এবারের একুশে প্রধান বিচারপতির কাছে একটি আবেদন by ফরহাদ মজহার
আদালতে
বাংলা ভাষা পুরোপুরি প্রবর্তন না হওয়ার কারণে সাধারণভাবে আদালত, তবে
বিশেষভাবে উচ্চ আদালত, সংবিধান মানেন না এবং নিজেদের সংবিধান ও
প্রজাতন্ত্রের অধীন গণ্য করেন না- এ ধরনের একটি গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা এটা
থাকার পরও সংবিধান আদালতের জন্য কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। একুশে ফেব্র“য়ারি
উপলক্ষে বাংলা ভাষার প্রতি যদি আমরা আদৌ কোনো শ্রদ্ধা জানাতে চাই, তাহলে
আমাদের প্রথম কাজ হবে সবাই মিলে উচ্চ আদালতের কাছে সংক্ষুব্ধ নাগরিক হিসেবে
এই ফরিয়াদটুকু জানানো যে উচ্চ আদালতের ভাষা বাংলা না হওয়ার কারণে মহামান্য
আদালত সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়া আমল করছেন না, এই উদ্বেগ
আশংকাজনকভাবে বাড়ছে এবং আদালতে বাংলা ভাষা চর্চা উপেক্ষিত হওয়ার কারণে
নাগরিকদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাচ্ছে কি-না সেটা সংশয়ের মধ্যে পতিত
হচ্ছে। এর আশু বিহিত হওয়া দরকার। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলে যে ভাষায়
অভিযুক্ত বোঝে সেই ভাষায় অভিযোগ ব্যাখ্যা ও বর্ণনা করা, যে আইনে তাকে
গ্রেফতার করা হয়েছে সেই আইন সহজ ভাষায় জানানো ও বোঝানো নিশ্চিত করা,
আদালতের সওয়াল জবাব, সাক্ষ্য-প্রমাণ বাদী ও বিবাদী উভয়ে যেন বুঝতে পারে সেই
ভাষায় করা এবং বিচারের রায় সমাজের প্রধান ভাষায় যথাসম্ভব বোধগম্যভাবে দেয়া
জরুরি। দেশীয় আদালতে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য
যেমন এসবের প্রয়োজন, তেমনি একইভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের রীতিনীতি
মান্য করে চলার জন্যও দরকার। বলাবাহুল্য, আদালতের ভাষা যদি বাংলা না হয়ে
ইংরেজি হয় কিংবা আদালত যদি সাধারণের বোধগম্য ভাষা চর্চা না করে, তাহলে
স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা অসম্ভব। বিচারব্যবস্থার প্রকট
অভাব অবিলম্বে নিরসন করা জরুরি। আদালতের সঙ্গে যুক্ত অল্প কিছু ব্যক্তি
যদি আদালতের ভাষার নামে অবস্কিউর, অস্পষ্ট, প্রাচীন, ঔপনিবেশিক, অপরিচ্ছন্ন
এবং সর্বোপরি গতিশীল সমাজের জীবন্ত ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন
পরদেশী ল্যাঙ্গুয়েজ চর্চা করে, তাহলে ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র উভয়ই মারাÍক
হুমকির মুখে পড়ে।
বিষয়টিকে আইন ও বিচারের দিক থেকে বুঝতে হবে। রাষ্ট্রভাষা চেয়ে বাংলাদেশের জনগণ এক অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় স্থাপন করেছে এবং যার জন্য একুশে ফেব্র“য়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ধরা যাক সেগুলো আমাদের জাতীয় গৌরবের দিক, বিচারব্যবস্থার নিজস্ব তাগিদের বাইরের আবেগ। এটাও ধরা যাক সংবিধান যখন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা বলে ঘোষণা দেয়, সেটাও জাতীয় আবেগেরই প্রক্ষেপ মাত্র। সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদের বিধান সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না দেখে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ (১৯৮৭ সালের ২নং আইন) জারি করা হয়েছিল। তর্কের খাতিরে ধরা যাক এই আইনটিও ভাষার জন্য আমাদের ভালোবাসা, আÍত্যাগ ও আবেগের সম্প্রসারণ মাত্র।
কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা কিংবা কোনো জাতীয়তাবোধের প্রতি তাড়িত হয়ে বাংলা ভাষা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা বা না করা আদালতের দিক থেকে বাহ্যিক ব্যাপার। এগুলো বিচারব্যবস্থার বাইরের দিক। বাংলা ভাষার জন্য আমরা আন্দোলন-সংগ্রাম না করলেও আদালতকে তা করতে হতো। সবার জন্য বোধগম্য ভাষায় আদালতকে বৈচারিক কর্মকাণ্ড নির্বাহ করতেই হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন করতে হবে? করতে হবে আদালতকে আদালত হওয়ার জন্যই, নইলে আদালত বড়জোর এজলাসে বসা কিছু ব্যক্তির হুকুম তামিল করার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হয়ে টিকে থাকবে; কিন্তু তার নিজের মর্ম ও মহিমা নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। আদালত যে সিদ্ধান্ত দেয় এবং যেভাবে দেয় তা বলবৎ করা যায় বলেই সেটা রায় হিসেবে আদালতের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ও রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের ভূমিকার কারণে রায় বলে গণ্য হয়। নিছক এজলাসে বসা কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সিদ্ধান্তমাত্র হয়ে থাকে না। এমনও হতে পারে, সমাজে সেই মানুষগুলো নিন্দিত বা সমালোচিত। কোনো মামলা নিয়ে আদালতের বাইরে সমাজের যে কোনো ব্যক্তি সিদ্ধান্ত দিতেই পারে, যিনি সিদ্ধান্ত দেন, আদালতের হাকিমের চেয়ে তিনি অনেক বড় পণ্ডিত হতে পারেন; কিন্তু তার সিদ্ধান্ত আদালতের রায় হয় না। আদালতের সিদ্ধান্ত বল প্রয়োগের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য বলে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ তা কার্যকর করে বলেই আদালতের সিদ্ধান্ত শুধু সিদ্ধান্ত কিংবা আক্ষরিক অর্থে আর জাজমেন্ট থাকে না। রায় হয়। ক্ষমতার সঙ্গে আইন ও আদালতের এই সম্পর্ক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় অচ্ছেদ্য ও অবিচ্ছিন্ন। কিন্তু সমাজ শুধু ক্ষমতা দিয়ে পরিচালিত হয় না। ক্ষমতা সমাজ থেকেই তৈরি হয় এবং সমাজ সেই ক্ষমতাকে ন্যায্যতা দিতে পারে। আবার নাও পারে। আদালতের রায় বলবৎ করার চরিত্র দিয়ে আদালতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ভূমিকা বোঝা যায় না।
সেটা বুঝব কী করে? আমাদের বুঝতে হবে, আদালত শুধু একটি আইনি বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নয়, একই সঙ্গে সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক দ্বন্দ্ব মীমাংসারও ক্ষেত্র। বিশেষত এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে ব্যক্তি ও সমষ্টির দ্বন্দ্ব ও বিরোধের সামাজিক মীমাংসা এবং সেই মীমাংসাকে ন্যায্য বলে সমাজের উপলব্ধি করারও ক্ষেত্র। আদালতের সিদ্ধান্ত বা মীমাংসা সমাজ শুধু আদালত রায় দিয়েছে বলে মানে না, একই সঙ্গে সেই সমস্যার সমাধান সমাজের নীতি-নৈতিকতা, বিবেকবুদ্ধি বা বিবেচনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হয়। বিদ্যমান আইনের কারণে আদালত যদি সংবিধান বা আইনের দ্বারা নিজেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পতিত হয়েছে মনে করে, তাহলে সেই সীমা চিহ্নিত করা এবং নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তার দাবিও তুলতে পারে। আইনি পরিমণ্ডলে সমাজের চিন্তা-চেতনা বিচার-বিবেচনায় পরিবর্তন ঘটে, সেখানে বিবর্তন আছে। ক্ষেত্রবিশেষে আদালতের প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠার উদাহরণ থাকলেও সেই বিবর্তনেও আদালত ভূমিকা রাখে।
ব্যক্তি সামাজিক। কিন্তু সমাজের পক্ষে আদালত ব্যক্তিকে শাস্তি দিয়ে একই সঙ্গে সমাজ ও ব্যক্তির স্বার্থের সীমা সমাজকে মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু আদালত নিজে সমাজের সীমা লংঘন করে সমাজের বিচারবুদ্ধি ও বিবেকের বিপরীতে দাঁড়ালে নিন্দা ও বিরোধিতার মুখোমুখি হয়। সমাজের সপ্রাণ বিবেক ও সজ্ঞান বিচারবুদ্ধির বাইরে আদালত যদি এমন কোনো রায় দেয় যা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে সমাজ মনে করে, তাহলে বিচারক ও আদালত নিন্দিত হয়। সাম্প্রতিককালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দেয়াসহ বেশ কয়েকটি রায় রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি করেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় নাগরিকদের মৃত্যুর ব্যাপারে মানুষ আদালতের ভূমিকা আশা করে। এসব ক্ষেত্রে সমাজে তার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার সুযোগ না থাকলেও কোনো না কোনো সময়ে আদালত কিংবা বিচারককে সমাজের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। বলাবাহুল্য, সামাজিক নীতি-নৈতিকতা কিংবা বাস্তব বা ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে জাত প্রজ্ঞা সংবিধান বা আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখে; কিন্তু তারা নিজের আইনের অন্তর্গত নয়, সেই পরিমণ্ডল আরও বৃহৎ আইনি বৃত্তের বাইরের ব্যাপার।
ওপরের কথাগুলো যদি আমরা বুঝে থাকি, তাহলে এই সত্য বোঝাও কঠিন নয় যে, আদালত সংবিধানের তিন অনুচ্ছেদ কিংবা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন কার্যকর করা থেকে বিরত থাকছে। বাংলা ভাষায় সহজবোধ্যভাবে আদালতের কর্মকাণ্ড পরিচালনা না করার অর্থ শুধু উচ্চ আদালতকে সংবিধান বা আইনের বাইরে রাখা নয়, একই সঙ্গে সমাজের বাইরে রাখাও বটে। উচ্চ আদালতে ইংরেজির চর্চা সংবিধানবিরোধী, আইনবিরোধী এবং একই সঙ্গে সমাজবিরোধীও বটে। বাংলা ভাষায় সমাজের চিন্তাচেতনার বিকাশে আদালত সহায়ক হয়ে উঠতে পারছে না। যে বিকাশের সঙ্গে সামাজিক শৃংখলা এবং স্বচ্ছ, ন্যায়সঙ্গত শাসনব্যবস্থা জারি রাখার প্রশ্ন জড়িত। সর্বোপরি যেখানে সুষ্ঠু চিন্তা ও নীতি-নৈতিকতার পর্যালোচনার প্রশ্ন জড়িত, আদালত তাকে উপেক্ষা ও অবহেলা করছে।
আদালতকে প্রশ্ন করতে হবে, সংবিধান, আইন, আদালত ও বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে ভাষার সম্পর্কটা কী? এটা কি বাহ্যিক? নাকি আন্তরিক? স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু বিচার মাতৃভাষা অর্থাৎ সাধারণের বোধগম্য ভাষায় পরিচালনা ছাড়া নিশ্চিত করা অসম্ভব, এটা বৈচারিক বিধান আকারে মান্যগণ্য করলেও এর মর্ম কত গভীর সেটা আমরা ওপরের আলোচনা থেকে বুঝতে পারি। আইন চর্চার সঙ্গে ভাষা চর্চার এবং ভাষা চর্চার মধ্য দিয়ে পুরো সমাজের সামষ্টিক চৈতন্য ও প্রজ্ঞা চর্চার ক্ষেত্রে আদালত যে বিশেষ ভূমিকা পালন করে, সমাজের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।
কিন্তু ভাষার সঙ্গে উচ্চ আদালতের আরেকটি গভীর সম্পর্ক আছে সে দিকটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। সংবিধান ও আইনের ভাষ্য বা ব্যাখ্যার ওপর আদালত, বিশেষভাবে উচ্চ আদালতের একচ্ছত্র এখতিয়ার মেনে নেয়ার রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও আইনি কারণ রয়েছে। কারণ ভাষার অর্থ বিবিধ। অর্থাৎ সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ, বাক্য বা শব্দের নানা অর্থ হতে পারে। যদি অর্থ বিবিধ হয়, তাহলে বিচার যেমন অসম্ভব, একই সঙ্গে বিবিধার্থ গুরুতর রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট তৈরি করতে পারে। এ কারণে সংবিধান বা আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, এমনকি কোনো শব্দ বা বাক্যের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতেরই একমাত্র এখতিয়ার রয়েছে। অন্য কোনো ব্যাখ্যা রাষ্ট্রের কাছে এবং সমাজের দিক থেকে বলবৎযোগ্য নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদার আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের একটি কথা মনে পড়ছে। তিনি লিখেছিলেন, সংবিধান ব্যাখ্যার একচেটিয়া এখতিয়ার চর্চার ও জুডিশিয়াল রিভিউর মধ্য দিয়ে আদালত এ সত্যই নিশ্চিত করে যে, লিখিত সংবিধানের মধ্য দিয়ে জনগণ যে ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করে, সেটা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নী সংস্থা, অর্থাৎ সিনেট বা জাতীয় সংসদের চেয়েও ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ জাতীয় সংসদও এই ব্যাখ্যা মানতে বাধ্য। এটা সুপ্রিম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ আদালতকে সুপ্রিমকোর্ট বলার গভীর অর্থ এখানেই নিহিত। উচ্চ আদালত ভাষা চর্চার মাধ্যমে সংবিধানের যে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন, যার এখতিয়ার একান্তই সুপ্রিমকোর্টের, সেই চর্চা জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ব্যাখ্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আর সে কারণেই রাষ্ট্রের সব অঙ্গসহ প্রত্যেকে তা মানতে বাধ্য। ভাষার বিবিধার্থ এখানে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কারণ সংবিধানকে সাহিত্যের বই হিসেবে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা গেলেও সুপ্রিমকোর্টের ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত। সুপ্রিম। হ্যামিল্টন বলছেন, আইন প্রণয়নী সংস্থা বা জাতীয় সংসদ জনগণের সাময়িক বা জনগণের খণ্ডিত অংশের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে; কিন্তু সংবিধানের মধ্য দিয়ে যে সামষ্টিক ইচ্ছা প্রতিষ্ঠিত হয়, তা ব্যাখ্যার এখতিয়ার সুপ্রিমকোর্টের। এ দিক থেকে সংসদ উচ্চ আদালতের অধীন, তার ঊর্ধ্বে নয়।
বলাবাহুল্য, জনগণ ইংরেজিতে কথা বলে না। ভাগ্য ভালো, ইংরেজিতে লিখলেও আমাদের সংবিধান বাংলা অনুবাদকেই প্রাধান্য দিয়েছে, ইংরেজিকে নয়। সুপ্রিমকোর্ট বাংলা ভাষায় রায় না লিখলে তাদের রায় জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করে- এটা দাবি করা যায় না। মহামান্য আদলতকে আমার প্রশ্ন, সুপ্রিমকোর্টের ইংরেজি রায় জনগণ মানতে বাধ্য কি-না?
তাহলে আমরা বুঝতে পারছি, উচ্চ আদালতসহ আদালতের সব স্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের দাবি মোটেও হালকা নয়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির সঙ্গে কিংবা সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা বলা কিংবা ১৯৮৭ সালের সব স্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের আইনের চেয়েও অধিক গুরুতর প্রশ্ন। বিচারব্যবস্থা ও আদালতের নিজের দিক থেকে, নিজের জন্য। ইংরেজি ভাষা জানে না বলে সংবিধান, আইন, অভিযোগ ও সওয়াল জবাব যদি বাদী ও বিবাদী বুঝতে না পারে, তাহলে উভয়কেই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়। কেউ কোনো অপরাধে অভিযুক্ত হলে কী কারণে এবং কোন আইনে অভিযুক্ত হয়েছেন সেটা অভিযুক্তের কাছে বোধগম্য ভাষায় বুঝিয়ে বলা আদালতের দায়। ইংরেজিতে লেখা আদালতের রায় জনগণ যদি পড়তে ও বুঝতে না পারে, জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের রক্ষাকর্তা হিসেবে আদালতের ভূমিকা জনগণ বিচার করবে কিভাবে?
উচ্চ আদালতের কাছে এই প্রশ্ন আমি অভিযোগ হিসেবে পেশ করতে চাই না, কারণ ওর মধ্যে আদালতের ভাষা বাংলা করার ব্যবহারিক ও বাস্তব জটিলতা অস্বীকার করে তাকে নিছকই একটি সাংবিধানিক অনুচ্ছেদ ও আইন পালনের বিষয়ে পরিণত করা হয়। এটা আমার ইচ্ছা নয়। শুধু আইন দিয়ে আদালত চলে না, জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে সম্পর্ক চর্চার ক্ষেত্র পরিচ্ছন্ন রাখা চাই। উচ্চ আদালত তাকে আমলে নিচ্ছেন কি-না, সেটাই নাগরিক হিসেবে আমার জানার বিষয়। ফলে একে আমি অভিযোগ হিসেবে নয়, ফরিয়াদ হিসেবে হাজির করতে চাই। ফরিয়াদ কথাটিকে আমরা বাংলা ভাষায় যেভাবে আত্মস্থ করেছি তার মাধুর্য বিপুল এবং তার আইনি তাৎপর্যও অসাধারণ। আদালতের কাছে ফরিয়াদ জানানোর মানে আদালতকে অভিযুক্ত করা নয়, কিংবা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে বিচার চাওয়াও নয়, সেটা হল নাগরিক হিসেবে নিজের সংক্ষুব্ধি এমনভাবে প্রকাশ করা যাতে আদালত বুঝতে পারে এই ফরিয়াদ একজন ব্যক্তির নয়, বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের। একই সঙ্গে, এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- আদালত আসলেই আদালত কি-না তার পরীক্ষার ক্ষেত্রও বটে। উচ্চ আদালতের ইংরেজি রায় অসাংবিধানিক, ১৯৮৭ সালের বিধান অনুযায়ী বেআইনি- এটা আদালত বোঝেন না, তা হতে পারে না। ইংরেজি চর্চার পক্ষে আদালতের একটি রায়ও আছে। যা আদালতের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষুণ্ন করে বলে এখানে তুলতে চাই না। কিন্তু মিনতি করি, উচ্চ আদালত দ্রুত একটি জাতীয় ভাষা কমিটি গঠন করবেন এবং এক্ষেত্রে জাতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবেন। এবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে নতুন প্রধান বিচারপতির কাছে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আমার এ লেখাটিকে বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের পক্ষে একুশের শহীদদের স্মৃতি ধারণ করে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও আইনি মর্মের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আকাক্সক্ষা হিসেবে উচ্চ আদালত পাঠ করবেন, এটাই আমার মিনতি।
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, ৮ ফাল্গন ১৪২১। শ্যামলী। ঢাকা
বিষয়টিকে আইন ও বিচারের দিক থেকে বুঝতে হবে। রাষ্ট্রভাষা চেয়ে বাংলাদেশের জনগণ এক অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় স্থাপন করেছে এবং যার জন্য একুশে ফেব্র“য়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ধরা যাক সেগুলো আমাদের জাতীয় গৌরবের দিক, বিচারব্যবস্থার নিজস্ব তাগিদের বাইরের আবেগ। এটাও ধরা যাক সংবিধান যখন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা বলে ঘোষণা দেয়, সেটাও জাতীয় আবেগেরই প্রক্ষেপ মাত্র। সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদের বিধান সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না দেখে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ (১৯৮৭ সালের ২নং আইন) জারি করা হয়েছিল। তর্কের খাতিরে ধরা যাক এই আইনটিও ভাষার জন্য আমাদের ভালোবাসা, আÍত্যাগ ও আবেগের সম্প্রসারণ মাত্র।
কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা কিংবা কোনো জাতীয়তাবোধের প্রতি তাড়িত হয়ে বাংলা ভাষা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা বা না করা আদালতের দিক থেকে বাহ্যিক ব্যাপার। এগুলো বিচারব্যবস্থার বাইরের দিক। বাংলা ভাষার জন্য আমরা আন্দোলন-সংগ্রাম না করলেও আদালতকে তা করতে হতো। সবার জন্য বোধগম্য ভাষায় আদালতকে বৈচারিক কর্মকাণ্ড নির্বাহ করতেই হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন করতে হবে? করতে হবে আদালতকে আদালত হওয়ার জন্যই, নইলে আদালত বড়জোর এজলাসে বসা কিছু ব্যক্তির হুকুম তামিল করার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হয়ে টিকে থাকবে; কিন্তু তার নিজের মর্ম ও মহিমা নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। আদালত যে সিদ্ধান্ত দেয় এবং যেভাবে দেয় তা বলবৎ করা যায় বলেই সেটা রায় হিসেবে আদালতের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ও রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের ভূমিকার কারণে রায় বলে গণ্য হয়। নিছক এজলাসে বসা কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সিদ্ধান্তমাত্র হয়ে থাকে না। এমনও হতে পারে, সমাজে সেই মানুষগুলো নিন্দিত বা সমালোচিত। কোনো মামলা নিয়ে আদালতের বাইরে সমাজের যে কোনো ব্যক্তি সিদ্ধান্ত দিতেই পারে, যিনি সিদ্ধান্ত দেন, আদালতের হাকিমের চেয়ে তিনি অনেক বড় পণ্ডিত হতে পারেন; কিন্তু তার সিদ্ধান্ত আদালতের রায় হয় না। আদালতের সিদ্ধান্ত বল প্রয়োগের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য বলে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ তা কার্যকর করে বলেই আদালতের সিদ্ধান্ত শুধু সিদ্ধান্ত কিংবা আক্ষরিক অর্থে আর জাজমেন্ট থাকে না। রায় হয়। ক্ষমতার সঙ্গে আইন ও আদালতের এই সম্পর্ক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় অচ্ছেদ্য ও অবিচ্ছিন্ন। কিন্তু সমাজ শুধু ক্ষমতা দিয়ে পরিচালিত হয় না। ক্ষমতা সমাজ থেকেই তৈরি হয় এবং সমাজ সেই ক্ষমতাকে ন্যায্যতা দিতে পারে। আবার নাও পারে। আদালতের রায় বলবৎ করার চরিত্র দিয়ে আদালতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ভূমিকা বোঝা যায় না।
সেটা বুঝব কী করে? আমাদের বুঝতে হবে, আদালত শুধু একটি আইনি বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নয়, একই সঙ্গে সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক দ্বন্দ্ব মীমাংসারও ক্ষেত্র। বিশেষত এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে ব্যক্তি ও সমষ্টির দ্বন্দ্ব ও বিরোধের সামাজিক মীমাংসা এবং সেই মীমাংসাকে ন্যায্য বলে সমাজের উপলব্ধি করারও ক্ষেত্র। আদালতের সিদ্ধান্ত বা মীমাংসা সমাজ শুধু আদালত রায় দিয়েছে বলে মানে না, একই সঙ্গে সেই সমস্যার সমাধান সমাজের নীতি-নৈতিকতা, বিবেকবুদ্ধি বা বিবেচনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হয়। বিদ্যমান আইনের কারণে আদালত যদি সংবিধান বা আইনের দ্বারা নিজেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পতিত হয়েছে মনে করে, তাহলে সেই সীমা চিহ্নিত করা এবং নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তার দাবিও তুলতে পারে। আইনি পরিমণ্ডলে সমাজের চিন্তা-চেতনা বিচার-বিবেচনায় পরিবর্তন ঘটে, সেখানে বিবর্তন আছে। ক্ষেত্রবিশেষে আদালতের প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠার উদাহরণ থাকলেও সেই বিবর্তনেও আদালত ভূমিকা রাখে।
ব্যক্তি সামাজিক। কিন্তু সমাজের পক্ষে আদালত ব্যক্তিকে শাস্তি দিয়ে একই সঙ্গে সমাজ ও ব্যক্তির স্বার্থের সীমা সমাজকে মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু আদালত নিজে সমাজের সীমা লংঘন করে সমাজের বিচারবুদ্ধি ও বিবেকের বিপরীতে দাঁড়ালে নিন্দা ও বিরোধিতার মুখোমুখি হয়। সমাজের সপ্রাণ বিবেক ও সজ্ঞান বিচারবুদ্ধির বাইরে আদালত যদি এমন কোনো রায় দেয় যা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে সমাজ মনে করে, তাহলে বিচারক ও আদালত নিন্দিত হয়। সাম্প্রতিককালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দেয়াসহ বেশ কয়েকটি রায় রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি করেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় নাগরিকদের মৃত্যুর ব্যাপারে মানুষ আদালতের ভূমিকা আশা করে। এসব ক্ষেত্রে সমাজে তার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার সুযোগ না থাকলেও কোনো না কোনো সময়ে আদালত কিংবা বিচারককে সমাজের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। বলাবাহুল্য, সামাজিক নীতি-নৈতিকতা কিংবা বাস্তব বা ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে জাত প্রজ্ঞা সংবিধান বা আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখে; কিন্তু তারা নিজের আইনের অন্তর্গত নয়, সেই পরিমণ্ডল আরও বৃহৎ আইনি বৃত্তের বাইরের ব্যাপার।
ওপরের কথাগুলো যদি আমরা বুঝে থাকি, তাহলে এই সত্য বোঝাও কঠিন নয় যে, আদালত সংবিধানের তিন অনুচ্ছেদ কিংবা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন কার্যকর করা থেকে বিরত থাকছে। বাংলা ভাষায় সহজবোধ্যভাবে আদালতের কর্মকাণ্ড পরিচালনা না করার অর্থ শুধু উচ্চ আদালতকে সংবিধান বা আইনের বাইরে রাখা নয়, একই সঙ্গে সমাজের বাইরে রাখাও বটে। উচ্চ আদালতে ইংরেজির চর্চা সংবিধানবিরোধী, আইনবিরোধী এবং একই সঙ্গে সমাজবিরোধীও বটে। বাংলা ভাষায় সমাজের চিন্তাচেতনার বিকাশে আদালত সহায়ক হয়ে উঠতে পারছে না। যে বিকাশের সঙ্গে সামাজিক শৃংখলা এবং স্বচ্ছ, ন্যায়সঙ্গত শাসনব্যবস্থা জারি রাখার প্রশ্ন জড়িত। সর্বোপরি যেখানে সুষ্ঠু চিন্তা ও নীতি-নৈতিকতার পর্যালোচনার প্রশ্ন জড়িত, আদালত তাকে উপেক্ষা ও অবহেলা করছে।
আদালতকে প্রশ্ন করতে হবে, সংবিধান, আইন, আদালত ও বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে ভাষার সম্পর্কটা কী? এটা কি বাহ্যিক? নাকি আন্তরিক? স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু বিচার মাতৃভাষা অর্থাৎ সাধারণের বোধগম্য ভাষায় পরিচালনা ছাড়া নিশ্চিত করা অসম্ভব, এটা বৈচারিক বিধান আকারে মান্যগণ্য করলেও এর মর্ম কত গভীর সেটা আমরা ওপরের আলোচনা থেকে বুঝতে পারি। আইন চর্চার সঙ্গে ভাষা চর্চার এবং ভাষা চর্চার মধ্য দিয়ে পুরো সমাজের সামষ্টিক চৈতন্য ও প্রজ্ঞা চর্চার ক্ষেত্রে আদালত যে বিশেষ ভূমিকা পালন করে, সমাজের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।
কিন্তু ভাষার সঙ্গে উচ্চ আদালতের আরেকটি গভীর সম্পর্ক আছে সে দিকটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। সংবিধান ও আইনের ভাষ্য বা ব্যাখ্যার ওপর আদালত, বিশেষভাবে উচ্চ আদালতের একচ্ছত্র এখতিয়ার মেনে নেয়ার রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও আইনি কারণ রয়েছে। কারণ ভাষার অর্থ বিবিধ। অর্থাৎ সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ, বাক্য বা শব্দের নানা অর্থ হতে পারে। যদি অর্থ বিবিধ হয়, তাহলে বিচার যেমন অসম্ভব, একই সঙ্গে বিবিধার্থ গুরুতর রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট তৈরি করতে পারে। এ কারণে সংবিধান বা আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, এমনকি কোনো শব্দ বা বাক্যের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতেরই একমাত্র এখতিয়ার রয়েছে। অন্য কোনো ব্যাখ্যা রাষ্ট্রের কাছে এবং সমাজের দিক থেকে বলবৎযোগ্য নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদার আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের একটি কথা মনে পড়ছে। তিনি লিখেছিলেন, সংবিধান ব্যাখ্যার একচেটিয়া এখতিয়ার চর্চার ও জুডিশিয়াল রিভিউর মধ্য দিয়ে আদালত এ সত্যই নিশ্চিত করে যে, লিখিত সংবিধানের মধ্য দিয়ে জনগণ যে ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করে, সেটা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নী সংস্থা, অর্থাৎ সিনেট বা জাতীয় সংসদের চেয়েও ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ জাতীয় সংসদও এই ব্যাখ্যা মানতে বাধ্য। এটা সুপ্রিম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ আদালতকে সুপ্রিমকোর্ট বলার গভীর অর্থ এখানেই নিহিত। উচ্চ আদালত ভাষা চর্চার মাধ্যমে সংবিধানের যে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন, যার এখতিয়ার একান্তই সুপ্রিমকোর্টের, সেই চর্চা জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ব্যাখ্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আর সে কারণেই রাষ্ট্রের সব অঙ্গসহ প্রত্যেকে তা মানতে বাধ্য। ভাষার বিবিধার্থ এখানে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কারণ সংবিধানকে সাহিত্যের বই হিসেবে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা গেলেও সুপ্রিমকোর্টের ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত। সুপ্রিম। হ্যামিল্টন বলছেন, আইন প্রণয়নী সংস্থা বা জাতীয় সংসদ জনগণের সাময়িক বা জনগণের খণ্ডিত অংশের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে; কিন্তু সংবিধানের মধ্য দিয়ে যে সামষ্টিক ইচ্ছা প্রতিষ্ঠিত হয়, তা ব্যাখ্যার এখতিয়ার সুপ্রিমকোর্টের। এ দিক থেকে সংসদ উচ্চ আদালতের অধীন, তার ঊর্ধ্বে নয়।
বলাবাহুল্য, জনগণ ইংরেজিতে কথা বলে না। ভাগ্য ভালো, ইংরেজিতে লিখলেও আমাদের সংবিধান বাংলা অনুবাদকেই প্রাধান্য দিয়েছে, ইংরেজিকে নয়। সুপ্রিমকোর্ট বাংলা ভাষায় রায় না লিখলে তাদের রায় জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করে- এটা দাবি করা যায় না। মহামান্য আদলতকে আমার প্রশ্ন, সুপ্রিমকোর্টের ইংরেজি রায় জনগণ মানতে বাধ্য কি-না?
তাহলে আমরা বুঝতে পারছি, উচ্চ আদালতসহ আদালতের সব স্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের দাবি মোটেও হালকা নয়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির সঙ্গে কিংবা সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা বলা কিংবা ১৯৮৭ সালের সব স্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের আইনের চেয়েও অধিক গুরুতর প্রশ্ন। বিচারব্যবস্থা ও আদালতের নিজের দিক থেকে, নিজের জন্য। ইংরেজি ভাষা জানে না বলে সংবিধান, আইন, অভিযোগ ও সওয়াল জবাব যদি বাদী ও বিবাদী বুঝতে না পারে, তাহলে উভয়কেই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়। কেউ কোনো অপরাধে অভিযুক্ত হলে কী কারণে এবং কোন আইনে অভিযুক্ত হয়েছেন সেটা অভিযুক্তের কাছে বোধগম্য ভাষায় বুঝিয়ে বলা আদালতের দায়। ইংরেজিতে লেখা আদালতের রায় জনগণ যদি পড়তে ও বুঝতে না পারে, জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের রক্ষাকর্তা হিসেবে আদালতের ভূমিকা জনগণ বিচার করবে কিভাবে?
উচ্চ আদালতের কাছে এই প্রশ্ন আমি অভিযোগ হিসেবে পেশ করতে চাই না, কারণ ওর মধ্যে আদালতের ভাষা বাংলা করার ব্যবহারিক ও বাস্তব জটিলতা অস্বীকার করে তাকে নিছকই একটি সাংবিধানিক অনুচ্ছেদ ও আইন পালনের বিষয়ে পরিণত করা হয়। এটা আমার ইচ্ছা নয়। শুধু আইন দিয়ে আদালত চলে না, জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে সম্পর্ক চর্চার ক্ষেত্র পরিচ্ছন্ন রাখা চাই। উচ্চ আদালত তাকে আমলে নিচ্ছেন কি-না, সেটাই নাগরিক হিসেবে আমার জানার বিষয়। ফলে একে আমি অভিযোগ হিসেবে নয়, ফরিয়াদ হিসেবে হাজির করতে চাই। ফরিয়াদ কথাটিকে আমরা বাংলা ভাষায় যেভাবে আত্মস্থ করেছি তার মাধুর্য বিপুল এবং তার আইনি তাৎপর্যও অসাধারণ। আদালতের কাছে ফরিয়াদ জানানোর মানে আদালতকে অভিযুক্ত করা নয়, কিংবা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে বিচার চাওয়াও নয়, সেটা হল নাগরিক হিসেবে নিজের সংক্ষুব্ধি এমনভাবে প্রকাশ করা যাতে আদালত বুঝতে পারে এই ফরিয়াদ একজন ব্যক্তির নয়, বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের। একই সঙ্গে, এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- আদালত আসলেই আদালত কি-না তার পরীক্ষার ক্ষেত্রও বটে। উচ্চ আদালতের ইংরেজি রায় অসাংবিধানিক, ১৯৮৭ সালের বিধান অনুযায়ী বেআইনি- এটা আদালত বোঝেন না, তা হতে পারে না। ইংরেজি চর্চার পক্ষে আদালতের একটি রায়ও আছে। যা আদালতের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষুণ্ন করে বলে এখানে তুলতে চাই না। কিন্তু মিনতি করি, উচ্চ আদালত দ্রুত একটি জাতীয় ভাষা কমিটি গঠন করবেন এবং এক্ষেত্রে জাতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবেন। এবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে নতুন প্রধান বিচারপতির কাছে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আমার এ লেখাটিকে বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের পক্ষে একুশের শহীদদের স্মৃতি ধারণ করে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও আইনি মর্মের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আকাক্সক্ষা হিসেবে উচ্চ আদালত পাঠ করবেন, এটাই আমার মিনতি।
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, ৮ ফাল্গন ১৪২১। শ্যামলী। ঢাকা
No comments