১৪ ফেব্রুয়ারি: এক রক্তঝরা দিন
আজ থেকে ৩১ বছর আগের সেই রাতের কথা প্রধানমন্ত্রীর ভুলে যাওয়ার কথা নয়। বেইলি রোডে আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. কামাল হোসেনের বাসায় বিএনপি ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দলের নেতারা বৈঠকে বসেছেন। ঢাকায় সেদিন ছাত্র আন্দোলন দমনে পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং ছাত্রহত্যা-পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও করণীয় নিয়ে আলোচনাই ছিল ওই বৈঠকের উদ্দেশ্য। কিন্তু সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের বাহিনী বাড়িটি ঘিরে ফেলে রাজনীতিকদের সবাইকে ধরে নিয়ে যায়। ড. কামালসহ পুরুষ নেতাদের সবাইকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে, যেটা সেনানিবাসের ভেতরে একটি জায়গায় বলেই আটক রাজনীতিকদের ধারণা। তবে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় আরও দুজন নারীনেত্রীকে নেওয়া হয় কাছেই মিন্টো রোডে স্পিকারের জন্য নির্ধারিত বাসভবন, দোতলা লাল দালানটিতে। তাঁদের অবশ্য চোখ বাঁধা ছিল না বলেই জেনেছি। সেই রাতে ভবনটিতে থাকা সেনাদলের দায়িত্বে ছিলেন যে মেজর, তাঁর কাছ থেকেই শুনেছি যে নেত্রীত্রয়ের রাত কেটেছিল নিচতলাতেই সোফায়। মশার কামড় আর শীতের কাঁপুনি—দুটির কোনোটি থেকে তাঁরা রেহাই পাননি। আমাদেরও সেই রাতটি কেটেছিল মশার কামড় আর শীতের কাঁপুনিতে। সূর্য সেন হলের পেছনে একজন হাউস টিউটরের খালি বাসায় আমরা তিনজন—মরহুম অলি আহাদের নেতৃত্বাধীন ডেমোক্রেটিক লীগের ছাত্রসংগঠনের সভাপতি কায়েস (বছর কয়েক আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে), জাতীয় ছাত্র আন্দোলনের শরিফুল ইসলাম আলমাজি ও আমি। দরজা বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে আমরা আলো নিভিয়ে সেখানে পালিয়ে ছিলাম।
ওই শিক্ষকের পরিবারের কেউ একজন বিদেশ যাবেন বলে তাঁরা সবাই বিমানবন্দরে গিয়ে আটকা পড়েছিলেন। রাতভর সূর্য সেন, মুহসীন ও জসীমউদ্দীন হলগুলোতে বুটের আওয়াজ, ছাত্রদের মারধরের শব্দ, কান্না আর চিৎকার শুনেছি এবং ক্ষণে ক্ষণে আঁতকে উঠেছি। পরে শুনেছি, কয়েক শ ছাত্রকে (এমনকি হাজারও ছাড়িয়ে যেতে পারে) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের খালি মাঠে রাতভর বসিয়ে রাখা হয়েছে। অনেক দিন আগে থেকেই ওই উদ্যানে তাঁবু খাটিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন রাখা হয়েছিল। শাহবাগের পুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষের বাইরের আঙিনায় রাতভর অনেক ছাত্রের ওপর চলেছে নির্যাতন। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র সফল আন্দোলনটির সূচনা হয়েছিল যে আশির দশকে, সেই আন্দোলনের প্রথম রক্তপাতের দিনটির আজ ৩১ বছর পূর্ণ হচ্ছে। শহীদ জাফর, জয়নাল, দীপালি সাহা, মোজাম্মেল, আয়ুবসহ অজ্ঞাত কয়েকজনের রক্তে রঞ্জিত ছাত্র আন্দোলনের এক গৌরবময় দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার এক অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে সেদিন যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তাতে বিএনপি ছাড়া আর প্রায় সব দলের সহযোগী ছাত্রসংগঠনগুলো জোটবদ্ধ হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় কয়েক বছর পর তাতে বিএনপির ছাত্রসংগঠনও যুক্ত হয় এবং নব্বইয়ের ছাত্রজনতার গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৪ ফেব্রুয়ারির স্মৃতি আমাদের প্রজন্মের স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল। বেলা সাড়ে ১১টা বা ১২টার দিকে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর মিছিল শিক্ষা ভবনের কাছে পৌঁছানোর পর পুলিশের কাঁটাতারের প্রতিবন্ধক ভেঙে ফেলার চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ গুলি ছোড়ে। মিছিলের সামনের দিকে ছিলেন তখনকার ছাত্রনেতাদের প্রায় সবাই।
আমি ছিলাম মিছিলের মাঝামাঝি, শিশু একাডেমীর সামনে। পুলিশ গুলি ছুড়তে শুরু করলে মিছিলের সবাই প্রাণ বাঁচাতে যে যেদিকে পেরেছেন, দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজেছেন। আমি গিয়েছিলাম শহীদ মিনারের দিকে এবং সেখান থেকে আবার কলা ভবনে। এর মধ্যেই দুর্দান্ত সাহসী কয়েকজন ছাত্র পুলিশের ছোবল পড়ার আগেই শহীদ জাফর ও জয়নালের মরদেহ নিয়ে আসে কলা ভবনে। অন্যদের মরদেহ পুলিশ নিয়ে গুম করে ফেলে শোনা যায়। জলকামানের পানির তোড়ে ধোয়া হয়ে যায় রক্তস্নাত রাজপথ। রাজনৈতিক নেতারা কেউ কেউ কলা ভবনে আসতে শুরু করেন সমবেদনা ও সংহতি জানাতে। শেখ হাসিনারও সেখানে আসার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে অবস্থান নিয়ে পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান চালায়। পুলিশের প্রথম লক্ষ্য, মরদেহগুলো উদ্ধার, যাতে লাশ নিয়ে কোনো মিছিল বেরোতে না পারে। এরই মধ্যে অন্তত একজনের লাশ নিয়ে একদল ছাত্র উপাচার্যের দপ্তর যে ভবনে, সেই রেজিস্টার বিল্ডিংয়ে ঢুকে পড়ে। শীতের বিকেলে দ্রুত সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে সেনাসদস্যরা অবস্থান নিতে শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে বেরোনোর সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর শহরেও কারফিউ জারি করা হয়। পরদিন ঢাকা শহরের কয়েকটি কলেজে ছাত্ররা বিক্ষোভ করতে গেলে সেগুলোও নির্দয়ভাবে দমন করে পুলিশ। মহাখালীতে যেখানে এখন গাওছুল আজম মসজিদ, সেই জায়গাটি তখন ছিল ফাঁকা। তিতুমীর কলেজের একদল ছাত্রকে পুলিশ কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে সেখানে প্রকাশ্যেই লাঠিপেটা করছিল। গুলিস্তান থেকে গুলশানের মধ্যে যাতায়াতকারী ৬ নম্বর বাসে বসে সেই দৃশ্য দেখে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তবে বছর না ঘুরতেই আবার সবাই সংগঠিত হতে শুরু করে।
১৯৮৪-এর ২৮ ফেব্রুয়ারিতে মিছিলের ওপর পুলিশের ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয় দুজন ছাত্র সেলিম ও দেলোয়ারকে। সেলিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে আমার সহপাঠী ছিলেন। সে বছরই তাঁর এমএ পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিল। ওই মিছিলেও শুরুতে আমি ছিলাম, কিন্তু ঢাকা মেডিকেল পর্যন্ত যাওয়ার পর অন্য একটি কাজে আমি মিরপুর চলে যাই। মিরপুর পৌঁছানোর পরই শুনতে পাই ওই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের কথা। আর পরের বছর ১৫ ফেব্রুয়ারিতে রাতের বেলায় বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে বেরোনোর আগেই পুলিশের গুলিতে নিহত হন জাতীয় ছাত্রলীগের নেতা রাউফুন বসুনিয়া। এরপর ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকার পাশাপাশি মৃত্যুর সারিও দীর্ঘতর হতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোয় শক্তির মহড়া দেওয়ার জন্য জেনারেল এরশাদ লেলিয়ে দেন জাতীয় ছাত্রসমাজ নামে সংগঠিত হওয়া কতিপয় দুর্বৃত্তকে। তাদেরই একজন আজম খানের গুলিতে নিহত হন রেডক্রসের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের নেতা ময়েজউদ্দিন, যাঁর মেয়ে বর্তমান মন্ত্রিসভার একজন সদস্য। পরবর্তী সময়ে কোনো এক নির্বাচনি জনসভায় আজম খানকে নিজের ছেলের সমতুল্য বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন জেনারেল এরশাদ। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এরশাদবিরোধী ছাত্র গণ-আন্দোলনে ঢাকায় পরবর্তী বছরগুলোতে আরও অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন, যাঁদের মধ্যে শহীদ ডাক্তার মিলন, নূর হোসেন, জেহাদের নাম বারবার উচ্চারিত হয় তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে। কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে কোনো যোগসূত্র ছিল না, এমন জীবনও ওই আন্দোলনে উৎসর্গিত হয়েছে। নব্বইয়ের ডিসেম্বরে কলাবাগানের একটি বাড়ির বারান্দায় মায়ের কোলে থাকা শিশুও গুলিতে নিহত হয়েছে। এত সব মৃত্যুর দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করার ঔদ্ধত্য দেখিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো টিকে আছেন সেই স্বৈরশাসক। তার সবচেয়ে বড় কারণ বোধ হয় ১৯৮৩-এর ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সারির নেতাদের কারও কারও রাজনৈতিক আপস অথবা অক্ষমতা।
১৯৮২-এর মার্চে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন জারির আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু), প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউকসু, রাজশাহীর রাকসু, চট্টগ্রামের চাকসু, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজ, তিতুমীরের মতো কলেজগুলোর ছাত্রসংসদগুলোতে নির্বাচনের মাধ্যমে যেসব ছাত্রনেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন, ওই আন্দোলনে তাঁদের ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নতুন দৃষ্টান্ত যোগ করেছে। তখন যেসব ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল, সেসব সংগঠনের নেতারা ভবিষ্যতে এমপি বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বা বড় বড় ব্যবসা বাড়ানোর আশায় ছাত্রসংগঠন করেছেন তা নয়। তেমনটি হলে আপসের বিনিময়ে তখনই তাঁরা কেউ কেউ তাঁদের সতীর্থ ডাকসুর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদকের মতো এরশাদের মন্ত্রী বা উপদেষ্টা বনে যেতে পারতেন। এঁদের অনেকেই রাজনীতির নামে অপরাজনীতিতে যুক্ত হওয়া থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন। হাতে গোনা কেউ কেউ এখনো তৃণমুলের রাজনীতি করছেন। তবে অর্ধেকেরও বেশি, বিশেষ করে যাঁরা মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোতে সক্রিয় হয়েছেন, তাঁরা যেমন তাঁদের নিজেদের দলগুলোতে গণতন্ত্রায়ণে ব্যর্থ হয়েছেন, তেমনি ধীরে ধীরে সব আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে সেই সামরিক শাসকের সঙ্গে জোটের রাজনীতি করছেন। আন্দোলনের সহযোদ্ধা, মিছিলের সহগামীর রক্তে রঞ্জিত হাতের সঙ্গে হাত মেলানোর আংশিক ক্ষতিপূরণ অবশ্য তাঁরা পেয়ে গেছেন হয় মন্ত্রিত্বে, নয়তো ব্যবসা-বাণিজ্য আর অর্থসম্পদে। এসব কতিপয় আপসকামী অথবা সুযোগসন্ধানীর দৃষ্টান্ত সম্ভবত উত্তরকালের ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করেছে। কেননা, এখনকার প্রজন্মের যাঁরা ছাত্ররাজনীতি করছেন, তাঁদের আকর্ষণ হচ্ছে ক্ষমতা আর বিত্ত। সেখানে কোনো আদর্শের লেশ অবশিষ্ট আছে কি না, বলা মুশকিল।
No comments