কলকাতার চিঠি- নন্দীগ্রামে মমতার অস্বস্তি by অমর সাহা
এমনটা ভাবেননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এভাবে ধাক্কা দেবে তাঁকে নন্দীগ্রাম। বড় বিশ্বাস ছিল তাঁর নন্দীগ্রাম নিয়ে। এই নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুরের আশীর্বাদ নিয়ে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় এসেছিলেন তিনি।
সেই নন্দীগ্রামের আশীর্বাদ এখন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। দেখা দিয়েছে অভিশাপরূপে। অথচ এই নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুর মমতাকে ক্ষমতায় আসার পথ দেখিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছে। সেদিনের সেই নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণবিরোধী আন্দোলন এবার অন্য এক পথের ঠিকানা দিয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই এই নন্দীগ্রামের আন্দোলন নিয়ে যে অভিযোগপত্র আদালতে পেশ করেছে গত মাসে, তা এককথায় উল্টে দিয়েছে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি এবং মমতার অভিযোগকে। ফলে, এই নিয়ে ফের রাজনৈতিক হোঁচট খেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস। অথচ পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এই আন্দোলনের জেরে সেদিন ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল ৩৪ বছর ধরে একটানা শাসনক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্টকে। আর রাজ্যসিংহাসনে বসিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের ‘অগ্নিকন্যা’ মমতাকে।
সেদিন সেই জমি অধিগ্রহণবিরোধী আন্দোলনের জেরে রক্তাক্ত হয়েছিল সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম। সিঙ্গুরে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল ওই আন্দোলনের অন্যতম কর্মী তাপসী মালিককে। আর নন্দীগ্রামে সেই ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ আন্দোলনের দিনে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছিল ১৪ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। এই আন্দোলনকে অস্ত্র করে সেদিন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মমতা। আন্দোলনে উত্তাল করে তুলেছিলেন গোটা পশ্চিমবঙ্গকে। বন্্ধ্, হরতাল আর মিছিল-মিটিংয়ে জেরবার হয়েছিল গোটা রাজ্য।
দেশজুড়ে ধিক্কার উঠেছিল। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এই ঘটনার প্রতিবাদে মাঠে নেমেছিল। মমতাও সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে একটানা ২৬ দিন অনশনও করেছিলেন। সেদিন রাজ্যসরকার নন্দীগ্রামের গুলিবর্ষণের ঘটনা সিআইডি দিয়ে তদন্তের উদ্যোগ নিলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে রাজ্যজুড়ে। দাবি ওঠে, এই তদন্ত করাতে হবে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই দিয়ে। এই দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও হয়। হাইকোর্ট অবশেষে নন্দীগ্রামের ঘটনা সিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করানোর নির্দেশ দেন।
মূলত, পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে একটি রসায়ন শিল্পাঞ্চল গড়ার জন্য তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একইভাবে আন্দোলন চলে হুগলি জেলার সিঙ্গুরে সেই ২০০৭ সালে। সেখানে ভারতের টাটা কোম্পানিকে সস্তায় একটি মোটরগাড়ি কারখানা গড়ার জন্য ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে তা তুলে দেওয়া হয় টাটার হাতে। মমতা দাবি তোলেন, ৪০০ একর জমির মালিক টাটাকে জমি দিতে রাজি নয়। মমতাও ঘোষণা দেন, ক্ষমতায় এলে তিনি অনিচ্ছুক কৃষকদের সেই ৪০০ একর জমি ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার আড়াই বছর কেটে গেলেও সেই জমি ফিরিয়ে দিতে পারেননি মমতা এখনো। চলছে সুপ্রিম কোর্টে মামলা।
এদিকে নন্দীগ্রামেও ২০০৭ সালে ২৫ হাজার একর জমি নিয়ে একটি বৃহৎ রসায়ন শিল্পাঞ্চল গড়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার উদ্যোগ নিলেও আপত্তি তোলেন মমতা। যদিও শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকার নন্দীগ্রামে কোনো জমি অধিগ্রহণ করেনি। তবু নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণ সিদ্ধান্তকে সামনে এনে নন্দীগ্রামে মমতা শুরু করেন আন্দোলন। এই নন্দীগ্রামে আন্দোলনের জেরে ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ পুলিশের গুলিবর্ষণে ১৪ জনের মৃত্যু হয়।
এরপর এই ঘটনা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই দিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন কলকাতা হাইকোর্ট। সিবিআই দীর্ঘদিন পর ওই ঘটনার চার্জশিট দেয় গত মাসে। সেই চার্জশিটে বলা হয়েছে, ১৪ মার্চ কোনো গোপন অপারেশন হয়নি। পুলিশ তিন মাস ধরে অবরুদ্ধ নন্দীগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্য নন্দীগ্রামে যায়। সেখানেই পুলিশ বাধাগ্রস্ত হয় মমতাদের গড়া নন্দীগ্রামের ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সদস্যদের দ্বারা।
পুলিশ ওই এলাকায় ঢুকতে গেলে প্রতিরোধ কমিটির অন্তত পাঁচ হাজার সদস্য প্রথমে আক্রমণ করে পুলিশের ওপর। এরপর পুলিশ লাঠিপেটা, টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করেও পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে না পেরে অগত্যা শূন্যে গুলি ছোড়ে। তাতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে কর্মরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। এতে আটজন গ্রামবাসী নিহত হয়। বাকিরা নিহত হন ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। চার্জশিটে যাঁদের নাম উল্লেখ করা হয় তাঁদের অধিকাংশই তৃণমূলের নেতা-কর্মী ।
এই চার্জশিটের কথা প্রচারিত হওয়ার ফলে কার্যত রাজনৈতিকভাবে ধাক্কা খায় শাসক তৃণমূল কংগ্রেস। যদিও মমতা অভিযোগ করে আসছিলেন, ওই ঘটনায় বহু গ্রামবাসীর প্রাণহানি হয়েছিল পুলিশের গুলিতে। তাদের লাশ পাচার করা হয়েছিল নৌকায় করে। বহু গ্রামবাসী নিখোঁজ হয়েছিল। কিন্তু সিবিআই এই অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পায়নি। সিবিআই ওই দিনের ঘটনাকে কোনো গোপন অপারেশনের সঙ্গে তুলনা না করে বরং চার্জশিটে বলেছে, পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বারবার মাইকে গ্রামবাসীকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানালেও তাতে গ্রামবাসী সাড়া দেয়নি। পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ।
এই চার্জশিটের কথা প্রচারিত হওয়ার পর চরম অস্বস্তিতে পড়েন মমতা এবং তাঁর দল তৃণমূল। আর বিরোধীদলীয় নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র চার্জশিট প্রদানের সুবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেই দিয়েছেন, নন্দীগ্রাম নিয়ে মিথ্যা প্রচার ও অপপ্রচার চালিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস। সিবিআইয়ের চার্জশিটে তারই প্রমাণ ফুটে উঠেছে। ফলে এই চার্জশিট দেওয়ার ঘটনায় ভারতের লোকসভা নির্বচনের আগে এক রাজনৈতিক ধাক্কা খেলেন মমতা এবং তাঁর দল। আগামী এপ্রিল-মে মাসে ভারতের লোকসভা নির্বাচন হওয়ার কথা।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।
No comments