংলাদেশে থাকছেন না। তার স্থলে নতুন একজন হাইকমিশনারের নাম শিগগিরই ঘোষণা করা হবে।
ভারতের সম্যক উপলব্ধি?
শেখ হাসিনার সাথে নরেন্দ্র মোদির টেলিফোন সংলাপের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দিল্লি থেকে ঘোষণা আসে যে, নরেদ্র মোদি নতুন পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্করকে শিগগিরই ঢাকা সফরের নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারি ঘোষণায় অবশ্যি এ সফরকে সার্কের সদস্যদের সাথে যোগাযোগের অংশ বলে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এমনও কি হতে পারে না, বাংলাদেশ পরিস্থিতির একটি বাস্তব ও নির্ভরযোগ্য মূল্যায়নের জন্যই প্রধানমন্ত্রী মোদি পররাষ্ট্র সচিব জয়শঙ্করকে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছেন? এবং পররাষ্ট্র সচিবের সফরের কথা নিশ্চয়ই মোদি গত শুক্রবারের টেলিফোন সংলাপে শেখ হাসিনাকে জানিয়ে থাকবেন।
বাংলাদেশের সঙ্কট সম্বন্ধে নরেন্দ্র মোদির এই আপাত গুরুত্বেরও কিছু কারণ আছে মনে হয়। বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগীরা, এমনকি জাতিসঙ্ঘও ২০১৩ সাল থেকে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা এবং সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জোর তাগিদ দিয়ে আসছে। বহু দেশের মন্ত্রীদের মতো জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো এবং দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেসাই বিসওয়ালও পৃথক পৃথকভাবে বাংলাদেশে এসেছেন এবং সরকার কর্তৃক অপমানিত হয়ে ফিরে গেছেন।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তো সম্প্রতি নিশা দেসাইকে ‘দুই আনার মন্ত্রী‘ বলে হেনস্তা করেছেন। মনে হচ্ছে যে, সংশ্লিষ্ট বন্ধু দেশ ও সংস্থাগুলো এখন যুগপৎ ও ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের ওপর চাপ দেবে। ব্রিটিশ, মার্কিন, কানাডীয় এবং আরো কোনো কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতেরা বিগত ক’দিনে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে দেখা করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরো একটি প্রতিনিধিদল এখন ঢাকায় আছে এবং জানা গেছে যে, প্রধানমন্ত্রী আবারো মান-অভিমানের খেলা খেলছেন, বলছেন ইউরোপীয়দের সাথে দেখা করবেন না।
স্বদেশের চাপ ও প্রস্তুতি
এবার কিন্তু চাপ শুধু বিদেশীদের দিকে থেকেই আসছে না। নাগরিক সমাজ সংলাপ ও সমঝোতায় ভূমিকা রাখার জন্য কিছু প্রাজ্ঞ ও সম্মানিত ব্যক্তিকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে। সরকারের শুভ বুদ্ধির উদ্রেক হলে বিলম্ব না করেই কাজ শুরু করা তাদের পরিকল্পনা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার সংলাপের পথে বর্তমান সঙ্কট দূর করতে এগিয়ে না এলে তারা সরকারের সাথে অসহযোগিতা করবেন। বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীরা বিল পরিশোধ না করার হুমকি দিচ্ছেন। বিএনপি ও ২০ দলের জোট হুমকি দিয়েছে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা কিংবা তার কোনো ক্ষতি করা হলে তারা গান্ধীর স্টাইলে দেশব্যাপী আইন অমান্য ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করবে। বেশ কিছু দিন থেকে শোনা যাচ্ছিল, প্রবাসী শ্রমিকেরা সরকারের একগুঁয়েমির প্রতিবাদে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করতে সংগঠিত হচ্ছেন। এরা এখন প্রকাশ্য হুমকি দিয়েছেন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে খাবার ও দর্শনার্থী প্রবেশে বাধাদান এবং তার সাথে অন্যান্য ধরনের অপকর্ম বন্ধ না হলে রেমিট্যান্স দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ থেকে আরো কিছু কৌতূহলোদ্দীপক খবর শুনছি।
খালেদা জিয়া ও তার সহকর্মীদের উপবিষ্ট রাখার জন্য যারা প্রকৃত দায়ী তাদের বাড়িতে কাঁচা কিংবা রান্না করা খাবার যাওয়ার বিরুদ্ধে অবেরোধ আরোপের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে ভেতরে ভেতরে। ইংরেজি প্রবাদ বাক্য হচ্ছে ‘অ্যাভরি অ্যাকশান হ্যাজ ইটস রিঅ্যাকশান’। বাংলায় বলে ‘শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ’। ভাষা যা-ই হোক না কেন, জাতির দুশমনদের একদিন না একদিন উপযুক্ত শাস্তি পেতেই হবে।
(লন্ডন, ১৭.০২.১৫)
serajurrahman34@gmail.com
No comments