ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়াই মুখ্য
সুশাসন নিয়ে গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) পক্ষ থেকে যে গবেষণার কাজটি হয়েছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যথার্থ চিত্রই উঠে এসেছে এই গবেষণা প্রতিবেদনে। সুশাসন বলতে স্বাভাবিকভাবে আমরা বুঝি স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, আইনের শাসন ও অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা, যেখানে সব শ্রেণীর নাগরিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত থাকবে এবং তাদের স্বার্থের বিষয়টির প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত না হলে সুশাসনের ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকেই যাবে। ফলে যে চিত্র প্রকাশ পেয়েছে তা নতুন নয়, ধারাবাহিকভাবেই এ অবস্থা চলে আসছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে আমরা যে যাত্রা শুরু করেছিলাম, তার কাঠামোগুলো কিন্তু রয়েছে। যেমন সংসদ, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন বা দুদক—এগুলো সবই আছে। এগুলোকে আমরা হার্ডওয়্যার হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। এই হার্ডওয়্যারগুলো আমাদের রয়েছে কিন্তু এর চর্চা বা এগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। সমস্যাটি সেখানেই। গবেষণা প্রতিবেদনে আইনের শাসন নিয়ে আমরা অনেক তথ্য পেয়েছি। তবে সেখানে বিশ্লেষণ নেই। জনগণ বলছে, তাদের আস্থা কমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগের ওপর। আবার র্যাবের ওপর বেড়েছে। এটা এক অশনিসংকেত। আমরা বুঝতে পারছি যে পুলিশ ও বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতার কারণ তারা এদের মাধ্যমে কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না। আইন লঙ্ঘনকারীদের শাস্তি দেওয়ার কাজটি র্যাবের কাছ থেকে পাচ্ছে। এটা প্রচলিত বিচারব্যবস্থার প্রতি চরম আস্থাহীনতারই প্রমাণ দিচ্ছে।
সুশাসনের জন্য এটা খুবই উদ্বেগজনক তথ্য। কারণ, যে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বিচার-প্রক্রিয়া লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত কাজের অভিযোগ রয়েছে, তার প্রতি জনগণের আস্থা বাড়ছে! এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা যাকে বলি ‘ট্রিগার হ্যাপিনেস’ তা আরও বাড়াতে পারে। এতে প্রচলিত প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন দিন দিন আরও আস্থাহীন হয়ে পড়বে, তেমনি মানুষের মধ্যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতাও বাড়তে পারে। আইনের শাসনের জন্য এটা খুবই উদ্বেগজনক। শুধু এই গবেষণা নয়, আমরা বিভিন্ন গবেষণায় দেখে আসছি যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থা কমছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। একজন সাংসদ যদি কোনো অপরাধীকে ছাড়িয়ে নিতে অনশন করেন, নারায়ণগঞ্জের এক সাংসদ যদি জনগণকে কর না দেওয়ার আহ্বান জানান বা চিফ হুইপ যদি ক্রেস্টের বদলে ক্যাশ দাবি করেন, তবে রাজনীতিবিদদের প্রতি খুব স্বাভাবিকভাবেই জনগণের আস্থা কমতে থাকবে। পত্রিকায় দেখলাম চার সাংসদ একই সঙ্গে মেয়র পদ ধরে রেখেছেন। এসব কর্মকাণ্ডে ক্ষমতার প্রতি তাঁদের মোহের বিষয়টি চরমভাবে প্রকাশ পায়। এ ধরনের কর্মকাণ্ড অব্যাহতভাবে চলতে থাকায় রাজনীতিবিদদের প্রতি জনগণের আস্থা কমছে। সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয় ও কার্যকর থাকা জরুরি, সেগুলো তাদের কর্মক্ষমতা হারিয়েছে ও হারাচ্ছে দলীয়করণের কারণে। রাজনৈতিক শক্তি নিজেদের স্বার্থে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করছে।
ফলে এসব প্রতিষ্ঠান পেশাদারি হারাচ্ছে এবং নিজেদের মতো কাজ করতে পারছে না। এর ফলাফল হিসেবে অন্যায় ও অপকর্ম করে পার পাওয়া সহজ হচ্ছে, অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে না, সাধারণ মানুষ বিচার পাচ্ছে না। একটা বিচারহীনতার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এতে সমাজে অপরাধ বেড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এই যে একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এর কেন্দ্রে রয়েছে রাজনীতির মধ্যে নিজের সুবিধা, নিজের দলের সুবিধা ও নিজের মুনাফা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা। রাজনীতির সবকিছুই এখন আবর্তিত হচ্ছে নিজের সুবিধা ও স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে। এই পরিস্থিতি সুশাসন সহায়ক না হয়ে সুশাসন প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে এই অবস্থাকে বাস্তবতা হিসেবে মেনে নেওয়ার বিষয়টি। জনগণ এ ধরনের পরিস্থিতিকে যেন মেনে নিতে শুরু করেছে বা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক যে জনগণ, এই বিষয়টি যেন তারা ভুলতে বসেছে। সুশাসনের মৌলিক ইস্যুগুলো দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বিবেচ্য বিষয় নয়। ক্ষমতায় থাকা, ধরে রাখা বা যেকোনোভাবে ক্ষমতায় যাওয়াই রাজনীতির মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে নাগরিক সমাজের মধ্যেও একধরনের নিস্পৃহতা ও হতাশা বিরাজ করছে। দলীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে কেউ কোনো ইস্যু তুলে ধরলেই তাকে দলীয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সমালোচক যে শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারে, সে বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর বিবেচনায় নেই। আসল কথা হচ্ছে, যত দিন ক্ষমতা ও রাজনৈতিক অবস্থান ব্যক্তিগত সুবিধা ও মুনাফা অর্জনের পথ হিসেবে ব্যবহূত হবে এবং বিচারহীনতার মাধ্যমে আইনের শাসন পদদলিত হবে, তত দিন সুশাসন মরীচিকা হয়েই থাকবে।
No comments