‘গণমাধ্যমে অনুরোধ এখন উপদ্রব’ by জাকারিয়া পলাশ
দৈনিক আমাদের অর্থনীতি সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেছেন, স্বাধীন সাংবাদিকতায় বৈরিতা-হুমকির সঙ্গে ইদানীং নতুন উপদ্রব হচ্ছে ‘অনুরোধ’। এর সঙ্গে রয়েছে ভীতি ও মিত্রতাজনিত সেলফ সেন্সরশিপ।
এ নিয়েই চলছে দেশের গণমাধ্যম। মানবজমিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকতার রূপ বদলায়, ক্রমান্বয়ে বিবর্তন হয়। ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়। এটা হলো দার্শনিক সত্য। আমরা ২০ বছর আগে সাংবাদিকতায় যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতাম এখনকার চ্যালেঞ্জ তার চেয়ে ভিন্নতর। অনেক ক্ষেত্রে আরও কঠিন, আরও দুরূহ। একই সঙ্গে প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে কিছু কিছু কাজ সহজ, স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হয়েছে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের মতো ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনে আগে কখনও ঘটেনি। এমন একটা ঘটনার সঙ্গে সাংবাদিকদেরও মানিয়ে নিতে সময় লাগছে। এর আগেও নতুন অবস্থায় মানিয়ে নিতে গিয়ে এমন অবস্থা দেখা গেছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা কতটা স্পর্শকাতরতা মাথায় রেখে কাভার করতে হবে তা খাপ খাইয়ে নিতে একটু সময় লেগেছে। সিলেটে মাগুরছড়ায় গ্যাস ফিল্ডে আগুন লাগার পর তা নেভাতে যে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় তার নাম লিখতেও আমরা ভুল করেছি। আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতাতেও এমনটা হয়ে থাকে। বাবরি মসজিদ যখন ভাঙা হলো তখন পাশ্চাত্যের অনেক নামী পত্রিকাও তার বিবরণ দিতে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। একটা মসজিদের কোনটা মিনার কোনটা মিম্বর- এ পার্থক্য তাদের কাছে সহজ ব্যাপার ছিল না। সাংবাদিকতায় নতুন পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ, বৈরিতার চ্যালেঞ্জ, হুমকি-ধমকি সব কিছুই নতুন রকম। এ সময়েও আমাদের নতুন অভিজ্ঞতা। এখন টেলিভিশনের ব্যাপক বিস্তৃতি হয়েছে। নতুন নতুন সংবাদপত্র এসেছে। এগুলোর মালিকানার আবার স্বরূপ আছে। ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মালিকানায় বড় প্রকাশনার পত্রিকা আসছে। পয়সাওয়ালারা পত্রিকা করবে, টিভি করবে এটা আমি খারাপ অর্থে বলি না। কিন্তু এই যে ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ এটা অসুবিধার। আর অন্যদিকে রয়েছে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। অনেকেই গণমাধ্যম করছেন যার একটা রাজনৈতিক পরিচয় আছে বা তারা কোন দলের সদস্য। তার সঙ্গে চিরন্তন হুমকি তো কমবেশি অব্যাহত আছে ঢাকার ভেতরে ও বাইরে। সঙ্গে আবার সাম্প্রতিককালে নতুন শব্দ হলো ‘অনুরোধ’। অনুরোধের ঢেঁকি গেলা এখন নতুন উপদ্রব। অনেক ক্ষেত্রে হুমকি আসে না। অনুরোধ আসে, প্লিজ! এ কথাটা লিখবেন না। এই যে অনুরোধ এটা ব্যক্তির কাছ থেকে আসে। প্রতিষ্ঠান থেকে আসে। এটাও সাংবাদিকতার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের চরিত্র এবং আমাদের রাজনীতির সংঘাতময় পরিবেশের কারণে হুমকি ও অনুরোধের চ্যালেঞ্জ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে আমরা সেলফ সেন্সরশিপেও যাচ্ছি। এটি আবার দুই প্রকার আছে। একটা হচ্ছে ভীতিজনিত সেলফ সেন্সরশিপ। আরেকটা রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা বা মিত্রতার জন্য সেলফ সেন্সরশিপ। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা যদি আরেকটু ফেয়ার হয়, ভাল হয়- জাতিসংঘের দূত অসকার ফারনান্দেজ-তারানকোর এ বক্তব্য উল্লেখ করে নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, তার মানে তিনি কি উপলব্ধি করেছিলেন, আমরা সম্ভবত সম্পূর্ণ ফ্রি ও ফেয়ার থাকতে পারছি না। এর সব কিছুই আমাদের সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ। এ অবস্থায় তিনি নিজের নীতি প্রসঙ্গে বলেন, আমি সাংবাদিকতার স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত না। আজকে আমি যেটুকু পারলাম না সেটা আগামী দিনের আমার বুদ্ধি-বিবেচনা, সাহস ও কৌশলের সমন্বয়ে আগামীতে করবো। এখন টিকে থেকে অস্তিত্ব রক্ষা করতে চাই। যদি প্রতিকূলতার জন্য আমি একটা রিপোর্ট না করতে পারি আপাতত সময়-সুযোগের জন্য আমি অপেক্ষা করবো। এতে হতাশাবোধ করলেও আমার মধ্যে কোন আত্মাহুতির প্রবণতা কাজ করে না। আমি শহীদ হয়ে যাওয়ায় বিশ্বাস করি না। চ্যালেঞ্জের মধ্যেও গণমাধ্যম কাজ করছে দাবি করে তিনি বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বহুত্ববাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে হবে। নিজের স্বার্থে, মালিকের স্বার্থে, ভয়ে বা চাপে এক পত্রিকা যা করতে পারছে না অন্য পত্রিকা তা করছে। সুতরাং, সামগ্রিক অর্থে কেউ না কেউ দায়িত্ব পালন করছে। সেটা দিয়েই আমি আমাদের অর্জনগুলো হিসাব করি। প্রতিটি পত্রিকা সব বিষয়ে দায়িত্ব পালন করবে- এমনটা বাস্তবসম্মত নয়, সেটা আশা করাও অন্যায় মনে করি। বর্তমান অবস্থা দীর্ঘদিন চললে কি হবে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার এসেছে তাতে রাজনৈতিকভাবে প্রধান বিরোধী দল সংসদের বাইরে রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে এ অবস্থা বিরাজ করলে তা আমাদের গণতন্ত্র, অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থের অনুকূল নয়। এর একটা পরিবর্তন হতে হবে। পরিবর্তন কত দ্রুত হবে তার চেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে সব পক্ষ সমাধানের জন্য কতটুকু এগিয়ে আসছে। সব পক্ষ এগিয়ে এলে তাতে একটু বেশিও যদি সময় লাগে সে সময়টা তো কাটবে সমঝোতার প্রয়াসে। সে সময়টুকু তো খারাপ কাটবে না। তাতে একটা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হতে পারে। সব বিষয়ে সমঝোতা হতে পারে।
No comments