দুই পক্ষের জেতার আশা বনাম দীর্ঘস্থায়ী সংকট by আলী রীয়াজ
দেশে
বিরাজমান অস্বাভাবিক পরিস্থিতিকে ‘অচলাবস্থা’ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
এই অবস্থা নিরসনের জন্য দেশের ভেতরের বিভিন্ন মহলের এবং আন্তর্জাতিক সমাজের
আবেদন-নিবেদন সত্ত্বেও অবস্থার আশু পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে
না। যেকোনো অচলাবস্থার ক্ষেত্রে যা ঘটে, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু
ঘটছে না। সরকার ও বিরোধীপক্ষ এখন আশু কোনো সমাধানের বিষয়ে ভাবিত বলে মনে হয়
না। উভয় পক্ষ অনুমান বা আশা করছে যে প্রতিপক্ষের সঞ্চিত শক্তি এবং তার
প্রতি সমর্থন একসময় শেষ হতে বাধ্য, সম্ভবত সেটা খুব দূরে নয়; ফলে তারা
অবশ্যই বিজয়ী হবে, এটি কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। সরকার ও সরকারি দলের
অবস্থান এই রকম যে যেহেতু সহিংসতা, বিশেষ করে পেট্রলবোমা হামলা এবং
সংশ্লিষ্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাবলি অবরোধের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে এবং
তার সঙ্গেই যুক্ত বলে সাধারণ মানুষের কাছে মনে হচ্ছে, সেহেতু বিএনপির
পক্ষে এই পরিস্থিতি আর বেশি দিন অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। তারা এটাও আশা
করছে যে ইতিমধ্যে যেহেতু বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের ডাকা হরতাল কার্যকারিতা
হারিয়ে ফেলছে, সেহেতু অচিরেই সাধারণ মানুষই সরকারের পক্ষে তা প্রতিহত
করবে। এ ধরনের আশা থেকেই সরকার গোড়াতে এক সপ্তাহের মধ্যে অবস্থার উন্নতি
ঘটবে বলে ঘোষণা দিয়ে আসছিল, সেটা এখন দেড় মাসের বেশি সময় ধরে চললেও এর
পরিণতি নিয়ে সরকারকে খুব বেশি উদ্বিগ্ন মনে হয় না। অন্যপক্ষে বিএনপি সম্ভবত
এই আশা করছে যে বিরাজমান অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে নাগরিকেরা
সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন, যা তাদের অনুকূলে আসবে। এ ধরনের মনোভাব ও
সমস্যা সমাধানের কৌশল অচলাবস্থার চিরায়ত লক্ষণ। দুই পক্ষ ধরে নেয় যে সময়ের
সঙ্গে সঙ্গে সমাধান তৈরি হবে।
পৃথিবীতে যেসব দেশ দীর্ঘমেয়াদি অভ্যন্তরীণ সংকটে নিপতিত হয়েছে, সেসব দেশের ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে গোড়াতে উভয় পক্ষ স্বল্পসময়ে বিজয়ী হওয়ার আশায় দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে; সে ক্ষেত্রে লক্ষ্যও থাকে সীমিত। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতা বা তা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারা এই সংকটকে দীর্ঘসূত্রী করে তোলে। এই প্রক্রিয়ায় একেক পক্ষ একেক সময়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে এবং তারা সেটাকে ঘটনাধারা তাদের অনুকূলে আসার লক্ষণ বলে মনে করে। ফলে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনের আগ্রহ কমতে থাকে। এখানে এটাও স্মরণ করা দরকার, সংকট যতই দীর্ঘমেয়াদি হয়, ততই আশু লক্ষ্যের বিষয়গুলো থেকে দৃষ্টি সরে যায়, নতুন নতুন বিষয় তাতে যুক্ত হয়, সংকটের চরিত্র ও প্রকৃতিতেও পরিবর্তন ঘটে। শুধু তা-ই নয়, এ ধরনের ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে দুই পক্ষের শক্তিতে বদল ঘটে থাকে।
বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে মনে হয় যে দেশ সেই পথেই অগ্রসর হতে শুরু করেছে। দেড় মাস আগে যখন এই পরিস্থিতির সূচনা হয়, তখন যেসব বিষয় ছিল রাজনীতির মুখ্য বিষয়, ক্রমাগতভাবে তা থেকে আলোচনা সরে এসেছে বলেই মনে হয়। এ ক্ষেত্রে সরকার ও সরকারি দল সফল। একসময় যারা বিএনপি ও বিরোধী জোটকে শক্তিহীন বলে উপহাস করেছে, তারা এখন দেখাতে চায় যে দলটি সারা দেশে, তাদের ভাষায় ‘বিচ্ছিন্নভাবে’ হলেও, অব্যাহতভাবে সহিংসতা চালানোর মতো একটি জোট। এ ক্ষেত্রে বিএনপি যে তার দাবির পক্ষে তার কর্মীদের রাজপথে সমবেত করতে ব্যর্থ হয়েছে, বিশেষ করে বড় শহরগুলোয় তাদের সাংগঠনিক উপস্থিতির কোনো প্রমাণ রাখতে পারেনি, সেটা সরকারের পক্ষেই গেছে। এ জন্য বিএনপি যে যুক্তিই দাঁড় করাক না কেন, সেটা দেশে ও দেশের বাইরে কেউ গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছে না। সামগ্রিক রাজনৈতিক সংকটের পেছনে যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একপক্ষীয় নির্বাচনের কোনো ভূমিকা রয়েছে এবং পরিস্থিতির সমাধানের লক্ষ্যে সে বিষয়ে মনোনিবেশ করা জরুরি, সেখান থেকে সাধারণ মানুষের আলোচনা কেবল সহিংসতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। যদিও বিএনপি এই দাবি করতে পারে যে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারাটা তাদের সাফল্যের দিক।
যেকোনো সংকট দীর্ঘসূত্রী হয়ে ওঠার লক্ষণ হলো যে সমাজে ও রাজনীতিতে কিছু কিছু প্রবণতার গ্রহণযোগ্যতা লাভ। অর্থাৎ নাগরিকদের মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে মেনে নেওয়ার প্রবণতা। গত দেড় মাসের ঘটনাপ্রবাহ এবং আগে ২০১৩ সাল থেকে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে দুই ধরনের সহিংসতা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। একদিকে বিরোধী দল কর্তৃক এবং তাদের নামে সংঘটিত সহিংসতা। বাংলাদেশে অতীতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিরাজমান সহিংসতাকে সাময়িক ও ব্যতিক্রমী বলে বিবেচনা করা হলেও এখন মনে হয় তা স্বাভাবিক বলেই মেনে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। এসব ঘটনার তদন্ত, দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা, তাদের বিচারের সম্মুখীন করার কোনো তাগিদ যেমন সরকারের পক্ষে দেখা যায়নি, তেমনি সমাজের ভেতরে থেকেও এই নিয়ে দাবি ওঠেনি। এটি নাগরিকদের মধ্যে আইন ও বিচার–প্রক্রিয়ার ব্যাপারে আস্থাহীনতাই প্রমাণ করে। তাঁরা ধরেই নিচ্ছেন যে এই বিষয়ে বাক্যব্যয় নিরর্থক। ২০১৩ সালে থেকে এযাবৎ রাজনৈতিক সহিংসতা বিষয়ে সরকার ও সরকারি দলের নেতারা যত কথা বলেছেন, বিরোধীদের বিরুদ্ধে হুমকি দিয়েছেন, সেই তুলনায় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ অকিঞ্চিৎকর। এগুলোকে ব্যবহার করে বিরোধী নেতাদের আটকের ঘটনা ঘটেছে বিস্তর। যদিও এসব একার্থে নতুন নয়, কিন্তু সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি সত্ত্বেও নাগরিকদের মধ্যে এটা মেনে নেওয়ার মানসিকতা সহিংসতা অব্যাহত রাখার অনুকূল অবস্থা তৈরি করেছে।
দ্বিতীয় ধরনের সহিংসতা হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। গত দেড় মাসে বোমা হামলায় প্রায় ৭০ জনের বেশি মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর পাশাপাশি কমপক্ষে ২০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন কথিত বন্দুকযুদ্ধে বা এ ধরনের ঘটনায়। লক্ষণীয়, কোনো ক্ষেত্রেই বিচারিক ব্যবস্থার মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কোনো চেষ্টা হয়নি। উপরন্তু সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা এমন সব কথা বলেছেন, যেগুলো আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি হুমকি বলেই মনে হয়। এসব বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার পরও পুলিশের মহাপরিদর্শক যখন বলেন ‘যে পুলিশের গুলিতে নিহত হবে, সে নিঃসন্দেহে সন্ত্রাসী’, তখন এই আশঙ্কাই সত্য মনে হয় যে শক্তি প্রয়োগের এই পদ্ধতি অব্যাহত রাখারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এই পরস্পরবিরোধী কিন্তু পরস্পর-সংশ্লিষ্ট প্রবণতার উপস্থিতি, সেগুলোকে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করা, এবং তার সমর্থনে সমাজে ‘যুক্তি প্রদর্শনের’ নগ্ন প্রচেষ্টা যেকোনো সমাজে দীর্ঘমেয়াদি সংকটের লক্ষণ। আপাতদৃষ্টে এই মুহূর্তে বিবদমান পক্ষগুলোর যে-ই মনে করুক না কেন তারা এগিয়ে আছে এবং সময়ের ব্যবধানে তারাই বিজয়ী হবে, তারা আসলে শক্তি প্রয়োগের এই ধারাকে অব্যাহতভাবে বৈধতা প্রদান করছে, জ্ঞাতসারে বা বিবেচনাহীনভাবে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রক্ষমতার শক্তি যেহেতু বেশি থাকে, রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা মনে করে থাকেন যে তাঁদের জন্য অবস্থা অনুকূলেই থাকবে; যেসব দেশে দীর্ঘমেয়াদি সংকটের ঘটনা ঘটেছে, সেখানেও আমরা তা-ই দেখতে পেয়েছি। কিন্তু তাঁরা এটা বিবেচনা করতে ব্যর্থ হন যে তাতে মধ্যমেয়াদেই দেশের জন্য এটা ক্ষতিকর পরিণতি বহন করে। ক্ষমতাসীন হিসেবে তাঁদের ওপরেই এই দায়িত্ব বর্তায় দেশকে সেই পরিণতি থেকে রক্ষা করার।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
পৃথিবীতে যেসব দেশ দীর্ঘমেয়াদি অভ্যন্তরীণ সংকটে নিপতিত হয়েছে, সেসব দেশের ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে গোড়াতে উভয় পক্ষ স্বল্পসময়ে বিজয়ী হওয়ার আশায় দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে; সে ক্ষেত্রে লক্ষ্যও থাকে সীমিত। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতা বা তা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারা এই সংকটকে দীর্ঘসূত্রী করে তোলে। এই প্রক্রিয়ায় একেক পক্ষ একেক সময়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে এবং তারা সেটাকে ঘটনাধারা তাদের অনুকূলে আসার লক্ষণ বলে মনে করে। ফলে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনের আগ্রহ কমতে থাকে। এখানে এটাও স্মরণ করা দরকার, সংকট যতই দীর্ঘমেয়াদি হয়, ততই আশু লক্ষ্যের বিষয়গুলো থেকে দৃষ্টি সরে যায়, নতুন নতুন বিষয় তাতে যুক্ত হয়, সংকটের চরিত্র ও প্রকৃতিতেও পরিবর্তন ঘটে। শুধু তা-ই নয়, এ ধরনের ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে দুই পক্ষের শক্তিতে বদল ঘটে থাকে।
বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে মনে হয় যে দেশ সেই পথেই অগ্রসর হতে শুরু করেছে। দেড় মাস আগে যখন এই পরিস্থিতির সূচনা হয়, তখন যেসব বিষয় ছিল রাজনীতির মুখ্য বিষয়, ক্রমাগতভাবে তা থেকে আলোচনা সরে এসেছে বলেই মনে হয়। এ ক্ষেত্রে সরকার ও সরকারি দল সফল। একসময় যারা বিএনপি ও বিরোধী জোটকে শক্তিহীন বলে উপহাস করেছে, তারা এখন দেখাতে চায় যে দলটি সারা দেশে, তাদের ভাষায় ‘বিচ্ছিন্নভাবে’ হলেও, অব্যাহতভাবে সহিংসতা চালানোর মতো একটি জোট। এ ক্ষেত্রে বিএনপি যে তার দাবির পক্ষে তার কর্মীদের রাজপথে সমবেত করতে ব্যর্থ হয়েছে, বিশেষ করে বড় শহরগুলোয় তাদের সাংগঠনিক উপস্থিতির কোনো প্রমাণ রাখতে পারেনি, সেটা সরকারের পক্ষেই গেছে। এ জন্য বিএনপি যে যুক্তিই দাঁড় করাক না কেন, সেটা দেশে ও দেশের বাইরে কেউ গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছে না। সামগ্রিক রাজনৈতিক সংকটের পেছনে যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একপক্ষীয় নির্বাচনের কোনো ভূমিকা রয়েছে এবং পরিস্থিতির সমাধানের লক্ষ্যে সে বিষয়ে মনোনিবেশ করা জরুরি, সেখান থেকে সাধারণ মানুষের আলোচনা কেবল সহিংসতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। যদিও বিএনপি এই দাবি করতে পারে যে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারাটা তাদের সাফল্যের দিক।
যেকোনো সংকট দীর্ঘসূত্রী হয়ে ওঠার লক্ষণ হলো যে সমাজে ও রাজনীতিতে কিছু কিছু প্রবণতার গ্রহণযোগ্যতা লাভ। অর্থাৎ নাগরিকদের মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে মেনে নেওয়ার প্রবণতা। গত দেড় মাসের ঘটনাপ্রবাহ এবং আগে ২০১৩ সাল থেকে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে দুই ধরনের সহিংসতা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। একদিকে বিরোধী দল কর্তৃক এবং তাদের নামে সংঘটিত সহিংসতা। বাংলাদেশে অতীতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিরাজমান সহিংসতাকে সাময়িক ও ব্যতিক্রমী বলে বিবেচনা করা হলেও এখন মনে হয় তা স্বাভাবিক বলেই মেনে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। এসব ঘটনার তদন্ত, দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা, তাদের বিচারের সম্মুখীন করার কোনো তাগিদ যেমন সরকারের পক্ষে দেখা যায়নি, তেমনি সমাজের ভেতরে থেকেও এই নিয়ে দাবি ওঠেনি। এটি নাগরিকদের মধ্যে আইন ও বিচার–প্রক্রিয়ার ব্যাপারে আস্থাহীনতাই প্রমাণ করে। তাঁরা ধরেই নিচ্ছেন যে এই বিষয়ে বাক্যব্যয় নিরর্থক। ২০১৩ সালে থেকে এযাবৎ রাজনৈতিক সহিংসতা বিষয়ে সরকার ও সরকারি দলের নেতারা যত কথা বলেছেন, বিরোধীদের বিরুদ্ধে হুমকি দিয়েছেন, সেই তুলনায় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ অকিঞ্চিৎকর। এগুলোকে ব্যবহার করে বিরোধী নেতাদের আটকের ঘটনা ঘটেছে বিস্তর। যদিও এসব একার্থে নতুন নয়, কিন্তু সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি সত্ত্বেও নাগরিকদের মধ্যে এটা মেনে নেওয়ার মানসিকতা সহিংসতা অব্যাহত রাখার অনুকূল অবস্থা তৈরি করেছে।
দ্বিতীয় ধরনের সহিংসতা হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। গত দেড় মাসে বোমা হামলায় প্রায় ৭০ জনের বেশি মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর পাশাপাশি কমপক্ষে ২০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন কথিত বন্দুকযুদ্ধে বা এ ধরনের ঘটনায়। লক্ষণীয়, কোনো ক্ষেত্রেই বিচারিক ব্যবস্থার মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কোনো চেষ্টা হয়নি। উপরন্তু সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা এমন সব কথা বলেছেন, যেগুলো আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি হুমকি বলেই মনে হয়। এসব বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার পরও পুলিশের মহাপরিদর্শক যখন বলেন ‘যে পুলিশের গুলিতে নিহত হবে, সে নিঃসন্দেহে সন্ত্রাসী’, তখন এই আশঙ্কাই সত্য মনে হয় যে শক্তি প্রয়োগের এই পদ্ধতি অব্যাহত রাখারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এই পরস্পরবিরোধী কিন্তু পরস্পর-সংশ্লিষ্ট প্রবণতার উপস্থিতি, সেগুলোকে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করা, এবং তার সমর্থনে সমাজে ‘যুক্তি প্রদর্শনের’ নগ্ন প্রচেষ্টা যেকোনো সমাজে দীর্ঘমেয়াদি সংকটের লক্ষণ। আপাতদৃষ্টে এই মুহূর্তে বিবদমান পক্ষগুলোর যে-ই মনে করুক না কেন তারা এগিয়ে আছে এবং সময়ের ব্যবধানে তারাই বিজয়ী হবে, তারা আসলে শক্তি প্রয়োগের এই ধারাকে অব্যাহতভাবে বৈধতা প্রদান করছে, জ্ঞাতসারে বা বিবেচনাহীনভাবে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রক্ষমতার শক্তি যেহেতু বেশি থাকে, রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা মনে করে থাকেন যে তাঁদের জন্য অবস্থা অনুকূলেই থাকবে; যেসব দেশে দীর্ঘমেয়াদি সংকটের ঘটনা ঘটেছে, সেখানেও আমরা তা-ই দেখতে পেয়েছি। কিন্তু তাঁরা এটা বিবেচনা করতে ব্যর্থ হন যে তাতে মধ্যমেয়াদেই দেশের জন্য এটা ক্ষতিকর পরিণতি বহন করে। ক্ষমতাসীন হিসেবে তাঁদের ওপরেই এই দায়িত্ব বর্তায় দেশকে সেই পরিণতি থেকে রক্ষা করার।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments