জ্বর ও গোঙানির গল্প by মশিউল আলম
অফিসে যাচ্ছিলাম। গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল ট্রাফিক সিগন্যালে। গাড়ির জানালায় টোকা দিচ্ছিল এক ভিক্ষুক। কাচের গায়ে তার আঙুলের ডগার মৃদু আঘাতের শব্দ নরম: টুক্ টুক্ টুক্। জুলজুলে চোখে সে তাকিয়ে ছিল আমার মুখের দিকে। তার চোখ হলুদ, চোখের কোণে লেগে-থাকা পিঁচুটিও হলদেটে। ঠোঁট ফাটা, বাম গালে বিরাট এক কাটা দাগ, চোয়াল তেড়া, নাক বাঁকা। তার ময়লা চুলের জটে নিঃশব্দে হাঁটছিল একটি পোকা; মুখের চারপাশে চক্কর খাচ্ছিল একটা ভোমা মাছি। বললাম, ‘মাফ করেন।’ সে মাফ করল না; ময়লা আঙুলের ডগা দিয়ে টোকা মেরেই চলল আমার গাড়ির জানালার স্বচ্ছ নির্মল কাচে। আমি আবার মাফ চাইলাম। সে জোরে জোরে টোকা মেরে প্রত্যাখ্যান করল আমাকে। আমার মনে হলো, বান্দা নাছোড়, ক্ষমা করবে না। বিরক্তি আর বিস্ময় বোধ হলো—এ কেমন দেশ! এই বিরক্তিমাখা বিস্ময়বোধ নিয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে। আমার গাড়ির জানালার কাচে লোকটার নোংরা আঙুলের টোকা ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠল। নরম টুক্ টুক্ শব্দ ক্রমেই বদলে গিয়ে একসময় হয়ে উঠল প্রবল ধাপ্ ধাপ্ ধাপ্। এবার আমার রাগ হলো, দাঁত কটমট করে চোখ পাকিয়ে তাকালাম লোকটার চোখের দিকে। সে প্রচণ্ড এক ঘুষি মেরে বসল আমার মিৎসুবিশি ল্যান্সারের জানালার মূল্যবান কাচে। কাচ ভেঙে তার হাত কেটে রক্ত ঝরতে লাগল। সেই রক্তাক্ত হাত গাড়ির ভাঙা জানালা গলে চলে এল ভেতরে, চেপে ধরল আমার টুঁটি। আমার গলা থেকে গোঁ গোঁ শব্দ বেরোতে শুরু করল।
গোঙাচ্ছি। প্রলাপ বকছি। কাতরাচ্ছি। জ্বর। বড্ড ভুগছি তিন দিন ধরে। সারা গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। এপাশ ফিরতে ব্যথা, ওপাশ ফিরতে ব্যথা। এপাশ-ওপাশ না ফিরে চুপচাপ শুয়ে থাকলেও ব্যথা। মনে হচ্ছে সারা শরীরের কোষে কোষে চরে বেড়াচ্ছে লক্ষ-কোটি দাঁতাল পোকা, কুটি কুটি করে কেটে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে আমার সারা শরীর। হাত-পায়ের আঙুলে ব্যথা, পাঁজরের হাড়ে ব্যথা, বুকের খাঁচায় ব্যথা, চোখের পাতায় ব্যথা। ঊরুর মাংসে ব্যথাটা এমন, যেন খোঁচানো হচ্ছে শূল দিয়ে। মাথায় এমন যন্ত্রণা, যেন পাগল হয়ে যাচ্ছি। টনটন করছে কপাল আর কপালের দুই পাশ; ব্রহ্মতালুতে পেটানো হচ্ছে ডাঙশ। কিন্তু এ রকম অসহ্য যন্ত্রণা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আমার স্নায়ু জন্ম থেকেই দুর্বল; প্রবল যন্ত্রণা অথবা সুখ কোনোটাই বেশিক্ষণ সইতে পারে না। একসময় ভোঁতা হয়ে যায়, অসাড় হয়ে পড়ে। অথবা এমন নির্বিকার একটা ভাব এসে যায়, যন্ত্রণা পাচ্ছি কি না সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ থাকে না। তখন আমি প্রচুর কথা বলি। জ্বর এলে আমার শুধু কথা বলতে ইচ্ছা করে। কত কথা যে বলি তার ইয়ত্তা নেই। যেমন: এখন হঠাৎ মনে হলো এই কথাটা এখনই বলা দরকার: আমার ছেলেটা বড় হয়ে যাচ্ছে। কথাটা যদি এখনই না বলি তাহলে হয়তো আর কখনোই বলা হবে না, হয়তো আর কখনো মনেই পড়বে না। তার মানে, এর কোনো রেকর্ডই থাকবে না। ব্যাপারটা এমন যেন আমি যত কথা বলি, তার সবই রেকর্ড করা হচ্ছে। কোথাও না কোথাও থেকে যাচ্ছে রেকর্ডগুলো। কথাটা হলো, আমার ছেলের বয়স যখন চার বছর, ওকে স্কুলে নিয়ে যেতাম রিকশায়। রাস্তায় যেতে যেতে লোকজনের প্রাইভেট কার দেখে ও আমাকে বলত, ‘বাবা, আমাদের গাড়ি নাই কেন?’
আমি আজীবন চাকরি করি খবরের কাগজে। বাংলাদেশে কোনো সাংবাদিক চাকরির টাকায় মোটরগাড়ি কিনতে পারে না। খবরের কাগজের অফিস সাংবাদিকদের গাড়ি দেয় এ রকম অসম্ভব কথাও কখনো শুনিনি। কিন্তু কী আশ্চর্য, বছর খানেক পর একদিন আমাদের অফিস খুশি হয়ে কুড়িটা গাড়ি উপহার দিল কুড়িজন কর্মীকে। যারা গাড়ি পেল, আমি তাদের একজন। ছোট্ট, লাল টুকটুকে গাড়িখানা পেয়ে আমার ছেলে কী যে খুশি হয়েছিল, বর্ণনা করা যায় না। ওর বয়স তখন পাঁচ বছর। লাল গাড়িতে চড়ে তার স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু হলো। বছর দু-এক পরে একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে যানজটে আটকা পড়ে সে বলে, ‘বাবা, ছোটমোটো একটা হেলিকপ্টার কিনতে পাওয়া যায় না? তাহলে তো এভাবে জ্যামের মধ্যে আটকে থাকতে হতো না।’ সেই ছেলের বয়স এখন এগারো। এখন সে বলে, ‘বাবা, এই দেশ ভালো না। চলো না, আমরা বিদেশে চলে যাই!’ আমি জানি, ওকে আমি বিদেশে নিয়ে না গেলেও এই দেশে ও থাকবে না। একদিন নিজেই চলে যাবে। ভালো পড়াশোনা করে বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে যদি না-ও পারে, জাহাজে, নৌকায়, পায়ে হেঁটে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে, বনজঙ্গল পার হয়ে কোনো না কোনো বিদেশ-বিভুঁইয়ে সে যাবেই চলে একদিন। এই এগারো বছর বয়সেই যখন ওর নিজের দেশকে এত অপছন্দ, কুড়ি-পঁচিশ বছর বয়স হলে এই মাটিতে সে তিষ্ঠিবে কেমনে?
জ্বরে কষ্ট হয় এ কথা ঠিক, আবার ভালোও লাগে। হ্যাঁ, জ্বর এলে ভালো লাগে। মনে হয়, বেশ একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছি। ভালো লাগে মানে, ঘোর লাগা অবস্থাটা বেশ মজার। শারীরিক কষ্ট পাচ্ছি, গোঙাচ্ছি—এতেও মজা। মজাটা এই রকম: আমি নিজেকে বলছি, গোঙাচ্ছিস, কেমন মজা? জ্বর এলে আরও কী হয়, অনেক কিছু দেখতে পাই। ঘোরের মধ্যে অনেক কিছু দেখা যায়, বোঝা যায়। সুস্থ অবস্থায় ও রকম হয় না। খুব মজা লাগে যখন দেখি আমি, পূর্ণবয়স্ক একটা লোক, দুই বাচ্চার বাপ, আবোলতাবোল বকছি বাচ্চা ছেলের মতো; অনর্গল আওড়াচ্ছি ছেলেবেলায় শেখা ছড়াগুলো। আমার খুব প্রিয় একটা ছড়া ‘ওই দেখা যায় তালগাছ, ওই আমাদের গাঁ’। এবার জ্বরে আমি অনেকগুলো স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নগুলো মজার, দু-একটা ভয়ংকরও ছিল। কিন্তু যতই ভয়ংকর হোক, স্বপ্ন যে স্বপ্নই এটা বোধ হয় স্বপ্নের মধ্যেই টের পাই। এটাও বেশ মজার ব্যাপার: এই ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে মজা পাওয়া। আরেকটা মজার কথা, জ্বরগ্রস্ত অবস্থায় স্বপ্ন দেখতে হলে যে ঘুমিয়ে পড়তে হবে, এ রকম কোনো কথা নেই। আধো-জাগা আধো-ঘুম অবস্থায়ও স্বপ্ন দেখা যায়। মানে, তন্দ্রাভাবের মধ্যে অনায়াসে চলে আসে স্বপ্ন। আকাশে ভেসে বেড়ানো এক মজার স্বপ্ন; কখনো মেঘের রাজ্যে, কখনো মাটি থেকে সামান্য ওপরে, যেমন: একটা দিঘির পানি থেকে দিঘিপাড়ের একটা তালগাছের মাথা পর্যন্ত উঁচুতে আমি ভাসছি, চিত হয়ে, পিঠে যেন টের পাচ্ছি দিঘির শীতল পানির পরশ। স্বপ্ন কী অদ্ভুত ব্যাপার: আমি চিত হয়ে ভাসছি, আমার চোখ আকাশের দিকে, নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছে, আবার একই সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি, দিঘিতে পদ্মফুল ফুটে আছে, কী অপূর্ব সুন্দর শ্বেতপদ্ম, কী গর্বিত ভঙ্গি তাদের। অথচ আমার চোখ আকাশের দিকে, দিঘির পানির দিকে নয়, কারণ আমি ভাসছি চিত হয়ে। তাহলে স্বপ্ন এমনই মজার ব্যাপার, তখন দেখার জন্য চোখেরও দরকার হয় না।
যে রাতে জ্বর এল, রাত গভীর হওয়ার আগে, এক বন্ধুর বাসা থেকে রিকশায় নিজের বাসায় ফেরার পথে ছিনতাইকারী ধরেছিল। গাড়িটা ওয়ার্কশপে ছিল বলে রিকশা ছাড়া উপায় ছিল না। ছুটন্ত রিকশার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা টেনে নামিয়েছিল আমাকে। তারপর কোনো কথা নেই, শুধু মার। এলোপাতাড়ি চড়, থাপ্পড়, ঘুষি, লাথি, কনুইয়ের গুঁতা। আমি বললাম, ‘মারছেন কেন ভাই? কী চান আপনারা?’
ওদের মার থামল না, ‘কী চান?’ বলে পেটাতে পেটাতে একজন বলল, ‘অখনো বোজো নাই?’
আমি বুঝেছিলাম। না বোঝার কিছু ছিল না। মানিব্যাগ বের করে দিলাম। একজন ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিল মোবাইল ফোন, আরেকজন ধমক দিয়ে বলল, ‘ঘড়ি খোল্!’ হাতঘড়ি খুলে দিলাম। ওরা আমার শার্টের পকেট হাতড়ে টাকা না পেয়ে হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে ফেলল তিনটা বোতাম। প্যান্টের সব পকেট হাতড়ে দেখল, চাবির গোছা ছাড়া আর কিছু নেই। তখন একজন আমার পশ্চাদ্দেশে এত জোরে লাথি মারল যে আমি সামনের দিকে ছিটকে পড়ে গেলাম। ওরা দুদ্দাড় চলে গেল। ওরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, যেন রেডি হয়েই ছিল, আশপাশ থেকে এগিয়ে এল কয়েকটা লোক। তাদের কথাবার্তা এই রকমের:
‘নাক দিয়ে তো রক্ত পড়তেছে।’
‘চউক্ষে মলম দেয় নাই?’
‘থানা ত কাছেই, থানায় যান।’
‘হ, পুলিশ জানে কারা অক্ষন এইখানে ডিউটি করতে আছেল।’ আমি বললাম, ‘আপনারা কারা?’ লোকগুলো রাস্তার ঠিক বিপরীতেই দেয়ালের ধার ঘেঁষে বিক্রিযোগ্য ফুলগাছের চারাগুলোর দিকে তাকাল। একজন বলল, ‘হয় থানায় যান, নাইলে বাসায় যান গিয়া। রাত্র হইছে।’ সত্যিই তাই। সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছিল। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওদের মা দরজা খুলে আমার চেহারাসুরত দেখেই নিশ্চিত কণ্ঠে বলেছিল, ‘আবার ছিনতাই?’
আমি হাসার চেষ্টা করে সায় দিয়ে মাথা দুলিয়েছিলাম। বাথরুমের আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম নিজের চেহারা: ভূগোল পাল্টে দিয়েছে। নাক দিয়ে রক্ত চোয়াচ্ছে, বাম চোখের ঠিক ওপরেই একটা গোল আলু। মুখের ভেতরে নোনা স্বাদ। বেসিনে থুতু ফেললাম, রক্ত। ওই রাতেই, তিন বা সাড়ে তিনটার দিকে সারা গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর বাবাজি এসে গেল। জ্বর আমাকে খুব পছন্দ করে। ছিনতাইকারীদের মার না খেলেও আমার জ্বর আসে। প্রতিবছর অন্তত দুবার। জুন-জুলাই মাসে, বা আগস্টে, অথবা সেপ্টেম্বরে—এক দফা জ্বর আসবেই আমার, মাফ করবে না। ডাক্তার বলে, ভাইরাস। ওষুধে মরে না, দিন সাতেকের মধ্যে আপনাআপনিই মরে যায়। ‘ওষুধ খেলে এক সপ্তাহ, না খেলে সাত দিন’—এই কথা বলে হেসেছিল ডাক্তার। ভালো ডাক্তার: মিছামিছি ওষুধ খেতে বলে না। আমি জানি, সব ডাক্তার এ রকম ভালো না। অধিকাংশ ডাক্তার বিনা দরকারে ওষুধ খেতে বলে, তাদের কাছে গেলেই একগাঁদা ওষুধের নাম লিখে দেয়। ওষুধ কোম্পানিগুলোর রিপ্রেজেন্টেটিভরা তাদের খুব প্ররোচিত করে; তারা ডাক্তারদের চেম্বারের সামনে ধরনা দিয়ে বসে থাকে; উপহার দেয়, কাকুতি-মিনতি করে। শুনেছি ওষুধ কোম্পানিগুলো ডাক্তারদের টাকাপয়সাও দেয়। বাংলাদেশে বছরে ছয় হাজার কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি হয়, গবেষকেরা সমীক্ষা-জরিপ করে বলেছেন, এর অর্ধেকটাই অতিরিক্ত, রোগ সারানোর জন্য এত ওষুধের দরকার হয় না।
তো, এই হচ্ছে ব্যাপার: জ্বর এলে আমি শুধু কথা বলি, সব এলোমেলো কথা, সেসব কথা কেউ শোনে না, আমি নিজেই শুধু শুনি, নিজের জন্যই বলি আসলে। অন্য কেউ আমার কথা শুনে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালে আমি চুপ মেরে যাই। তারা ভাবে আমি প্রলাপ বকছিলাম। কিন্তু আমি প্রলাপ বকতে চাই না। অন্তত এটা চাই যে অন্যদের মনে হোক আমি প্রলাপ বকছি। আমি একা নিজে নিজে কথা বলি, নিজে বক্তা, নিজেই শ্রোতা, এই ব্যাপারটা আমি জ্বরের ঘোরে বেশ উপভোগ করি, সম্পূর্ণ একা একা, আর কাউকে ভাগ দিতে চাই না, কারণ আমি জানি আমার মতো করে আর কেউ ভাগ নিতে পারবে না, কারণ তারা আমার এলোমেলো কথা শুনে ভাববে আমি প্রলাপ বকছি, ফলে তারা হাসবে, কিন্তু আমি তো আমার কথাগুলো শুনে নিজে হাসি না, আমার এলোমেলো কথাগুলো আমার ভালো লাগে, আমি সেগুলোকে প্রলাপ বলে মনে করি না। আর যখন সারা শরীর ভীষণ ব্যথা করে—ব্যথা তো লেগেই আছে সব সময়—তবু যখন মনে হয় যে ব্যথাটার বাড় বড্ড বেড়েছে, তখন আমি গোঙাই। গোঙাতে বড় আরাম লাগে। দস্তইয়েফ্স্কির নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড-এ পড়েছিলাম, ভূতলবাসী লোকটা গোঙানির মনোস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে এইভাবে: গুঙিয়ে মানুষ আনন্দ পায়, যদি না পেত, তাহলে কেউ গোঙানোর ধারই ধারত না। আমারও একই মত। আমি গুঙিয়ে আনন্দ না হোক, আরাম পাই। তাই গোঙাতে থাকি। কিন্তু আমার গোঙানি শুনে আমার ছোট্ট মেয়েটা যখন শিয়রের কাছে এসে দাঁড়িয়ে করুণ গলায় বলে, ‘বাবা, কষ্ট হচ্ছে?’ তখন আমার গোঙানি থেমে যায়, আমার কান্না পায়, নিজের কষ্টের জন্য নয়, আমার মেয়ের কষ্টের জন্য। আমাকে গোঙাতে দেখে সে কষ্ট পাচ্ছে দেখে আমার কান্না পায়। আমি আর গোঙাই না, মেয়েকে বলি, ‘না মা, কষ্ট হচ্ছে না। তুমি ও ঘরে যাও, খেলা করো, আমার কাছে থাকলে তোমারও জ্বর আসতে পারে।’ ‘আচ্ছা’ বলে মেয়ে যখন অন্য ঘরে চলে যায়, আমি আবার কঁকিয়ে উঠে গোঙাতে শুরু করি। মেয়ে নিশ্চয়ই আবার আমার গোঙানি শুনতে পায়, কিন্তু সে আর ফিরে এসে একই কথা জিজ্ঞাসা করে না। সে হয়তো বুঝতে পারে, আমার গোঙানি শুনে সে আমার কাছে এসে দাঁড়ালে আমি লজ্জা পাই, কিন্তু বাবাকে সে লজ্জা দিতে চায় না। সে হয়তো তার মাকে গিয়ে বলে, ‘মা, বাবার কষ্ট হচ্ছে।’ তখন হয়তো তার মা আমার ঘরে এসে ঢোকে, সে কোনো ভদ্রতা বজায় রাখে না, সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করে ‘কী হলো, এভাবে গোঙাচ্ছ কেন?’ তার অসংবেদনশীল অভব্যতায় আমার হয়তো রাগ লাগে, আমি হয়তো বলি, ‘মজা পাচ্ছি, আরাম পাচ্ছি। আরাম না পেলে কেউ শুধু শুধু গোঙায়?’
বউ সম্ভবত তখন বুঝে ফেলে যে আমি তার ওপর রেগে গিয়ে অমন কথা বলছি। তখন সে বলে, ‘আমি কি বললাম যে তুমি আরাম পাচ্ছ?’
আমি বলি, ‘না, তুমি বল নাই, কিন্তু গোঙালে আমি সত্যিই সত্যিই আরাম পাই।’ এই কথা আমি অবশ্য রাগ করে বলি না; বলি দস্তইয়েফ্স্কির কথা স্মরণ করে। দস্তইয়েফ্স্কির ওই ভূতলবাসী ছিল উনিশ শতকের শিক্ষিত ভদ্রলোক। আর আমি একুশ শতকের উচ্চশিক্ষিত নাগরিক। আমার গোঙানি আরও বেশি আরামদায়ক, আরও বেশি সফিস্টিকেটেড। কিন্তু আমি যতটা ভাবি আমার বউ ততটা অসংবেদনশীল নয়। সে আমাকে দরদের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে? মাথায় পানি ঢালব?’
আমি বলি, ‘ঢালো, তুমি আমার মাথায় পানি ঢালবে আর আমি দুই চোখ বন্ধ করে আরামে গোঙাব। গোঙানোর মতো আরাম আর কোনো কিছুতে নাই।’ ‘পাগলের গুষ্টি’ বলে বিড়বিড় করতে করতে বউ চলে যায়। কিছুক্ষণ পরেই বালতি ভরে পানি আর পলিথিন নিয়ে ফিরে আসে। আমার শিয়রের পাশে মোড়ায় বসে ঠান্ডা পানি ঢালতে শুরু করে আমার মাথায়, আর আমি মনের সুখে গোঙাতে আরম্ভ করি। গোঙাতে গোঙাতে হঠাৎ আমার মেয়ের কথা মনে পড়ে যায়, তখন বউকে বলি, ‘বুড়ি যেন এখন এই ঘরে না আসে।’ বউ কিছু বলে না। নীরবে আমার মাথায় পানি ঢালতে থাকে, আর আমি মনের সুখে গোঙাই। গোঙাতে গোঙাতে আমার চোখজুড়ে ভারী হয়ে ঘুম নেমে এল। আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম: সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে হাতিরঝিলের পাড়ে ইট বিছানো পথ। সেই পথের ধারে বসে হাতিরঝিলের দিকে চেয়ে আকাশের দিকে গলা বাড়িয়ে গান গাচ্ছে একটা নেড়ি কুকুর: আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
কী রে? আমার মনে হলো কুকুরটা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে ভেঙাচ্ছে। ভীষণ জোরে ধমক দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম: ‘হেই!’
কুকুরটা ঝট করে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে চেয়ে গলা বাড়িয়ে বলল, ‘ঘেউ!’ সেই ঘেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল এক হলকা আগুন। ঠিক সেই মুহূর্তে আমাকে পেরিয়ে যাচ্ছিল এক টোকাই, তার হাতে একটা জেরিক্যান, সেটাতে কী ছিল কে জানে, কুকুরটার মুখের আগুনের হলকা এসে পড়ল তার জেরিক্যানের ওপর, সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল জেরিক্যান। টোকাইটা ‘উরে, মা রে’ বলে জেরিক্যানটি ছুড়ে মারল সোনারগাঁও হোটেলের দিকে, সেটি গিয়ে পড়ল হোটেলের সীমানাপ্রাচীর পেরিয়ে ভেতরের লনে। সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন, শহরজুড়ে বেজে উঠল দমকল বাহিনীর সাইরেন।
আমার জ্বর ছুটে গেল। আমি বউকে পানি ঢালা বন্ধ করতে বলে উঠে বসলাম। তার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বললাম, ‘শহরে আগুন লেগেছে। বুড়িকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।’
বউ চোখ দুটি আলুর মতো বড় বড় করে চেয়ে রইল আমার মুখের দিকে।
আমি আবার বললাম, ‘আগুন লেগেছে।’
গোঙাচ্ছি। প্রলাপ বকছি। কাতরাচ্ছি। জ্বর। বড্ড ভুগছি তিন দিন ধরে। সারা গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। এপাশ ফিরতে ব্যথা, ওপাশ ফিরতে ব্যথা। এপাশ-ওপাশ না ফিরে চুপচাপ শুয়ে থাকলেও ব্যথা। মনে হচ্ছে সারা শরীরের কোষে কোষে চরে বেড়াচ্ছে লক্ষ-কোটি দাঁতাল পোকা, কুটি কুটি করে কেটে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে আমার সারা শরীর। হাত-পায়ের আঙুলে ব্যথা, পাঁজরের হাড়ে ব্যথা, বুকের খাঁচায় ব্যথা, চোখের পাতায় ব্যথা। ঊরুর মাংসে ব্যথাটা এমন, যেন খোঁচানো হচ্ছে শূল দিয়ে। মাথায় এমন যন্ত্রণা, যেন পাগল হয়ে যাচ্ছি। টনটন করছে কপাল আর কপালের দুই পাশ; ব্রহ্মতালুতে পেটানো হচ্ছে ডাঙশ। কিন্তু এ রকম অসহ্য যন্ত্রণা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আমার স্নায়ু জন্ম থেকেই দুর্বল; প্রবল যন্ত্রণা অথবা সুখ কোনোটাই বেশিক্ষণ সইতে পারে না। একসময় ভোঁতা হয়ে যায়, অসাড় হয়ে পড়ে। অথবা এমন নির্বিকার একটা ভাব এসে যায়, যন্ত্রণা পাচ্ছি কি না সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ থাকে না। তখন আমি প্রচুর কথা বলি। জ্বর এলে আমার শুধু কথা বলতে ইচ্ছা করে। কত কথা যে বলি তার ইয়ত্তা নেই। যেমন: এখন হঠাৎ মনে হলো এই কথাটা এখনই বলা দরকার: আমার ছেলেটা বড় হয়ে যাচ্ছে। কথাটা যদি এখনই না বলি তাহলে হয়তো আর কখনোই বলা হবে না, হয়তো আর কখনো মনেই পড়বে না। তার মানে, এর কোনো রেকর্ডই থাকবে না। ব্যাপারটা এমন যেন আমি যত কথা বলি, তার সবই রেকর্ড করা হচ্ছে। কোথাও না কোথাও থেকে যাচ্ছে রেকর্ডগুলো। কথাটা হলো, আমার ছেলের বয়স যখন চার বছর, ওকে স্কুলে নিয়ে যেতাম রিকশায়। রাস্তায় যেতে যেতে লোকজনের প্রাইভেট কার দেখে ও আমাকে বলত, ‘বাবা, আমাদের গাড়ি নাই কেন?’
আমি আজীবন চাকরি করি খবরের কাগজে। বাংলাদেশে কোনো সাংবাদিক চাকরির টাকায় মোটরগাড়ি কিনতে পারে না। খবরের কাগজের অফিস সাংবাদিকদের গাড়ি দেয় এ রকম অসম্ভব কথাও কখনো শুনিনি। কিন্তু কী আশ্চর্য, বছর খানেক পর একদিন আমাদের অফিস খুশি হয়ে কুড়িটা গাড়ি উপহার দিল কুড়িজন কর্মীকে। যারা গাড়ি পেল, আমি তাদের একজন। ছোট্ট, লাল টুকটুকে গাড়িখানা পেয়ে আমার ছেলে কী যে খুশি হয়েছিল, বর্ণনা করা যায় না। ওর বয়স তখন পাঁচ বছর। লাল গাড়িতে চড়ে তার স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু হলো। বছর দু-এক পরে একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে যানজটে আটকা পড়ে সে বলে, ‘বাবা, ছোটমোটো একটা হেলিকপ্টার কিনতে পাওয়া যায় না? তাহলে তো এভাবে জ্যামের মধ্যে আটকে থাকতে হতো না।’ সেই ছেলের বয়স এখন এগারো। এখন সে বলে, ‘বাবা, এই দেশ ভালো না। চলো না, আমরা বিদেশে চলে যাই!’ আমি জানি, ওকে আমি বিদেশে নিয়ে না গেলেও এই দেশে ও থাকবে না। একদিন নিজেই চলে যাবে। ভালো পড়াশোনা করে বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে যদি না-ও পারে, জাহাজে, নৌকায়, পায়ে হেঁটে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে, বনজঙ্গল পার হয়ে কোনো না কোনো বিদেশ-বিভুঁইয়ে সে যাবেই চলে একদিন। এই এগারো বছর বয়সেই যখন ওর নিজের দেশকে এত অপছন্দ, কুড়ি-পঁচিশ বছর বয়স হলে এই মাটিতে সে তিষ্ঠিবে কেমনে?
জ্বরে কষ্ট হয় এ কথা ঠিক, আবার ভালোও লাগে। হ্যাঁ, জ্বর এলে ভালো লাগে। মনে হয়, বেশ একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছি। ভালো লাগে মানে, ঘোর লাগা অবস্থাটা বেশ মজার। শারীরিক কষ্ট পাচ্ছি, গোঙাচ্ছি—এতেও মজা। মজাটা এই রকম: আমি নিজেকে বলছি, গোঙাচ্ছিস, কেমন মজা? জ্বর এলে আরও কী হয়, অনেক কিছু দেখতে পাই। ঘোরের মধ্যে অনেক কিছু দেখা যায়, বোঝা যায়। সুস্থ অবস্থায় ও রকম হয় না। খুব মজা লাগে যখন দেখি আমি, পূর্ণবয়স্ক একটা লোক, দুই বাচ্চার বাপ, আবোলতাবোল বকছি বাচ্চা ছেলের মতো; অনর্গল আওড়াচ্ছি ছেলেবেলায় শেখা ছড়াগুলো। আমার খুব প্রিয় একটা ছড়া ‘ওই দেখা যায় তালগাছ, ওই আমাদের গাঁ’। এবার জ্বরে আমি অনেকগুলো স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নগুলো মজার, দু-একটা ভয়ংকরও ছিল। কিন্তু যতই ভয়ংকর হোক, স্বপ্ন যে স্বপ্নই এটা বোধ হয় স্বপ্নের মধ্যেই টের পাই। এটাও বেশ মজার ব্যাপার: এই ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে মজা পাওয়া। আরেকটা মজার কথা, জ্বরগ্রস্ত অবস্থায় স্বপ্ন দেখতে হলে যে ঘুমিয়ে পড়তে হবে, এ রকম কোনো কথা নেই। আধো-জাগা আধো-ঘুম অবস্থায়ও স্বপ্ন দেখা যায়। মানে, তন্দ্রাভাবের মধ্যে অনায়াসে চলে আসে স্বপ্ন। আকাশে ভেসে বেড়ানো এক মজার স্বপ্ন; কখনো মেঘের রাজ্যে, কখনো মাটি থেকে সামান্য ওপরে, যেমন: একটা দিঘির পানি থেকে দিঘিপাড়ের একটা তালগাছের মাথা পর্যন্ত উঁচুতে আমি ভাসছি, চিত হয়ে, পিঠে যেন টের পাচ্ছি দিঘির শীতল পানির পরশ। স্বপ্ন কী অদ্ভুত ব্যাপার: আমি চিত হয়ে ভাসছি, আমার চোখ আকাশের দিকে, নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছে, আবার একই সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি, দিঘিতে পদ্মফুল ফুটে আছে, কী অপূর্ব সুন্দর শ্বেতপদ্ম, কী গর্বিত ভঙ্গি তাদের। অথচ আমার চোখ আকাশের দিকে, দিঘির পানির দিকে নয়, কারণ আমি ভাসছি চিত হয়ে। তাহলে স্বপ্ন এমনই মজার ব্যাপার, তখন দেখার জন্য চোখেরও দরকার হয় না।
যে রাতে জ্বর এল, রাত গভীর হওয়ার আগে, এক বন্ধুর বাসা থেকে রিকশায় নিজের বাসায় ফেরার পথে ছিনতাইকারী ধরেছিল। গাড়িটা ওয়ার্কশপে ছিল বলে রিকশা ছাড়া উপায় ছিল না। ছুটন্ত রিকশার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা টেনে নামিয়েছিল আমাকে। তারপর কোনো কথা নেই, শুধু মার। এলোপাতাড়ি চড়, থাপ্পড়, ঘুষি, লাথি, কনুইয়ের গুঁতা। আমি বললাম, ‘মারছেন কেন ভাই? কী চান আপনারা?’
ওদের মার থামল না, ‘কী চান?’ বলে পেটাতে পেটাতে একজন বলল, ‘অখনো বোজো নাই?’
আমি বুঝেছিলাম। না বোঝার কিছু ছিল না। মানিব্যাগ বের করে দিলাম। একজন ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিল মোবাইল ফোন, আরেকজন ধমক দিয়ে বলল, ‘ঘড়ি খোল্!’ হাতঘড়ি খুলে দিলাম। ওরা আমার শার্টের পকেট হাতড়ে টাকা না পেয়ে হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে ফেলল তিনটা বোতাম। প্যান্টের সব পকেট হাতড়ে দেখল, চাবির গোছা ছাড়া আর কিছু নেই। তখন একজন আমার পশ্চাদ্দেশে এত জোরে লাথি মারল যে আমি সামনের দিকে ছিটকে পড়ে গেলাম। ওরা দুদ্দাড় চলে গেল। ওরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, যেন রেডি হয়েই ছিল, আশপাশ থেকে এগিয়ে এল কয়েকটা লোক। তাদের কথাবার্তা এই রকমের:
‘নাক দিয়ে তো রক্ত পড়তেছে।’
‘চউক্ষে মলম দেয় নাই?’
‘থানা ত কাছেই, থানায় যান।’
‘হ, পুলিশ জানে কারা অক্ষন এইখানে ডিউটি করতে আছেল।’ আমি বললাম, ‘আপনারা কারা?’ লোকগুলো রাস্তার ঠিক বিপরীতেই দেয়ালের ধার ঘেঁষে বিক্রিযোগ্য ফুলগাছের চারাগুলোর দিকে তাকাল। একজন বলল, ‘হয় থানায় যান, নাইলে বাসায় যান গিয়া। রাত্র হইছে।’ সত্যিই তাই। সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছিল। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওদের মা দরজা খুলে আমার চেহারাসুরত দেখেই নিশ্চিত কণ্ঠে বলেছিল, ‘আবার ছিনতাই?’
আমি হাসার চেষ্টা করে সায় দিয়ে মাথা দুলিয়েছিলাম। বাথরুমের আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম নিজের চেহারা: ভূগোল পাল্টে দিয়েছে। নাক দিয়ে রক্ত চোয়াচ্ছে, বাম চোখের ঠিক ওপরেই একটা গোল আলু। মুখের ভেতরে নোনা স্বাদ। বেসিনে থুতু ফেললাম, রক্ত। ওই রাতেই, তিন বা সাড়ে তিনটার দিকে সারা গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর বাবাজি এসে গেল। জ্বর আমাকে খুব পছন্দ করে। ছিনতাইকারীদের মার না খেলেও আমার জ্বর আসে। প্রতিবছর অন্তত দুবার। জুন-জুলাই মাসে, বা আগস্টে, অথবা সেপ্টেম্বরে—এক দফা জ্বর আসবেই আমার, মাফ করবে না। ডাক্তার বলে, ভাইরাস। ওষুধে মরে না, দিন সাতেকের মধ্যে আপনাআপনিই মরে যায়। ‘ওষুধ খেলে এক সপ্তাহ, না খেলে সাত দিন’—এই কথা বলে হেসেছিল ডাক্তার। ভালো ডাক্তার: মিছামিছি ওষুধ খেতে বলে না। আমি জানি, সব ডাক্তার এ রকম ভালো না। অধিকাংশ ডাক্তার বিনা দরকারে ওষুধ খেতে বলে, তাদের কাছে গেলেই একগাঁদা ওষুধের নাম লিখে দেয়। ওষুধ কোম্পানিগুলোর রিপ্রেজেন্টেটিভরা তাদের খুব প্ররোচিত করে; তারা ডাক্তারদের চেম্বারের সামনে ধরনা দিয়ে বসে থাকে; উপহার দেয়, কাকুতি-মিনতি করে। শুনেছি ওষুধ কোম্পানিগুলো ডাক্তারদের টাকাপয়সাও দেয়। বাংলাদেশে বছরে ছয় হাজার কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি হয়, গবেষকেরা সমীক্ষা-জরিপ করে বলেছেন, এর অর্ধেকটাই অতিরিক্ত, রোগ সারানোর জন্য এত ওষুধের দরকার হয় না।
তো, এই হচ্ছে ব্যাপার: জ্বর এলে আমি শুধু কথা বলি, সব এলোমেলো কথা, সেসব কথা কেউ শোনে না, আমি নিজেই শুধু শুনি, নিজের জন্যই বলি আসলে। অন্য কেউ আমার কথা শুনে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালে আমি চুপ মেরে যাই। তারা ভাবে আমি প্রলাপ বকছিলাম। কিন্তু আমি প্রলাপ বকতে চাই না। অন্তত এটা চাই যে অন্যদের মনে হোক আমি প্রলাপ বকছি। আমি একা নিজে নিজে কথা বলি, নিজে বক্তা, নিজেই শ্রোতা, এই ব্যাপারটা আমি জ্বরের ঘোরে বেশ উপভোগ করি, সম্পূর্ণ একা একা, আর কাউকে ভাগ দিতে চাই না, কারণ আমি জানি আমার মতো করে আর কেউ ভাগ নিতে পারবে না, কারণ তারা আমার এলোমেলো কথা শুনে ভাববে আমি প্রলাপ বকছি, ফলে তারা হাসবে, কিন্তু আমি তো আমার কথাগুলো শুনে নিজে হাসি না, আমার এলোমেলো কথাগুলো আমার ভালো লাগে, আমি সেগুলোকে প্রলাপ বলে মনে করি না। আর যখন সারা শরীর ভীষণ ব্যথা করে—ব্যথা তো লেগেই আছে সব সময়—তবু যখন মনে হয় যে ব্যথাটার বাড় বড্ড বেড়েছে, তখন আমি গোঙাই। গোঙাতে বড় আরাম লাগে। দস্তইয়েফ্স্কির নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড-এ পড়েছিলাম, ভূতলবাসী লোকটা গোঙানির মনোস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে এইভাবে: গুঙিয়ে মানুষ আনন্দ পায়, যদি না পেত, তাহলে কেউ গোঙানোর ধারই ধারত না। আমারও একই মত। আমি গুঙিয়ে আনন্দ না হোক, আরাম পাই। তাই গোঙাতে থাকি। কিন্তু আমার গোঙানি শুনে আমার ছোট্ট মেয়েটা যখন শিয়রের কাছে এসে দাঁড়িয়ে করুণ গলায় বলে, ‘বাবা, কষ্ট হচ্ছে?’ তখন আমার গোঙানি থেমে যায়, আমার কান্না পায়, নিজের কষ্টের জন্য নয়, আমার মেয়ের কষ্টের জন্য। আমাকে গোঙাতে দেখে সে কষ্ট পাচ্ছে দেখে আমার কান্না পায়। আমি আর গোঙাই না, মেয়েকে বলি, ‘না মা, কষ্ট হচ্ছে না। তুমি ও ঘরে যাও, খেলা করো, আমার কাছে থাকলে তোমারও জ্বর আসতে পারে।’ ‘আচ্ছা’ বলে মেয়ে যখন অন্য ঘরে চলে যায়, আমি আবার কঁকিয়ে উঠে গোঙাতে শুরু করি। মেয়ে নিশ্চয়ই আবার আমার গোঙানি শুনতে পায়, কিন্তু সে আর ফিরে এসে একই কথা জিজ্ঞাসা করে না। সে হয়তো বুঝতে পারে, আমার গোঙানি শুনে সে আমার কাছে এসে দাঁড়ালে আমি লজ্জা পাই, কিন্তু বাবাকে সে লজ্জা দিতে চায় না। সে হয়তো তার মাকে গিয়ে বলে, ‘মা, বাবার কষ্ট হচ্ছে।’ তখন হয়তো তার মা আমার ঘরে এসে ঢোকে, সে কোনো ভদ্রতা বজায় রাখে না, সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করে ‘কী হলো, এভাবে গোঙাচ্ছ কেন?’ তার অসংবেদনশীল অভব্যতায় আমার হয়তো রাগ লাগে, আমি হয়তো বলি, ‘মজা পাচ্ছি, আরাম পাচ্ছি। আরাম না পেলে কেউ শুধু শুধু গোঙায়?’
বউ সম্ভবত তখন বুঝে ফেলে যে আমি তার ওপর রেগে গিয়ে অমন কথা বলছি। তখন সে বলে, ‘আমি কি বললাম যে তুমি আরাম পাচ্ছ?’
আমি বলি, ‘না, তুমি বল নাই, কিন্তু গোঙালে আমি সত্যিই সত্যিই আরাম পাই।’ এই কথা আমি অবশ্য রাগ করে বলি না; বলি দস্তইয়েফ্স্কির কথা স্মরণ করে। দস্তইয়েফ্স্কির ওই ভূতলবাসী ছিল উনিশ শতকের শিক্ষিত ভদ্রলোক। আর আমি একুশ শতকের উচ্চশিক্ষিত নাগরিক। আমার গোঙানি আরও বেশি আরামদায়ক, আরও বেশি সফিস্টিকেটেড। কিন্তু আমি যতটা ভাবি আমার বউ ততটা অসংবেদনশীল নয়। সে আমাকে দরদের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে? মাথায় পানি ঢালব?’
আমি বলি, ‘ঢালো, তুমি আমার মাথায় পানি ঢালবে আর আমি দুই চোখ বন্ধ করে আরামে গোঙাব। গোঙানোর মতো আরাম আর কোনো কিছুতে নাই।’ ‘পাগলের গুষ্টি’ বলে বিড়বিড় করতে করতে বউ চলে যায়। কিছুক্ষণ পরেই বালতি ভরে পানি আর পলিথিন নিয়ে ফিরে আসে। আমার শিয়রের পাশে মোড়ায় বসে ঠান্ডা পানি ঢালতে শুরু করে আমার মাথায়, আর আমি মনের সুখে গোঙাতে আরম্ভ করি। গোঙাতে গোঙাতে হঠাৎ আমার মেয়ের কথা মনে পড়ে যায়, তখন বউকে বলি, ‘বুড়ি যেন এখন এই ঘরে না আসে।’ বউ কিছু বলে না। নীরবে আমার মাথায় পানি ঢালতে থাকে, আর আমি মনের সুখে গোঙাই। গোঙাতে গোঙাতে আমার চোখজুড়ে ভারী হয়ে ঘুম নেমে এল। আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম: সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে হাতিরঝিলের পাড়ে ইট বিছানো পথ। সেই পথের ধারে বসে হাতিরঝিলের দিকে চেয়ে আকাশের দিকে গলা বাড়িয়ে গান গাচ্ছে একটা নেড়ি কুকুর: আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
কী রে? আমার মনে হলো কুকুরটা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে ভেঙাচ্ছে। ভীষণ জোরে ধমক দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম: ‘হেই!’
কুকুরটা ঝট করে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে চেয়ে গলা বাড়িয়ে বলল, ‘ঘেউ!’ সেই ঘেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল এক হলকা আগুন। ঠিক সেই মুহূর্তে আমাকে পেরিয়ে যাচ্ছিল এক টোকাই, তার হাতে একটা জেরিক্যান, সেটাতে কী ছিল কে জানে, কুকুরটার মুখের আগুনের হলকা এসে পড়ল তার জেরিক্যানের ওপর, সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল জেরিক্যান। টোকাইটা ‘উরে, মা রে’ বলে জেরিক্যানটি ছুড়ে মারল সোনারগাঁও হোটেলের দিকে, সেটি গিয়ে পড়ল হোটেলের সীমানাপ্রাচীর পেরিয়ে ভেতরের লনে। সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন, শহরজুড়ে বেজে উঠল দমকল বাহিনীর সাইরেন।
আমার জ্বর ছুটে গেল। আমি বউকে পানি ঢালা বন্ধ করতে বলে উঠে বসলাম। তার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বললাম, ‘শহরে আগুন লেগেছে। বুড়িকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।’
বউ চোখ দুটি আলুর মতো বড় বড় করে চেয়ে রইল আমার মুখের দিকে।
আমি আবার বললাম, ‘আগুন লেগেছে।’
No comments