কে এই কাবুল by চৌধুরী মুমতাজ আহমদ
লন্ডন থেকে
জাহাজে করে মিতসুবিশি শোগান ব্র্যান্ডের রুপালি রঙের দু’টি এবং কালো রঙের
একটি পাজেরো এসে নামে ভারতের মুম্বইয়ের জওয়াহরলাল নেহরু সমুদ্র বন্দরে।
এমডি৫১
সিসিএন, এক্স৮৭৫ ওএভি এবং এলভি৫২ জেডআরও নাম্বারের গাড়ি তিনটি সেখান থেকে
গ্রহণ করেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশী কাবুল মিয়া। ভারতের মাল্টিপল
ভিসাধারী কাবুল মিয়া গাড়ি পৌঁছার আগেই ২৩শে সেপ্টেম্বর পৌঁছে গিয়েছিলেন।
দামে দরে বনিবনা হওয়ায় সম্ভবত প্রথম গাড়িটি (রুপালি রঙের) ভারতেই বিক্রি
হয়ে যায়। দুই সহযোগী আসকার উদ্দিন এবং আমতর আলীকে সঙ্গে করে বাকি দু’টি
গাড়ি নিয়ে কাবুল মিয়া বাংলাদেশের পথে রওনা হন। প্রবেশপথ হিসেবে পছন্দ করেন
সিলেটের বিয়ানীবাজারের শেওলা (সুতারকান্দি) ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট। গাড়ি নিয়ে
নির্বিঘ্নে চেকপোস্ট পেরোনোর ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল। কাবুল মিয়া,
আসকার উদ্দিন ও আমতর আলী গাড়ি নিয়ে ঢোকার আগে তিন দিন ওই সীমান্তে মহড়া
দিয়েছেন বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। ৩০শে অক্টোবর বিকালে বাংলাদেশে
প্রবেশের প্রথম প্রচেষ্টা চালান তারা। ভারতীয় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসে সব কাজ
সম্পন্নের পরও সবুজ সঙ্কেত না পেয়ে ফিরে যান। পরদিন ৩১শে অক্টোবর সকালে
ভারতের করিমগঞ্জের নোয়াগাঁয় ইমিগ্রেশন শেষে শেওলা চেকপোস্টের কাছে আসতেই
কাবুল মিয়া বুঝতে পারেন এ দিনও ঠিক ছিল না সাজানো ছক। ফিরে যাওয়ারও উপায়
নেই। দায়িত্বরতদের ফাঁকি দিয়ে তল্লাশি চৌকির প্রবেশ ফটকের বাঁশের খুঁটির
ডান পাশের ফাঁকা জায়গা দিয়ে দ্রুত ঢুকে পড়েন গাড়ি দু’টি নিয়ে। রওনা হন
অজানা গন্তব্যে। তবে সিলেট নগরীতেই যে গন্তব্য ছিল তা জানা যায় রাতে গাড়ি
উদ্ধারের পর। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, সিলেট নগরীর উপ-শহর ও কুমারপাড়া থেকে
উদ্ধার করা হয় গাড়ি দু’টো। তবে মানবজমিন-এর অনুসন্ধান বলছে ভিন্ন কথা। একটি
সূত্র বলছে, গাড়ি দু’টো পুলিশের জিম্মায় এসেছিল দিনেই। সূত্রটি এও নিশ্চিত
করে আসকার উদ্দিনের ভাই একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের
তত্ত্বাবধানেই গাড়িগুলোর সন্ধান পায় পুলিশ। রহস্যজনকভাবে বাংলাদেশে
প্রবেশের পর গাড়ি দু’টোর পাশাপাশি এর ভেতরে কি থাকতে পারে এ নিয়েও নানা
জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। এমনকি গাড়িতে করে ৬৫ লাখ পাউন্ড (প্রায় সাড়ে ৮২
কোটি টাকা) মূল্যের সোনা এসেছে এমন খবরও প্রচারিত হয়। পাশাপাশি গাড়িতে জাল
পাউন্ড ছিল জানা গিয়েছিল। তবে পুলিশ বলছে এমন খবরের সত্যতা তারা খুঁজে
পাননি।
চল্লিশ বছর বয়সী কাবুল মিয়ার গাড়ি নিয়ে
বাংলাদেশের প্রবেশের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগেও তিনি গাড়ি নিয়ে একাধিকবার
বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন বলে দুই পাজেরা আটকের পর পত্র-পত্রিকায় খবর
প্রকাশিত হয়েছিল। তবে আগের দফাগুলোতে ছক ঠিকঠাক থাকায় সফলতারই দেখা
পেয়েছিলেন। আগের সফলতায় উজ্জীবিত হয়ে এ দফা সঙ্গী করেন আরও দু’জনকে।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী মো. কাবুল মিয়া ওরফে মো. কাবুল
সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার নিহালের নোয়াগাঁও গ্রামের আবদুল বারী কলাইয়ের
ছেলে। বৃটিশ পাসপোর্টধারী (নং পি ৪৫৪৭৯৩৩৫৬) কাবুল মিয়ার বাসা সিলেট নগরীর
উপ-শহরে। এফ-ব্লকের ৩ নম্বর রোডের ৭৭ নম্বর বাসাটি তার। একটি সূত্রমতে,
কাবুল মিয়ার আরও একটি পাসপোর্ট আছে আবদুর রব ড্যানি নামে। তার সঙ্গী আসকার
উদ্দিন বিয়ানীবাজার উপজেলার আঙ্গুরা গ্রামের মৃত হাবিবুর রহমানের ছেলে।
বৃটিশ পাসপোর্টে (নং পি ৫০৮৮৯৮৫৫৮) তার নাম আসকার উদ্দিন হলেও কবির আলী এবং
আজগর আলী নামেও তিনি নিকটজনদের কাছে পরিচিত। অপর সঙ্গী বৃটিশ পাসপোর্টধারী
(নং ৬৫২৪৯১৪৮৭) আমতর আলী ওরফে আনোয়ার বালাগঞ্জের ওসমানীনগর থানার
ঘোষগাঁওয়ের মৃত মজম্মিল আলীর ছেলে। তারও একাধিক নাম রয়েছে তবে বেশি পরিচিতি
চান্দু ওরফে বাট্টি চান্দু নামেই।
তারা চোরাকারবারী দলের সদস্য এবং এর আগেও এভাবে বিভিন্ন চেকপোস্ট দিয়ে বাংলাদেশে দামি গাড়ি প্রবেশ করিয়েছেন- তদন্তে এর প্রমাণ পেয়েছে বলে রিমান্ড আবেদনে উল্লেখ করে পুলিশ।
বৃটেনের রয়েল অটোমোবাইল ক্লাবের সদস্য হিসেবে কাবুল মিয়া ও তার সঙ্গীরা গাড়িগুলো ‘কারনেট দ্য প্যাসেজের’ আওতায় নিয়ে আসেন। ‘দ্য কাস্টমস কনভেনশন অন দ্য টেম্পোরারি ইমপোর্টেশন অব প্রাইভেট ভেহিক্যালস অ্যান্ড কমার্শিয়াল রোড ভেহিক্যালস’ নামে একটি আন্তর্জাতিক আইন আছে, যা ‘কারনেট দ্য প্যাসেজ’ নামেই সারা বিশ্বে পরিচিত। এ সুবিধার আওতায় ফিরে যাওয়ার সময় নিয়ে যাবেন এমন শর্তে কোন পর্যটক ইচ্ছা করলে তার নিজের গাড়িটি নিয়ে বিনা শুল্কে যে কোন দেশে প্রবেশ করার আইনগত অধিকার রাখেন। কারনেটের মাধ্যমে নিয়ে আসার কারণে ভারত থেকে বের করে নিয়ে আসতে কোন সমস্যা ছিল না। সমস্যা কেবল বাংলাদেশে গাড়ি নিয়ে প্রবেশে। কারনেটের গাড়ির ক্ষেত্রে শুল্ক পরিশোধ করতে না হলেও ফিরিয়ে নেয়ার নিশ্চয়তা হিসেবে প্রযোজ্য শুল্ক (গাড়ির মূল্যের ৪০০ শতাংশ) জামানত দিতে হয়। কারনেটের অপব্যবহারের কারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ শর্ত আরোপ করেছিল। শুল্ক ফাঁকি দিতেই আগে থেকে ছক তৈরি করে রেখেছিলেন কাবুল মিয়া।
তারা চোরাকারবারী দলের সদস্য এবং এর আগেও এভাবে বিভিন্ন চেকপোস্ট দিয়ে বাংলাদেশে দামি গাড়ি প্রবেশ করিয়েছেন- তদন্তে এর প্রমাণ পেয়েছে বলে রিমান্ড আবেদনে উল্লেখ করে পুলিশ।
বৃটেনের রয়েল অটোমোবাইল ক্লাবের সদস্য হিসেবে কাবুল মিয়া ও তার সঙ্গীরা গাড়িগুলো ‘কারনেট দ্য প্যাসেজের’ আওতায় নিয়ে আসেন। ‘দ্য কাস্টমস কনভেনশন অন দ্য টেম্পোরারি ইমপোর্টেশন অব প্রাইভেট ভেহিক্যালস অ্যান্ড কমার্শিয়াল রোড ভেহিক্যালস’ নামে একটি আন্তর্জাতিক আইন আছে, যা ‘কারনেট দ্য প্যাসেজ’ নামেই সারা বিশ্বে পরিচিত। এ সুবিধার আওতায় ফিরে যাওয়ার সময় নিয়ে যাবেন এমন শর্তে কোন পর্যটক ইচ্ছা করলে তার নিজের গাড়িটি নিয়ে বিনা শুল্কে যে কোন দেশে প্রবেশ করার আইনগত অধিকার রাখেন। কারনেটের মাধ্যমে নিয়ে আসার কারণে ভারত থেকে বের করে নিয়ে আসতে কোন সমস্যা ছিল না। সমস্যা কেবল বাংলাদেশে গাড়ি নিয়ে প্রবেশে। কারনেটের গাড়ির ক্ষেত্রে শুল্ক পরিশোধ করতে না হলেও ফিরিয়ে নেয়ার নিশ্চয়তা হিসেবে প্রযোজ্য শুল্ক (গাড়ির মূল্যের ৪০০ শতাংশ) জামানত দিতে হয়। কারনেটের অপব্যবহারের কারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ শর্ত আরোপ করেছিল। শুল্ক ফাঁকি দিতেই আগে থেকে ছক তৈরি করে রেখেছিলেন কাবুল মিয়া।
কারনেট সংক্রান্ত জাতিসংঘের কোন সনদে স্বাক্ষর না করলেও বাংলাদেশও এতদিন ধরে এ সুবিধা দিয়ে আসছিল। ২০০৯ সাল থেকে বাড়তে থাকে কারনেট সুবিধার অপব্যবহার। ওই বছর কারনেট সুবিধায় আসা ১৩টি গাড়ির মধ্যে ৫টিই ফেরত যায়নি। পরের বছর এ হার আরও বাড়ে। ৪৯টি গাড়ির মাত্র ৪টি শুধু ফেরত যায়। কারনেটের গাড়ি ফেরত না যাওয়ার প্রথা ভয়াবহ রূপ নেয় ২০১১ সালে। ওই বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৬৬টি গাড়ি এলেও তার একটি গাড়িও ফেরত যায়নি। কারনেটের অপব্যবহার বেপরোয়া গতিতে বাড়তে থাকায় ২০১১ সালে প্রযোজ্য শুল্ক কর (গাড়ির মূল্যের ৪০০ শতাংশ) গ্যারান্টি হিসেবে রাখার নিয়ম করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। তবুও লাগাম টানতে না পেরে শেষমেশ ২০১৩ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ এ সুবিধাটি বাতিল করে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৩ সাল পর্যন্ত কারনেট সুবিধায় ৩১৫টি গাড়ি বাংলাদেশে এসেছে যার ১১৮টিই ফেরত যায়নি। আরও ৭০টি গাড়ি খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে বন্দরে। মানবজমিন-এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফেরত না যাওয়া গাড়ি যাদের নামে এসেছে তাদের বেশির ভাগই সিলেটের বাসিন্দা।
No comments