জাতি গঠনে উন্নয়ন যোগাযোগ এবং হৃদয়ে মাটি ও মানুষ by গোলাম রহমান
গণমাধ্যম
গণমানুষের জন্য। মানুষের দৈনন্দিন কার্যক্রম তার মধ্যে একটা বড় ধরনের
ভূমিকা রাখে। মানুষের প্রতিদিনের আচার-অনুষ্ঠান, কার্যকলাপসহ দৈনন্দিন জীবন
ব্যবস্থায় জীবনের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক তা নতুন করে রচনা হয় প্রতি
মুহূর্তে। সেখানে গণমাধ্যম, বিশেষ করে আজকের অডিও-ভিজুয়্যাল মাধ্যম বড় একটি
স্থান দখল করে থাকে এবং বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। আমাদের জীবনের অনেকটা সময়
গণমাধ্যম কেড়ে নেয়। কারণ গণমাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার সুযোগ এখন আর
নেই। এখন আমাদের প্রতিদিনের চাহিদা, প্রতিদিনের জীবন ব্যবস্থার মধ্যে
জীবনঘনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে গণমাধ্যম। গণমাধ্যম আমাদের তথ্য দেয়, সংবাদ
দেয়, শিক্ষা দেয়। শিক্ষায় গণমাধ্যম আমাদের বিনোদন দেয়। গণমাধ্যমের
বহুবিধ কার্যক্রমকে যদি আমরা আরও বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব, আমাদের
জীবনাচারের মধ্যে গণমাধ্যম বিভিন্নভাবে বিদ্যমান। আমাদের জীবনের মানোন্নয়ন ও
মান পরিবর্তনে গণমাধ্যম অবদান রাখে। গণমাধ্যমের, বিশেষ করে আজকের
টেলিভিশনের এই ভূমিকার জায়গায় একটু বিবেচনা করে দেখা যায় কীভাবে আমরা
আমাদের জীবনমানকে উন্নত করতে পারি। আমরা যদি কোনো একটি কাজকে আরেকটি উপযোগ,
সহযোগ দিয়ে আরও বাড়াতে পারি তাহলে কাজটির সঙ্গে মূল্য সংযোজন হয়। যেমন
কৃষক যখন ধান ফলায়, তখন ধান থেকে চাল হয় আর সেই চাল থেকে নানাবিধ খাবার
তৈরি হয়। আবার সেই ধান দিয়েই খৈ, মুড়ি, চিড়া, মুড়কি তৈরি হয়। এখানে তার আরও
মূল্য সংযোজন হয়। এ সংযোজনের মধ্য দিয়ে কাজটির রূপ, রস, গন্ধ- সবকিছু
পাল্টে যায়। এভাবে আমরা নতুন নতুন জিনিসের দিকে ধাবিত হই, নতুন স্বাদ নেয়ার
চেষ্টা করি। এভাবেই গণমাধ্যম আমাদের জীবনাচরণ ও জীবনমানের পরিবর্তনে বড়
ধরনের কাজ করতে পারে। টেলিভিশন অবশ্যই তা করে যাচ্ছে।
শুধু সংবাদ বা তথ্য বা বিনোদন দিয়েই গণমাধ্যম তার দায়িত্ব শেষ করছে না। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে কৃষক, শ্রমিক যারা কাজ করছে, তাদের ঘামের মূল্য দিয়ে শুধু যে তারা জীবিকা অর্জন করছে তাই নয়; দেশের কোটি কোটি মানুষ তাদের উৎপাদিত শস্যকণা, অর্থাৎ খাদ্যের ওপর ভিত্তি করে জীবন ধারণ করছে। সুতরাং এই জীবন ধারণের ব্যাপারটি অত্যন্ত শর্তসাপেক্ষ। যদি আমাদের কৃষক সঠিকভাবে সেই কাজটি না করে, তাহলে কিন্তু আমাদের জীবন বিপন্ন হওয়ার কথা। আমাদের মতো কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় কৃষকের যে ভূমিকা, প্রতিদিন নতুন নতুন ভাবধারা এবং চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে তাদের যে কার্যক্রম, এটিকে আমরা উপলব্ধি করি। আমরা দেখি, এক সময় খুব সনাতন পদ্ধতিতে আমাদের কৃষি কাজ হতো। মাছ চাষ হতো, গাছগাছালি বড় হতো; কিন্তু নতুন নতুন চিন্তাভাবনা, বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার- এগুলো কৃষকদের কাছে খুব একটা পৌঁছত না। এখন বিজ্ঞানাগার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাঠপর্যায়ের গবেষণার ফল কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে গণমাধ্যম।
গণমাধ্যম থেকে মানুষ শুধু যে তথ্য নিয়েই যায় তা তো নয়, জ্ঞানও বৃদ্ধি করে। গণমাধ্যমে পরিবেশিত তথ্য থেকে সাধারণ মানুষ ততক্ষণ জ্ঞান নেয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা মনে করে এই জ্ঞান তাদের কোনো না কোনোভাবে মুনাফা দিচ্ছে। অর্থাৎ কোনো না কোনোভাবে তাদের এক ধরনের প্রাপ্তি যোগ করছে। একজন কৃষক কিংবা জেলে যখন আধুনিক চাষাবাদ বা মাছ চাষ পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিসহ গণমাধ্যমে দেখেন, তখন তার ওপর তিনি নির্ভর করেন। এর সুবিধার কথা তিনি বুঝতে পারেন। সুতরাং তাদের জীবনে যে সংযোজন হচ্ছে, এটি কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত উপলব্ধির বিষয়। আমাদের মতো ট্রাডিশনাল সমাজে এটি হওয়ার কথা নয়, যতক্ষণ না মন-মানসিকতার দিক থেকে তাদের পরিবর্তন হচ্ছে। আর মন-মানসিকতায় পরিবর্তন হচ্ছে তখনই, যখন তারা উপলব্ধি করে তাদের একটি প্রাপ্তি যোগ হচ্ছে। কৃষক যেখানে একরে ২০ মণ ধান পেতেন, সেখানে যদি গণমাধ্যমে পাওয়া কোনো জ্ঞানের কারণে একরে ৪০ মণ ধান পান, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি তৃপ্ত হবেন। গণমাধ্যম এ প্রক্রিয়ায়ই তথ্য বা সংবাদ মানুষের মাঝে উপস্থাপন করে।
আগে বাংলাদেশে একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন বা বিটিভি। আশির দশকে আমরা দেখেছি বিনোদন মাধ্যম হিসেবেই টেলিভিশন চালু ছিল। সেই টেলিভিশনে মাটি ও মানুষ নামে একটি অনুষ্ঠানে যখন কৃষি, কৃষক, ক্ষেত-খামার, উন্নয়ন নিয়ে কথা বলা হতে থাকল, তখন তা এতটাই জনপ্রিয় হল যে, মানুষের মাঝে সাড়া পড়ে গেল। কারণ তখন মানুষ দেখল, এর মধ্য দিয়ে একজন কৃষক তার পেশার উন্নতির জন্য নতুন ধারণা পাচ্ছে এবং তার উৎপাদন বাড়াতে পারছে।
আবার বিষয়টি যে খুব সহজ ছিল তা নয়। টেলিভিশন কিংবা এ অনুষ্ঠানের নির্মাতাদের জন্য তা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল সে সময়ে। টেলিভিশনে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এ ধরনের তথ্যমূলক অনুষ্ঠান পরিবেশন করার ঝুঁকি বা নতুন দায়-দায়িত্ব বা চ্যালেঞ্জটা আমরা দেখেছি। কিন্তু এটি যে খুব ফলপ্রসূ হয়েছে, তা আমরা দেখেছি যখন মানুষ বাড়িতে বাড়িতে মুরগি চাষ করেছিল; কাজিপেয়ারা চাষ শুরু করেছিল। বাড়ির ছাদ কিংবা বারান্দার টবে কাজিপেয়ারার চাষ শুধু গ্রামে নয়, শহরেও প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। আমি এখনও মনে করতে পারি হাকিম আলী নামের এক ব্যক্তি কীভাবে মাছ চাষ করে সফল হয়েছিলেন, সেই গল্প। তিনি লাভের অংক হাজার হাজার টাকা গুনছেন এমন চিত্র আমরা দেখেছি টেলিভিশন পর্দায়, অর্থাৎ মাটি ও মানুষ এবং পরবর্তীকালে হৃদয়ে মাটি ও মানুষ-এর ক্যামেরায়। যার পেছনের প্রধান নির্মাতা হিসেবে কাজ করেছেন শাইখ সিরাজ। যার কাজকর্ম দেখে গ্রামের মানুষ যেমন উৎসাহিত হয়েছেন, প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন আমাদের মতো শহরবাসীও। তার মাধ্যমে টেলিভিশন একটি বড় অবদান রাখতে পেরেছে।
ওই যে হাকিম আলী, তার মৎস্য খামারে রুপালি মাছের লাফালাফিতে মাছের সৌন্দর্য দেখে মানুষের মাঝে দারুণ আশা জেগেছে। তাদের মনে হয়েছে বিরাট বিনোদনের জায়গা এটি, শুধু আর্থিক সুবিধা কিংবা একটি পেশার মর্যাদায় আয় করাই নয়। গণমাধ্যম যে তথ্যের পাশাপাশি বিনোদনও সরবরাহ করতে পারে, এটি তার বড় প্রমাণ। হৃদয়ে মাটি ও মানুষ বা শাইখ সিরাজের অনুষ্ঠান থেকে আমরা দেখেছি একটা মাছের মাথা তেলের ওপর ভেজে তোলার শব্দের মধ্য দিয়ে কীভাবে মাছের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করে তুলতে হয়, সেই কৌশলও। তখনই মনে হয়েছে, গণমাধ্যম তার একাডেমিক ভূমিকা বা টেলিভিশন পর্দার বাইরেও একটি বড় জায়গায় পৌঁছে গেছে। মানুষের বাণী ও ছবির যে মাহাত্ম্য এবং তার যে প্রভাব, তা বলে শেষ করা যাবে না।
বাংলাদেশে টেলিভিশনের সাম্প্রতিক যে জয়জয়কার, সে তুলনায় আমরা অনেক বেশি বৈচিত্র্য হয়তো দেখি না। তার মধ্যেও যদি দুয়েকটি কার্যক্রম আমরা লক্ষ করি, সেখানে হৃদয়ে মাটি ও মানুষ-এর কথা বলতে হবে। এ অনুষ্ঠান যে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে টেলিভিশনের ভূমিকার মধ্য দিয়ে কৃষককে শুধু সমৃদ্ধ করছে তাই নয়, এটি জাতীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে উন্নয়ন যোগাযোগের নতুন ভিত্তি তৈরি করছে। এই যে উন্নয়ন যোগাযোগ, তা আমরা পাশ্চাত্যের যোগাযোগের তত্ত্বীয় কাঠামোর ভেতর দেখি না। এটি একান্তই আমাদের নিজস্ব। আমাদের এশিয়ান পার্সপেক্টিভেই আমরা একে দেখি। এখানে উন্নয়নের জন্য যোগাযোগের যে বড় অবদান, তা-ই শাইখ সিরাজ অনন্যভাবে উপস্থাপন করেছেন।
আমাদের দেশে কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান যে বিভিন্ন মাধ্যমে শুরু হয়েছে, এর প্রণেতা শাইখ সিরাজ। প্রচ্ছন্নভাবে বোঝা যায় যে, মাটি ও মানুষ বা হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এক নতুন ধারা সৃষ্টি হয়েছে। উন্নয়ন যোগাযোগের ধারায় কৃষি অনুষ্ঠানগুলো আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এক সময় খাদ্য ঘাটতির দেশ ছিল এই বাংলাদেশ। সেই দেশ এখন খাদ্য রফতানিকারক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য যে মার্কেটিং সিস্টেম, এর চাহিদা ও সরবরাহের সবকিছু শাইখ সিরাজ উপস্থাপন করেছেন। এখানে বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন কর্তৃপক্ষও তাদের জায়গা থেকে কাজ করেছেন; কিন্তু এটিকে অনেক বেশি ফলপ্রসূ করতে গণমাধ্যমের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, তা অনস্বীকার্য এবং জাতি এজন্য শাইখ সিরাজকে মনে রাখবে।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি মালয়েশিয়ায় একটি প্রকাশনা বেরিয়েছিল। সেখানে দেখেছিলাম, আমাদের দেশে টেলিভিশনে মাটি ও মানুষ বা কৃষিভিত্তিক যে অনুষ্ঠান হয় তার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে। তবে এ জনপ্রিয়তা মাপার প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা যে হয়নি সে কথাটি তখন বলেছিলাম। পরবর্তীকালে দেখেছি, এর ধারাবাহিকতায় কিছু ছোট ছোট গবেষণা হয়েছে। সম্প্রতি নতুন করে এ ধরনের গবেষণার আরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখন আমাদের বুঝতে হবে, গণযোগাযোগের ধারায় টেলিভিশনের কৃষি অনুষ্ঠান একটি জাতি গঠনে কীভাবে কাজ করছে। এ ধরনের গবেষণা খুব বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরিচালনা করা উচিত। এতে জাতি আরও বেশি উপকৃত হবে।
অধ্যাপক গোলাম রহমান : উপ-উপাচার্য, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শুধু সংবাদ বা তথ্য বা বিনোদন দিয়েই গণমাধ্যম তার দায়িত্ব শেষ করছে না। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে কৃষক, শ্রমিক যারা কাজ করছে, তাদের ঘামের মূল্য দিয়ে শুধু যে তারা জীবিকা অর্জন করছে তাই নয়; দেশের কোটি কোটি মানুষ তাদের উৎপাদিত শস্যকণা, অর্থাৎ খাদ্যের ওপর ভিত্তি করে জীবন ধারণ করছে। সুতরাং এই জীবন ধারণের ব্যাপারটি অত্যন্ত শর্তসাপেক্ষ। যদি আমাদের কৃষক সঠিকভাবে সেই কাজটি না করে, তাহলে কিন্তু আমাদের জীবন বিপন্ন হওয়ার কথা। আমাদের মতো কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় কৃষকের যে ভূমিকা, প্রতিদিন নতুন নতুন ভাবধারা এবং চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে তাদের যে কার্যক্রম, এটিকে আমরা উপলব্ধি করি। আমরা দেখি, এক সময় খুব সনাতন পদ্ধতিতে আমাদের কৃষি কাজ হতো। মাছ চাষ হতো, গাছগাছালি বড় হতো; কিন্তু নতুন নতুন চিন্তাভাবনা, বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার- এগুলো কৃষকদের কাছে খুব একটা পৌঁছত না। এখন বিজ্ঞানাগার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাঠপর্যায়ের গবেষণার ফল কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে গণমাধ্যম।
গণমাধ্যম থেকে মানুষ শুধু যে তথ্য নিয়েই যায় তা তো নয়, জ্ঞানও বৃদ্ধি করে। গণমাধ্যমে পরিবেশিত তথ্য থেকে সাধারণ মানুষ ততক্ষণ জ্ঞান নেয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা মনে করে এই জ্ঞান তাদের কোনো না কোনোভাবে মুনাফা দিচ্ছে। অর্থাৎ কোনো না কোনোভাবে তাদের এক ধরনের প্রাপ্তি যোগ করছে। একজন কৃষক কিংবা জেলে যখন আধুনিক চাষাবাদ বা মাছ চাষ পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিসহ গণমাধ্যমে দেখেন, তখন তার ওপর তিনি নির্ভর করেন। এর সুবিধার কথা তিনি বুঝতে পারেন। সুতরাং তাদের জীবনে যে সংযোজন হচ্ছে, এটি কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত উপলব্ধির বিষয়। আমাদের মতো ট্রাডিশনাল সমাজে এটি হওয়ার কথা নয়, যতক্ষণ না মন-মানসিকতার দিক থেকে তাদের পরিবর্তন হচ্ছে। আর মন-মানসিকতায় পরিবর্তন হচ্ছে তখনই, যখন তারা উপলব্ধি করে তাদের একটি প্রাপ্তি যোগ হচ্ছে। কৃষক যেখানে একরে ২০ মণ ধান পেতেন, সেখানে যদি গণমাধ্যমে পাওয়া কোনো জ্ঞানের কারণে একরে ৪০ মণ ধান পান, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি তৃপ্ত হবেন। গণমাধ্যম এ প্রক্রিয়ায়ই তথ্য বা সংবাদ মানুষের মাঝে উপস্থাপন করে।
আগে বাংলাদেশে একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন বা বিটিভি। আশির দশকে আমরা দেখেছি বিনোদন মাধ্যম হিসেবেই টেলিভিশন চালু ছিল। সেই টেলিভিশনে মাটি ও মানুষ নামে একটি অনুষ্ঠানে যখন কৃষি, কৃষক, ক্ষেত-খামার, উন্নয়ন নিয়ে কথা বলা হতে থাকল, তখন তা এতটাই জনপ্রিয় হল যে, মানুষের মাঝে সাড়া পড়ে গেল। কারণ তখন মানুষ দেখল, এর মধ্য দিয়ে একজন কৃষক তার পেশার উন্নতির জন্য নতুন ধারণা পাচ্ছে এবং তার উৎপাদন বাড়াতে পারছে।
আবার বিষয়টি যে খুব সহজ ছিল তা নয়। টেলিভিশন কিংবা এ অনুষ্ঠানের নির্মাতাদের জন্য তা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল সে সময়ে। টেলিভিশনে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এ ধরনের তথ্যমূলক অনুষ্ঠান পরিবেশন করার ঝুঁকি বা নতুন দায়-দায়িত্ব বা চ্যালেঞ্জটা আমরা দেখেছি। কিন্তু এটি যে খুব ফলপ্রসূ হয়েছে, তা আমরা দেখেছি যখন মানুষ বাড়িতে বাড়িতে মুরগি চাষ করেছিল; কাজিপেয়ারা চাষ শুরু করেছিল। বাড়ির ছাদ কিংবা বারান্দার টবে কাজিপেয়ারার চাষ শুধু গ্রামে নয়, শহরেও প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। আমি এখনও মনে করতে পারি হাকিম আলী নামের এক ব্যক্তি কীভাবে মাছ চাষ করে সফল হয়েছিলেন, সেই গল্প। তিনি লাভের অংক হাজার হাজার টাকা গুনছেন এমন চিত্র আমরা দেখেছি টেলিভিশন পর্দায়, অর্থাৎ মাটি ও মানুষ এবং পরবর্তীকালে হৃদয়ে মাটি ও মানুষ-এর ক্যামেরায়। যার পেছনের প্রধান নির্মাতা হিসেবে কাজ করেছেন শাইখ সিরাজ। যার কাজকর্ম দেখে গ্রামের মানুষ যেমন উৎসাহিত হয়েছেন, প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন আমাদের মতো শহরবাসীও। তার মাধ্যমে টেলিভিশন একটি বড় অবদান রাখতে পেরেছে।
ওই যে হাকিম আলী, তার মৎস্য খামারে রুপালি মাছের লাফালাফিতে মাছের সৌন্দর্য দেখে মানুষের মাঝে দারুণ আশা জেগেছে। তাদের মনে হয়েছে বিরাট বিনোদনের জায়গা এটি, শুধু আর্থিক সুবিধা কিংবা একটি পেশার মর্যাদায় আয় করাই নয়। গণমাধ্যম যে তথ্যের পাশাপাশি বিনোদনও সরবরাহ করতে পারে, এটি তার বড় প্রমাণ। হৃদয়ে মাটি ও মানুষ বা শাইখ সিরাজের অনুষ্ঠান থেকে আমরা দেখেছি একটা মাছের মাথা তেলের ওপর ভেজে তোলার শব্দের মধ্য দিয়ে কীভাবে মাছের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করে তুলতে হয়, সেই কৌশলও। তখনই মনে হয়েছে, গণমাধ্যম তার একাডেমিক ভূমিকা বা টেলিভিশন পর্দার বাইরেও একটি বড় জায়গায় পৌঁছে গেছে। মানুষের বাণী ও ছবির যে মাহাত্ম্য এবং তার যে প্রভাব, তা বলে শেষ করা যাবে না।
বাংলাদেশে টেলিভিশনের সাম্প্রতিক যে জয়জয়কার, সে তুলনায় আমরা অনেক বেশি বৈচিত্র্য হয়তো দেখি না। তার মধ্যেও যদি দুয়েকটি কার্যক্রম আমরা লক্ষ করি, সেখানে হৃদয়ে মাটি ও মানুষ-এর কথা বলতে হবে। এ অনুষ্ঠান যে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে টেলিভিশনের ভূমিকার মধ্য দিয়ে কৃষককে শুধু সমৃদ্ধ করছে তাই নয়, এটি জাতীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে উন্নয়ন যোগাযোগের নতুন ভিত্তি তৈরি করছে। এই যে উন্নয়ন যোগাযোগ, তা আমরা পাশ্চাত্যের যোগাযোগের তত্ত্বীয় কাঠামোর ভেতর দেখি না। এটি একান্তই আমাদের নিজস্ব। আমাদের এশিয়ান পার্সপেক্টিভেই আমরা একে দেখি। এখানে উন্নয়নের জন্য যোগাযোগের যে বড় অবদান, তা-ই শাইখ সিরাজ অনন্যভাবে উপস্থাপন করেছেন।
আমাদের দেশে কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান যে বিভিন্ন মাধ্যমে শুরু হয়েছে, এর প্রণেতা শাইখ সিরাজ। প্রচ্ছন্নভাবে বোঝা যায় যে, মাটি ও মানুষ বা হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এক নতুন ধারা সৃষ্টি হয়েছে। উন্নয়ন যোগাযোগের ধারায় কৃষি অনুষ্ঠানগুলো আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এক সময় খাদ্য ঘাটতির দেশ ছিল এই বাংলাদেশ। সেই দেশ এখন খাদ্য রফতানিকারক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য যে মার্কেটিং সিস্টেম, এর চাহিদা ও সরবরাহের সবকিছু শাইখ সিরাজ উপস্থাপন করেছেন। এখানে বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন কর্তৃপক্ষও তাদের জায়গা থেকে কাজ করেছেন; কিন্তু এটিকে অনেক বেশি ফলপ্রসূ করতে গণমাধ্যমের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, তা অনস্বীকার্য এবং জাতি এজন্য শাইখ সিরাজকে মনে রাখবে।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি মালয়েশিয়ায় একটি প্রকাশনা বেরিয়েছিল। সেখানে দেখেছিলাম, আমাদের দেশে টেলিভিশনে মাটি ও মানুষ বা কৃষিভিত্তিক যে অনুষ্ঠান হয় তার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে। তবে এ জনপ্রিয়তা মাপার প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা যে হয়নি সে কথাটি তখন বলেছিলাম। পরবর্তীকালে দেখেছি, এর ধারাবাহিকতায় কিছু ছোট ছোট গবেষণা হয়েছে। সম্প্রতি নতুন করে এ ধরনের গবেষণার আরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখন আমাদের বুঝতে হবে, গণযোগাযোগের ধারায় টেলিভিশনের কৃষি অনুষ্ঠান একটি জাতি গঠনে কীভাবে কাজ করছে। এ ধরনের গবেষণা খুব বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরিচালনা করা উচিত। এতে জাতি আরও বেশি উপকৃত হবে।
অধ্যাপক গোলাম রহমান : উপ-উপাচার্য, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments