ভালোবাসি তাই, ভালো কাজ চাই
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিদেশি কূটনীতিকদের, আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার ব্যাপক তৎপরতা দেখা দিয়েছিল। একদিকে আমেরিকা থেকে উড়ে আসেন নিশা দেশাই, আরেক দিকে ভারত থেকে আসেন সুজাতা সিং। এই জাতিসংঘের সেক্রেটারির ফোন তো ওই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বার্তা। তাঁরা একবার আওয়ামী লীগের নেতার সঙ্গে দেখা করেন, একবার বিএনপির নেতার সঙ্গে। তাঁরা কী বলতেন? এখন শোনা যাচ্ছে, তাঁরা বিএনপির নেতাদের বলতেন, আপনারা নির্বাচনে অংশ নিন।
নিশা দেশাইয়ের সংবাদ সম্মেলনে তো বলেই দেওয়া হয়েছিল, নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি পাবে না তা নির্ভর করছে বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনটাকে গ্রহণ করবে কি করবে না তার ওপর। এখনো অন্তত আমেরিকানরা এই নির্বাচনকে মেনে নিয়েছে, সে রকম ভাবার কোনো কারণ ঘটেনি। কিন্তু যদি ডিআইয়ের জরিপ ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে নির্বাচনের পর জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি অর্জন করেছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের পর প্রশ্ন করা হয়েছিল, সব দল অংশ নিলে আপনি কাকে ভোট দিতেন। ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তাঁরা আওয়ামী লীগকেই ভোট দিতেন। আর ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা ভোট দিতেন বিএনপিকে। অথচ নির্বাচনের আগের জরিপে দেখা গিয়েছিল, প্রায় ৫০ ভাগ মানুষ বিএনপিকে ভোট দিতে চান। এর ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই একেকজন একেক রকমভাবে দেবেন। আমাদের মনে হচ্ছে, বিএনপির নির্বাচন বর্জন করাটাকেই দেশের মানুষ ঠিকভাবে গ্রহণ করেনি। তার ওপর জামায়াতের সঙ্গে পরিচালিত আন্দোলনের নামে যেভাবে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারা হয়েছে, মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে আর স্কুল-কলেজে আগুন দেওয়া হয়েছে, সেটাকেই বা কে সমর্থন করবে? মার্চ ফর ডেমোক্রেসিতে কোথাও কোনো মার্চ হয়নি। এমন দুর্বল দলের ভোট না কমার কি কোনো কারণ আছে?
আবার নির্বাচনের নামে যা হয়েছে, তা খুবই দৃষ্টিকটু। এক এরশাদ সাহেবকে নিয়ে যে নাটক হয়ে গেছে, তা মলিয়েঁরের মতো কমেডি নাটক-রচয়িতার পক্ষেও কল্পনা করা অসম্ভব ছিল। ১৫৩টা আসনে ভোটই হয়নি। তার পরও দেশের মানুষের মধ্যে এখন কিন্তু একটা স্বস্তির ভাব। কারণ অনির্দিষ্টকালের জন্য ঘোষণা করা অবরোধটা এখন আর নেই। এখন বিএনপি কী করবে? আমেরিকানরা চায়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আরেকটা সর্বগ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। গতকাল ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত একটা জনমত জরিপেও দেখা যাচ্ছে, দেশের বেশির ভাগ মানুষ তাড়াতাড়ি আরেকটা নির্বাচন চায়। এখন আসুন একটা কল্পনা করি, সরকার আরেকটা নির্বাচন দিচ্ছে। সেই নির্বাচন কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেবে? কোনো কারণ দেখি না। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে শেখ হাসিনা সরে যাবেন? মনে হয় না। তাহলে সেই নির্বাচনে বিএনপি কেন যাবে? যদি যায়, তাহলে প্রশ্ন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে কেন তারা তাহলে গেল না? এত প্রাণহানি, এত অঙ্গহানি, এত সম্পদ ধ্বংসের দায় কে নেবে? কাজেই খুব তাড়াতাড়ি দেশে একটা নির্বাচন হচ্ছে, এই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এই সরকার বেশ কিছুদিনের জন্য রয়ে যাচ্ছে, এই হলো আমার ভবিষ্যদ্বাণী। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবেরা বলেছিলেন, সরকার একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসে ভালো ভালো কাজ করবে। জনগণের মন জয় করে বিপুলভাবে জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনবে। তারপর আবার একটা নির্বাচন দেবে। শুনে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, সরকার যদি জানেই যে ভালো ভালো কাজ করলে জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায়, গত পাঁচ বছরে তা বেশি বেশি করে করল না কেন? এই দেশের নিয়ম হলো, যে ক্ষমতায় থাকে, সে জনপ্রিয়তা হারায়।
কিন্তু এই প্রথম এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটল, ডিআইয়ের জরিপে যার প্রতিফলন ঘটেছে। ক্ষমতা ধরে রাখতে পারার সাফল্যে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে। এখন আওয়ামী লীগের সরকার ভালো ভালো কাজ করুক। আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, আওয়ামী লীগের সরকার ভালো ভালো কাজ করে জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে ক্ষমতায় বহুদিন থাকুক, আপনি তা-ই চান? আমি বলব, আমি চাই সরকারের ভালো ভালো কাজ। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তার কাজকর্মে যদি দেশের ভালো হয়, মানুষের ভালো হয়, আমি এক শ বার সেটাই চাইব। গতকাল প্রকাশিত একটা খবরে আশার সঞ্চার হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন গত মহাজোট সরকারের দুজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে তলব করেছে। একটা সূত্রে খবর পেয়েছি, বেশ কজন সাবেক মন্ত্রী সম্পর্কে তদন্তে নামার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী দুদককে অনুমোদন দিয়েছেন। এটা একটা সংকেত। এর আগেও শোনা গিয়েছিল, হলফনামায় মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদের রকেটগতির উল্লম্ফন দেখে প্রধানমন্ত্রী নাকি বলেছেন, এঁদের দায়দায়িত্ব দল নেবে না, দুদক এসবের তদন্ত করবে। সরকারের কাছে মানুষের চাওয়া দুটো: দুর্নীতি না করা, আর দক্ষতা। পদ্মা সেতু চাই, বিদ্যুৎ চাই, যোগাযোগ, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি চাই, আইনের শাসন চাই, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা চাই, মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠা চাই, খেয়ে-পরে বাঁচতে চাই, লেখাপড়ার পরিবেশ চাই। আর চাই গণতান্ত্রিক আচরণ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর গুলি করা কোনো যুক্তিতেই মেনে নেওয়া যায় না। একটা ছবিতে দেখা গেছে, একজন ছাত্রর পিঠে ছর্রা গুলির অসংখ্য দাগ। আর দেখা গেছে, ছাত্রলীগের ছেলেরা পিস্তল/রিভলভার উঁচিয়ে গুলি ছুড়ছে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের দাবি যত অযৌক্তিকই হোক না কেন, কোনো অবস্থাতেই পুলিশ তাদের ওপর গুলি ছুড়তে পারে না। এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
আগে তো ক্যাম্পাসে পুলিশের ঢোকাই নিষেধ ছিল, বিশেষ অনুমতি ছাড়া পুলিশ কখনো শিক্ষাঙ্গনে ঢুকত না। এখন পুলিশ ছাত্রদের ওপর রাবার বুলেট হলেও ছুড়ছে! এটা একেবারেই কাম্য নয়। আর ছাত্রলীগের নেতাদের গুলি করার ছবি? কারোরই গুলি করার অধিকার নেই, সে ছাত্রলীগ হোক, ছাত্রদল হোক আর অছাত্র হোক বা নির্দলীয় ছাত্র হোক। ছাত্রদের আন্দোলন রুখতে ছাত্রলীগ শক্তির মহড়া দেখাবে, এটা তো কৌশল হিসেবেও খুবই অকার্যকর, খুবই বিপজ্জনক। বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনার পরও কি এদের শিক্ষা হয় না? nতবে হ্যাঁ, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন বাড়ানো যাবে না, রাতের শিফট চালু করা যাবে না—এই অবস্থানও ঢালাওভাবে ঠিক নয়। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মোবাইল ফোনে মাসে তিন-চার শ টাকা খরচ করেনই। সেখানে এক শ টাকা বেতন দেওয়া যাবে না, এটা হয়তো সাধারণভাবে ঠিক নয়। হ্যাঁ, গরিব ছাত্রদের জন্য ফুল ফ্রি, হাফ ফ্রি এমনকি বৃত্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। সম্পন্ন পরিবারের সন্তানেরা বেশি করে বেতন দেবেন, অসচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা উল্টো বৃত্তি পাবেন। উন্নত দেশেও এটাই প্রচলিত। আবার ওয়াকিফহাল মহল বলছে, শুধু বেতন বৃদ্ধি কিংবা সান্ধ্য কোর্স চালুর প্রতিবাদেই এই আন্দোলন ছিল না, এর পেছনে ছিল ফল হতে দেরি হওয়া বা পরীক্ষার ফি বেশি বেশি নিয়ে ভাগ করে নেওয়ার মতো নানা অভিযোগ। যেটাই হোক, ক্ষোভের প্রকৃত কারণ বের করে তা নিরসন করতে হবে। গুলি কোনো সমস্যারই সমাধান নয়। আর সব সময় আন্দোলনই বা করতে হবে কেন? বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢোকার মুখে দেখি আলো নেই, তোরণ দেখা যায় না। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরকে আমি বহুদিন থেকে চিনি। আমি তাঁকে ফোন করে জানালাম, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশমুখে আলো চাই।
দুই ঘণ্টার মধ্যে দেখি আলো ঝকমক করছে। আমরা বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলায় শুধু বাংলাদেশের বই-ই দেখতে চাই। আবার আমরা অন্য দেশের বই পড়ব না বা কলকাতা থেকে প্রকাশিত শঙ্খ ঘোষ, কিংবা অমিয়ভূষণ মজুমদারের বই সহজে পাব না, তাও তো ঠিক নয়। সে জন্য একটা আন্তর্জাতিক বইমেলা করা হোক আলাদা করে, আগে যেটা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র করত ঢাকা বইমেলা নামে। কোনো অসুবিধা নেই। প্রতিযোগিতাকে আমরা ভয় পাই না। রাস্তায় সুনীল-শীর্ষেন্দুর নকল বই খুব কম দামে পাওয়া যায়, তা সত্ত্বেও বইমেলায় ঢুকে বেশি বেশি দাম দিয়ে পাঠক দেশি লেখকদের বই কিনছেন তো! কারণ পঞ্চাশের দশকের ঢাকার বর্ণনা সৈয়দ শামসুল হকের তিন পয়সার জোছনাতেই কেবল পাওয়া যাবে, যেমন বীরাঙ্গনার কথা পাওয়া যাবে সেলিনা হোসেনের গেরিলা ও বীরাঙ্গনায়। হুমায়ূন আহমেদ আর মুহম্মদ জাফর ইকবালের একাত্তরের ডায়েরি আমার বাবা ও একাত্তর তো কলকাতার বইয়ে পাওয়া যাবে না। এসব প্রসঙ্গেও আন্দোলন করতে হবে বলে মনে করি না, শুধু ঠিক জায়গায় প্রত্যাশার কথাটা জানানোই যথেষ্ট। তাই জানিয়ে রাখি। বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলায় বিদেশি বই চাই না। আর এবারের বইমেলা রাত নয়টা পর্যন্ত খোলা রাখা হোক। অফিস সেরে যানজট ঠেলে বইমেলায় পৌঁছাতেই তো আটটা বেজে যায়। আজ ভালোবাসা দিবস। এই দিনে ভালোবাসার কথা না বলে কী বলছি এসব! আসলে ভালোবাসার কথাই বলছি। আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ভালোবাসার সংলাপ তো ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। সে কারণেই আমরা সরকারগুলোর কাছে ভালো ভালো কাজ চাই। ভালো ভালো কাজ করে জনগণের হূদয় হরণের প্রতিযোগিতার চেয়ে ভালো প্রতিযোগিতা আর কী হতে পারে?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments