বাংলা ভাষার ঐশ্বর্য ও সংকট by সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ
মাতৃভাষার
প্রতি মানুষের ভালোবাসা চিরন্তন। বাংলাভাষী মানুষ বাংলা ভাষাকে
ভালোবেসেছে, ভালোবাসে এবং ভালোবাসবে। তবে এ সহজাত ভালোবাসার বাইরেও বাংলা
ভাষা নিয়ে বিশেষ গৌরব করার কারণ রয়েছে।
প্রথমত, বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র, যার স্বাধীনতার সংগ্রাম বিকশিত হয়েছিল ভাষার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে ভারতবর্ষের মুসলমানরা স্বাধীন হবে_ এ স্বপ্নে সবচেয়ে বেশি বিভোর হয়েছিল বাঙালি মুসলমানরাই। পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ, পাঠানরা সে দৌড়ে পেছনে ছিল। ভারত বিভাগ যে বাঙালির মুক্তি নিয়ে আসেনি, বাঙালি মুসলমানরা তা প্রথম বুঝতে পেরেছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে শুধু উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণায়। তারই প্রতিবাদে ভাষার দাবি আদায়ে জীবন দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাস এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করল বাঙালি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় মূলত ভাষা আন্দোলনের ফসল। আর এ পথ ধরেই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার বাইরেও পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। অবশ্য ইংরেজি, ফরাসি, স্পেনীয়ও একাধিক দেশের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে। এর বাইরেও ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বৃহৎ নগরগুলোতে রয়েছে 'লিটল বেঙ্গল'। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বাইরে সেসব জায়গায় চীনা, পাঞ্জাবি, গ্রিক বা ইতালীয়দের মতোই বাঙালি সংস্কৃতি সুপরিচিত। শান্তিরক্ষীদের কল্যাণে আফ্রিকার সিয়েরালিওনে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছে- এও এক অভূতপূর্ব ঘটনা।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। গ্রেকো রোমান, হিব্রু-আরবি বা সংস্কৃত-প্রাকৃতের মতো ধ্রুপদী ভাষাগুলো ছাড়া এত দীর্ঘ ধারাবাহিক সাহিত্যসম্পদ পৃথিবীর কম ভাষারই আছে। বিষয়বৈচিত্র্যেও এই সাহিত্যকীর্তি অনন্যসাধারণ। বৌদ্ধ সনাতন, শাক্ত বৈষ্ণব, মুসলিম ঐতিহ্যের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ লোকসাহিত্য মিলে বাংলা সাহিত্য তাই এত ঋদ্ধ। বাংলা সাহিত্যের এই বিপুল ভাণ্ডারে মিশে আছে আরব, পারস্য, পর্তুগিজ, ইংরেজ থেকে প্রতিবেশী আরাকান পর্যন্ত; আসাম, উৎকল বা মিথিলার সঙ্গেও তার যোগ সামান্য নয়।
বাংলা ভাষায় একজন কবি আছেন, নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাহিত্যে এশিয়ায় প্রথম নোবেল নিয়ে এসেছিলেন তিনিই। তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত তার রচিত_ বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকা। এমন ঘটনা জাতীয় সঙ্গীতের ইতিবৃত্তে আর নেই।
বাংলা ভাষার অক্ষরের শক্তি অনেক। প্রায় সব উচ্চারণই বাংলা অক্ষর দিয়ে বর্ণিকর করা যায়। সব ভাষার এ শক্তি নেই। ইংরেজিতে 'ট' (T) আছে; 'ত' নেই। জাপানি সব 'ল'কে 'র' বানিয়ে ফেলে। আরবিতে 'প' নেই; তাই পাকিস্তানকে 'বাকিস্তান বানিয়েছিল। বানান ও উচ্চারণের সংঘাতও বাংলায় কম। 'ক্ষ' (ক+ষ)-র মতো দু'একটি অক্ষর ছাড়া উচ্চারণ আর বানান একই। 'পঙ্ক্তি'র মতো মাত্র কয়েকটি ব্যতিক্রম চোখে পড়ে।
বানান থেকে উচ্চারণে উহ্য শব্দের অত্যাচার নেই। 'নাইফ' (knife) লিখতে গিয়ে অযথা একটি k সংযোগের মতো ঘটনা বিরল। Beauty লিখতে গিয়ে প্রায় সব স্বরবর্ণের সার বেঁধে দাঁড়ানোর মতো অবস্থাও নেই। Jose লিখে 'হোসে' পড়তে হবে, দীর্ঘ renaissance লিখব, পড়ব রেনেসাঁ অথবা ভার্সাই শহরের নাম লিখতে অতিরিক্ত‘lles লেখার বিড়ম্বনা বাংলা ভাষায় নেই।
বাংলা ভাষা আবেগের ভাষা। সমগ্র মধ্য যুগজুড়ে কাব্য লেখা হয়েছে সে ভাষায়। চণ্ডীদাস, আলাওল, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র থেকে মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ তৈরি করেছেন বাংলার কাব্যভাষা। বাংলা ভাষা যুক্তিরও ভাষা। তা দিয়েই ধর্মের তর্ক করেছেন রামমোহন রায়, বিজ্ঞানের কথা বলেছেন অক্ষয় কুমার দত্ত, জগদীশচন্দ্র বসুরা। আবার গল্প-উপন্যাস-নাটকেরও ভাষা হয়েছে বাংলা। বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলাল রায়রা সে ভাষায় এনেছেন পরিপকস্ফতা। নবরূপে তাকে উপস্থাপনা করেছেন প্রমথ চৌধুরী।
অথচ সেই বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে প্রচলন নিয়ে এখন তর্ক চলে। প্রশাসনের একটা বড় অংশ মনে করে, বাংলা প্রশাসনের সর্বস্তরে বা সব কাজে ব্যবহারের উপযোগী নয়। সমস্যাটি অভ্যাস বদলানোর। ইংরেজ আমলে এ দেশে আইসিএস-বিসিএস গড়ে তোলা হয়েছিল সেকলেতত্ত্ব দিয়ে_ রক্তে ভারতীয় আর মনে ইংরেজ গড়ে। তখন ইংরেজ রাজা আর প্রশাসকরা তার পরিষদ। স্বাধীন দেশে তো সেই প্রজারাই প্রজাতন্ত্রের মালিক প্রশাসকরা তাদের সেবকমাত্র। কিন্তু প্রশাসনের একটা বড় অংশের মানসিকতা দেখে তা তো মনে হয় না। ভাগ্যিস চৈত্র মাসের গরমে সুট পরে অফিস করা বন্ধ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। তবে কাঁটা চামুচ দিয়ে ডাল খাওয়ার দৃশ্য এখনও মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে। প্রশাসনের নথি বা টোকায় যারা বাংলা লিখতে পারেন না, তাদের অধিকাংশ শুদ্ধ ইংরেজিও লিখতে পারেন না বলে ধারণা করি।
আইন-আদালতেও একই অবস্থা। সরকারের কাজকর্মে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক; এর অন্যথা হলে শাস্তির বিধান রয়েছে বলে শুনেছি। আইনের ফাঁক আছে নিশ্চয়ই, নইলে এ অপরাধে শাস্তির কোনো সংবাদ তো গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখিনি। একদিনে না হলেও ধীরে ধীরে কি মাতৃভাষাকে আইনের ভাষা করা যায় না?
আরেক দল বলে, বাংলা প্রযুক্তির ভাষা নয়, কম্পিউটারের ভাষাও নয়। বিশেষজ্ঞরাই এর সঠিক উত্তর জানান। তবে সাধারণ বিবেচনায় মনে প্রশ্ন জাগে, হাজার দুয়েক অক্ষর না চিনলে যে বিনাভাষায় সংবাদপত্র পাঠ করা যায় না; তারা তো চীনা ভাষাতেই কম্পিউটারে কাজ করছে। কানজি, হিরাগানা, কাতাকানা সংবলিত জাপানি ভাষায় প্রযুক্তি জ্ঞানের উৎকর্ষের কথা কেন আমরা ভুলে যাই?
আসলে সমস্যাটার গোড়ায় রয়েছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা। এ দেশে একসময় ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে যেত উচ্চবিত্তরা; পরে মধ্যবিত্তরা তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। উচ্চবেতন গ্রহণের মাধ্যমে ইংরেজি স্কুলগুলো যে আয় করে তা দিয়ে ভবন আর আসবাব সাজায় চকচকে করে। বাংলা স্কুলগুলোতে ভবন বড়। খেলার মাঠ আছে_ তবুও কেমন একটা দীন চেহারা। সরকারি স্কুলে শিক্ষকদের সম্পর্কে ঢালাও অভিযোগ-ক্লাসের চেয়ে টিউশনিতে মনোযোগ বেশি। ইংরেজি স্কুলে শিক্ষকদের থেকে কর্তৃপক্ষ ষোলআনা আদায় করে নিতে পারেন। ফলে যাদের সামান্য সামর্থ্য আছে তাদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি স্কুলে যাচ্ছে। এ অপরাধে আমরা সবাই অপরাধী। ফলে বাংলা স্কুলগুলোও সমান্তরালভাবে চালু করছে তাদের ইংলিশ ভার্সন। এ সমস্যা দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে। এর পরিণতি কী হবে? ইংরেজি তো আর আমাদের মাতৃভাষা হয়ে যাবে না।
আমাদের দেশে মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষায় দানের প্রয়াস ১৯৬০-এর দশক থেকেই। স্বাধীনতা লাভের পর তা বেগবান হয়েছিল; কিন্তু সত্তরের দশকের শেষ থেকে উল্টো যাত্রায় তা ধীরে ধীরে থেমে গেছে। এমন ধারণা বদ্ধমূল করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে যে, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান, চিকিৎসা বা প্রকৌশল বিষয়ে শিক্ষা সম্ভব নয়। চীনা বা জাপানের কথা তখন আবার মনে পড়ে! আসলে বিশ্বজ্ঞানকে অনুবাদ ও রূপান্তরের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় আত্তীকরণ করার কাজটি আমরা ঠিকমতো করতে পারছি না। ইংরেজি শিখছি বলে যতই আনন্দিত হই না কেন, বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় দক্ষ এমন জ্ঞানীর সংখ্যা হাতেগোনা।
এর সঙ্গে নতুন ঝামেলা বিকৃত বাংলা। বাংলা বাক্যের আদি-অন্ত-মধ্যে ইংরেজি শব্দ বসিয়ে একটা খিচুড়ি তৈরি হচ্ছে। সো, বাট প্রভৃতিকে যত্রতত্র সংযোজন, বাক্যের মধ্যে অকারণে 'কিন্তু' ব্যবহার, আঞ্চলিক ভাষার আবরণে অদ্ভুত শব্দ ও উচ্চারণ এবং প্রায় সমগ্র বাক্যে নাসিক্য উচ্চারণ যোগ_ সব মিলিয়ে মাতৃভাষা বাংলার এক বিপর্যস্ত অবস্থা!
তবু এত কিছুর পরও আমরা আশায় বুক বাঁধতে চাই। সংকট-উত্তরণের মতো ঐশ্বর্য মাতৃভাষা বাংলায় আছে।
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি
প্রথমত, বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র, যার স্বাধীনতার সংগ্রাম বিকশিত হয়েছিল ভাষার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে ভারতবর্ষের মুসলমানরা স্বাধীন হবে_ এ স্বপ্নে সবচেয়ে বেশি বিভোর হয়েছিল বাঙালি মুসলমানরাই। পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ, পাঠানরা সে দৌড়ে পেছনে ছিল। ভারত বিভাগ যে বাঙালির মুক্তি নিয়ে আসেনি, বাঙালি মুসলমানরা তা প্রথম বুঝতে পেরেছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে শুধু উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণায়। তারই প্রতিবাদে ভাষার দাবি আদায়ে জীবন দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাস এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করল বাঙালি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় মূলত ভাষা আন্দোলনের ফসল। আর এ পথ ধরেই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার বাইরেও পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। অবশ্য ইংরেজি, ফরাসি, স্পেনীয়ও একাধিক দেশের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে। এর বাইরেও ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বৃহৎ নগরগুলোতে রয়েছে 'লিটল বেঙ্গল'। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বাইরে সেসব জায়গায় চীনা, পাঞ্জাবি, গ্রিক বা ইতালীয়দের মতোই বাঙালি সংস্কৃতি সুপরিচিত। শান্তিরক্ষীদের কল্যাণে আফ্রিকার সিয়েরালিওনে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছে- এও এক অভূতপূর্ব ঘটনা।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। গ্রেকো রোমান, হিব্রু-আরবি বা সংস্কৃত-প্রাকৃতের মতো ধ্রুপদী ভাষাগুলো ছাড়া এত দীর্ঘ ধারাবাহিক সাহিত্যসম্পদ পৃথিবীর কম ভাষারই আছে। বিষয়বৈচিত্র্যেও এই সাহিত্যকীর্তি অনন্যসাধারণ। বৌদ্ধ সনাতন, শাক্ত বৈষ্ণব, মুসলিম ঐতিহ্যের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ লোকসাহিত্য মিলে বাংলা সাহিত্য তাই এত ঋদ্ধ। বাংলা সাহিত্যের এই বিপুল ভাণ্ডারে মিশে আছে আরব, পারস্য, পর্তুগিজ, ইংরেজ থেকে প্রতিবেশী আরাকান পর্যন্ত; আসাম, উৎকল বা মিথিলার সঙ্গেও তার যোগ সামান্য নয়।
বাংলা ভাষায় একজন কবি আছেন, নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাহিত্যে এশিয়ায় প্রথম নোবেল নিয়ে এসেছিলেন তিনিই। তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত তার রচিত_ বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকা। এমন ঘটনা জাতীয় সঙ্গীতের ইতিবৃত্তে আর নেই।
বাংলা ভাষার অক্ষরের শক্তি অনেক। প্রায় সব উচ্চারণই বাংলা অক্ষর দিয়ে বর্ণিকর করা যায়। সব ভাষার এ শক্তি নেই। ইংরেজিতে 'ট' (T) আছে; 'ত' নেই। জাপানি সব 'ল'কে 'র' বানিয়ে ফেলে। আরবিতে 'প' নেই; তাই পাকিস্তানকে 'বাকিস্তান বানিয়েছিল। বানান ও উচ্চারণের সংঘাতও বাংলায় কম। 'ক্ষ' (ক+ষ)-র মতো দু'একটি অক্ষর ছাড়া উচ্চারণ আর বানান একই। 'পঙ্ক্তি'র মতো মাত্র কয়েকটি ব্যতিক্রম চোখে পড়ে।
বানান থেকে উচ্চারণে উহ্য শব্দের অত্যাচার নেই। 'নাইফ' (knife) লিখতে গিয়ে অযথা একটি k সংযোগের মতো ঘটনা বিরল। Beauty লিখতে গিয়ে প্রায় সব স্বরবর্ণের সার বেঁধে দাঁড়ানোর মতো অবস্থাও নেই। Jose লিখে 'হোসে' পড়তে হবে, দীর্ঘ renaissance লিখব, পড়ব রেনেসাঁ অথবা ভার্সাই শহরের নাম লিখতে অতিরিক্ত‘lles লেখার বিড়ম্বনা বাংলা ভাষায় নেই।
বাংলা ভাষা আবেগের ভাষা। সমগ্র মধ্য যুগজুড়ে কাব্য লেখা হয়েছে সে ভাষায়। চণ্ডীদাস, আলাওল, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র থেকে মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ তৈরি করেছেন বাংলার কাব্যভাষা। বাংলা ভাষা যুক্তিরও ভাষা। তা দিয়েই ধর্মের তর্ক করেছেন রামমোহন রায়, বিজ্ঞানের কথা বলেছেন অক্ষয় কুমার দত্ত, জগদীশচন্দ্র বসুরা। আবার গল্প-উপন্যাস-নাটকেরও ভাষা হয়েছে বাংলা। বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলাল রায়রা সে ভাষায় এনেছেন পরিপকস্ফতা। নবরূপে তাকে উপস্থাপনা করেছেন প্রমথ চৌধুরী।
অথচ সেই বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে প্রচলন নিয়ে এখন তর্ক চলে। প্রশাসনের একটা বড় অংশ মনে করে, বাংলা প্রশাসনের সর্বস্তরে বা সব কাজে ব্যবহারের উপযোগী নয়। সমস্যাটি অভ্যাস বদলানোর। ইংরেজ আমলে এ দেশে আইসিএস-বিসিএস গড়ে তোলা হয়েছিল সেকলেতত্ত্ব দিয়ে_ রক্তে ভারতীয় আর মনে ইংরেজ গড়ে। তখন ইংরেজ রাজা আর প্রশাসকরা তার পরিষদ। স্বাধীন দেশে তো সেই প্রজারাই প্রজাতন্ত্রের মালিক প্রশাসকরা তাদের সেবকমাত্র। কিন্তু প্রশাসনের একটা বড় অংশের মানসিকতা দেখে তা তো মনে হয় না। ভাগ্যিস চৈত্র মাসের গরমে সুট পরে অফিস করা বন্ধ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। তবে কাঁটা চামুচ দিয়ে ডাল খাওয়ার দৃশ্য এখনও মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে। প্রশাসনের নথি বা টোকায় যারা বাংলা লিখতে পারেন না, তাদের অধিকাংশ শুদ্ধ ইংরেজিও লিখতে পারেন না বলে ধারণা করি।
আইন-আদালতেও একই অবস্থা। সরকারের কাজকর্মে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক; এর অন্যথা হলে শাস্তির বিধান রয়েছে বলে শুনেছি। আইনের ফাঁক আছে নিশ্চয়ই, নইলে এ অপরাধে শাস্তির কোনো সংবাদ তো গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখিনি। একদিনে না হলেও ধীরে ধীরে কি মাতৃভাষাকে আইনের ভাষা করা যায় না?
আরেক দল বলে, বাংলা প্রযুক্তির ভাষা নয়, কম্পিউটারের ভাষাও নয়। বিশেষজ্ঞরাই এর সঠিক উত্তর জানান। তবে সাধারণ বিবেচনায় মনে প্রশ্ন জাগে, হাজার দুয়েক অক্ষর না চিনলে যে বিনাভাষায় সংবাদপত্র পাঠ করা যায় না; তারা তো চীনা ভাষাতেই কম্পিউটারে কাজ করছে। কানজি, হিরাগানা, কাতাকানা সংবলিত জাপানি ভাষায় প্রযুক্তি জ্ঞানের উৎকর্ষের কথা কেন আমরা ভুলে যাই?
আসলে সমস্যাটার গোড়ায় রয়েছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা। এ দেশে একসময় ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে যেত উচ্চবিত্তরা; পরে মধ্যবিত্তরা তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। উচ্চবেতন গ্রহণের মাধ্যমে ইংরেজি স্কুলগুলো যে আয় করে তা দিয়ে ভবন আর আসবাব সাজায় চকচকে করে। বাংলা স্কুলগুলোতে ভবন বড়। খেলার মাঠ আছে_ তবুও কেমন একটা দীন চেহারা। সরকারি স্কুলে শিক্ষকদের সম্পর্কে ঢালাও অভিযোগ-ক্লাসের চেয়ে টিউশনিতে মনোযোগ বেশি। ইংরেজি স্কুলে শিক্ষকদের থেকে কর্তৃপক্ষ ষোলআনা আদায় করে নিতে পারেন। ফলে যাদের সামান্য সামর্থ্য আছে তাদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি স্কুলে যাচ্ছে। এ অপরাধে আমরা সবাই অপরাধী। ফলে বাংলা স্কুলগুলোও সমান্তরালভাবে চালু করছে তাদের ইংলিশ ভার্সন। এ সমস্যা দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে। এর পরিণতি কী হবে? ইংরেজি তো আর আমাদের মাতৃভাষা হয়ে যাবে না।
আমাদের দেশে মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষায় দানের প্রয়াস ১৯৬০-এর দশক থেকেই। স্বাধীনতা লাভের পর তা বেগবান হয়েছিল; কিন্তু সত্তরের দশকের শেষ থেকে উল্টো যাত্রায় তা ধীরে ধীরে থেমে গেছে। এমন ধারণা বদ্ধমূল করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে যে, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান, চিকিৎসা বা প্রকৌশল বিষয়ে শিক্ষা সম্ভব নয়। চীনা বা জাপানের কথা তখন আবার মনে পড়ে! আসলে বিশ্বজ্ঞানকে অনুবাদ ও রূপান্তরের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় আত্তীকরণ করার কাজটি আমরা ঠিকমতো করতে পারছি না। ইংরেজি শিখছি বলে যতই আনন্দিত হই না কেন, বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় দক্ষ এমন জ্ঞানীর সংখ্যা হাতেগোনা।
এর সঙ্গে নতুন ঝামেলা বিকৃত বাংলা। বাংলা বাক্যের আদি-অন্ত-মধ্যে ইংরেজি শব্দ বসিয়ে একটা খিচুড়ি তৈরি হচ্ছে। সো, বাট প্রভৃতিকে যত্রতত্র সংযোজন, বাক্যের মধ্যে অকারণে 'কিন্তু' ব্যবহার, আঞ্চলিক ভাষার আবরণে অদ্ভুত শব্দ ও উচ্চারণ এবং প্রায় সমগ্র বাক্যে নাসিক্য উচ্চারণ যোগ_ সব মিলিয়ে মাতৃভাষা বাংলার এক বিপর্যস্ত অবস্থা!
তবু এত কিছুর পরও আমরা আশায় বুক বাঁধতে চাই। সংকট-উত্তরণের মতো ঐশ্বর্য মাতৃভাষা বাংলায় আছে।
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি
No comments