নিরাপত্তা- পুলিশ কেন হামলার শিকার হবে? by আলী ইমাম মজুমদার
২০১৩ সালের
সূচনা থেকে পুলিশের ওপর অব্যাহতভাবে হামলার ঘটনা ঘটে চলছে। এই সময়কালে এ
ধরনের নৃশংস হামলায় পুলিশের ১৫ জন সদস্য নিহত ও প্রায় আড়াই হাজার আহত হন।
নিহত
হয়েছেন বিজিবির দুজন সদস্যও। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে একাধিক সাব-ইন্সপেক্টর
এমনকি ওসিও রয়েছেন। এই ডিসেম্বর মাসেরই সূচনায় রাজশাহীর মতিহার থানার ওসির
পা ভেঙে দেয় হামলাকারীরা। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে হামলাকারীরা এ কাজটি করে
পুলিশের থেকে কেড়ে নেওয়া অস্ত্র দিয়েই। পুলিশের ছয়জন সদস্য ছিলেন দলটিতে।
সঙ্গে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। আইনের সমর্থন তো ছিলই। ছিল আত্মরক্ষার অধিকার।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের অসহায় অবস্থাতেই আমরা দেখলাম। সংবাদপত্র থেকে জানা
যায়, এসব হামলা প্রতিরোধ ও হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে পারছে না পুলিশ।
এসব ঘটনায় করা মামলার তদন্তেও তেমন অগ্রগতি নেই বলে জানা যায়। অথচ বেশ কিছু
ক্ষেত্রে হামলার ঘটনার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।
এ
ধরনের হামলার ঘটনায় জনগণ উদ্বিগ্ন হয়। যখন জানতে পারে, প্রকৃত অপরাধীরা
ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে, তখন প্রবল নৈরাশ্যে ভোগে। কেননা, পুলিশ
রাজপথে রাষ্ট্রশক্তির প্রতীক। রাষ্ট্রের সব কটি অঙ্গের অনেক সিদ্ধান্ত ও
নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে হয় পুলিশকে। পুলিশ সম্পর্কে যত অভিযোগই থাকুক,
বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে তাদেরই সহায়তা নিতে হয়। জনগণ চায় একটি শক্তিশালী,
দায়িত্বশীল ও জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে পুলিশ
বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য ক্ষেত্রবিশেষে জনহয়রানির কারণ ঘটান, এটা সত্য।
আমাদের দেশে এটা আরও বেশি ঘটে। তা সত্ত্বেও পুলিশ ছাড়া কিন্তু কোনো দেশ চলে
না। আমরাও চলতে পারব না। অবশ্যই সে পুলিশের সক্ষমতা থাকতে হবে দায়িত্ব
সম্পাদনের। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের হামলায় তাদের
অসহায় অবস্থা আমাদের বিচলিত করেছে। এ ধরনের ঘটনা জনমনে স্বাভাবিকভাবেই
শঙ্কা জাগায়। প্রশ্ন আসে, যারা নিজেদের রক্ষা করতে পারছে না, তারা কীভাবে
জনগণের নিরাপত্তা বিধান করবে?
একটু তলিয়ে দেখার দরকার এ ধরনের ঘটনা কেন আর কীভাবে ঘটে? ২০১৩ সালের সূচনা থেকে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মামলার রায় দেওয়া শুরু হয়। মামলাগুলোর দণ্ডাদেশের বিরোধিতা করে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির একের পর এক কর্মসূচি দেয়। ঘটতে থাকে হিংসাত্মক ঘটনা। হতাহত হয়েছেন কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী দলের সদস্যসহ সাধারণ মানুষও। বস্তুতপক্ষে সে কর্মসূচির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকলেও বিরোধীদলীয় জোট কর্তৃক নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতি-সংক্রান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি একাকার হয়ে যায়। পুলিশের ওপর হামলার এ ঘটনাগুলোর বেশ কিছু এসব কর্মসূচি চলাকালীন। কোনো কর্মসূচি ব্যতিরেকেই অতর্কিত হামলার ঘটনাও কিছু আছে। তবে হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে অসুবিধা কোথায়, এটা বোধগম্য হচ্ছে না। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রচণ্ড ব্যস্ততার কারণে তারা সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের ব্যস্ততার বিষয়টি যথার্থ। সংস্থাটি প্রবল চাপের মুখে আছে। তবে এটা বিবেচনায় নেওয়া দরকার যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনেই এ ধরনের হামলাকারীদের আইনের আওতায় নেওয়া প্রয়োজন। বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতি নিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা গেলে আন্দোলনটির তীব্রতা কমে যেত বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি।
দেখার বিষয়, এসব ঘটনা যারা ঘটায়, তারা কীভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কিছু স্ববিরোধী ভূমিকা নজরে আসার মতো। কিছু ক্ষেত্রে এ-জাতীয় ঘটনার পর মামলার আসামির সংখ্যা হাজার হাজার দেখানো হয়। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে পুলিশের চারজন সদস্যকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। সে সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলোয় ৩২টি মামলা করা হয় ৬০ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করে। এযাবৎ গ্রেপ্তার হয়েছে তিন শতাধিক। তবে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হয়নি কেউ। উত্তরাঞ্চলের একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে এসব অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনৈক জামায়াতের নেতার জমি লেনদেন নিয়ে একটি প্রতিবেদন সংবাদপত্রে দেখা গেল। পুলিশ বাহিনীর ভেতরেই কারও কারও এ ধরনের মনোভাব থাকলে প্রকৃত আসামি চিহ্নিত হবে কীভাবে? অন্যদিকে, অকারণে বৈরী করা হচ্ছে হাজার হাজার পরিবারকে। পালিয়ে থাকছে তারা গ্রেপ্তার এড়াতে।অনেক ক্ষেত্রে নাশকতার মামলা হলেই প্রথম দিককার আসামি করা হচ্ছে বিরোধী দলের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের নেতাদের। নাশকতার ঘটনায় তাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী হলে অবশ্যই আইনের আওতায় আসবেন। তবে যাচাই-বাছাই না করে শুধু শায়েস্তা করার জন্য এটা করা হচ্ছে বলেই অনেকে মনে করেন। ফলে পুলিশের প্রতি তাঁদের সমর্থকেরাও বৈরী হচ্ছেন। প্রকৃত অপরাধীরা গা ঢাকা দেওয়ার উৎকৃষ্ট সুযোগও পায়। আরেকটি নিকৃষ্ট সংস্কৃতি চালু রয়েছে গত কয়েকটি সরকারের সময় থেকে। যারা সরকারে থাকে, তাদের কর্মী-সমর্থকেরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিরোধী দলের ওপর সশস্ত্র হামলা চালান পুলিশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। এ ধরনের কার্যক্রম পুলিশের মর্যাদা কমিয়ে দিচ্ছে।
পত্রপত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আরও জানা গেছে, এ ধরনের ঘটনা যাঁরা ঘটান, তাঁরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরকারি দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় পান। জামিন লাভের সুবিধার্থে পেয়ে যান সরকারি দলের সমর্থক বলে স্বীকৃতির সনদ। এটা আত্মীয়তা কিংবা অন্য যেকোনো সুবিধার বিনিময়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা অবশ্যই দেখতে পারেন নিরপরাধ কোনো লোক যেন হয়রানির শিকার না হন। প্রকৃতপক্ষে ঘটছে ভিন্ন কিছু। সীতাকুণ্ডে মাসাধিক কাল মহাসড়ককে অগ্নিকুণ্ড করে রেখেছিল কিছু আন্দোলনকারী। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক কার্যত পরিত্যক্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল হামলার ভয়ে। দেশের অর্থনীতিতে অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে এ মহাসড়কের। যৌথ বাহিনী নিয়োগ করে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় বেশ কিছু ব্যক্তিকে। সবাই হয়তো বা অপরাধী না-ও হতে পারেন। সেটা দ্রুত তদন্ত করে শনাক্ত আর নিরপরাধ ব্যক্তিদের মুক্তির ব্যবস্থা করাই যৌক্তিক ছিল। কিন্তু জানা যায়, সরকারি দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সুপারিশে পার পেয়ে যাচ্ছে অনেকেই। এ ধরনের ঘটনা কিন্তু দেশের অন্যত্রও ঘটে চলছে।
পুলিশের এ বেহাল অবস্থার জন্য চলমান অস্থিতিশীল রাজনীতি অনেকাংশে দায়ী। তবে এ-জাতীয় পরিস্থিতিতেও তারা নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকলে হয়তো বা প্রতিক্রিয়া ভিন্নরূপ হতে পারত। সরকারি দলে যারা থাকে, তারা গত কয়েক যুগ বিবেচনাহীনভাবে ব্যবহার করে চলছে পুলিশসহ গোটা বেসামরিক প্রশাসনকে। সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ কিছুও এ নির্দয় দলীয়করণের করুণ শিকার। এটা একা পুলিশের দায় নয়। তবে যেহেতু তাদের সামনে থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সামাল দিতে হয়, তাই দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতিহিংসার দায় প্রথমে তারাই ভোগ করছে। অবশ্য অন্যরাও বাদ থাকছে না। হামলাকারীরা ইউএনও অফিস পুড়িয়ে দিচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। এভাবে চলতে দিলে ভবিষ্যতে আরও হবে, এমনটাই স্বাভাবিক। তবে এ ব্যাধি জটিল। এর সহজ সমাধান নেই। বলা হয়, বর্তমান পুলিশ আইন তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালনে অন্তরায়। প্রয়োজন হতে পারে আইনের সংস্কার কিংবা নতুন আইন। তবে শুধু আইনই তাদের নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা দেবে না। যেমনটা দেয়নি দুর্নীতি দমন কমিশনকে। সংবিধান ও আইনে পূর্ণ স্বাধীন হলেও বাস্তবে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতাও অনেক ক্ষেত্রে পক্ষপাতসুলভ বলে অভিযোগ আসে। এটা শুধু বর্তমান কমিশনের ক্ষেত্রেই নয়, আগেও হয়েছে।
এখন মাঠপর্যায়ে সামরিক বাহিনী আছে। তাদের অবস্থান সাময়িক। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশকেই পালন করতে হবে। এ-জাতীয় হামলা মোকাবিলায় তাদের সক্ষমতার অভাব আমাদের মর্মাহত ও হতাশ করে। মেধাসম্পন্ন সাহসী কর্মকর্তা যথেষ্ট আছেন পুলিশে। তাঁরা দায়িত্ব পালনে অবিচল ও নিষ্ঠাবান থাকলে এরূপ চলতে পারে না। আকস্মিক দু-এক জায়গায় হলেও ত্বরিত প্রতিকার এর পুনরাবৃত্তি রোধে সহায়ক হবে। অস্ত্রধারী পুলিশ দলের কাউকে নির্মমভাবে পেটায় হামলাকারীরা। আগুন ধরিয়ে দেয় তাঁদের গাড়িতে। অন্যরা পালিয়ে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা অগ্রহণযোগ্য। ধৈর্য ধারণ অবশ্যই ভালো। তবে তা দুর্বলতার রূপ নিতে পারে না। সহিংস হামলা সব ক্ষেত্রে অহিংসভাবে মোকাবিলা করা যায় না। এভাবে ছাড় দিলে ঘটনাগুলো দিন দিন বেড়েই চলবে। সব শঙ্কা ঝেড়ে ফেলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ়সংকল্প হতে হবে তাদের। নিজদের সুরক্ষার পূর্ণ ব্যবস্থা নিতে হবে। দলমত-নির্বিশেষে জনগণের যানমাল রক্ষায়ও আপসহীন দৃষ্টিভঙ্গি আবশ্যক। অকারণে শক্তি প্রয়োগ আর প্রয়োজনের সময়ে নিষ্ক্রিয়তা—উভয়ই আইনত অগ্রহণযোগ্য।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments