পৌনে তেরো আনাই খাদ by সৈয়দ আবুল মকসুদ
১০০ বছর আগে সুনামগঞ্জের মরমি পল্লিকবি
রাধারমণ দত্ত লিখে গেছেন গানটি। বহুদিন পর তাতে সুরারোপ করেন প্রখ্যাত
সংগীতশিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী। জনপ্রিয় গানটি হলো:
যে জন প্রেমের ভাব জানে না,
তার সঙ্গে নাই লেনাদেনা;
খাঁটি সোনা ছাড়িয়া যে নেয়
নকল সোনা,
সে জন সোনা চেনে না।
যে জন প্রেমের ভাব জানে না,
তার সঙ্গে নাই লেনাদেনা;
খাঁটি সোনা ছাড়িয়া যে নেয়
নকল সোনা,
সে জন সোনা চেনে না।
গানটির কথাগুলো মনে পড়ল প্রীতিভাজনিয়া রোজিনা ইসলামের প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পড়ে। ‘বিদেশি বন্ধু ও সংগঠনকে মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা/ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে!’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের
জন্য বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠনকে সম্মাননার সময় দেওয়া ক্রেস্টে যে পরিমাণ স্বর্ণ থাকার কথা ছিল, তা দেওয়া হয়নি। আর ক্রেস্টে রুপার বদলে দেওয়া হয় পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত সংকর ধাতু।
‘বিদেশিদের সম্মাননা প্রদানসংক্রান্ত নীতিমালায় বলা আছে, প্রতিটি ক্রেস্টে এক ভরি (১৬ আনা) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রুপা থাকবে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে করা বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় দেখা গেছে, এক ভরির (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) জায়গায় ক্রেস্টে স্বর্ণ পাওয়া গেছে মাত্র ২ দশমিক ৩৬৩ গ্রাম (সোয়া তিন আনা)। এক ভরির মধ্যে প্রায় ১২ আনাই নেই। আর রুপার বদলে ৩০ ভরি বা যে ৩৫১ গ্রাম পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত সংকর ধাতু পাওয়া গেছে।’
যে জন সোনা চেনে না, তার কাছে খাঁটি সোনাই কী আর নকল সোনাই বা কী! তৃতীয় পর্বে সম্মাননা প্রাপক ৬১ ব্যক্তি ও সংগঠনের মধ্যে যাঁরা উপমহাদেশের বাইরে অন্যান্য দেশের, তাঁরা খাঁটি আর নকল নিয়ে বোধ হয় মাথা ঘামাননি। তা ছাড়া রোজিনার প্রতিবেদনের একটি সুবিধা এই যে তা বাংলা ভাষায় লেখা। অবাংলাভাষী সম্মাননা গ্রহীতারা সোনা তিন আনাকেই মনে করবেন ১৬ আনা। সীমান্তের ওপারের সম্মাননা প্রাপক কেউ অনলাইনে এই প্রতিবেদন পড়ে মাথায় হাত দেবেন। বলবেন: ‘হায়, একি পেলুম!’ তবে তাঁরা বন্ধু-সরকারকে বিব্রতও করতে চাইবেন না। অনেকেই সস্ত্রীক এসেছিলেন ঢাকায়। ধারণা করি, এই প্রতিবেদন তাঁদের সম্মাননা পাওয়ার পরদিনও যদি প্রকাশিত হতো, তবু বাঙালি প্রাপকদের পত্নীরা সান্ত্বনা দিয়ে স্বামীকে রবীন্দ্রসংগীত শোনাতেন: ‘যাহা পাও তাই লও, হাসিমুখে ফিরে যাও।’
এই প্রতিবেদন দেখে মনে পড়ল আমার পিতৃপ্রতিম কথাশিল্পী শওকত ওসমানকে। মাঝেমধ্যে তিনি সকালে হাঁটতে হাঁটতে আমার বাসায় আসতেন। একসঙ্গে নাশতা করতাম। একদিন বেশ বেলাবেলিতে খানিকটা উত্তেজিত অবস্থায় এলেন। তিনি ছিলেন অতি আবেগপ্রবণ, স্নেহশীল ও ছাত্রবৎসল। বললেন, জলদি চলো আমার সঙ্গে বায়তুল মোকাররম মার্কেটে। একুশে পদক হিসেবে তাঁকে যে মেডেলটি দেওয়া হয়েছিল, স্যাকরার দোকানে গিয়ে তা পরীক্ষা করে দেখা গেল, তাতে খাদ ভর্তি। সেটা পল্লিবন্ধুর শাসনামল। তা নিয়ে কাগজে লেখালেখি হলো। তিনি বলেন, আমার মেডেল-টেডেলের দরকার নেই। মেডেলে যে পরিমাণ স্বর্ণ থাকার কথা, সেই পরিমাণ স্বর্ণের দামটা আমাকে দিলেই আমি বর্তে যাই।
মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা প্রাপক ব্যক্তিরা দেশদেশান্তরে ছড়িয়ে আছেন। তাঁরা শওকত ওসমান স্যারের ব্যাপারটা জানেন না। তাই তাঁর পথ অনুস্মরণ করতে যাবেন, সে সম্ভাবনা নেই। তবে এসব পদক-পুরস্কারের সোনার মেডেলে যে ১৩ আনাই খাদ ও ভেজাল দিয়ে হয়, তা আমাদের নেতা ও তাঁদের সহযোগী কর্মকর্তারা আলবৎ জানেন।
মুক্তিযুদ্ধে বিদেশিদের যাঁরা আমাদের সাহায্য করেছেন, তাঁদের সম্মান জানানো আমাদের জাতীয় কর্তব্য—এ কথাটা আমি দুই যুগ আগে অধ্যাপক মেসবাহ কামালের পত্রিকা সমাজ চেতনায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, জয়প্রকাশ নারায়ণ, আদ্রেঁ মালরোসহ অনেকের নামও উল্লেখ করেছিলাম। তখন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সদ্য ক্ষমতাসীন হয়েছেন। আমি কোথাকার কোন কে যে সরকার আমার কথা শুনবে? যা হোক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সরকারও গেল। পরের বার তিনি সরকার গঠন করে এই জাতীয় গুরুদায়িত্বটি সম্পন্ন করেন। তবে একপর্যায়ে আমার মনে একটু খটকা বাধল, যখন দেখলাম সম্মাননা প্রাপকদের তালিকা ক্রমাগত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ব্যাপার কী? কত বন্ধু আমাদের? রোজিনার প্রতিবেদন পড়ে ব্যাপারটা পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। যত বেশি মানুষকে সম্মাননা দেওয়া হবে, তত...।
তবে একটি জিনিস ভেবে আমি তাজ্জব না হয়ে পারিনি। তা হলো, বর্তমানে বাংলাদেশে সোনায় ভেজাল দেওয়া হবে কেন? খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল হবে, নির্মাণসামগ্রীতে ভেজাল হবে, যাবতীয় জিনিসে ভেজাল হলেও স্বর্ণে ভেজাল কেন? দেশে কি এখন স্বর্ণের অভাব? স্বাধীনতার আগে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের যুগে, স্বর্ণও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ব বাংলার চেয়ে সস্তা। সে জন্য কেউ কেউ করাচি-লাহোর থেকে ঢাকায় আসার সময় কয়েক ভরি স্বর্ণ গোপনে আনত। কাগজে সে খবর বেরোত। কেউ সোনার পাত ঢোকাত জুতার সুকতলিতে, কেউ মোজার মধ্যে, কেউ গুহ্যদ্বারে। ওর ভেতরেই যে কয় ভরি আনা সম্ভব আনত। ধরা পড়ে দিন কয়েক শ্রীঘরে কাটাত। এখন এক মণ সোনা আনলেও নাজিমউদ্দিন রোড বা কাশিমপুরের দালানে ঢোকার আশঙ্কা নেই। এখন সোনার অভাব কোথায়? পাঁচ-দশ কেজি সোনা তো এখন বাংলাদেশ বিমানের টয়লেটে, বিমানবন্দরের বারান্দায় কিংবা কনভেয়ার বেল্টের ওপরই পড়ে থাকতে দেখা যায়। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা ক্রেস্টে ভেজাল না দিয়ে সোনা চোরাচালানিদের বলে দিলেই মন্ত্রণালয়ে সোনার বিস্কুট পৌঁছে যেত।
প্রতিবেদনটিতে জানা গেল, ‘উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়া এই ক্রেস্ট কেনা হয়েছিল। ৩৩৮টির মধ্যে ৬০টি ছাড়া বাকি সব ক্রেস্ট সরবরাহ করেছে এমিকন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তবে ৬০টি ক্রেস্ট কোন প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করেছে, মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে তা জানা সম্ভব হয়নি।’ কী মুশকিলের কথা! রাষ্ট্রীয় গোপনীয় তথ্য কেন তাঁরা মিডিয়ার লোকদের জানাবেন? পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে প্রতিবেদক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকের কাছে জানতে চাইলে, তিনি বলেন, ‘বিএসটিআই স্বর্ণগুলো মেশিনে তাপ দিয়ে গলিয়েছে। গলানোর পর পানি বের হয়েছে এবং তার সঙ্গে স্বর্ণ চলে গেছে।’ অর্থাৎ পরীক্ষায় যাওয়াটাই হয়েছে ভুল।
ক্রয় কমিটির ব্যক্তিরা বলতে চাইছেন, যা হওয়ার হয়ে গেছে, এত দিন পর সোনা নিয়ে টানাটানির দরকার কী? এক সদস্য সাফ জবাব দিয়েছেন, ‘স্বর্ণ তো কোটিং করা হয়েছে। কোটিংকে আলাদা করে পরীক্ষা করা হলে পুনরায় স্বর্ণ পাওয়া দুষ্কর।’
স্বর্ণ কার কাছ থেকে কিনেছিলেন, প্রতিবেদকের এ ধরনের অন্যায় প্রশ্নের জবাবে সরবরাহকারী বলেন, ‘তাঁতীবাজার থেকে কিনেছি।’ কোন দোকান থেকে কিনেছেন, এ প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব দেননি তিনি। স্বর্ণ কেনার রসিদ আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেক দিন আগের কাগজপত্র। তাই খুঁজে পাব কি না, সন্দেহ।’ তাঁর সন্দেহ থাকলেও আমাদের কিন্তু কোনোই সন্দেহ নেই। কাগজ খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। তারপর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে যে রসিদ রচনা করা হবে, তার রচনাকাল হবে ৬ এপ্রিলের পরবর্তী কোনো শুভদিন।
একটি বিল থেকে দেখা যায়, একটি ক্রেস্টের জন্য ২৩ দশমিক ৫ গ্রাম স্বর্ণ আর ৩০ গ্রাম রুপার বিল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নীতিমালা অনুযায়ী স্বর্ণ দেওয়ার কথা ছিল ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম। ‘ওই বিলে ২৩ দশমিক ৫ গ্রাম স্বর্ণ এক লাখ ১৬ হাজার ৩২৫ টাকা, ৩০ গ্রাম রুপার জন্য ৮৭ হাজার টাকা, ধাতব মানপত্র পাঁচ হাজার টাকা, রুপা গলানো ও ছাঁচ তৈরি বাবদ ১৫ হাজার টাকা, ক্রেস্ট রাখার জন্য জামদানি বর্ডার দেওয়া কাঠের বাক্স বাবদ ১৫ হাজার টাকা, স্বর্ণ ও রুপা প্রক্রিয়াকরণ বাবদ ২৫ হাজার টাকা মিলিয়ে মোট দুই লাখ ৬৩ হাজার ৩২৫ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।’ চাওয়া হলো সাড়ে ১১ গ্রাম, বিল পরিশোধ করা হলো ২৩ গ্রামের। না চাইতেই দ্বিগুণেরও বেশি স্বর্ণ দেওয়ার কারণ, বাংলাদেশে এখন প্লাটিনামের কিছু অভাব থাকলেও, আগেই বলেছি, সোনার কোনো ঘাটতি নেই।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা গেল, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বিএসটিআইয়ের পরীক্ষার প্রতিবেদন পেলেও ক্রেস্ট সরবরাহকারীসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কী আশ্চর্যের কথা! কেন ব্যবস্থা নেবে?
যেখানে দুধে ভেজাল, ঘিয়ে ভেজাল, গুঁড়া হলুদ-মরিচে ইটের গুঁড়া, মহান মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট জাল, নেতা-নেত্রীর জন্মতারিখ জাল, উঁচু পদের কর্মকর্তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট জাল, স্বাধীনতাসংক্রান্ত তথ্য জাল, সেখানে স্বর্ণে ভেজাল থাকলে ক্ষতি কী? নির্বাচনের ফলাফল জাল। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান সংসদ। যে দেশে সেই সংসদেই ভেজাল, সংসদের কথিত বিরোধী দলে ভেজাল, সেখানে স্বর্ণে ভেজাল তো মামুলি ব্যাপার। সোনার বাংলারও যে ১৫ আনাই ভেজাল হবে, তাতেই বা সন্দেহ কার?
এ ঘটনায় আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে যা, তা হলো, রসায়নবিজ্ঞানের ইতিহাসে যোগ হলো এক নতুন অধ্যায়। পিতল, তামা ও দস্তা কিঞ্চিৎ স্বর্ণের সঙ্গে মিশিয়ে জন্ম নিল এক নতুন ধাতু, তার নাম ‘পিতাদ’। প্রখ্যাত রসায়নবিজ্ঞানী কুদরাত-এ-খুদাও এ ধাতু বানাতে পারতেন না। সংকর ধাতু সৃষ্টি করে আমরা আরেকটি ইতিহাস গড়লাম।
লাখ লাখ শহীদের আত্মা নিঃশব্দ চিৎকার করে বলছে: ‘তোরা চুরিচামারি করবি তো কর। সে জন্য বহু প্রকল্প রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা থেকে কেন? তোরা চেতনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আর কত নিচে নামবি। ছেলেমেয়ে বিদেশে পাঠাবি, বাড়ি করবি, রাজউকের প্লট ও খাসজমি কিনবি, নতুন মডেলের গাড়ি কিনবি—টাকার দরকার। অন্য প্রকল্পের টাকা মার (মারা শব্দটি মহাজোট নেতাদের মুখের)। কাজ না করে প্রকল্পের টাকা তুলে নে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নামে এ কী করছিস? ছি, তোরা মানুষ না!’
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments