আমাদের সিন্দুকভরা ডলার by ফারুক মঈনউদ্দীন
প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধি বোঝাতে একসময়
গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ আর গোয়ালভরা গরু—এমন অবস্থাকেই বোঝানো হতো। সেই
অতি সরল সমৃদ্ধির মাপকাঠিটা কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে, উপচে পড়া সম্পদ আগলে
বসে থাকা এখন আর অর্থনৈতিক সুবিবেচনার পরিচয় বহন করে না। কয়েক বছর ধরে
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সিন্দুকভরা এই ডলার
নিয়ে আমরা কী করব, আমাদের কতখানি মজুত থাকা উচিত—এসব প্রশ্ন উঠে আসছে
বিভিন্ন আলোচনায়। ইতিমধ্যে (ফেব্রুয়ারি ২০১৪) আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত
এক হাজার ৯০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে, এই প্রবণতায় জুন নাগাদ দুই হাজার কোটি
ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
আমাদের এই রিজার্ভের বিষয়টি শুধু একাডেমিক বিতর্কে থেমে নেই। এমনও বলা হচ্ছে, বিনিয়োগবিহীন এই রিজার্ভ ধরে রাখা অর্থনীতির দুর্বলতা, সরকারের অদক্ষতা ইত্যাদি। এ অবস্থার জন্য দায়ী করা হচ্ছে বিনিয়োগের মন্দাকে, যে কারণে শিল্পের জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির আমদানি প্রত্যাশা মোতাবেক হচ্ছে না। ঢালাওভাবে বলা হচ্ছে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সমস্যা, ব্যাংকঋণের চড়া সুদ, দেশে শিল্পায়নের প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবের কারণে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হচ্ছে না বলেই আমদানি খরচ কমে গিয়ে রিজার্ভ বেড়ে যাচ্ছে।
এ কথা ঠিক, অর্থনীতির গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি ঘটছে না, তবে রিজার্ভ বৃদ্ধির বিষয়টিকে সর্বতোভাবে নেতিবাচক গণ্য করার যুক্তি নেই। বুঝতে হবে, কেবল বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে রিজার্ভ বেড়ে যায়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের ক্রমবর্ধমান প্রবাসী-আয় ও রপ্তানির প্রবৃদ্ধি। গত বছরের প্রায় পুরোটা সময় দেশে চলেছে রাজনৈতিক সহিংসতা ও অস্থিরতা। সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আমাদের রপ্তানি আয় ও প্রবাসী-আয়প্রবাহ সচল ছিল, ফলে গড়ে উঠেছে এই সম্মানজনক রিজার্ভ।
আমরা যদি বড় আকারের রিজার্ভের প্রয়োজনীয়তাগুলো বিবেচনা করি, তাহলে হয়তো এই রিজার্ভ সঠিকভাবে ব্যয় বা বিনিয়োগ করার সুযোগগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়ার প্রয়াস পাব। দেশের রিজার্ভে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা মজুত থাকলে যেকোনো জরুরি অবস্থায় অত্যাবশ্যক পণ্য আমদানির খরচ নির্বাহ করা যায়।
একটি দেশের এই আত্মবিশ্বাস থাকলে বিদেশি সাহায্য বা ঋণের বিপরীতে যেকোনো বিরূপ শর্তের বিরুদ্ধে দর-কষাকষির সুযোগ থাকে। বৈদেশিক মুদ্রার বড় সঞ্চিতি স্থানীয় মুদ্রার বিপরীতে নিরাপত্তাসহায়ক হিসেবে কাজ করে। তা ছাড়া, বড় রিজার্ভ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নকামী একটা দেশের ঋণ পরিশোধ ক্ষমতার মাপকাঠি, ফলে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর আস্থা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। দেশের সংকটকালে কিংবা কোনো বিশ্বমন্দাকালীন পরিস্থিতিতে একটা বড় রিজার্ভ দিতে পারে প্রয়োজনীয় নিশ্চিতি। অর্থনীতিবিদ আহসান হাবিব মনসুর দেশের এই অর্থনৈতিক আত্মবিশ্বাসের বিষয়টিকে সরাসরি যুক্ত করেছেন ১৯৯৭ সালের পূর্ব এশীয় সংকটের সঙ্গে। এ সময় পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে বৈদেশিক মুদ্রার যে সংকট দেখা দিয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা থেকে বড় অঙ্কের একটা রিজার্ভ রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা যৌক্তিক।
সাধারণ হিসাবে ধরা হয়, তিন মাসের খাদ্য কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি খরচের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থাকা বাঞ্ছনীয়। কাঙ্ক্ষিত রিজার্ভের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য বহু কিছু বিবেচনায় রাখতে হয়, যেমন মুদ্রাব্যবস্থা, লেনদেন ভারসাম্যের আকার ও প্রকৃতি এবং এটাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম নানাবিধ বৈদেশিক উপাদান, অর্থনীতিতে বিদেশি তহবিল ব্যবহার করার ক্ষমতা ইত্যাদি। বিভিন্ন দেশের নিজ নিজ অর্থনীতির বাস্তবতা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত রিজার্ভের বিষয়টি নির্ধারণ করা যায়। যেমন, উন্নত অর্থনীতিতে রিজার্ভ বেশি রাখার প্রয়োজন পড়ে না, কারণ তাদের নিজস্ব মুদ্রা বিনিময়যোগ্য ও বহির্বিশ্বে স্বীকৃত। পক্ষান্তরে, উন্নয়নশীল দেশের দুর্বল অর্থনীতি, নিম্ন রপ্তানি আয়, স্থানীয় মুদ্রার অগ্রহণযোগ্যতা—এসব কারণে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতি বেশি রাখতে হয়।
এ বিষয়ে সাবেক আর্জেন্টাইন ডেপুটি অর্থমন্ত্রী পাবলো গুইদোত্তি ও ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান এলান গ্রিনস্পানের একটা তত্ত্ব আছে, যার নাম গুইদোত্তি-গ্রিনস্পান তত্ত্ব। এই হিসাবে কোনো উন্নয়নশীল দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এমন থাকা উচিত, যাতে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের দায় মেটানো যায়। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হবে দেশটির এক বছর কিংবা তার কম মেয়াদের বৈদেশিক ঋণের সমান। স্মরণে রাখতে হবে, ১৯৮৯-৯০ সালে আমাদের এমন কঠিন সময়ও গেছে, যখন মাত্র দেড় মাসের আমদানি খরচ মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল। সেই উদ্বেগজনক অবস্থা থেকে আজকের উত্তরণ শ্লাঘার বিষয় বৈকি। উল্লেখ্য, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রায় ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের পরই। চীন কিংবা জাপানে এই রিজার্ভ যথাক্রমে তাদের ১৮ ও ১৪ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান।
এ কথা অনস্বীকার্য যে অব্যবহূত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বহন করার কিছু অসুবিধা বা দুর্বলতাও রয়েছে। প্রথমত, বিশাল পরিমাণের এই রিজার্ভ রক্ষিত থাকে বিদেশে। দেশের বাইরে সুদের হার অতি নগণ্য বলে সেই গচ্ছিত রিজার্ভ থেকে আমরা খুব সামান্যই লাভবান হই। অন্যদিকে, এই রিজার্ভের একটা অংশ যদি বেশি লাভজনক কোনো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা যেত, তাহলে সেটা হতো কাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থা।
দ্বিতীয়ত, দেশে আসা বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে স্থানীয় মুদ্রা ছাড় করা হয় বলে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে, যদি বিদেশি আয়কে কোনো উৎপাদনশীল খাতে প্রবাহিত করা না যায়। তৃতীয়ত, বড় রিজার্ভ ধরে রাখার মধ্যে কিছু ঝুঁকি থেকে যায়, যেমন বৈদেশিক মুদ্রার যদি অবমূল্যায়ন ঘটে, তাহলে রক্ষিত রিজার্ভের মূল্যেরও অবনতি ঘটে। ফলে বড় অঙ্কের রিজার্ভও কখনো হয়ে উঠতে পারে সম্ভাব্য ক্ষতির কারণ। দেখা যাচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর যেখানে মহার্ঘ বিদেশি মুদ্রা খরচের বেলায় হিসাবি হওয়া উচিত, সেখানে বড় অঙ্কের রিজার্ভ রক্ষা করতে গিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষতি কখনো বা অধিকতর লাভজনক বিনিয়োগের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের ধারণা, এই উচ্চ রিজার্ভ ধরে রাখার প্রবণতা মুদ্রাসংকট থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য নয়, বরং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়মূল্য নিয়ে নয়ছয় করার সুযোগ রাখার জন্য পথ খুলে রাখা। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য যে উদাহরণটি টানা হয়ে থাকে, সেটি হচ্ছে ১৮ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো চীনের বিশাল রিজার্ভ।
বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষজ্ঞ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা সৈয়দ আশরাফ আলী আমাদের সন্তোষজনক মজুতের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু ব্যতিক্রমী সুপারিশ রেখেছেন। আমাদের পোশাকশিল্পের উষালগ্নে অপর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের কারণে আমরা বাকিতে (ব্যাক টু ব্যাক এলসি) কাঁচামাল আমদানি করতাম, যাতে রপ্তানিমূল্য থেকে এই আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা যায়। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার বর্তমান মজুত ব্যবহার করে নগদ এলসি দিয়েই কাঁচামাল আমদানি করার সক্ষমতা আমাদের হয়েছে, এতে বিপুল পরিমাণ সাশ্রয় হবে, কারণ দেশীয় ক্রেতারা তখন নগদে সস্তায় কেনাকাটা করার মতো দর-কষাকষি করার সুযোগ পাবেন। এ ছাড়া, বাকিতে সরবরাহকৃত পণ্যের দাম সব সময়ই নগদের তুলনায় বেশি হয়। দেরিতে পরিশোধযোগ্য বা ডেফার্ড পেমেন্ট এলসির ক্ষেত্রে ব্যাংককে প্রদেয় সুদ না থাকলেও অন্যান্য সেবা খরচও বেশি হয়, যার পরিমাণ ৩ থেকে ৪ শতাংশ বেশি।
উপরন্তু, নগদে আমদানির ব্যবস্থা করা গেলে ব্যাংকগুলোও আমদানি-পরবর্তী ঋণ (পোস্ট ইম্পোর্ট ফিন্যান্স) দিয়ে তাদের উদ্বৃত্ত আমানত উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগ করতে পারবে। তাঁর হিসাবমতো, এই সুপারিশ মোতাবেক বছরে ৩০ থেকে ৪০ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আমরা সাশ্রয় করতে পারি। আরও একটি ব্যাপার লক্ষণীয় যে দেশে ইতিহাসের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বানুমতি নিয়ে স্বল্প সুদে (৫ থেকে ৬ শতাংশ) বিদেশি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করছে। অথচ এই ঋণ যদি আমাদের নিজস্ব রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে দেওয়া যেত, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু বাড়তি আয় হতো, দেশের সুদ ব্যয় দেশেই থাকত, বিদেশি ঋণদাতার কাছে পাড়ি দিত না। এতে আমাদের সিন্দুকভর্তি ডলারের একটা গতি হতো, উপরন্তু বিদেশে পাড়ি দেওয়া সুদের অংশটা থেকে যেত রিজার্ভের সঙ্গেই। তবে মাস ছয়েকের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ নিয়ে অতি উৎসাহী হওয়ার অবকাশ নেই, দেশের স্থিতিশীল পরিস্থিতিটা আরও একটু টেকসই হলে এই রিজার্ভ বিনিয়োগের অনেক দরজা খুলে যাবে।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com
No comments