মানুষ মারা বার্গেইনিং পয়েন্ট হতে পারে না by বদিউর রহমান
গত
বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এক বছর চুপ থেকে এ বছর ৫ জানুয়ারি
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বেশ কড়াভাবে সরগরম হয়েছে মর্মে
হাল-অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে। এর আগে বিএনপি অন্য কিছু সমাবেশ,
কর্মসূচি, জনসভা অবশ্য করেছে। কিন্তু এবার ৫ জানুয়ারিকে গণতন্ত্র হত্যা
দিবস হিসেবে পালন করার জন্য বিএনপিকে নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে না দেয়ার ফলে
খালেদা জিয়া দৃশ্যত অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে
মুখ-ফসকে লাগাতার অবরোধ দিয়ে বসেন। হেফাজতী-অভিজ্ঞতা থেকে আওয়ামী লীগ সরকার
হয়তো টের পেয়েছে যে, নয়াপল্টনে বিএনপিকে বসতে দিলে তারা হয়তো সরকারের পতন
না ঘটিয়ে সেখান থেকে আর নাও উঠতে পারে। সরকারের বা আওয়ামী লীগের এমন ধারণা
অবশ্যই অমূলক নয়। কারণ হেফাজতী সমাবেশের সময়ে বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া
হেফাজতীদের সাহায্য করার জন্য ঢাকাবাসীকে অনুরোধও করেছিলেন। আমি আগে এক
লেখায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলাম, হেফাজতীদের মতিঝিল থেকে উৎখাত করা
শুধু সরকারের সাহসী পদক্ষেপই ছিল না, বরং সঠিক কাজই ছিল। নচেৎ
ওয়াদাভঙ্গকারী হেফাজতীদের সমাবেশের লংকাকাণ্ডের পর আরও খারাপ-ভয়াবহ
পরিস্থিতি সৃষ্টির সমূহ আশংকা ছিল। ওই সমাবেশকে পুঁজি করে শেখ হাসিনা
সরকারকে ফেলে দেয়ার একটা অপচেষ্টা অবশ্যই হতো। হেফাজতীদের সঙ্গে একাত্মতা
প্রকাশের জন্য যেভাবে অন্য অনেক অগুরুত্বপূর্ণ নেতা মঞ্চে উঠছিলেন, তাতে
মনে হচ্ছিল দেশটা বুঝি শেখ হাসিনা বনাম বাকি সব।
বিডিআর-অঘটনের পর হেফাজতী সমাবেশ সরকারের জন্য এক বড় ধাক্কা ছিল বটে। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পেতেই পারে। অতএব সরকার বিএনপির নয়াপল্টনের সমাবেশ বন্ধ করতে নিজেই ঢাকাকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। হেফাজতীদের সমাবেশ থেকে উৎখাত সঠিক ছিল, খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের ১৬৬ কাঠা বরাদ্দ বাতিলেও আমার আপত্তি ছিল না; কিন্তু চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের প্রতিশোধ হিসেবে জিয়া বিমানবন্দরের নাম কিংবা ভাসানী নভোথিয়েটারের নাম পরিবর্তন সঠিক হয়নি। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার জন্য এ ধরনের নাম পরিবর্তনে যেমন অবদান রেখেছে, তেমনি জিয়ার সঙ্গে খালেদা সরকার প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা পুরস্কার বহাল রেখে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে প্রদত্ত স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিল না করে আরও জঘন্য অপরাধ করেছে। যিনি দেশ দেন, জাতিকে স্বাধীন করেন তার আবার স্বাধীনতা পুরস্কার কিসের? জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর পর্যায়ে জোর করে তোলার জন্য এবং বঙ্গবন্ধুকে জিয়ার পর্যায়ে নামানোর জন্য ২০০৩ সালে শুধু ওই দুজনকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়, আর আওয়ামী লীগও তা মেনে বসে আছে। এ বছর ২৬ মার্চের আগে বঙ্গবন্ধুকে দেয়া স্বাধীনতা পুরস্কার অবশ্যই বাতিল করা হোক।
আমরা এ দেশে রাজনীতিকদের অবদান অস্বীকার করি না, করবও না। বারবার সামরিক শাসন এনেও সময়ের পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, দেশে রাজনীতির বিকল্প নেই। সামরিক শাসন সাময়িক ভূমিকা রাখলেও শেষ পর্যন্ত আবার রাজনীতির / রাজনীতিকদের কাছেই যেতে হয়। তাই যদি না হতো তাহলে জিয়া দল করতে যেতেন না, এরশাদও রাজনীতিক হতে চাইতেন না, মঈনউদ্দীনরাও আবার রাজনীতিকদের দ্বারস্থ হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতেন না। দেশে-বিদেশে তাই তো কেবল দেখছি, জেনারেল সাহেবরা প্রায় ক্ষেত্রেই পরে রাজনীতিক বনে যান। উর্দ্দি ছেড়ে জনতার নেতা হতে লেগে যান। কিন্তু রাজনীতিকদের অবদানের ধারাবাহিকতা তারা অস্বীকার যেমন করতে পারেন না, তেমনি শেষতক তেমন ধারাবাহিকতার সৃষ্টিও করতে পারেন খুব কমই। হালে আমাদের দেশেও সিভিল-মিলিটারি (অব.) আমলাদের অনেককে রাজনীতিক হয়ে যেতে দেখতে হচ্ছে। কিন্তু যারা কোনোভাবেই কোনো দলে ঠাঁই করে নিতে পারেন না বা ঠাঁই নিতে চান না, তেমন কিছু অব. তথাকথিত সিভিল সোসাইটির অংশ হতে লেগে যান। আলোচনা, সেমিনার, টকশোতে, পত্রিকার লেখায় তাদের কারও কারও বেশ বিচরণও দেখা যায়। এসবের মাধ্যমে তাদের সিভিল সোসাইটির সদস্য হওয়ার কনফারমেশনও নাকি হয়। রাজনৈতিক বেয়াদবি আমরা অনেক দেখি। ড. কামাল হোসেনের বাড়ির সামনে আবর্জনা ফেলে দেয়া যেমন রাজনৈতিক বেয়াদবি, তেমনি খালেদা জিয়াকে অফিসে আটকে রাখার জন্য বালুর বা ইটের ট্রাক রেখে দেয়াও বেয়াদবি। রাজনৈতিক শিষ্টাচার থাকলে মরিচ-স্প্রে ধরনের কিছু না মেরে গোলাপজল মারা যেত, সেন্ট মারলে তিনি হয়তো খুশিই হতেন। কিন্তু রাজনীতিকদের রাজনৈতিক বেয়াদবি নিয়ে আমি তত উদ্বিগ্ন নই এজন্য যে, এ দেশে রাজনীতি করতে হলে নাকি একটু-আধটু বেয়াদব হতে হয় এবং তা সংসদের ভেতরেও নিশিকুটুম্ব থেকে চুপ বেয়াদব পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। তবে তথাকথিত সুশীল বা সু-শীল(!)দের সামান্যতম সুযোগসন্ধানী হওয়াও আমার কাছে এ সমাজের শিষ্টাচারহীনতাই মনে হয়।
আমাকেও কেউ কেউ সুশীল বা সু-শীল গোত্রের বলে ফেলেন কখনও-সখনও। কিন্তু আমি এত হাবা যে কোথাও মিশে যেতে পারছি না, ফলে নাকি জাতেও উঠতে পারছি না। প্রথম প্রথম সুশীল-জাতীয় আলোচনায় আমাকে কেউ কেউ আগ্রহভরে ডাকেন, পরে আমার কথাবার্তায় তারা হতাশ হন। কোদালকে কোদাল বললেই যত জ্বালা! সুজন-কুজন যাই বলুন, একটা বলয় রক্ষা করতে হবে, একটা সুরে সুর মেলাতে হবে। সরাসরি অসুবিধা হলে অন্তত নাঁকিসুরেও মিলে থাকতে হবে, তবেই আপনি ওই গোত্রের হতে পারবেন। গান্ধীর নেংটির বদলে গামছা গলায় বেঁধে আপনি গান্ধী সাজুন, অসুবিধা নেই; আপনার সুবিধার জন্য আপনি দেশপ্রেমে বিভোর হয়ে নন্দলাল হোন, তাতেই বা ক্ষতি কী? কিন্তু আপনি কোনো অবস্থায়ই দলভুক্ত বা গোত্রভুক্ত থাকতে হলে ওই দল বা গোত্রের অসন্তুষ্টি ঘটবে জানলে কোদালকে কোদাল বলতে পারবেন না। আওয়ামী লীগে থাকলে না হয় শেখ হাসিনার বক্তব্য আপনার জন্য বাইবেল, বিএনপিতে থাকলে না হয় খালেদা জিয়ার চাহনি আপনার জন্য ঈশারাই কাফি, জামায়াতে থাকলে না হয় রগ কাটলে বেহেশত অবধারিত; কমিউনিস্ট নামধারী, জাসদ-বাসদ অর্থাৎ ইনু-বাদল-রবদের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু (অব.) আমলা বা (অব.) জেনারেলরা, যারা কোনো দলে ভেড়েননি অথচ সুশীল ঢোল বাজাতে পছন্দ করেন, তারা কেন তথাকথিত সুশীল হবেন? তারা কেন কোদালকে কোদাল বলতে পারবেন না? ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ভিন্নকথা, কিন্তু শিয়ালের জোট বাঁধা কেন? তারা কি বোঝেন না যে, সিংহের একবারের গর্জনে বন কাঁপে, অথচ শিয়ালের সারারাত হুক্কা-হুয়ায়ও বনের কোনো খবর হয় না?
অতি সম্প্রতি নাগরিক সমাজ, নাগরিক ঐক্য, সুশীল সমাজ ইত্যাদি নামে বেশ কিছু ডক্টরেট রাজনীতিক-আমলাকে বহুল আলোচিত সংকট নিরসনে তাদের করণীয় নির্ধারণে আগ্রহী হতে দেখা গেল। তারা একটা গোলটেবিল বৈঠকও করলেন, একটা রেজুলেশনও নাকি নিলেন এবং তারপর আর যায় কোথায়- রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি-প্রধানকে চিঠি দিয়ে দিলেন। ভালো কথা, দেশের খারাপ অবস্থায় তাদেরও তো একটা দায়িত্ব রয়েছে, নাকি? কিন্তু তারা কারা, তাদের পূর্বপরিচয় কী? তারা ওই কজনই কি নাগরিক সমাজ? তাদের পেছনে জনসমর্থন কতটুকু আছে? চিঠি লেখক সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কি তার নিজের রাজনৈতিক বিভাজনের চিঠিটির কথা স্মরণ করবেন? আরেক ডক্টরেট সাহেব তো এক সময়ে পদত্যাগ করেই চলে এসেছিলেন, চাকরিতেও ঠিকাদারি নিয়েছিলেন, এখন আবার হুদা সাহেবকে নেতা মানছেন, কিন্তু কেন? ড. কামাল এবং মান্নারা তো হালে পানি না পেয়ে কেবল হা-পিত্যেশ করেই চলেছেন। তাদেরই বা কেমন জনসমর্থন রয়েছে? আসলে এখন একটা মহাসুযোগ যাচ্ছে- যে যেভাবে জাতে উঠতে পারে আর কী! অপসারিত যার দ্বারা তার কাছেই ফিরে যান, বঙ্গবীর বসে যান রাস্তায়, আর এরা কয়েকজন এসে হয়ে যান নাগরিক সমাজ! আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি, এদের উদ্দেশ্য যথেষ্ট স্বচ্ছ নয়। এই যে এক মাস নাগাদ এত অগ্নিদগ্ধ মানুষ মারা গেল, কই এদের তো তখন সোচ্চার দেখলাম না! এখন বিএনপির হরতাল-অবরোধ-পেট্রলবোমা বহাল রেখে সঙের লাফ শুরু করা হলে কি একটা নজির সৃষ্টি হবে না? নজিরটা অবশ্যই পরে খারাপ নজির হতে বাধ্য। তখন খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগও একই কায়দায় লগি-বৈঠা ছেড়ে পেট্রলবোমার নতুন কোনো সংস্করণে লাগাতার জনজীবন অস্থির করে এ ধরনের সুশীলদের মতো সঙের লাফের প্রস্তাব বর্তমান বিএনপির মতো সমর্থন করবে। আমরা কি এ ধারায়ই চলতে থাকব?
রাষ্ট্র যদি তার সর্বোচ্চ শক্তি কাজে লাগিয়ে পেট্রলবোমার জীবননাশের এ দুঃসহ নারকীয়তা থেকে জনগণকে সুরক্ষা না দিতে পারে, তখন বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র হবে। জনগণ তখন একাত্তরের শক্তি নিয়ে নিশ্চয়ই জ্বলে উঠবে। তখন আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হবে, না বিএনপি বাজে দল হবে, তা দেখা যাবে। এখনই যদি আওয়ামী লীগ কোনো সংলাপে অর্থাৎ আগের অভিজ্ঞতায় (অন্তত মান্নান-জলিল সংলাপ) সঙের মতো লাফাতে থাকে তবে আমরা ধরে নেব যে, রাষ্ট্র নিজেই দেশে খারাপ নজির সৃষ্টির সুযোগই বরং করতে চায়। সরকার কঠোর হোক, আইনি ব্যবস্থায় জনজীবন সচল করুক। আর সরকার যদি মনে করে, রাষ্ট্রযন্ত্রের পূর্ণ ব্যবহার করেও তার পক্ষে এ অরাজকতা সামাল দেয়া সম্ভব হবে না, তবে কালবিলম্ব না করে সঙের লাফে শামিল হওয়াই কি উত্তম নয়? আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ-যুবলীগ-শ্রমিক লীগের অনেক কর্মকাণ্ড তাদের নৈতিক মনোবল অবশ্যই কমিয়েছে বটে; কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জঙ্গি কর্মকাণ্ডের বিরোধিতায় তাদের ভূমিকা তো এখনও ফেলনা হয়ে যায়নি। অতএব সঙের লাফে আওয়ামী লীগ ধরা দেবে কী দেবে না, তা গভীরভাবে ভাবতে হবে। মানুষ মারার অপসংস্কৃতি সংলাপের জন্য ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি পাক তা আমরা চাই না, চাইবও না। আমরা সুন্দর রাজনীতি চাই, সুন্দর জীবনও চাই, কোনোক্রমেই মৃত্যুফাঁদকে সংলাপের ভিত্তি হিসেবে দেখতে চাই না।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
বিডিআর-অঘটনের পর হেফাজতী সমাবেশ সরকারের জন্য এক বড় ধাক্কা ছিল বটে। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পেতেই পারে। অতএব সরকার বিএনপির নয়াপল্টনের সমাবেশ বন্ধ করতে নিজেই ঢাকাকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। হেফাজতীদের সমাবেশ থেকে উৎখাত সঠিক ছিল, খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের ১৬৬ কাঠা বরাদ্দ বাতিলেও আমার আপত্তি ছিল না; কিন্তু চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের প্রতিশোধ হিসেবে জিয়া বিমানবন্দরের নাম কিংবা ভাসানী নভোথিয়েটারের নাম পরিবর্তন সঠিক হয়নি। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার জন্য এ ধরনের নাম পরিবর্তনে যেমন অবদান রেখেছে, তেমনি জিয়ার সঙ্গে খালেদা সরকার প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা পুরস্কার বহাল রেখে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে প্রদত্ত স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিল না করে আরও জঘন্য অপরাধ করেছে। যিনি দেশ দেন, জাতিকে স্বাধীন করেন তার আবার স্বাধীনতা পুরস্কার কিসের? জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর পর্যায়ে জোর করে তোলার জন্য এবং বঙ্গবন্ধুকে জিয়ার পর্যায়ে নামানোর জন্য ২০০৩ সালে শুধু ওই দুজনকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়, আর আওয়ামী লীগও তা মেনে বসে আছে। এ বছর ২৬ মার্চের আগে বঙ্গবন্ধুকে দেয়া স্বাধীনতা পুরস্কার অবশ্যই বাতিল করা হোক।
আমরা এ দেশে রাজনীতিকদের অবদান অস্বীকার করি না, করবও না। বারবার সামরিক শাসন এনেও সময়ের পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, দেশে রাজনীতির বিকল্প নেই। সামরিক শাসন সাময়িক ভূমিকা রাখলেও শেষ পর্যন্ত আবার রাজনীতির / রাজনীতিকদের কাছেই যেতে হয়। তাই যদি না হতো তাহলে জিয়া দল করতে যেতেন না, এরশাদও রাজনীতিক হতে চাইতেন না, মঈনউদ্দীনরাও আবার রাজনীতিকদের দ্বারস্থ হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতেন না। দেশে-বিদেশে তাই তো কেবল দেখছি, জেনারেল সাহেবরা প্রায় ক্ষেত্রেই পরে রাজনীতিক বনে যান। উর্দ্দি ছেড়ে জনতার নেতা হতে লেগে যান। কিন্তু রাজনীতিকদের অবদানের ধারাবাহিকতা তারা অস্বীকার যেমন করতে পারেন না, তেমনি শেষতক তেমন ধারাবাহিকতার সৃষ্টিও করতে পারেন খুব কমই। হালে আমাদের দেশেও সিভিল-মিলিটারি (অব.) আমলাদের অনেককে রাজনীতিক হয়ে যেতে দেখতে হচ্ছে। কিন্তু যারা কোনোভাবেই কোনো দলে ঠাঁই করে নিতে পারেন না বা ঠাঁই নিতে চান না, তেমন কিছু অব. তথাকথিত সিভিল সোসাইটির অংশ হতে লেগে যান। আলোচনা, সেমিনার, টকশোতে, পত্রিকার লেখায় তাদের কারও কারও বেশ বিচরণও দেখা যায়। এসবের মাধ্যমে তাদের সিভিল সোসাইটির সদস্য হওয়ার কনফারমেশনও নাকি হয়। রাজনৈতিক বেয়াদবি আমরা অনেক দেখি। ড. কামাল হোসেনের বাড়ির সামনে আবর্জনা ফেলে দেয়া যেমন রাজনৈতিক বেয়াদবি, তেমনি খালেদা জিয়াকে অফিসে আটকে রাখার জন্য বালুর বা ইটের ট্রাক রেখে দেয়াও বেয়াদবি। রাজনৈতিক শিষ্টাচার থাকলে মরিচ-স্প্রে ধরনের কিছু না মেরে গোলাপজল মারা যেত, সেন্ট মারলে তিনি হয়তো খুশিই হতেন। কিন্তু রাজনীতিকদের রাজনৈতিক বেয়াদবি নিয়ে আমি তত উদ্বিগ্ন নই এজন্য যে, এ দেশে রাজনীতি করতে হলে নাকি একটু-আধটু বেয়াদব হতে হয় এবং তা সংসদের ভেতরেও নিশিকুটুম্ব থেকে চুপ বেয়াদব পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। তবে তথাকথিত সুশীল বা সু-শীল(!)দের সামান্যতম সুযোগসন্ধানী হওয়াও আমার কাছে এ সমাজের শিষ্টাচারহীনতাই মনে হয়।
আমাকেও কেউ কেউ সুশীল বা সু-শীল গোত্রের বলে ফেলেন কখনও-সখনও। কিন্তু আমি এত হাবা যে কোথাও মিশে যেতে পারছি না, ফলে নাকি জাতেও উঠতে পারছি না। প্রথম প্রথম সুশীল-জাতীয় আলোচনায় আমাকে কেউ কেউ আগ্রহভরে ডাকেন, পরে আমার কথাবার্তায় তারা হতাশ হন। কোদালকে কোদাল বললেই যত জ্বালা! সুজন-কুজন যাই বলুন, একটা বলয় রক্ষা করতে হবে, একটা সুরে সুর মেলাতে হবে। সরাসরি অসুবিধা হলে অন্তত নাঁকিসুরেও মিলে থাকতে হবে, তবেই আপনি ওই গোত্রের হতে পারবেন। গান্ধীর নেংটির বদলে গামছা গলায় বেঁধে আপনি গান্ধী সাজুন, অসুবিধা নেই; আপনার সুবিধার জন্য আপনি দেশপ্রেমে বিভোর হয়ে নন্দলাল হোন, তাতেই বা ক্ষতি কী? কিন্তু আপনি কোনো অবস্থায়ই দলভুক্ত বা গোত্রভুক্ত থাকতে হলে ওই দল বা গোত্রের অসন্তুষ্টি ঘটবে জানলে কোদালকে কোদাল বলতে পারবেন না। আওয়ামী লীগে থাকলে না হয় শেখ হাসিনার বক্তব্য আপনার জন্য বাইবেল, বিএনপিতে থাকলে না হয় খালেদা জিয়ার চাহনি আপনার জন্য ঈশারাই কাফি, জামায়াতে থাকলে না হয় রগ কাটলে বেহেশত অবধারিত; কমিউনিস্ট নামধারী, জাসদ-বাসদ অর্থাৎ ইনু-বাদল-রবদের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু (অব.) আমলা বা (অব.) জেনারেলরা, যারা কোনো দলে ভেড়েননি অথচ সুশীল ঢোল বাজাতে পছন্দ করেন, তারা কেন তথাকথিত সুশীল হবেন? তারা কেন কোদালকে কোদাল বলতে পারবেন না? ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ভিন্নকথা, কিন্তু শিয়ালের জোট বাঁধা কেন? তারা কি বোঝেন না যে, সিংহের একবারের গর্জনে বন কাঁপে, অথচ শিয়ালের সারারাত হুক্কা-হুয়ায়ও বনের কোনো খবর হয় না?
অতি সম্প্রতি নাগরিক সমাজ, নাগরিক ঐক্য, সুশীল সমাজ ইত্যাদি নামে বেশ কিছু ডক্টরেট রাজনীতিক-আমলাকে বহুল আলোচিত সংকট নিরসনে তাদের করণীয় নির্ধারণে আগ্রহী হতে দেখা গেল। তারা একটা গোলটেবিল বৈঠকও করলেন, একটা রেজুলেশনও নাকি নিলেন এবং তারপর আর যায় কোথায়- রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি-প্রধানকে চিঠি দিয়ে দিলেন। ভালো কথা, দেশের খারাপ অবস্থায় তাদেরও তো একটা দায়িত্ব রয়েছে, নাকি? কিন্তু তারা কারা, তাদের পূর্বপরিচয় কী? তারা ওই কজনই কি নাগরিক সমাজ? তাদের পেছনে জনসমর্থন কতটুকু আছে? চিঠি লেখক সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কি তার নিজের রাজনৈতিক বিভাজনের চিঠিটির কথা স্মরণ করবেন? আরেক ডক্টরেট সাহেব তো এক সময়ে পদত্যাগ করেই চলে এসেছিলেন, চাকরিতেও ঠিকাদারি নিয়েছিলেন, এখন আবার হুদা সাহেবকে নেতা মানছেন, কিন্তু কেন? ড. কামাল এবং মান্নারা তো হালে পানি না পেয়ে কেবল হা-পিত্যেশ করেই চলেছেন। তাদেরই বা কেমন জনসমর্থন রয়েছে? আসলে এখন একটা মহাসুযোগ যাচ্ছে- যে যেভাবে জাতে উঠতে পারে আর কী! অপসারিত যার দ্বারা তার কাছেই ফিরে যান, বঙ্গবীর বসে যান রাস্তায়, আর এরা কয়েকজন এসে হয়ে যান নাগরিক সমাজ! আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি, এদের উদ্দেশ্য যথেষ্ট স্বচ্ছ নয়। এই যে এক মাস নাগাদ এত অগ্নিদগ্ধ মানুষ মারা গেল, কই এদের তো তখন সোচ্চার দেখলাম না! এখন বিএনপির হরতাল-অবরোধ-পেট্রলবোমা বহাল রেখে সঙের লাফ শুরু করা হলে কি একটা নজির সৃষ্টি হবে না? নজিরটা অবশ্যই পরে খারাপ নজির হতে বাধ্য। তখন খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগও একই কায়দায় লগি-বৈঠা ছেড়ে পেট্রলবোমার নতুন কোনো সংস্করণে লাগাতার জনজীবন অস্থির করে এ ধরনের সুশীলদের মতো সঙের লাফের প্রস্তাব বর্তমান বিএনপির মতো সমর্থন করবে। আমরা কি এ ধারায়ই চলতে থাকব?
রাষ্ট্র যদি তার সর্বোচ্চ শক্তি কাজে লাগিয়ে পেট্রলবোমার জীবননাশের এ দুঃসহ নারকীয়তা থেকে জনগণকে সুরক্ষা না দিতে পারে, তখন বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র হবে। জনগণ তখন একাত্তরের শক্তি নিয়ে নিশ্চয়ই জ্বলে উঠবে। তখন আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হবে, না বিএনপি বাজে দল হবে, তা দেখা যাবে। এখনই যদি আওয়ামী লীগ কোনো সংলাপে অর্থাৎ আগের অভিজ্ঞতায় (অন্তত মান্নান-জলিল সংলাপ) সঙের মতো লাফাতে থাকে তবে আমরা ধরে নেব যে, রাষ্ট্র নিজেই দেশে খারাপ নজির সৃষ্টির সুযোগই বরং করতে চায়। সরকার কঠোর হোক, আইনি ব্যবস্থায় জনজীবন সচল করুক। আর সরকার যদি মনে করে, রাষ্ট্রযন্ত্রের পূর্ণ ব্যবহার করেও তার পক্ষে এ অরাজকতা সামাল দেয়া সম্ভব হবে না, তবে কালবিলম্ব না করে সঙের লাফে শামিল হওয়াই কি উত্তম নয়? আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ-যুবলীগ-শ্রমিক লীগের অনেক কর্মকাণ্ড তাদের নৈতিক মনোবল অবশ্যই কমিয়েছে বটে; কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জঙ্গি কর্মকাণ্ডের বিরোধিতায় তাদের ভূমিকা তো এখনও ফেলনা হয়ে যায়নি। অতএব সঙের লাফে আওয়ামী লীগ ধরা দেবে কী দেবে না, তা গভীরভাবে ভাবতে হবে। মানুষ মারার অপসংস্কৃতি সংলাপের জন্য ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি পাক তা আমরা চাই না, চাইবও না। আমরা সুন্দর রাজনীতি চাই, সুন্দর জীবনও চাই, কোনোক্রমেই মৃত্যুফাঁদকে সংলাপের ভিত্তি হিসেবে দেখতে চাই না।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
No comments