নতুন বছর হোক জাতীয় ঐকমত্যের by ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
(নতুন বছরের প্রত্যাশা)
সদ্য গত হওয়া বছরের শেষ দিকে এসে যদি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক
সংকট সৃষ্টি না হতো, তাহলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতের অনেক বড় বড় আশাবাদ
নিয়ে আমরা নতুন বছর শুরু করতে পারতাম। কারণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও
প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ সামাজিক ও
অর্থনৈতিক খাতে প্রভূত উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করেছে। বিশেষত, গত কয়েক বছর
ধরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা সূচকে আমাদের দেশ যে সাফল্য দেখিয়েছে, তা
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসা অর্জন করেছে। আমরা দেখছি, বিশ্ব পরিমণ্ডলে
নেতিবাচক পরিস্থিতি সত্ত্বেও গত ৫ বছর বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে
বছরে ৬ শতাংশের ওপর থেকেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে রফতানি ও রেমিট্যান্স।
বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল সম্প্রতি অভূতপূর্ব ১৮০০ কোটি ডলার অতিক্রম করেছে।
গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়েছে, কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে
উল্লেখযোগ্যভাবে। আমরা এখন স্বল্পোন্নত দেশের গণ্ডি অতিক্রম করার প্রায়
দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে এমন অর্জন সহজ ছিল
না। অবশ্যই সরকারের অবদান গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে নীতিকাঠামো ও আবহ
তৈরিতে। তবে কৃষক-কৃষি শ্রমিক-শিল্প শ্রমিকসহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এটা
সম্ভব হয়েছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে কয়েক মাস ধরে অর্থনীতি ও সামাজিক খাতের অগ্রগতির এই ধারাবাহিকতা থমকে গেছে। রাজনৈতিক সংকটের মাশুল দিতে গিয়ে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তা। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পেঁৗছেছে যে যদি আমরা এই সংকট থেকে দ্রুত উত্তরণ ঘটাতে না পারি, তাহলে অগ্রগতি শুধু থমকে থাকবে না, অধোগতি শুরু হতে পারে। আর সেই নাজুক অবস্থা থেকে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার যে কঠিন হয়ে পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক ডামাডোলে শঙ্কিত নাগরিকরা স্বাভাবিক চলাচল ও কাজকর্ম করতে পারছেন না এবং হরতাল, অবরোধ ও সন্ত্রাসের কারণে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
সংবাদমাধ্যমে যদিও প্রায় প্রতিদিনই এসব বিষয়ে সংবাদ, প্রকৃত চিত্র তাতে পুরোপুরি ফুটে উঠেছে না বলে আমার ধারণা। দেখা যাচ্ছে, পরিবহন সংকটের কারণে অনেক এলাকায় কৃষক ফসল তুলতে পেরেছেন বটে, বাজারে নিতে পারছেন না। মৌসুমে স্বাভাবিক বাজারদর এমনিতেই কম থাকে। এখন তা আরও পড়ে গেছে। সারের পরিবহনও সম্ভব হচ্ছে না। গুদামে গুদামে সার আটকে আছে। একটি সংবাদপত্রে দেখলাম উত্তরাঞ্চলের বাফার স্টক বাঘাবাড়ী ঘাটে খোলা আকাশের নিচে পড়ে রয়েছে সারের স্তূপ। এ বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে যে, রাজনৈতিক সংকট ও উদ্ভূত ধ্বংসলীলার কারণে কৃষক এই মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত তো হচ্ছেনই, আগামী মৌসুমের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রাপ্তিও সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে। গোটা কৃষি অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য।
আবার কৃষি কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কারণে কৃষি মজুররা সবচেয়ে কঠিন অবস্থা পার করছেন। উল্লেখযোগ্যভাবে কৃষি মজুরি বাড়ায় তাদের জীবনমানে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছিল। এই সংকটের কারণে অনেকে হয়তো আবার চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন। কারণ তারা প্রতিদিন কাজ করে যে মজুরি পান, তা দিয়ে সংসার চালান। আর কোনো কাজ তারা জানেন না; ফলে কৃষিকাজ ব্যাহত হওয়ায় তারা কাজ পাচ্ছেন না। এমন পুঁজিও নেই যে ছোটখাটো ব্যবসা করবেন। অন্যদিকে কৃষিপণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় সারাদেশেই বাড়ছে খাদ্যদ্রব্যের দাম। এমনিতে খেটে খাওয়া মানুষের জীবিকা সংকটে, তদুপরি খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তি। সব মিলিয়ে সাধারণ কৃষি ও শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অথচ তারাই আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। তারাই এই প্রজাতন্ত্রের মালিক, ভোটের মালিক। তাদের কথা ভাবাই হচ্ছে না।
দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছর ধরে আমরা খুবই আশাবাদী ছিলাম। বিশেষত বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রুত দারিদ্র্য নিরসন ও সামাজিক বৈষম্য কমিয়ে আনার প্রতি নজর দিয়েছিল। অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী যাতে আরও প্রান্তিক হয়ে না পড়ে, সেজন্য বেশ কিছু সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীমূলক কর্মসূচি দেশজুড়েই জোরদার করা হয়। ফলে রংপুর অঞ্চল থেকে মঙ্গার মতো মৌসুমি আকাল দূর করা সম্ভব হয়েছে। এখন অবস্থার অবনতি ঘটার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমরা যদি তাদের জন্য আর অকৃষি খাতে, যা বিকশিত হচ্ছিল, ক্রমবর্ধমান কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারি, যদি স্থিতিশীলতা দিতে না পারি, তাহলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার কাজ অনেকদূর পিছিয়ে যাবে বলে আমি শঙ্কিত। কৃষি মজুরদের কথা বললাম। শহুরে ভোক্তারা, বিশেষ করে স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা কি ভালো আছেন? পরিবহন ব্যবস্থা বিঘি্নত হওয়ায় তাদের বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। শহরে যারা দৈনন্দিন আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন, হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচির কারণে তারা মৌসুমি বেকারে পরিণত হয়েছেন।
পাশাপাশি রফতানি পরিবহনও ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে ধস নামার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আগামী দিনের জন্য রফতানি অর্ডারও কমে যেতে পারে স্বাভাবিকভাবেই এবং তা ঘটতে শুরু করেছে। নাশকতামূলক ও সহিংস রাজনীতির প্রভাব পড়ছে কৃষি খাতের মতো বর্তমান ও ভবিষ্যতের রফতানি বাণিজ্যেও। একই কারণে বিনিয়োগও কমে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব হতে পারে আরও সুদূরপ্রসারী। এমন অনেক বিনিয়োগ প্রস্তাব বা রফতানি অর্ডার আছে, যেগুলোর ক্ষেত্রে এখন ব্যবস্থা গ্রহণ না করা গেলে সেগুলো ভবিষ্যতে আর পাওয়া যাবে না। অন্য দেশ বা অঞ্চলে তা চলে যাবে। ধ্বংসাত্মক রাজনীতির কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অর্থনৈতিক সুযোগ আমরা হারাতে বসেছি।
পুরনো বছরের শেষ দিকের নেতিবাচক পরিস্থিতি সত্ত্বেও নতুন বছরের শুরুতে আমি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে চাই যে, রাজনৈতিক সংঘাত যত দ্রুত সমাধান হয়, ততই মঙ্গল। তা না হলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার গুরুতরভাবে সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। আমি ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলীয় সব রাজনৈতিক দলকেই বলতে চাই, দেশের অর্থনীতির কথা ভেবে, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কথা ভেবে তারা যেন একটা সমাধানে পেঁৗছান। আর এজন্য সংলাপ ও সমঝোতার বিকল্পও নেই। আমি আশা করি, নতুন বছরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন বোধোদয় ঘটবে।
বিশেষ করে বিরোধী দলকে মনে রাখতে হবে, তারা যেসব রাজনৈতিক কর্মসূচি দিচ্ছে, তা যে কেবল অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য আত্মঘাতী এমন নয়, জনসাধারণের কাছে এর আকর্ষণও দ্রুত কমে যাচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা ভেবে হলেও সংলাপ ও সমঝোতার প্রতি মনোযোগী হতে হবে বিরোধী দলকে। অবশ্যই ক্ষমতাসীন দলকেও আরও উদারতা ও সহনশীলতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর ঐকমত্য ও সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে একাদশ সংসদ নির্বাচনের যে কথা এখন বলা হচ্ছে তা বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সহায়ক হবে বলে আমার মনে হয়।
তবে রাজনৈতিক সমঝোতা এমন হতে হবে যেন নাশকতাকারী ও সন্ত্রাসীদের কোনো দল প্রশ্রয় না দেয়। আমরা দেখছি, দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবরোধের নামে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। যানবাহনেও নির্বিচারে অগি্নসংযোগ বা পেট্রোল বোমা মারা হচ্ছে। রেলপথ ধরে নানা ধরনের নাশকতা দেখছি আমরা। সমঝোতা যদি দেশের মানুষের কল্যাণে এবং রাজনৈতিক দলগুলোরও ভবিষ্যৎ স্বার্থে ফলপ্রসূ করতে হয়, তাহলে এসব সন্ত্রাস ও সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে। এসব সন্ত্রাসের সঙ্গে যারা সরাসরি যুক্ত, তাদের প্রকাশ্যে বা নেপথ্যে যু্ক্ত রেখে সমঝোতা গ্রহণযোগ্য নয়। আশার কথা হচ্ছে, প্রধান বিরোধী দলও বলেছে, এই সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে এদের প্রশ্রয় না দেওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা কঠিন হওয়ার কথা নয়। ইতিমধ্যে সহিংসতায় আমরা অনেক প্রাণ হারিয়ে ফেলেছি। এর জন্য যারা সরাসরি দায়ী তাদেরও বিচারের কাঠগড়ায় আনতে হবে। জানমাল ধ্বংসের জন্য যারা দায়ী তাদের ক্ষমা না করার ব্যাপারে যদি ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের ঐকমত্য না হয়, তাহলে এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম ভবিষ্যতেও চলতে থাকবে।
বস্তুতপক্ষে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়, এসব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের প্রধান উদ্দেশ্য আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর লক্ষ্যে। ফলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে স্বাভাবিক রাজনীতির স্বার্থেই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সমঝোতায় গিয়ে এই সন্ত্রাসীদের দমন একসঙ্গে করে রাজনৈতিক সুষ্ঠু পথ প্রসন্ন করতে হবে। আর ভবিষ্যতে সুস্থ রাজনীতির বাংলাদেশ দেখতে চাইলে যুদ্ধাপরাধের বিচার তো শেষ করতেই হবে। সূচনালগ্নের এত বড় ক্ষত ও কলঙ্ক এড়িয়ে আমরা সামনের দিকে এগোতে পারব না। ইতিমধ্যে একজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। অন্যগুলোও যথাযথভাবে দ্রুত সম্পন্ন হবে বলে আমি আশা করি। নতুন বছরে আমরা আশা করতে পারি, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডকে না বলার ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
আমরা বিশ্বের অনেক দেশের দিকে লক্ষ্য করলে দেখব, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শ, দর্শন ও কর্মপদ্ধতি, উন্নয়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিপুল ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে একত্রে কাজ করতে সমস্যা হয় না। রাজনৈতিক প্রশ্নে বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোও জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে কীভাবে একত্র হতে পারে, তার নজির সম্প্রতি আমরা ভারতে দেখেছি। দেশের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হলে এ ধরনের নজির আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকেও সৃষ্টি করতে হবে।
দুর্নীতি দমনের প্রশ্নেও দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য দেখতে চাই। ব্যাপক দুর্নীতির কারণে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় আর বিবেচনাতেই আসতে পারে না। বিভিন্ন দলের কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ সাধারণ মানুষের একটি ব্যাপক অংশ বিশ্বাস করে। দুই দল যদি সমঝোতায় বসে এবং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেওয়ার প্রকাশ্য ঐকমত্য ঘোষণা করে, তাহলে দুই দলই রাজনীতিতে লাভবান হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
মনে রাখতে হবে, আমরা বিশ্বায়নের যুগে বাস করছি। গোটা বিশ্বে রাজনীতিকরা কীভাবে কাজ করেন, জাতীয় প্রশ্নে কীভাবে একমত হন, সাধারণ মানুষ এখন জানে। ফলে পুরনো দিনের বিভেদমূলক রাজনীতি আর চলবে না। জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখতে যদি একত্রে কাজ করতে না পারি, তাহলে দেশে ও বিদেশে আমরা ক্রমেই মর্যাদাহীন জাতিতে পরিণত হওয়ার দিকে যাব। অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রশ্নে আমরা যদি একমত হতে না পারি, তাহলে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এবং মধ্যম আয়ের ও এক পর্যায়ে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ভেস্তে যাবে।
দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বিষয়গুলো আমাদের চেয়ে ভালো বোঝেন বলে আমি বিশ্বাস করি। এই বিশ্বাসেরই বাস্তবায়ন দেখতে চাই নতুন বছরে। বিভেদের পুরনো বছর পার হয়ে নতুন বছর হোক জনকল্যাণে, জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখতে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করতে এবং সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমনে জাতীয় ঐকমত্যের।
অর্থনীতিবিদ; পিকেএসএফের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান
দুর্ভাগ্যজনকভাবে কয়েক মাস ধরে অর্থনীতি ও সামাজিক খাতের অগ্রগতির এই ধারাবাহিকতা থমকে গেছে। রাজনৈতিক সংকটের মাশুল দিতে গিয়ে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তা। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পেঁৗছেছে যে যদি আমরা এই সংকট থেকে দ্রুত উত্তরণ ঘটাতে না পারি, তাহলে অগ্রগতি শুধু থমকে থাকবে না, অধোগতি শুরু হতে পারে। আর সেই নাজুক অবস্থা থেকে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার যে কঠিন হয়ে পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক ডামাডোলে শঙ্কিত নাগরিকরা স্বাভাবিক চলাচল ও কাজকর্ম করতে পারছেন না এবং হরতাল, অবরোধ ও সন্ত্রাসের কারণে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
সংবাদমাধ্যমে যদিও প্রায় প্রতিদিনই এসব বিষয়ে সংবাদ, প্রকৃত চিত্র তাতে পুরোপুরি ফুটে উঠেছে না বলে আমার ধারণা। দেখা যাচ্ছে, পরিবহন সংকটের কারণে অনেক এলাকায় কৃষক ফসল তুলতে পেরেছেন বটে, বাজারে নিতে পারছেন না। মৌসুমে স্বাভাবিক বাজারদর এমনিতেই কম থাকে। এখন তা আরও পড়ে গেছে। সারের পরিবহনও সম্ভব হচ্ছে না। গুদামে গুদামে সার আটকে আছে। একটি সংবাদপত্রে দেখলাম উত্তরাঞ্চলের বাফার স্টক বাঘাবাড়ী ঘাটে খোলা আকাশের নিচে পড়ে রয়েছে সারের স্তূপ। এ বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে যে, রাজনৈতিক সংকট ও উদ্ভূত ধ্বংসলীলার কারণে কৃষক এই মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত তো হচ্ছেনই, আগামী মৌসুমের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রাপ্তিও সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে। গোটা কৃষি অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য।
আবার কৃষি কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কারণে কৃষি মজুররা সবচেয়ে কঠিন অবস্থা পার করছেন। উল্লেখযোগ্যভাবে কৃষি মজুরি বাড়ায় তাদের জীবনমানে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছিল। এই সংকটের কারণে অনেকে হয়তো আবার চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন। কারণ তারা প্রতিদিন কাজ করে যে মজুরি পান, তা দিয়ে সংসার চালান। আর কোনো কাজ তারা জানেন না; ফলে কৃষিকাজ ব্যাহত হওয়ায় তারা কাজ পাচ্ছেন না। এমন পুঁজিও নেই যে ছোটখাটো ব্যবসা করবেন। অন্যদিকে কৃষিপণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় সারাদেশেই বাড়ছে খাদ্যদ্রব্যের দাম। এমনিতে খেটে খাওয়া মানুষের জীবিকা সংকটে, তদুপরি খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তি। সব মিলিয়ে সাধারণ কৃষি ও শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অথচ তারাই আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। তারাই এই প্রজাতন্ত্রের মালিক, ভোটের মালিক। তাদের কথা ভাবাই হচ্ছে না।
দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছর ধরে আমরা খুবই আশাবাদী ছিলাম। বিশেষত বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রুত দারিদ্র্য নিরসন ও সামাজিক বৈষম্য কমিয়ে আনার প্রতি নজর দিয়েছিল। অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী যাতে আরও প্রান্তিক হয়ে না পড়ে, সেজন্য বেশ কিছু সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীমূলক কর্মসূচি দেশজুড়েই জোরদার করা হয়। ফলে রংপুর অঞ্চল থেকে মঙ্গার মতো মৌসুমি আকাল দূর করা সম্ভব হয়েছে। এখন অবস্থার অবনতি ঘটার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমরা যদি তাদের জন্য আর অকৃষি খাতে, যা বিকশিত হচ্ছিল, ক্রমবর্ধমান কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারি, যদি স্থিতিশীলতা দিতে না পারি, তাহলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার কাজ অনেকদূর পিছিয়ে যাবে বলে আমি শঙ্কিত। কৃষি মজুরদের কথা বললাম। শহুরে ভোক্তারা, বিশেষ করে স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা কি ভালো আছেন? পরিবহন ব্যবস্থা বিঘি্নত হওয়ায় তাদের বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। শহরে যারা দৈনন্দিন আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন, হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচির কারণে তারা মৌসুমি বেকারে পরিণত হয়েছেন।
পাশাপাশি রফতানি পরিবহনও ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে ধস নামার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আগামী দিনের জন্য রফতানি অর্ডারও কমে যেতে পারে স্বাভাবিকভাবেই এবং তা ঘটতে শুরু করেছে। নাশকতামূলক ও সহিংস রাজনীতির প্রভাব পড়ছে কৃষি খাতের মতো বর্তমান ও ভবিষ্যতের রফতানি বাণিজ্যেও। একই কারণে বিনিয়োগও কমে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব হতে পারে আরও সুদূরপ্রসারী। এমন অনেক বিনিয়োগ প্রস্তাব বা রফতানি অর্ডার আছে, যেগুলোর ক্ষেত্রে এখন ব্যবস্থা গ্রহণ না করা গেলে সেগুলো ভবিষ্যতে আর পাওয়া যাবে না। অন্য দেশ বা অঞ্চলে তা চলে যাবে। ধ্বংসাত্মক রাজনীতির কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অর্থনৈতিক সুযোগ আমরা হারাতে বসেছি।
পুরনো বছরের শেষ দিকের নেতিবাচক পরিস্থিতি সত্ত্বেও নতুন বছরের শুরুতে আমি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে চাই যে, রাজনৈতিক সংঘাত যত দ্রুত সমাধান হয়, ততই মঙ্গল। তা না হলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার গুরুতরভাবে সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। আমি ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলীয় সব রাজনৈতিক দলকেই বলতে চাই, দেশের অর্থনীতির কথা ভেবে, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কথা ভেবে তারা যেন একটা সমাধানে পেঁৗছান। আর এজন্য সংলাপ ও সমঝোতার বিকল্পও নেই। আমি আশা করি, নতুন বছরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন বোধোদয় ঘটবে।
বিশেষ করে বিরোধী দলকে মনে রাখতে হবে, তারা যেসব রাজনৈতিক কর্মসূচি দিচ্ছে, তা যে কেবল অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য আত্মঘাতী এমন নয়, জনসাধারণের কাছে এর আকর্ষণও দ্রুত কমে যাচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা ভেবে হলেও সংলাপ ও সমঝোতার প্রতি মনোযোগী হতে হবে বিরোধী দলকে। অবশ্যই ক্ষমতাসীন দলকেও আরও উদারতা ও সহনশীলতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর ঐকমত্য ও সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে একাদশ সংসদ নির্বাচনের যে কথা এখন বলা হচ্ছে তা বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সহায়ক হবে বলে আমার মনে হয়।
তবে রাজনৈতিক সমঝোতা এমন হতে হবে যেন নাশকতাকারী ও সন্ত্রাসীদের কোনো দল প্রশ্রয় না দেয়। আমরা দেখছি, দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবরোধের নামে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। যানবাহনেও নির্বিচারে অগি্নসংযোগ বা পেট্রোল বোমা মারা হচ্ছে। রেলপথ ধরে নানা ধরনের নাশকতা দেখছি আমরা। সমঝোতা যদি দেশের মানুষের কল্যাণে এবং রাজনৈতিক দলগুলোরও ভবিষ্যৎ স্বার্থে ফলপ্রসূ করতে হয়, তাহলে এসব সন্ত্রাস ও সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে। এসব সন্ত্রাসের সঙ্গে যারা সরাসরি যুক্ত, তাদের প্রকাশ্যে বা নেপথ্যে যু্ক্ত রেখে সমঝোতা গ্রহণযোগ্য নয়। আশার কথা হচ্ছে, প্রধান বিরোধী দলও বলেছে, এই সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে এদের প্রশ্রয় না দেওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা কঠিন হওয়ার কথা নয়। ইতিমধ্যে সহিংসতায় আমরা অনেক প্রাণ হারিয়ে ফেলেছি। এর জন্য যারা সরাসরি দায়ী তাদেরও বিচারের কাঠগড়ায় আনতে হবে। জানমাল ধ্বংসের জন্য যারা দায়ী তাদের ক্ষমা না করার ব্যাপারে যদি ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের ঐকমত্য না হয়, তাহলে এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম ভবিষ্যতেও চলতে থাকবে।
বস্তুতপক্ষে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়, এসব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের প্রধান উদ্দেশ্য আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর লক্ষ্যে। ফলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে স্বাভাবিক রাজনীতির স্বার্থেই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সমঝোতায় গিয়ে এই সন্ত্রাসীদের দমন একসঙ্গে করে রাজনৈতিক সুষ্ঠু পথ প্রসন্ন করতে হবে। আর ভবিষ্যতে সুস্থ রাজনীতির বাংলাদেশ দেখতে চাইলে যুদ্ধাপরাধের বিচার তো শেষ করতেই হবে। সূচনালগ্নের এত বড় ক্ষত ও কলঙ্ক এড়িয়ে আমরা সামনের দিকে এগোতে পারব না। ইতিমধ্যে একজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। অন্যগুলোও যথাযথভাবে দ্রুত সম্পন্ন হবে বলে আমি আশা করি। নতুন বছরে আমরা আশা করতে পারি, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডকে না বলার ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
আমরা বিশ্বের অনেক দেশের দিকে লক্ষ্য করলে দেখব, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শ, দর্শন ও কর্মপদ্ধতি, উন্নয়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিপুল ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে একত্রে কাজ করতে সমস্যা হয় না। রাজনৈতিক প্রশ্নে বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোও জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে কীভাবে একত্র হতে পারে, তার নজির সম্প্রতি আমরা ভারতে দেখেছি। দেশের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হলে এ ধরনের নজির আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকেও সৃষ্টি করতে হবে।
দুর্নীতি দমনের প্রশ্নেও দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য দেখতে চাই। ব্যাপক দুর্নীতির কারণে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় আর বিবেচনাতেই আসতে পারে না। বিভিন্ন দলের কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ সাধারণ মানুষের একটি ব্যাপক অংশ বিশ্বাস করে। দুই দল যদি সমঝোতায় বসে এবং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেওয়ার প্রকাশ্য ঐকমত্য ঘোষণা করে, তাহলে দুই দলই রাজনীতিতে লাভবান হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
মনে রাখতে হবে, আমরা বিশ্বায়নের যুগে বাস করছি। গোটা বিশ্বে রাজনীতিকরা কীভাবে কাজ করেন, জাতীয় প্রশ্নে কীভাবে একমত হন, সাধারণ মানুষ এখন জানে। ফলে পুরনো দিনের বিভেদমূলক রাজনীতি আর চলবে না। জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখতে যদি একত্রে কাজ করতে না পারি, তাহলে দেশে ও বিদেশে আমরা ক্রমেই মর্যাদাহীন জাতিতে পরিণত হওয়ার দিকে যাব। অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রশ্নে আমরা যদি একমত হতে না পারি, তাহলে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এবং মধ্যম আয়ের ও এক পর্যায়ে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ভেস্তে যাবে।
দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বিষয়গুলো আমাদের চেয়ে ভালো বোঝেন বলে আমি বিশ্বাস করি। এই বিশ্বাসেরই বাস্তবায়ন দেখতে চাই নতুন বছরে। বিভেদের পুরনো বছর পার হয়ে নতুন বছর হোক জনকল্যাণে, জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখতে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করতে এবং সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমনে জাতীয় ঐকমত্যের।
অর্থনীতিবিদ; পিকেএসএফের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান
No comments