চাচার পাঁচালি- নব্য গণতন্ত্র by মাহবুব তালুকদার
চাচা বললেন, ছাত্রলীগের মিডিয়া কানেকশন বিশেষ ভালো নয়। সে কারণে বারবার
তাদের খেসারত দিতে হচ্ছে।
আমি বললাম, এ কথার অর্থ কী?
তাদের খেসারত দিতে হচ্ছে।
আমি বললাম, এ কথার অর্থ কী?
অর্থ খুব সোজা। মিডিয়া ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।
মিডিয়া তো রিপোর্ট করা ছাড়া আর কিছুই করছে না।
সেটাই বলতে চাচ্ছি। সেদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতার পিস্তল হাতে ছবি ছাপা হয়েছে। এ রকম একপেশে রিপোর্ট বা ছবি ছাপার নাম কী সাংবাদিকতা?
কিন্তু একপেশে রিপোর্ট হলো কীভাবে?
আরে ভাই! জামায়াতে ইসলামীর ক্যাডাররা যখন প্লাস্টিক বোমা ছোড়ে, তাদের কী কোনো ছবি আজ পর্যন্ত পত্রিকায় ছাপা হয়েছে? হয়নি। অথচ ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা যখন আত্মরক্ষার্থে পিস্তল হাতে নেয়, ফলাও করে সেটা ছাপা হয়, যা দুরভিসন্ধিমূলক।
চাচা কোনো বিষয়ে উত্তেজিত হয়ে গেলে আমাকে ভাই বলে সম্বোধন করেন। এটা নতুন কিছু নয়। আমি বললাম, ক’দিন আগে জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজী সেলিম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘শিবির রগ কাটে, ছাত্রলীগ কবজি কাটে, মাথা কাটে।’ এ কথার জবাবে ছাত্রলীগ লিখিতভাবে প্রতিবাদলিপিতে জানিয়েছে, হাজী সেলিম একজন ‘অশিক্ষিত’ ও ‘মূর্খ’ লোক। কিন্তু এটা কী হাজি সেলিমের কথার জবাব হলো?
ঠিকই বলেছে ওরা। চাচা জানালেন, ছাত্রলীগের ছেলেরা যেহেতু ছাত্র, সেহেতু তাদের চোখে ‘অশিক্ষিত’ ও ‘মূর্খ’ হাজী সেলিমের অপরাধ হচ্ছে ‘শিক্ষিত’ ও ‘বিদ্বান’ ছাত্রদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মুখ খোলা। সংসদ সদস্য হয়েছেন বলে সংসদে দাঁড়িয়ে সমাজের শিক্ষিত অংশের বিরুদ্ধে গায়ে পড়ে মন্তব্য করা হাজী সেলিমের উচিত হয়নি। ছাত্রশিবির আর ছাত্রলীগ কি এক বিষয় হলো যে তাদের তুলনা করা হবে? ‘অশিক্ষিত’ আর ‘মূর্খ’ না হলে হাজী সেলিম এটা করতে পারতেন না।
আমি বললাম, চাচা! ছাত্রলীগ সম্পর্কে আরো অভিযোগ আছে। ক’দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হল থেকে ৯৭ জন শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগ নেতারা বের করে দিয়েছে। ওই ৯৭ ছাত্রের অপরাধ হলো তাদের কাছে স্থানীয় ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রত্যয়নপত্র নেই। তাদেরকে জানানো হয়েছে, তারা শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না এবং ছাত্রলীগ করত- এ রকম প্রত্যয়নপত্র যার যার এলাকার আওয়ামী লীগ নেতার কাছ থেকে আনতে হবে। এটা কেমন কথা?
কী আশ্চর্য! এতে অভিযোগের কী আছে? চাচা ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, ছাত্রলীগ স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি যাতে আসন পেতে ঘাঁটি বানাতে না পারে, তা দেখা নিশ্চয়ই অন্যায় কিছু নয়। তাতে প্রয়োজনে ৯৭ জন কেন, ৯৭০ জনকে হলে থাকতে না দেয়ার অধিকার ছাত্রলীগের রয়েছে।
কিন্তু ছাত্রলীগ তো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। হলে স্থান পেতে ছাত্রদের যার যার এলাকার আওয়ামী লীগ নেতার প্রত্যয়নপত্রইবা আনতে হবে কেন?
তুমি ব্যাপারটা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছ কেন? ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সাহায্য করছে বলেই তাদের এটা করতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এককভাবে আবাসন সমস্যার সমাধান করতে পারছে না বলেই ছাত্রলীগ এ ব্যাপার হ্যান্ডেল করছে। ওরা যদি অন্যায় কিছু করত তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই তাতে বাধা দিতো। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি কিছু বলেছে?
না। তারা তো ছাত্রলীগের পক্ষে।
তাহলেই বুঝতে পার, ছাত্রলীগ কোনো অন্যায় করছে না। তুমিও দেখছি হাজী সেলিম হয়ে গেলে।
চাচার কথায় আমি রীতিমতো বিচলিতবোধ করলাম। হাজী সেলিম ঢাকার একজন খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হননি। আওয়ামী লীগের আরেক প্রখ্যাত নেতা ও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীনকে নির্বাচনে পরাজিত করে তিনি সংসদ সদস্য হয়েছেন। ভবিষ্যতে তিনি মন্ত্রীও হতে পারেন। যদি তাই হয়, তাহলে তিনি হবেন ছাত্রলীগের ভাষায় দেশের প্রথম ‘অশিক্ষিত’ ও ‘মূর্খ’ মন্ত্রী। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে যা বলেছেন, আমি তা সমর্থন করিনি। তাহলে আমি তার সঙ্গে তুলনীয় হলাম কী করে?
আমি প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বললাম, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ঘোষণা করেছেন, আগামী ২০১৯ সালের ২৮শে জানুয়ারির পূর্বে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মেয়াদ শেষে বর্তমান সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
এটা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের আন্তরিকতা ও স্বচ্ছতার প্রমাণ। চাচা বললেন, বিএনপি যাতে এ সময়ের মধ্যে নিজেদের তৈরি করে নিতে পারে, এজন্যই সৈয়দ আশরাফ সময়টি অগ্রিম জানিয়ে দিয়েছেন।
চাচা! নির্বাচন কী বিগত নির্বাচনের মতোই হবে?
অবশ্যই। চাচা বললেন, দু-একটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব দেশ আমাদের নির্বাচন মেনে নিয়েছে। সবাই বর্তমান নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছেন। তাছাড়া, বাংলাদেশের বিগত নির্বাচন একটা মডেল হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ভবিষ্যতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ মডেলটিকে গ্রহণ করবে। সুতরাং, সংবিধানের বাধ্যবাধকতা রক্ষা করে একই পদ্ধতিতে আগামী নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে।
কিন্তু এটা তো বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন!
কেন? জাতীয় সংসদে বিরোধী দল তো আছে। বেগম রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা।
উনি কি সত্যি বিরোধীদলীয় নেতা?
তোমার এসব অহেতুক প্রশ্ন আমার ভালো লাগে না। বেগম রওশন এরশাদ একজন অসাধারণ রাজনীতিবিদ। তিনি একদিকে তার স্বামী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কাছ থেকে দলের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন, অন্যদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ক্ষমতার অংশীদার হিসেবে ভারসাম্য রক্ষা করছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় এমন উদাহরণ আর এক পিস পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
আমি চুপ করে চাচার কথা শুনলাম। জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝি না। গত নির্বাচনে এরশাদের নির্দেশে ১৮৬ জন প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। বাকিরা নির্দেশ অমান্য করে নির্বাচন করেন। বর্তমান সংসদে জাতীয় পার্টির ৩৪ জন সদস্য রয়েছেন। এরশাদ নিজেও সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এরপর তাকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করা হয়। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। অন্যদিকে তার স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদ দলের যে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে স্বামীকে ক্ষমতাহীন করেছেন, তা ফিরে পেতে এরশাদ সমপ্রতি দলের নেতাকর্মীদের এক সম্মেলনে গান গেয়েছেন? ‘আয় খোকা আয়!’ তবে দলের ৩০ জন সংসদ সদস্য তার ডাকে সাড়া দেননি। আসলে দলের খোকারা বুঝতে পারছেন না কার কাছে যাবেন? ক্ষমতাবান রওশন এরশাদের কাছে, না ক্ষমতাহীন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কাছে?
আমি আবার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললাম, চাচা! উপজেলা নির্বাচনে তো দেখছি রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন আছে, অথচ কাগজপত্রে সবই নির্দলীয়। নির্বাচনে একক প্রার্থী দেয়ার জন্য বিদ্রোহী প্রার্থীদের দল থেকে বহিষ্কারও করা হচ্ছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত নয়?
তোমার কাছে তো সবই অদ্ভুত। তবে এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গুরুত্বপূর্ণ কেন?
বিএনপি তলে তলে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে বলে। বর্তমান সরকারকে বিএনপি অবৈধ সরকার বলছে, আবার এ সরকারের অধীনে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এটা কেমন নৈতিকতাবিরোধী কথা?
নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নেই বলেই বোধহয়। আমি বললাম।
আওয়ামী লীগের উচিত ছিল এবারও কৌশল করে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। চেষ্টাও করা হয়েছিল। তবে তা ব্যর্থ হয়েছে। এখন একটা ভিন্ন কৌশল দেখা যাচ্ছে।
কি কৌশল?
এবার উপজেলা নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপর বিশেষভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের ওপর তেমন আস্থা রাখা যায়নি বলেই এ ব্যবস্থা। চাচা বললেন।
এভাবে নির্বাচন করে কি গণতন্ত্র রক্ষিত হতে পারে?
গণতন্ত্রের তুমি বোঝটা কী? চাচা বিরক্তিস্বরে আমাকে বললেন, তুমি কি মনে করো নির্বাচনে কেবল দেশের মানুষেরা ভোট দেয়, বিদেশীরা কিছু করে না?
তা করে। বিগত জাতীয় নির্বাচনে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের সচিব সুজাতা সিং সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন। জাতীয় পার্টি যাতে নির্বাচনে যায়, তার জন্য এরশাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি।
কথাটা ফাঁস করা এরশাদের মোটেই উচিত হয়নি। চাচা গলার স্বর স্বাভাবিক করে বললেন, গণতন্ত্রের পুরোনো ধারণা এখন আর নেই। নির্বাচন ছাড়া কিংবা নামকা-ওয়াস্তে নির্বাচন করেও গণতন্ত্র রক্ষিত হতে পারে। এর নাম হচ্ছে নব্য গণতন্ত্র।
নব্য গণতন্ত্র!
আঁতকে উঠলে যে! এটা অবশ্য আইউব খানের মৌলিক গণতন্ত্র নয়। বর্তমান নব্য গণতন্ত্র সময়ের প্রয়োজনে ও সংবিধান রক্ষার্থে গণতন্ত্রের ভিন্নতর রূপ। এটা ওয়েস্ট মিনস্টার গণতন্ত্রের আদল থেকে আলাদা। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ নব্য গণতন্ত্রের বিকাশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সেটা কী রকম? আমি প্রশ্ন করলাম।
মিসরের দিকে তাকিয়ে দেখ। মিসরের সেনাপ্রধান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফিল্ড মার্শাল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি আগামী এপ্রিলে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। ফিল্ড মার্শাল সিসি বিগত নির্বাচনে নির্বাচিত মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে শাসনক্ষমতা দখল করেন ও মুরসিকে জেলে দেন। মিসরের এবারের নির্বাচনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ফিল্ড মার্শাল সিসিকে প্রকাশ্যে অগ্রিম সমর্থন দিয়েছেন। আমি শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, মিসরের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফিল্ড মার্শাল সিসি জয়যুক্ত হবেন।
কিন্তু এতে কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে? আমি প্রশ্ন করলাম।
তুমি গণতন্ত্রের পুরোনো ধ্যানধারণার বিষয়টা ভুলে যাও। চাচা বিগলিত হাসি মুখে বললেন, নব্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যে কোনো একটা নির্বাচন হলেই হলো। কিভাবে কী নির্বাচন হলো, তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা হবে না।
মিডিয়া তো রিপোর্ট করা ছাড়া আর কিছুই করছে না।
সেটাই বলতে চাচ্ছি। সেদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতার পিস্তল হাতে ছবি ছাপা হয়েছে। এ রকম একপেশে রিপোর্ট বা ছবি ছাপার নাম কী সাংবাদিকতা?
কিন্তু একপেশে রিপোর্ট হলো কীভাবে?
আরে ভাই! জামায়াতে ইসলামীর ক্যাডাররা যখন প্লাস্টিক বোমা ছোড়ে, তাদের কী কোনো ছবি আজ পর্যন্ত পত্রিকায় ছাপা হয়েছে? হয়নি। অথচ ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা যখন আত্মরক্ষার্থে পিস্তল হাতে নেয়, ফলাও করে সেটা ছাপা হয়, যা দুরভিসন্ধিমূলক।
চাচা কোনো বিষয়ে উত্তেজিত হয়ে গেলে আমাকে ভাই বলে সম্বোধন করেন। এটা নতুন কিছু নয়। আমি বললাম, ক’দিন আগে জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজী সেলিম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘শিবির রগ কাটে, ছাত্রলীগ কবজি কাটে, মাথা কাটে।’ এ কথার জবাবে ছাত্রলীগ লিখিতভাবে প্রতিবাদলিপিতে জানিয়েছে, হাজী সেলিম একজন ‘অশিক্ষিত’ ও ‘মূর্খ’ লোক। কিন্তু এটা কী হাজি সেলিমের কথার জবাব হলো?
ঠিকই বলেছে ওরা। চাচা জানালেন, ছাত্রলীগের ছেলেরা যেহেতু ছাত্র, সেহেতু তাদের চোখে ‘অশিক্ষিত’ ও ‘মূর্খ’ হাজী সেলিমের অপরাধ হচ্ছে ‘শিক্ষিত’ ও ‘বিদ্বান’ ছাত্রদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মুখ খোলা। সংসদ সদস্য হয়েছেন বলে সংসদে দাঁড়িয়ে সমাজের শিক্ষিত অংশের বিরুদ্ধে গায়ে পড়ে মন্তব্য করা হাজী সেলিমের উচিত হয়নি। ছাত্রশিবির আর ছাত্রলীগ কি এক বিষয় হলো যে তাদের তুলনা করা হবে? ‘অশিক্ষিত’ আর ‘মূর্খ’ না হলে হাজী সেলিম এটা করতে পারতেন না।
আমি বললাম, চাচা! ছাত্রলীগ সম্পর্কে আরো অভিযোগ আছে। ক’দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হল থেকে ৯৭ জন শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগ নেতারা বের করে দিয়েছে। ওই ৯৭ ছাত্রের অপরাধ হলো তাদের কাছে স্থানীয় ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রত্যয়নপত্র নেই। তাদেরকে জানানো হয়েছে, তারা শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না এবং ছাত্রলীগ করত- এ রকম প্রত্যয়নপত্র যার যার এলাকার আওয়ামী লীগ নেতার কাছ থেকে আনতে হবে। এটা কেমন কথা?
কী আশ্চর্য! এতে অভিযোগের কী আছে? চাচা ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, ছাত্রলীগ স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি যাতে আসন পেতে ঘাঁটি বানাতে না পারে, তা দেখা নিশ্চয়ই অন্যায় কিছু নয়। তাতে প্রয়োজনে ৯৭ জন কেন, ৯৭০ জনকে হলে থাকতে না দেয়ার অধিকার ছাত্রলীগের রয়েছে।
কিন্তু ছাত্রলীগ তো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। হলে স্থান পেতে ছাত্রদের যার যার এলাকার আওয়ামী লীগ নেতার প্রত্যয়নপত্রইবা আনতে হবে কেন?
তুমি ব্যাপারটা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছ কেন? ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সাহায্য করছে বলেই তাদের এটা করতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এককভাবে আবাসন সমস্যার সমাধান করতে পারছে না বলেই ছাত্রলীগ এ ব্যাপার হ্যান্ডেল করছে। ওরা যদি অন্যায় কিছু করত তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই তাতে বাধা দিতো। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি কিছু বলেছে?
না। তারা তো ছাত্রলীগের পক্ষে।
তাহলেই বুঝতে পার, ছাত্রলীগ কোনো অন্যায় করছে না। তুমিও দেখছি হাজী সেলিম হয়ে গেলে।
চাচার কথায় আমি রীতিমতো বিচলিতবোধ করলাম। হাজী সেলিম ঢাকার একজন খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হননি। আওয়ামী লীগের আরেক প্রখ্যাত নেতা ও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীনকে নির্বাচনে পরাজিত করে তিনি সংসদ সদস্য হয়েছেন। ভবিষ্যতে তিনি মন্ত্রীও হতে পারেন। যদি তাই হয়, তাহলে তিনি হবেন ছাত্রলীগের ভাষায় দেশের প্রথম ‘অশিক্ষিত’ ও ‘মূর্খ’ মন্ত্রী। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে যা বলেছেন, আমি তা সমর্থন করিনি। তাহলে আমি তার সঙ্গে তুলনীয় হলাম কী করে?
আমি প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বললাম, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ঘোষণা করেছেন, আগামী ২০১৯ সালের ২৮শে জানুয়ারির পূর্বে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মেয়াদ শেষে বর্তমান সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
এটা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের আন্তরিকতা ও স্বচ্ছতার প্রমাণ। চাচা বললেন, বিএনপি যাতে এ সময়ের মধ্যে নিজেদের তৈরি করে নিতে পারে, এজন্যই সৈয়দ আশরাফ সময়টি অগ্রিম জানিয়ে দিয়েছেন।
চাচা! নির্বাচন কী বিগত নির্বাচনের মতোই হবে?
অবশ্যই। চাচা বললেন, দু-একটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব দেশ আমাদের নির্বাচন মেনে নিয়েছে। সবাই বর্তমান নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছেন। তাছাড়া, বাংলাদেশের বিগত নির্বাচন একটা মডেল হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ভবিষ্যতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ মডেলটিকে গ্রহণ করবে। সুতরাং, সংবিধানের বাধ্যবাধকতা রক্ষা করে একই পদ্ধতিতে আগামী নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে।
কিন্তু এটা তো বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন!
কেন? জাতীয় সংসদে বিরোধী দল তো আছে। বেগম রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা।
উনি কি সত্যি বিরোধীদলীয় নেতা?
তোমার এসব অহেতুক প্রশ্ন আমার ভালো লাগে না। বেগম রওশন এরশাদ একজন অসাধারণ রাজনীতিবিদ। তিনি একদিকে তার স্বামী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কাছ থেকে দলের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন, অন্যদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ক্ষমতার অংশীদার হিসেবে ভারসাম্য রক্ষা করছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় এমন উদাহরণ আর এক পিস পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
আমি চুপ করে চাচার কথা শুনলাম। জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝি না। গত নির্বাচনে এরশাদের নির্দেশে ১৮৬ জন প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। বাকিরা নির্দেশ অমান্য করে নির্বাচন করেন। বর্তমান সংসদে জাতীয় পার্টির ৩৪ জন সদস্য রয়েছেন। এরশাদ নিজেও সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এরপর তাকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করা হয়। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। অন্যদিকে তার স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদ দলের যে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে স্বামীকে ক্ষমতাহীন করেছেন, তা ফিরে পেতে এরশাদ সমপ্রতি দলের নেতাকর্মীদের এক সম্মেলনে গান গেয়েছেন? ‘আয় খোকা আয়!’ তবে দলের ৩০ জন সংসদ সদস্য তার ডাকে সাড়া দেননি। আসলে দলের খোকারা বুঝতে পারছেন না কার কাছে যাবেন? ক্ষমতাবান রওশন এরশাদের কাছে, না ক্ষমতাহীন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কাছে?
আমি আবার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললাম, চাচা! উপজেলা নির্বাচনে তো দেখছি রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন আছে, অথচ কাগজপত্রে সবই নির্দলীয়। নির্বাচনে একক প্রার্থী দেয়ার জন্য বিদ্রোহী প্রার্থীদের দল থেকে বহিষ্কারও করা হচ্ছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত নয়?
তোমার কাছে তো সবই অদ্ভুত। তবে এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গুরুত্বপূর্ণ কেন?
বিএনপি তলে তলে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে বলে। বর্তমান সরকারকে বিএনপি অবৈধ সরকার বলছে, আবার এ সরকারের অধীনে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এটা কেমন নৈতিকতাবিরোধী কথা?
নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নেই বলেই বোধহয়। আমি বললাম।
আওয়ামী লীগের উচিত ছিল এবারও কৌশল করে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। চেষ্টাও করা হয়েছিল। তবে তা ব্যর্থ হয়েছে। এখন একটা ভিন্ন কৌশল দেখা যাচ্ছে।
কি কৌশল?
এবার উপজেলা নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপর বিশেষভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের ওপর তেমন আস্থা রাখা যায়নি বলেই এ ব্যবস্থা। চাচা বললেন।
এভাবে নির্বাচন করে কি গণতন্ত্র রক্ষিত হতে পারে?
গণতন্ত্রের তুমি বোঝটা কী? চাচা বিরক্তিস্বরে আমাকে বললেন, তুমি কি মনে করো নির্বাচনে কেবল দেশের মানুষেরা ভোট দেয়, বিদেশীরা কিছু করে না?
তা করে। বিগত জাতীয় নির্বাচনে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের সচিব সুজাতা সিং সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন। জাতীয় পার্টি যাতে নির্বাচনে যায়, তার জন্য এরশাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি।
কথাটা ফাঁস করা এরশাদের মোটেই উচিত হয়নি। চাচা গলার স্বর স্বাভাবিক করে বললেন, গণতন্ত্রের পুরোনো ধারণা এখন আর নেই। নির্বাচন ছাড়া কিংবা নামকা-ওয়াস্তে নির্বাচন করেও গণতন্ত্র রক্ষিত হতে পারে। এর নাম হচ্ছে নব্য গণতন্ত্র।
নব্য গণতন্ত্র!
আঁতকে উঠলে যে! এটা অবশ্য আইউব খানের মৌলিক গণতন্ত্র নয়। বর্তমান নব্য গণতন্ত্র সময়ের প্রয়োজনে ও সংবিধান রক্ষার্থে গণতন্ত্রের ভিন্নতর রূপ। এটা ওয়েস্ট মিনস্টার গণতন্ত্রের আদল থেকে আলাদা। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ নব্য গণতন্ত্রের বিকাশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সেটা কী রকম? আমি প্রশ্ন করলাম।
মিসরের দিকে তাকিয়ে দেখ। মিসরের সেনাপ্রধান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফিল্ড মার্শাল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি আগামী এপ্রিলে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। ফিল্ড মার্শাল সিসি বিগত নির্বাচনে নির্বাচিত মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে শাসনক্ষমতা দখল করেন ও মুরসিকে জেলে দেন। মিসরের এবারের নির্বাচনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ফিল্ড মার্শাল সিসিকে প্রকাশ্যে অগ্রিম সমর্থন দিয়েছেন। আমি শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, মিসরের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফিল্ড মার্শাল সিসি জয়যুক্ত হবেন।
কিন্তু এতে কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে? আমি প্রশ্ন করলাম।
তুমি গণতন্ত্রের পুরোনো ধ্যানধারণার বিষয়টা ভুলে যাও। চাচা বিগলিত হাসি মুখে বললেন, নব্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যে কোনো একটা নির্বাচন হলেই হলো। কিভাবে কী নির্বাচন হলো, তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা হবে না।
No comments