কূটনীতি- বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ by ড্যান মজীনা
অনেকে ইতিমধ্যে জানেন, আমার কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক গভীর। আমি বাংলাদেশি মানুষের দ্বারা অত্যন্ত অনুপ্রাণিত এবং এ দেশের এশিয়ার ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক টাইগার হয়ে ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনার প্রতি আমার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য আমার প্রগাঢ় শ্রদ্ধার তাড়নায় আমি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার মতামত প্রকাশ করছি। বাংলাদেশের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ থেকেই আমি বাংলাদেশের মানুষের জন্য যথোপযোগী সমাধান খোঁজার জন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচেষ্টা কেন দ্বিগুণ ত্বরান্বিত করতে হবে, সে বিষয়ে আমার মতামত তুলে ধরছি।
আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের প্রতি দৃঢ়ভাবে নিবেদিত। তারা এমন একটি নির্বাচন চায়, তাদের এমন একটি নির্বাচন প্রয়োজন যা অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে। সুতরাং, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এ রকম একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এখনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি বলে আমি নিরাশ হয়েছি।
এ কথাগুলো যখন লিখছি, তখন আমি টেলিভিশনে এই সুন্দর দেশের রাস্তাঘাট ও গ্রামেগঞ্জে চলমান সহিংসতার জন্য বাংলাদেশি মানুষের হতাশা ও ভয়ভীতিও লক্ষ করছি। চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা জাতির অবকাঠামোর ওপর ভয়ংকর প্রভাব ফেলেছে। মানবাধিকার ও অন্যান্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় চার শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। অসংখ্য মানুষ গুরুতর আহত কিংবা অনেক ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে জখম হয়েছে। জীবনযাত্রা ও ঘরবাড়ির ধ্বংসের ঘটনা দেশের প্রতিটি অংশে দেখা গিয়েছে। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলো অতিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সমাজ এক বাস্তব আতঙ্কে তটস্থ—ইচ্ছাকৃত বা অন্য কোনোভাবে হোক, কে হবে সহিংসতার পরবর্তী শিকার, এই প্রশ্নই এখন সবার মনে।
এমন অবস্থায় রবিঠাকুরের ও আমাদের সবার স্বপ্নের সোনার বাংলা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে? কৃষকেরা তাঁদের শস্য বাজারজাত করতে না পারায় কিংবা তাঁদের শস্যের জন্য প্রয়োজনীয় বীজ ও সার সংগ্রহ করতে না পারায় অর্থনীতি এখন দোদুল্যমান। পণ্য প্রস্তুতকারীরা প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না এবং তৈরি হওয়া পণ্য রপ্তানি করতে পারছেন না। বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার দিতে পারছেন না। কারণ, পণ্য সময়মতো পাওয়া যাবে বলে তাঁরা ভরসা পাচ্ছেন না। দিনমজুরেরা কাজের অভাবে না খেয়ে থাকছেন। কারণ, রাজনৈতিক অচলাবস্থা অর্থনীতিকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। স্কুলে না যেতে পেরে শিক্ষার্থীরা হতাশাগ্রস্ত, তারা পরীক্ষা দিতে পারছে না। তারা যদি স্কুলেও না যেতে পারে, তাহলে আমরা পরবর্তী প্রজন্ম কীভাবে গড়ে তুলব?
এই রাজনৈতিক অচলাবস্থা অব্যাহত থাকলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। কয়েক সপ্তাহ আগে আমি বাংলাদেশের কয়েকজন খ্যাতিমান ব্যবসায়ীর একটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে হংকং সফর করি।
আমাদের লক্ষ্য ছিল হংকংয়ের অনেক আমেরিকান ও অন্যান্য দেশের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা, যাতে বাংলাদেশ আরও বিস্তৃত বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুফল উপভোগ করতে পারে। প্রধান পোশাক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের সফরকালে একটি কঠোর বার্তা দেয়, সেই বৈঠকে প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিটি ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে তাদের ব্যবসা তুলে নেওয়ার একটি কৌশল ইতিমধ্যে গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি অর্ডারের প্রায় অর্ধেক হংকং থেকে আসে বলে আমরা অবগত। ফলে তাদের এমন কঠোর মনোভাব সম্পর্কে জানতে পেরে ওই প্রতিনিধিদল ও আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। প্রকৃতপক্ষে, বর্তমান সহিংস ও ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক অচলাবস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
এটা হওয়া উচিত নয়।
আমার বিশ্বাস, অধিকাংশ বাংলাদেশি চায় জীবন শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিতে অতিবাহিত করতে। তারা নিজ পরিবারের জন্য নিরাপদ, সুরক্ষিত আশ্রয়, পর্যাপ্ত ও পুষ্টিসম্মত খাদ্য, ভালো স্বাস্থ্যসেবা ও নিজ সন্তানদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা চায়। শত হলেও, বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ দেশ: উর্বর জমি, পর্যাপ্ত পানি, তিনটি শস্য উৎপাদনের উপযোগী জলবায়ু, কয়লা ও গ্যাসের বিশাল মজুতের আশীর্বাদপুষ্ট। এটি এমন একটি দেশ, যার ভৌগোলিক অবস্থান একে একবিংশ শতাব্দীর বিশাল বাণিজ্যিক পথ ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডরের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। অবশ্য বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো এর জনগণ। আমার জানামতে, বিশ্বের সবচেয়ে উদ্যমী, বৈচিত্র্যময়, পরিশ্রমী, সৃষ্টিশীল, উদার, উদ্যোগী ও সহনশীল মানুষ। সত্যিকার অর্থেই, বাংলাদেশ এশিয়ার পরবর্তী অর্থনৈতিক টাইগার হতে পারে, হওয়া উচিত। এতে লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের বেড়াজাল ভেঙে মধ্য আয়বিশিষ্ট শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবে। তবে, বর্তমান রাজনৈতিক জটিলতা এবং আনুষঙ্গিক অমানবিক সহিংসতা অর্থনীতিকে বিনষ্ট করছে। আমি আগেও আমার আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেছি যে এই অবস্থা এশিয়ার অর্থনৈতিক টাইগারকে জন্মের আগেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবে।
আমরা সবাই যে বাংলাদেশকে জানি ও ভালোবাসি, সেই বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করেছে। এই বাংলাদেশ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুহার ও মাতৃ মৃত্যুহার ব্যাপকভাবে হ্রাস করতে পেরেছে। একেবারে শূন্য থেকে এই দেশ একটি বিশাল পোশাক খাত গড়ে তুলেছে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। একসময় তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত এই বাংলাদেশ এখন কৃষি সম্পদে উপচে পড়া ঝুড়িতে পরিণত হচ্ছে। এই জাতি ইতিমধ্যে ধানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই অর্জনগুলো অত্যন্ত চমৎকার এবং এসব সাফল্যের অনেকগুলোয় সহায়তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের দৃঢ় অংশীদার হওয়ায় আমি গর্বিত।
যে বাংলাদেশকে আমি চিনি, যে বাংলাদেশে আমি বিশ্বাস করি; সেই বাংলাদেশ এই উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো হারাতে চায় না, সেই বাংলাদেশ এই রাজনৈতিক অচলাবস্থার শিকার হতে চায় না। লাইনচ্যুত ট্রেনে যে মায়ের ছেলে আহত হলো, যে শিশুর মা বাসে পুড়ে গেলেন, প্রত্যেক অভিভাবক ও সন্তান যাদের জীবন এই রাজনৈতিক অচলাবস্থার জন্য চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেই একজন বাংলাদেশি; যার স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও আশা রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের টেবিলে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়েছে। তাদের প্রত্যেকেই একজন বাংলাদেশি, যারা নিজ জীবনে এগিয়ে যেতে ও নিজ পরিবারের যত্ন নিতে চেয়েছিল।
গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার প্রকাশ করার একটি সুযোগ প্রদান করে নির্বাচন, এটি ১৯৭১ সালের বিশাল মূল্যের বিনিময়ে প্রাপ্ত আদর্শগুলো পূরণ করার সুযোগ প্রদান করে; প্রত্যেক অভিভাবক নিজের জন্য বা নিজ সন্তানের জন্য যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, সেটা গড়ে তোলার সুযোগ প্রদান করে; বাংলাদেশ যে পরবর্তী এশিয়ান টাইগার হতে পারে, হতে পারবে এবং বৈশ্বিক পটভূমিতে বাংলাদেশ নিজের প্রাপ্য অবস্থান গ্রহণ করতে পারবে, সেটা বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়ার সুযোগ দেয় একটি নির্বাচন।
তবে, সেটা অর্জন করতে এখনো অনেক কিছু করা বাকি। প্রথমত ও সর্বাগ্রে, সহিংসতা বন্ধ হতে হবে। যেকোনো ধরনের সহিংসতা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ নয়, এটা অগ্রহণযোগ্য এবং এখনই থামতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের, হোক সে সংখ্যাগরিষ্ঠ কিংবা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, একটি অসহিংস ও ভীতিমুক্ত পরিবেশে নিজ জাতীয় প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ প্রাপ্য। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং যাঁরা নেতৃত্ব প্রদানের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন, তাঁদের আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে এবং সহিংসতা, উসকানিমূলক বক্তব্য ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সব রাজনৈতিক দল ও বাংলাদেশি নাগরিকদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় শান্তিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র অনুপ্রাণিত করে। সহিংসতা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।
দ্বিতীয়ত, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপ অব্যাহত রাখতে হবে এবং চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার সমাধানের জন্য নিজ প্রচেষ্টাকে দ্বিগুণ ত্বরান্বিত করতে হবে। উভয় পক্ষের সামান্য সদিচ্ছার মাধ্যমে, দুই দলের নেতারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ খুঁজে বের করতে পারবেন।
তৃতীয়ত, নাগরিক সমাজের সংগঠন-সংস্থাসহ সব রাজনৈতিক দল ও বাংলাদেশি নাগরিকের নিজ মতামত স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণভাবে প্রকাশের অধিকার রয়েছে। এই মতামত প্রকাশের সুযোগ প্রদান করা সরকারের দায়িত্ব; একইভাবে, এই সুযোগ শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবহার করা বিরোধী দলের দায়িত্ব।
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে একই স্বার্থ ও একই মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা অনেক বছরের পুরোনো বন্ধুত্ব রয়েছে বলেই আমি আজ কলম হাতে ধরেছি। বাংলাদেশের প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজ, এর উন্নয়নমূলক অর্জন, নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এর সাফল্য বিশ্বের জন্য মডেলে পরিণত হয়েছে বলে আজ আমি কলম হাতে ধরেছি। আমি আমাদের দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক উদ্যাপনের জন্য কলম হাতে নিয়েছি।
এই সম্পর্ক এর আগে এত বিস্তৃত, গভীর ও শক্তিশালী ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে আছে বলে আমি আজ এই লেখা লিখছি; যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বন্ধু এবং এ দেশের স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমরা একই লক্ষ্য পোষণ করি।
আমি আজ লিখছি কারণ আমার কাছে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ, এই মহান জাতির চমৎকার জনগণ আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই, আমি বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানাই, এই মুহূর্তের সদ্ব্যবহার করতে, জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে। বাংলাদেশের মানুষ যে ধরনের নির্বাচন চায়, যে ধরনের নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষের প্রাপ্য, সে রকম নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সবার সমর্থিত পথ খুঁজে বের করার সদিচ্ছা ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে সংলাপের টেবিলে বসার জন্য আমি সরকার ও বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানাই।
বর্তমান পরিস্থিতির একটি আশু, শান্তিপূর্ণ সমাধান হওয়া অপরিহার্য, এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা বাংলাদেশের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ।
ড্যান মজীনা: বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত।
No comments