স্বাগত ২০১৪- এমন ক্রান্তিকাল কখনো আসেনি by আলী রীয়াজ
অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তা ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের সূচনা হতে চলেছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক—সব ক্ষেত্রেই এই বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট।
যেকোনো নতুন বছরের গোড়ায় যেমন অনিশ্চয়তা থাকে, এ বছরের অনিশ্চয়তা তেমন নয়; বরং অতীতের তুলনায় এই বছরের শুরুর সময়টি অনেক বেশি উদ্বেগের এবং আশঙ্কার। ২০১৩ সালের ঘটনাপ্রবাহের কারণে যেকোনো নাগরিকের মনে দেশের আগামী দিনগুলো কেমন হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন ও দুশ্চিন্তা আছে। যাঁরা বাংলাদেশের রাজনীতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁদের মনেও এই প্রশ্ন। বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সেই সময়কে বর্ণনা করতে ‘ক্রান্তিকাল’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু বোধ করি, আর কোনো সময়ই তা এতটা যথাযথ হয়নি, যতটা আজকে নতুন বছরে পা দিয়ে এবং সামনের দিনগুলোর কথা বিবেচনা করে আমরা বলতে পারি। এই অবস্থার সৃষ্টি যদিও এক দিনে হয়নি, এমনকি একটি বছরেও হয়নি, তথাপি এ কথা মানতেই হবে যে গত বছরের ঘটনাপ্রবাহ এই ক্রান্তিকালের দিকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে বিরাজমান পরস্পরবিরোধী প্রবণতা ও দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ ২০১৩ সালে যেভাবে প্রকাশিত এবং মুখোমুখি অবস্থানে উপনীত হয়েছে, তেমনটি আমরা আগে কখনো দেখিনি।
গণতন্ত্র, শাসনব্যবস্থা, সামাজিক বৈষম্য, জবাবদিহি, দুর্নীতি, রাজনীতি ও ধর্মের সম্পর্ক, যুদ্ধাপরাধের মতো জাতির অসমাপ্ত দায় বিষয়ে বিভিন্ন চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আদর্শিক অবস্থান বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ছিল। গত ৪২ বছরে অন্যান্য ইস্যুকে কেন্দ্র করে এগুলোর কোনো কোনোটি কখনো কখনো সামনে এসেছে, কিন্তু এর অনেকগুলো একার্থে অমীমাংসিত বিষয় হিসেবেই থেকে গেছে। যেকোনো সময়ে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় কিছু বিষয় অমীমাংসিত থাকা কোনো ব্যতিক্রম নয়। কোনো জাতি ও জাতিরাষ্ট্র যত পরিপক্ব হয়ে ওঠে, সেই রাষ্ট্র ও তার নাগরিকেরা একাদিক্রমে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর মোকাবিলা করে; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু বিষয় প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে, কিছু বিষয় আরও বেশি জরুরি হয়ে ওঠে।
গত বছরে আমরা একই সময়ে এই বিষয়গুলো রাজনীতির কেন্দ্রে এসে হাজির হতে দেখেছি। অবশ্যই বিষয়গুলো পরস্পরবিরোধী নয়, গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাবান মানুষ সুশাসন ও সামাজিক বৈষম্যের অবসানের দাবি করতেই পারে। রাজনীতি ও ধর্মের সম্পর্কের প্রশ্নে গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন দুজন নাগরিকের ভিন্নমত থাকা অসম্ভব নয়। একইভাবে কোনো এক বিষয়ে কোনো নাগরিকের অবস্থান অন্য বিষয়ে তার কী অবস্থান হবে, তা নির্ধারণ করে না। ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের জবাবদিহির দাবি তোলার মানে এটা নয় যে ওই নাগরিক অন্য প্রশ্নে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থার সমর্থক হতে পারবে না। বিরোধী দলের দায়িত্বজ্ঞানহীন, আশু স্বার্থপ্রণোদিত আচরণের বিরোধিতা করা মাত্রই তাকে ক্ষমতাসীনদের অনুচর বলার সংস্কৃতি অগ্রহণযোগ্য। জবাবদিহি বা গণতন্ত্রের প্রশ্ন কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে নাকচ করে দেয় না; এই দুটি পরস্পরবিরোধী নয়। দুজন নাগরিকের ভেতরে একটি বিষয়ে মতৈক্য মানে সব বিষয়ে তাদের মতৈক্য হবেই—এমন আশা করা অসমীচীন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘শত্রু’ বলে গণ্য করা, তার ন্যূনতম নাগরিক অধিকার হরণ করা এবং সহিংসভাবে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক শক্তিরা নিজেদের জন্যই কেবল বিপদ ডেকে আনে তা নয়, তারা গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয়কেই অস্বীকার করে, সমাজে অসহিষ্ণু সংস্কৃতি তৈরি করে, যার পরিণাম তাদেরও ভোগ করতে হয় আজ অথবা আগামীকাল।
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অগ্রাধিকার তৈরিতে নিঃসন্দেহে ভিন্ন মত থাকবে। কিন্তু গত বছরে দেশের রাজনীতি ও সমাজে অগ্রাধিকারের প্রশ্নে অন্যের ওপরে নিজের পছন্দ চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এটি গণতান্ত্রিক সমাজের লক্ষণ নয়। এই অবস্থা কেবল তাঁরাই পছন্দ করবেন, যাঁরা গণতন্ত্রের যে সামান্য অবশেষ এখনো বাংলাদেশে বিরাজমান, তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে একধরনের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুকূল সামাজিক ও মানসিক পরিস্থিতি তৈরি করতে চান। বল প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন ও সন্ত্রাসী আচরণের মাধ্যমে, দাবি আদায়ের নামে, সাংবিধানিক ধারা চালু রাখার অজুহাতে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার বাতাবরণ তৈরি করে, ধর্মকে আশ্রয় করে কিংবা অন্য যেকোনো আদর্শের নামেই তা করা হোক না কেন, তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে এক অন্ধকার পথে চালিত করবে। অনুমান করতে পারি যে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা যতই অপসৃত হবে, এই প্রবণতা তত বেশি শক্তিশালী হবে। বছরের গোড়াতেই অনুষ্ঠেয় একতরফা নির্বাচন এবং তা প্রতিরোধে বিরোধীদের সহিংস আচরণ গণতন্ত্রের উল্টো পথেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে। বছরের শুরুটা এভাবেই হবে বলে আমরা জানি এবং তা আগামী দিনগুলোকে আরও কঠিন করে তুলবে। বাংলাদেশ গণতন্ত্রের উল্টো পথে এগোবে কি না, তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ২০১৪ সাল গুরুত্বপূর্ণ বলেই আমার অনুমান। বাংলাদেশ কোন পথে এগোবে, তা নিয়তি-নির্ধারিত নয়, রাজনীতিতে কোনো পথই অনিবার্য নয়। রাজনৈতিক নেতারা ও নাগরিকেরাই এই পথ নির্ধারণ করবেন। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের দায়িত্ব অন্যদের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের নাগরিকেরা অতীতে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে আপসহীন থেকেছে, ২০১৪ সাল তার ব্যতিক্রম হবে না বলেই আমার ধারণা।
দুই
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২০১৩ সালে একধরনের মেরুকরণের সূচনা হয়েছে। প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরে গড়ে ওঠা দুই কেন্দ্রের বাইরে যেসব দল ছিল, তাদের এক বড় অংশই এখন এই দুই কেন্দ্রমুখী হয়ে পড়েছে। বিএনপি ২০০১ সালের আগেই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যে চারদলীয় জোট গড়ে তুলেছে, তারই পরিবর্ধিত রূপ আমরা দেখতে পাই ১৮-দলীয় জোট হিসেবে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ২০০৬ সালে যে মহাজোট গড়ে তোলে, তার অনেক দল যেমন তা থেকে সরে গেছে, তেমনি অন্যদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে এবং জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে চাপের মুখে তাদের শরিক করে রেখেছে। এই ঐক্যে যেসব দল শরিক হয়েছে, তারা অচিরেই ভিন্ন অবস্থান নিতে সক্ষম হবে না। কিন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দল যে ধরনের আচরণ করেছে, মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের সম্পদের যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তা ক্ষমতাসীন দল ও জোটের জন্য ভবিষ্যতেও স্বস্তির বিষয় হবে না। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট গঠন ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে যতটুকু সুবিধা প্রদান করেছিল ২০০১-২০০৬ সালের সরকারে থাকা অবস্থায় এবং গত কয়েক বছরে তার চেয়ে বেশি মাশুল গুনতে হয়েছে দলটিকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে জামায়াতের অব্যাহত সন্ত্রাসী তৎপরতা দেশের জন্য এক বিরাট হুমকি সৃষ্টি করেছে। জামায়াতের এসব আচরণ বিএনপির রাজনৈতিক দাবিকে গত বছরে পেছনে ফেলে দিয়েছে। অন্যদিকে, বিএনপি জামায়াত-নির্ভর হয়ে পড়েছে। জামায়াতে ইসলামী সাংগঠনিকভাবেই ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত এবং গত ৪২ বছরে তাদের ভূমিকার জন্য কখনোই ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দলের নেতাদের বিচার ও শাস্তি দলটিকে দেশের এক বড় অংশের কাছে অগ্রহণযোগ্য করে ফেলেছে।
এই প্রশ্ন বিএনপি কীভাবে তা মোকাবিলা করবে, সেটা ২০১৩ সালে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই বছরে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়বে। এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বিএনপি তার অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশের অপেক্ষা করবে, নাকি ঝুঁকি নিয়ে হলেও একটি পদক্ষেপ নেবে তার ওপর কেবল দলের নয়, দেশের সাংবিধানিক নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ অংশত নির্ভরশীল। দায়িত্বশীল বিরোধী দল হিসেবে আচরণে বিএনপির ব্যত্যয় হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল যদি দেশে নিয়মতান্ত্রিক সাংবিধানিক রাজনীতির ধারাকে অব্যাহত রাখতে চায়, তবে কেবল কথায় নয়, কাজেও তা প্রমাণ করতে হবে। সহিংসতা মোকাবিলা করে নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়া যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তেমনি নাগরিকের ভিন্ন মত প্রকাশ এবং তার পক্ষে সংবিধান প্রদত্ত গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের কর্তব্য। এর অন্যথা হলে অসাংবিধানিক শক্তিই কেবল লাভবান হবে। তার পরিণতির জন্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না; ২০১৪ সালেই আমরা তার বিবিধ পরিণতি দেখতে পাব বলে আমার আশঙ্কা। মেরুকরণের এই প্রক্রিয়ায় দুই কেন্দ্রের বাইরে যেসব দল রয়েছে, তাদের ভূমিকা মোটেই অকিঞ্চিৎকর নয়; তারা কী ভূমিকা নেয়, সেটাও লক্ষণীয়।
তিন
ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের কারণে বৈশ্বিক পরিসরে বাংলাদেশের ভূমিকা রাখার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সেই বিবেচনায় ২০১৪ সাল আলাদা গুরুত্ব বহন করে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি পরিবর্তনশীল, ফলে আজকে একটি দেশ যে গুরুত্ব বহন করে, তা ভবিষ্যতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই ভূমিকা পালনের সুযোগ নাও থাকতে পারে। বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো দেশের পক্ষেই বিশ্বরাজনীতির বাইরে থেকে তার সুবিধা নেওয়া সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে গত বছরগুলোতে, বিশেষত আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত কয়েক মাসে সরকারের ভূমিকার কারণে আন্তর্জাতিক সমাজের সঙ্গে যে ধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, তা দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নতুন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার উদ্ভব হচ্ছে। সেটি আফগানিস্তান থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতির অবসান ও সেখানকার নির্বাচন যেমন একটি দিক, ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা বদলের সম্ভাবনা, মিয়ানমারের নতুন গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সুযোগ তেমনি আরেকটি দিক। এই অঞ্চলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর নতুন বিন্যাস হচ্ছে। এসব ঘটনার যে অভিঘাত তৈরি হবে, বাংলাদেশ তাতে তার নিজস্ব অবস্থান নিয়ে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না, সেটা অনেকাংশেই নির্ভর করবে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ওপরে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ইতিমধ্যেই অর্থনীতি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে দেশের প্রধান রপ্তানিনির্ভর উৎপাদনশীল খাতই সবচেয়ে আগে ক্ষতির মুখোমুখি হবে।
এই যে নতুন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের স্বার্থে বাংলাদেশকেই প্রতিনিধিত্ব করতে হবে, বাংলাদেশ যদি অন্য কোনো একক দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাতে তার নিজস্ব স্বার্থেরই কেবল ক্ষতি হবে তা নয়, আঞ্চলিক ক্ষমতা ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। বহুজাতিক আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে অস্বস্তিকর সম্পর্ক তৈরি করে বাংলাদেশ তার নিজের স্বার্থানুকূল ভূমিকা নিতে পারবে—এটা মনে করার কারণ নেই।
আন্তর্জাতিক সমাজের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের একটা প্রশ্ন উঠবে আসন্ন নির্বাচনের পরেই; সে কারণে এই প্রশ্নের উত্তরের ওপরে নির্ভর করবে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রূপ কী দাঁড়াবে।
l আলী রীয়াজ: অধ্যাপক, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
গণতন্ত্র, শাসনব্যবস্থা, সামাজিক বৈষম্য, জবাবদিহি, দুর্নীতি, রাজনীতি ও ধর্মের সম্পর্ক, যুদ্ধাপরাধের মতো জাতির অসমাপ্ত দায় বিষয়ে বিভিন্ন চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আদর্শিক অবস্থান বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ছিল। গত ৪২ বছরে অন্যান্য ইস্যুকে কেন্দ্র করে এগুলোর কোনো কোনোটি কখনো কখনো সামনে এসেছে, কিন্তু এর অনেকগুলো একার্থে অমীমাংসিত বিষয় হিসেবেই থেকে গেছে। যেকোনো সময়ে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় কিছু বিষয় অমীমাংসিত থাকা কোনো ব্যতিক্রম নয়। কোনো জাতি ও জাতিরাষ্ট্র যত পরিপক্ব হয়ে ওঠে, সেই রাষ্ট্র ও তার নাগরিকেরা একাদিক্রমে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর মোকাবিলা করে; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু বিষয় প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে, কিছু বিষয় আরও বেশি জরুরি হয়ে ওঠে।
গত বছরে আমরা একই সময়ে এই বিষয়গুলো রাজনীতির কেন্দ্রে এসে হাজির হতে দেখেছি। অবশ্যই বিষয়গুলো পরস্পরবিরোধী নয়, গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাবান মানুষ সুশাসন ও সামাজিক বৈষম্যের অবসানের দাবি করতেই পারে। রাজনীতি ও ধর্মের সম্পর্কের প্রশ্নে গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন দুজন নাগরিকের ভিন্নমত থাকা অসম্ভব নয়। একইভাবে কোনো এক বিষয়ে কোনো নাগরিকের অবস্থান অন্য বিষয়ে তার কী অবস্থান হবে, তা নির্ধারণ করে না। ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের জবাবদিহির দাবি তোলার মানে এটা নয় যে ওই নাগরিক অন্য প্রশ্নে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থার সমর্থক হতে পারবে না। বিরোধী দলের দায়িত্বজ্ঞানহীন, আশু স্বার্থপ্রণোদিত আচরণের বিরোধিতা করা মাত্রই তাকে ক্ষমতাসীনদের অনুচর বলার সংস্কৃতি অগ্রহণযোগ্য। জবাবদিহি বা গণতন্ত্রের প্রশ্ন কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে নাকচ করে দেয় না; এই দুটি পরস্পরবিরোধী নয়। দুজন নাগরিকের ভেতরে একটি বিষয়ে মতৈক্য মানে সব বিষয়ে তাদের মতৈক্য হবেই—এমন আশা করা অসমীচীন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘শত্রু’ বলে গণ্য করা, তার ন্যূনতম নাগরিক অধিকার হরণ করা এবং সহিংসভাবে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক শক্তিরা নিজেদের জন্যই কেবল বিপদ ডেকে আনে তা নয়, তারা গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয়কেই অস্বীকার করে, সমাজে অসহিষ্ণু সংস্কৃতি তৈরি করে, যার পরিণাম তাদেরও ভোগ করতে হয় আজ অথবা আগামীকাল।
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অগ্রাধিকার তৈরিতে নিঃসন্দেহে ভিন্ন মত থাকবে। কিন্তু গত বছরে দেশের রাজনীতি ও সমাজে অগ্রাধিকারের প্রশ্নে অন্যের ওপরে নিজের পছন্দ চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এটি গণতান্ত্রিক সমাজের লক্ষণ নয়। এই অবস্থা কেবল তাঁরাই পছন্দ করবেন, যাঁরা গণতন্ত্রের যে সামান্য অবশেষ এখনো বাংলাদেশে বিরাজমান, তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে একধরনের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুকূল সামাজিক ও মানসিক পরিস্থিতি তৈরি করতে চান। বল প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন ও সন্ত্রাসী আচরণের মাধ্যমে, দাবি আদায়ের নামে, সাংবিধানিক ধারা চালু রাখার অজুহাতে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার বাতাবরণ তৈরি করে, ধর্মকে আশ্রয় করে কিংবা অন্য যেকোনো আদর্শের নামেই তা করা হোক না কেন, তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে এক অন্ধকার পথে চালিত করবে। অনুমান করতে পারি যে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা যতই অপসৃত হবে, এই প্রবণতা তত বেশি শক্তিশালী হবে। বছরের গোড়াতেই অনুষ্ঠেয় একতরফা নির্বাচন এবং তা প্রতিরোধে বিরোধীদের সহিংস আচরণ গণতন্ত্রের উল্টো পথেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে। বছরের শুরুটা এভাবেই হবে বলে আমরা জানি এবং তা আগামী দিনগুলোকে আরও কঠিন করে তুলবে। বাংলাদেশ গণতন্ত্রের উল্টো পথে এগোবে কি না, তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ২০১৪ সাল গুরুত্বপূর্ণ বলেই আমার অনুমান। বাংলাদেশ কোন পথে এগোবে, তা নিয়তি-নির্ধারিত নয়, রাজনীতিতে কোনো পথই অনিবার্য নয়। রাজনৈতিক নেতারা ও নাগরিকেরাই এই পথ নির্ধারণ করবেন। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের দায়িত্ব অন্যদের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের নাগরিকেরা অতীতে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে আপসহীন থেকেছে, ২০১৪ সাল তার ব্যতিক্রম হবে না বলেই আমার ধারণা।
দুই
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২০১৩ সালে একধরনের মেরুকরণের সূচনা হয়েছে। প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরে গড়ে ওঠা দুই কেন্দ্রের বাইরে যেসব দল ছিল, তাদের এক বড় অংশই এখন এই দুই কেন্দ্রমুখী হয়ে পড়েছে। বিএনপি ২০০১ সালের আগেই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যে চারদলীয় জোট গড়ে তুলেছে, তারই পরিবর্ধিত রূপ আমরা দেখতে পাই ১৮-দলীয় জোট হিসেবে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ২০০৬ সালে যে মহাজোট গড়ে তোলে, তার অনেক দল যেমন তা থেকে সরে গেছে, তেমনি অন্যদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে এবং জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে চাপের মুখে তাদের শরিক করে রেখেছে। এই ঐক্যে যেসব দল শরিক হয়েছে, তারা অচিরেই ভিন্ন অবস্থান নিতে সক্ষম হবে না। কিন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দল যে ধরনের আচরণ করেছে, মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের সম্পদের যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তা ক্ষমতাসীন দল ও জোটের জন্য ভবিষ্যতেও স্বস্তির বিষয় হবে না। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট গঠন ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে যতটুকু সুবিধা প্রদান করেছিল ২০০১-২০০৬ সালের সরকারে থাকা অবস্থায় এবং গত কয়েক বছরে তার চেয়ে বেশি মাশুল গুনতে হয়েছে দলটিকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে জামায়াতের অব্যাহত সন্ত্রাসী তৎপরতা দেশের জন্য এক বিরাট হুমকি সৃষ্টি করেছে। জামায়াতের এসব আচরণ বিএনপির রাজনৈতিক দাবিকে গত বছরে পেছনে ফেলে দিয়েছে। অন্যদিকে, বিএনপি জামায়াত-নির্ভর হয়ে পড়েছে। জামায়াতে ইসলামী সাংগঠনিকভাবেই ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত এবং গত ৪২ বছরে তাদের ভূমিকার জন্য কখনোই ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দলের নেতাদের বিচার ও শাস্তি দলটিকে দেশের এক বড় অংশের কাছে অগ্রহণযোগ্য করে ফেলেছে।
এই প্রশ্ন বিএনপি কীভাবে তা মোকাবিলা করবে, সেটা ২০১৩ সালে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই বছরে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়বে। এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বিএনপি তার অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশের অপেক্ষা করবে, নাকি ঝুঁকি নিয়ে হলেও একটি পদক্ষেপ নেবে তার ওপর কেবল দলের নয়, দেশের সাংবিধানিক নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ অংশত নির্ভরশীল। দায়িত্বশীল বিরোধী দল হিসেবে আচরণে বিএনপির ব্যত্যয় হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল যদি দেশে নিয়মতান্ত্রিক সাংবিধানিক রাজনীতির ধারাকে অব্যাহত রাখতে চায়, তবে কেবল কথায় নয়, কাজেও তা প্রমাণ করতে হবে। সহিংসতা মোকাবিলা করে নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়া যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তেমনি নাগরিকের ভিন্ন মত প্রকাশ এবং তার পক্ষে সংবিধান প্রদত্ত গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের কর্তব্য। এর অন্যথা হলে অসাংবিধানিক শক্তিই কেবল লাভবান হবে। তার পরিণতির জন্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না; ২০১৪ সালেই আমরা তার বিবিধ পরিণতি দেখতে পাব বলে আমার আশঙ্কা। মেরুকরণের এই প্রক্রিয়ায় দুই কেন্দ্রের বাইরে যেসব দল রয়েছে, তাদের ভূমিকা মোটেই অকিঞ্চিৎকর নয়; তারা কী ভূমিকা নেয়, সেটাও লক্ষণীয়।
তিন
ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের কারণে বৈশ্বিক পরিসরে বাংলাদেশের ভূমিকা রাখার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সেই বিবেচনায় ২০১৪ সাল আলাদা গুরুত্ব বহন করে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি পরিবর্তনশীল, ফলে আজকে একটি দেশ যে গুরুত্ব বহন করে, তা ভবিষ্যতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই ভূমিকা পালনের সুযোগ নাও থাকতে পারে। বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো দেশের পক্ষেই বিশ্বরাজনীতির বাইরে থেকে তার সুবিধা নেওয়া সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে গত বছরগুলোতে, বিশেষত আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত কয়েক মাসে সরকারের ভূমিকার কারণে আন্তর্জাতিক সমাজের সঙ্গে যে ধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, তা দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নতুন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার উদ্ভব হচ্ছে। সেটি আফগানিস্তান থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতির অবসান ও সেখানকার নির্বাচন যেমন একটি দিক, ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা বদলের সম্ভাবনা, মিয়ানমারের নতুন গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সুযোগ তেমনি আরেকটি দিক। এই অঞ্চলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর নতুন বিন্যাস হচ্ছে। এসব ঘটনার যে অভিঘাত তৈরি হবে, বাংলাদেশ তাতে তার নিজস্ব অবস্থান নিয়ে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না, সেটা অনেকাংশেই নির্ভর করবে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ওপরে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ইতিমধ্যেই অর্থনীতি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে দেশের প্রধান রপ্তানিনির্ভর উৎপাদনশীল খাতই সবচেয়ে আগে ক্ষতির মুখোমুখি হবে।
এই যে নতুন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের স্বার্থে বাংলাদেশকেই প্রতিনিধিত্ব করতে হবে, বাংলাদেশ যদি অন্য কোনো একক দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাতে তার নিজস্ব স্বার্থেরই কেবল ক্ষতি হবে তা নয়, আঞ্চলিক ক্ষমতা ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। বহুজাতিক আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে অস্বস্তিকর সম্পর্ক তৈরি করে বাংলাদেশ তার নিজের স্বার্থানুকূল ভূমিকা নিতে পারবে—এটা মনে করার কারণ নেই।
আন্তর্জাতিক সমাজের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের একটা প্রশ্ন উঠবে আসন্ন নির্বাচনের পরেই; সে কারণে এই প্রশ্নের উত্তরের ওপরে নির্ভর করবে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রূপ কী দাঁড়াবে।
l আলী রীয়াজ: অধ্যাপক, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
No comments