সবার আগে চাই একটি ভাষানীতি by সৌরভ সিকদার
বাংলা
ভাষার প্রতি আমাদের বর্তমান মনোভাব, প্রাত্যহিক জীবনে বাংলা ভাষার প্রয়োগ
এবং তার দুরবস্থা, সেই সঙ্গে ভাষার প্রতি আমাদের একমাসের ভালোবাসা নিয়ে গত
বছর ফেব্রুয়ারি মাসে দৈনিক পত্রিকায় একটি লেখা লিখেছিলাম। তার শিরোনাম ছিল_
'আমি একমাস তোমায় ভালোবাসি'। লেখাটির মূল বক্তব্য ছিল ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার
প্রতি ভালোবাসা এবং তাকে রক্ষার যে অসাধারণ দৃষ্টান্ত বাঙালিরা রেখেছিল তা
ম্লান হতে হতে এমন এক পর্যায়ে এসেছে যে, ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদের
ভাষায় বলতে হয়_ 'কত বেশি টাকা হলে বাঙলাকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করে?' আমরা
জানি_ বিশ্বায়ন, তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন, ইংরেজি ও হিন্দির
আধিপত্য একুশ শতকের বাংলাদেশের নাগরিক বাস্তবতার এক অনিবার্য সত্য।
আমরা না চাইলেও প্রতিনিয়ত আমাদের বসার ঘরে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি সেই সঙ্গে ইংরেজি-হিন্দি উঁকি-ঝুঁকি মারে। কিন্তু সেই উঁকি-ঝুঁকি যখন শোবার ঘরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে, তা মোটেও সহজ করে নেওয়া যায় না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা শোবার ঘরটাও ক্রমশ ছেড়ে দিতে যাচ্ছি। নিজের ভাষা সংস্কৃতিকে যে বিশ্বায়ন আর বহুজাতিক আকাশ সংস্কৃতির ইবোলা ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন, সেই বোধও আমাদের লুপ্ত হতে বসেছে আজ।
তা না হলে যে শব্দ, যে উচ্চারণভঙ্গি, যে বাক্য গঠন বাংলা ভাষার নয় অথবা বাংলা ভাষায় যার কোনো প্রয়োজনই নেই, সেই অপ্রয়োজনীয় অথবা অযাচিত ভাষা সংস্কৃতির আগ্রাসনে কেন আমাদের পড়তে হবে? ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা সম্ভবত বাংলা-ইংরেজির এক অদ্ভুত মিশেলে বকবক করে চলে আমাদের এফএম বেতার কেন্দ্রগুলো। গত বছর ঈদের সময় মুক্তি পাওয়া ১১টি বাংলা ছবির মধ্যে ১০টির নাম ছিল ইংরেজিতে; একই সময় টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রদর্শিত দুই শতাধিক নাটকের অর্ধেকের বেশি নাম ছিল ইংরেজি, সঙ্গীত আর বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের কথা নাইবা বললাম। কেননা আমাদের টিভিতে কোনো সঙ্গীত হয় না, তবে প্রতিদিন কোনো না কোনো 'মিউজিক্যাল প্রোগ্রাম' হয়। এ জন্যই সম্ভবত অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ভাষাদূষণকে নদীদূষণের সঙ্গে তুলনা করে কয়েক বছর আগে একটি অসাধারণ লেখা লেখেন। এই লেখাটি আদালতের দৃষ্টিগোচর হয় এবং তারা সরকারকে বাংলা ভাষার 'সম্ভ্রম' রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এরপর সরকারিভাবে একটি কমিটি গঠন করা হয়। বাকি ইতিহাস আমাদের সবার জানা।
দু'বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও বাংলা ভাষার 'বিশুদ্ধতা' রক্ষার জন্য একটি কমিটি গঠন করে। পরবর্তীকালে তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগেও একই ধরনের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রমিত বাংলা, শুদ্ধ বানান ও বাংলায় নোট লেখার বিষয়ে কোষ গঠন করেছে, এ কমিটিগুলো আদৌ কার্যকর কিনা? তারা কী ধরনের সুপারিশ ও কার্যক্রমের প্রস্তাবনা করেছে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্র্র কিংবা মন্ত্রণালয় বাস্তবমুখী কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা আমাদের আজও জানা হলো না।
লক্ষ্য করার বিষয়, প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস এলে আমাদের গণমাধ্যম, মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সংস্থা সবাই মিলে বাংলা ভাষার করুণ দশা দেখে শুধুই দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকেন। অথচ অন্য সময় এই আমরা সবাই মিলে ভুলেই থাকি একুশের শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীন দেশ, বাংলা ভাষা, দুঃখিনী বর্ণমালার কথা।
বাংলা ভাষার নানা বিকৃতি অসঙ্গতি, অপ্রয়োজনীয় মিশ্রণ, এমনকি ইংরেজি-হিন্দির ঢঙ্গে বাংলা বাক্য গঠন ও উচ্চারণ সে তো লেগেই আছে। সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত বিশেষ শ্রেণী জীবনের প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি, কখনোবা হিন্দির ব্যবহারের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। আপনি কি জানেন আপনার সন্তান বিদ্যালয়ে তার বন্ধুর সঙ্গে ইংরেজি কিংবা হিন্দিতে কথা বলাকে মর্যাদার মনে করে। বাংলা ভাষার প্রতি তার মনে ভালোবাসা তৈরি করতে পরিবার অথবা বিদ্যালয় কিছু করেছে? রাষ্ট্র কি ভেবে দেখেছে তারও কিছু করার ছিল? যে মায়ের ভাষাকে ভালোবাসতে শেখেনি সে দেশকে কীভাবে ভালোবাসবে?
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হচ্ছে, ক্রমে ক্রমে বাংলার পরিবর্তে রোমান হরফ জায়গা দখল করে নিচ্ছে আমাদের চারপাশে। আবাসন কোম্পানির জায়গা দখলের মতো। এই তো মাত্র ক'দিন আগে মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে আমাদের জাতীয় শিল্পকলা একাডেমিতে ছবি নিয়ে দারুণ এক আন্তর্জাতিক মেলা হলো। মেলার নামটিও চমৎকার বাংলায় 'ছবিমেলা'। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই মেলার পোস্টার এমনকি মূল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যানারেও অনেক বড় করে রোমান হরফে 'ছবিমেলা' লেখা হয়েছিল। সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হওয়া বহুজাতিক বিজ্ঞাপনে, রাস্তায় টাঙানো বড় বড় বিজ্ঞাপন ফলকে আজকাল প্রতিনিয়তই চোখে পড়ে রোমান হরফের আধিক্য। এমনকি বাংলাদেশি চা কিংবা আলকাতরার ঘাড়েও ভর করেছে ঔপনিবেশিক ভূত। চানাচুর তো অনেক আগেই খাওয়া হয়েছে, সম্প্রতি ঝালমুড়িও খাচ্ছে রোমান হরফ।
এই তো আশির দশকেও ভারতের অপর্ণা সেন বাংলাদেশে পা দিয়ে চারদিকে বাংলা বর্ণমালার প্রসার দেখে অভিভূত হয়ে বলেছিলেন, 'বাংলা ভাষার কদর এখন শুধুই বাংলাদেশেই।' আজ ৩০ বছর পরে আমাদের চারপাশ এবং ঘরে-বাইরে তাকিয়ে আমরা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি না প্রিয় বাংলা ভাষা, প্রিয় বর্ণমালা আমি তোমায় ভালোবাসি।
বাংলা ভাষার অনুরাগী একজন পাঠক ও গবেষক হিসেবে বলতে পারি, ভাষা জোর করে কিংবা নদীর মতো বাঁধ দিয়ে আটকিয়ে রাখা যায় না সত্য। মুখের ভাষা নানা কারণে বদলাতেই পারে। বিশ্বায়ন, পণ্য ও সংস্কৃতির কারণে ইংরেজি কিংবা হিন্দি আসবেই। কিন্তু যে ভাষার সঙ্গে আমাদের মহান ত্যাগ, ঐতিহ্য এবং আবেগ জড়িয়ে আছে তার প্রতি অবহেলাও এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ অসম্মান গ্রহণ করতে পারি না। আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের কথা বলি, কিন্তু যেটুকু প্রচলিত আছে তার যে শুদ্ধ কিংবা প্রমিত রূপ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি কম। শিক্ষার মাধ্যম আর অভ্যন্তরীণ পণ্যের বাণিজ্যিক বিনিময়ে বাংলা অনিবার্য কেন হবে না, গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনে অকারণ ইংরেজি কেন আমাদের মুখ ঢেকে দেবে, এ প্রশ্নের উত্তর আমাদেরই খুঁজতে হবে। রাষ্ট্রকেও দায়িত্ব নিতে হবে। উন্নত বিশ্বের কথা বাদই দিলাম, আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলংকায় ভাষা কমিশন রয়েছে, এমনকি ভাষানীতিও। বাংলাদেশে যুগোপযোগী শিক্ষানীতি আছে, নারীনীতি আছে; কিন্তু স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও ভাষা আন্দোলনের এই পুণ্যভূমিতে কোনো ভাষানীতি হয়নি। সময়, প্রকৃতি ও সভ্যতার নিয়মে ভাষা বদলাতেই পারে; কিন্তু রাষ্ট্র কি তার দায়িত্ব থেকে একটি ভাষানীতি দিতে পেরেছে?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার উদ্যোগে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়েছে, আপনি আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট দিয়েছেন; এ বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা কি আপনার কাছে একটি ভাষানীতি কিংবা কার্যকর একটি ভাষা কমিশন প্রত্যাশা করতে পারি?
অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
murshedsm@du.ac.bd
আমরা না চাইলেও প্রতিনিয়ত আমাদের বসার ঘরে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি সেই সঙ্গে ইংরেজি-হিন্দি উঁকি-ঝুঁকি মারে। কিন্তু সেই উঁকি-ঝুঁকি যখন শোবার ঘরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে, তা মোটেও সহজ করে নেওয়া যায় না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা শোবার ঘরটাও ক্রমশ ছেড়ে দিতে যাচ্ছি। নিজের ভাষা সংস্কৃতিকে যে বিশ্বায়ন আর বহুজাতিক আকাশ সংস্কৃতির ইবোলা ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন, সেই বোধও আমাদের লুপ্ত হতে বসেছে আজ।
তা না হলে যে শব্দ, যে উচ্চারণভঙ্গি, যে বাক্য গঠন বাংলা ভাষার নয় অথবা বাংলা ভাষায় যার কোনো প্রয়োজনই নেই, সেই অপ্রয়োজনীয় অথবা অযাচিত ভাষা সংস্কৃতির আগ্রাসনে কেন আমাদের পড়তে হবে? ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা সম্ভবত বাংলা-ইংরেজির এক অদ্ভুত মিশেলে বকবক করে চলে আমাদের এফএম বেতার কেন্দ্রগুলো। গত বছর ঈদের সময় মুক্তি পাওয়া ১১টি বাংলা ছবির মধ্যে ১০টির নাম ছিল ইংরেজিতে; একই সময় টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রদর্শিত দুই শতাধিক নাটকের অর্ধেকের বেশি নাম ছিল ইংরেজি, সঙ্গীত আর বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের কথা নাইবা বললাম। কেননা আমাদের টিভিতে কোনো সঙ্গীত হয় না, তবে প্রতিদিন কোনো না কোনো 'মিউজিক্যাল প্রোগ্রাম' হয়। এ জন্যই সম্ভবত অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ভাষাদূষণকে নদীদূষণের সঙ্গে তুলনা করে কয়েক বছর আগে একটি অসাধারণ লেখা লেখেন। এই লেখাটি আদালতের দৃষ্টিগোচর হয় এবং তারা সরকারকে বাংলা ভাষার 'সম্ভ্রম' রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এরপর সরকারিভাবে একটি কমিটি গঠন করা হয়। বাকি ইতিহাস আমাদের সবার জানা।
দু'বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও বাংলা ভাষার 'বিশুদ্ধতা' রক্ষার জন্য একটি কমিটি গঠন করে। পরবর্তীকালে তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগেও একই ধরনের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রমিত বাংলা, শুদ্ধ বানান ও বাংলায় নোট লেখার বিষয়ে কোষ গঠন করেছে, এ কমিটিগুলো আদৌ কার্যকর কিনা? তারা কী ধরনের সুপারিশ ও কার্যক্রমের প্রস্তাবনা করেছে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্র্র কিংবা মন্ত্রণালয় বাস্তবমুখী কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা আমাদের আজও জানা হলো না।
লক্ষ্য করার বিষয়, প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস এলে আমাদের গণমাধ্যম, মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সংস্থা সবাই মিলে বাংলা ভাষার করুণ দশা দেখে শুধুই দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকেন। অথচ অন্য সময় এই আমরা সবাই মিলে ভুলেই থাকি একুশের শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীন দেশ, বাংলা ভাষা, দুঃখিনী বর্ণমালার কথা।
বাংলা ভাষার নানা বিকৃতি অসঙ্গতি, অপ্রয়োজনীয় মিশ্রণ, এমনকি ইংরেজি-হিন্দির ঢঙ্গে বাংলা বাক্য গঠন ও উচ্চারণ সে তো লেগেই আছে। সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত বিশেষ শ্রেণী জীবনের প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি, কখনোবা হিন্দির ব্যবহারের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। আপনি কি জানেন আপনার সন্তান বিদ্যালয়ে তার বন্ধুর সঙ্গে ইংরেজি কিংবা হিন্দিতে কথা বলাকে মর্যাদার মনে করে। বাংলা ভাষার প্রতি তার মনে ভালোবাসা তৈরি করতে পরিবার অথবা বিদ্যালয় কিছু করেছে? রাষ্ট্র কি ভেবে দেখেছে তারও কিছু করার ছিল? যে মায়ের ভাষাকে ভালোবাসতে শেখেনি সে দেশকে কীভাবে ভালোবাসবে?
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হচ্ছে, ক্রমে ক্রমে বাংলার পরিবর্তে রোমান হরফ জায়গা দখল করে নিচ্ছে আমাদের চারপাশে। আবাসন কোম্পানির জায়গা দখলের মতো। এই তো মাত্র ক'দিন আগে মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে আমাদের জাতীয় শিল্পকলা একাডেমিতে ছবি নিয়ে দারুণ এক আন্তর্জাতিক মেলা হলো। মেলার নামটিও চমৎকার বাংলায় 'ছবিমেলা'। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই মেলার পোস্টার এমনকি মূল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যানারেও অনেক বড় করে রোমান হরফে 'ছবিমেলা' লেখা হয়েছিল। সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হওয়া বহুজাতিক বিজ্ঞাপনে, রাস্তায় টাঙানো বড় বড় বিজ্ঞাপন ফলকে আজকাল প্রতিনিয়তই চোখে পড়ে রোমান হরফের আধিক্য। এমনকি বাংলাদেশি চা কিংবা আলকাতরার ঘাড়েও ভর করেছে ঔপনিবেশিক ভূত। চানাচুর তো অনেক আগেই খাওয়া হয়েছে, সম্প্রতি ঝালমুড়িও খাচ্ছে রোমান হরফ।
এই তো আশির দশকেও ভারতের অপর্ণা সেন বাংলাদেশে পা দিয়ে চারদিকে বাংলা বর্ণমালার প্রসার দেখে অভিভূত হয়ে বলেছিলেন, 'বাংলা ভাষার কদর এখন শুধুই বাংলাদেশেই।' আজ ৩০ বছর পরে আমাদের চারপাশ এবং ঘরে-বাইরে তাকিয়ে আমরা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি না প্রিয় বাংলা ভাষা, প্রিয় বর্ণমালা আমি তোমায় ভালোবাসি।
বাংলা ভাষার অনুরাগী একজন পাঠক ও গবেষক হিসেবে বলতে পারি, ভাষা জোর করে কিংবা নদীর মতো বাঁধ দিয়ে আটকিয়ে রাখা যায় না সত্য। মুখের ভাষা নানা কারণে বদলাতেই পারে। বিশ্বায়ন, পণ্য ও সংস্কৃতির কারণে ইংরেজি কিংবা হিন্দি আসবেই। কিন্তু যে ভাষার সঙ্গে আমাদের মহান ত্যাগ, ঐতিহ্য এবং আবেগ জড়িয়ে আছে তার প্রতি অবহেলাও এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ অসম্মান গ্রহণ করতে পারি না। আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের কথা বলি, কিন্তু যেটুকু প্রচলিত আছে তার যে শুদ্ধ কিংবা প্রমিত রূপ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি কম। শিক্ষার মাধ্যম আর অভ্যন্তরীণ পণ্যের বাণিজ্যিক বিনিময়ে বাংলা অনিবার্য কেন হবে না, গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনে অকারণ ইংরেজি কেন আমাদের মুখ ঢেকে দেবে, এ প্রশ্নের উত্তর আমাদেরই খুঁজতে হবে। রাষ্ট্রকেও দায়িত্ব নিতে হবে। উন্নত বিশ্বের কথা বাদই দিলাম, আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলংকায় ভাষা কমিশন রয়েছে, এমনকি ভাষানীতিও। বাংলাদেশে যুগোপযোগী শিক্ষানীতি আছে, নারীনীতি আছে; কিন্তু স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও ভাষা আন্দোলনের এই পুণ্যভূমিতে কোনো ভাষানীতি হয়নি। সময়, প্রকৃতি ও সভ্যতার নিয়মে ভাষা বদলাতেই পারে; কিন্তু রাষ্ট্র কি তার দায়িত্ব থেকে একটি ভাষানীতি দিতে পেরেছে?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার উদ্যোগে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়েছে, আপনি আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট দিয়েছেন; এ বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা কি আপনার কাছে একটি ভাষানীতি কিংবা কার্যকর একটি ভাষা কমিশন প্রত্যাশা করতে পারি?
অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
murshedsm@du.ac.bd
No comments