নতুন ভাবনা- বিনা চাষে পালং শাক by মৃত্যুঞ্জয় রায়
নাটোর সদর উপজেলা অফিসের উল্টো দিকেই হাজরা নাটোর গ্রাম। সে গ্রামে যারা
বাস করেন তাদের বেশির ভাগই কৃষিজীবী। রাস্তার দুই ধারে তাদের বাড়িঘর। আর
তার পেছনে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ।
সে মাঠে নানা রকমের ফসলের
চাষ হয়। ধানই বেশি হয়। দুই মওসুমে তারা ধান করেনÑ রোপা আমন ও বোরো। রোপা
আমন মওসুমে ধান চাষ করে সে ধান কাটার পর বোরো ধানের চারা লাগানো পর্যন্ত
প্রায় দেড়-দুই মাস সেসব জমি ফাঁকা পড়ে থাকে। কিন্তু সে গ্রামের কয়েকজন
কৃষকের জন্য সে জমির বিশ্রাম নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা এই স্বল্প সময়ের
মধ্যেও আর একটি ফসল তুলে নিচ্ছেন। পালং শাক, ধনিয়াপাতা, দেশী সরিষা, লাল
শাক প্রভৃতি ফসল চাষ করছেন সেখানে।
বলা যায় বিনা চাষেই এসব ফসল হচ্ছে। এমনকি সেসব ফসল চাষে কারো কারো ধানের চেয়েও বেশি লাভ হচ্ছে।
হাজরা নাটোর গ্রামের কৃষক মোশাররফ হোসেন বললেন, তার বিনা চাষে পালং শাক আবাদের গল্প। প্রায় দুই বিঘা জমিতে তিনি এবার আম ধানের চাষ করেছিলেন। জাত ছিল নেপালি স্বর্ণা। এ জমির মধ্যে মাত্র চার শতক জমিতে তিনি এবার বিনা চাষে পালং শাকের আবাদ করেছেন। তিনি অগ্রহায়ণের শেষে আমন ধান কাটার ছয় থেকে সাত দিন আগে জমি কাদা থাকা অবস্থায়ই সে জমিতে পালং শাকের বীজ ছিটিয়ে দেন।
দেশী জাতের পালং শাকের বীজ জমিতে ছিটানোর অগে এক রাত পানিতে ভিজিয়ে নেন। ধান জমিতে থাকা অবস্থায় পালং শাকের বীজ গজিয়ে দুই পাতা ছেড়ে দেয়। এরপর ধান কেটে ফেলেন।
ধানের সেসব কাটা গোড়ার ফাঁকে ফাঁকেই বেড়ে উঠতে থাকে পালং শাকের চারা। কোনো যতœ নেই, কোনো সার বা সেচ দেয়ারও কিছু নেই। এভাবে ধান কাটার পর ১০ থেকে ১২ দিন পার হয়। এবার তিনি সে জমিতে নিড়ানি দিয়ে আগাছা ও ধানগাছের গোড়াগুলো তুলে পরিষ্কার করে দেন।
বীজ বোনার সাধারণত ২০ দিন পর এটা করতে হয় বলে তিনি জানান। সে সময় জমি নিড়ানোর পর তার চার শতক জমিতে তিনি ১.৫ কেজি ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম জিপসাম ও ৫০ গ্রাম দস্তা সার ছিটিয়ে দেন। কোন সেচ দেয়ার দরকার হয়নি। মাটির রস আর সার খেয়ে পালং শাকের পাতা দ্রুত বড় হতে থাকে।
এর ১৫ দিন পর তিনি ওই জমিতে আবার ১.৫ কেজি ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দেন। ব্যস, এই তার আবাদের কাজ। খরচ বলতে তার সামান্য পরিশ্রম, বীজ আর সারের দাম মিলিয়ে বড়জোর ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। ৪০ দিন বয়স হওয়ার পর থেকেই তিনি পালং শাক তোলা শুরু করেন।
প্রতি দুই দিন পর পর তিনি পালং শাক তুলছেন। প্রতি বারে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ কেজি পালং শাক তুলছেন। এবার শাকের দাম ভালো থাকায় প্রতি কেজি পালং শাক বাড়িতে বসেই বিক্রি করছেন ৮ থেকে ১০ টাকা দরে। পাইকারেরা বাড়িতে এসে ক্ষেত থেকেই শাক কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রতি দফায় এভাবে তিনি প্রায় হাজার টাকার পালং শাক বিক্রি করছেন। এ পর্যন্ত তিনি মাত্র দুইবার সে ক্ষেত থেকে শাক তুলেছেন। আশা করছেন, এ সপ্তাহের মধ্যেই সব শাক তুলে ফেলবেন এবং সব মিলিয়ে প্রায় আট থেকে ১০ হাজার টাকার পালং শাক বিক্রি হবে। এটা তার ফাও বা বাড়তি আয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। কেননা, এ সময় জমিটা ফাঁকা পড়ে থাকে, কোনো ফসল হয় না। মাত্র চার শতক জমিতে চাষ করে অবশ্যই তিনি লাভবান।
যদি এক বিঘায় করতেন তাহলে বিঘায় প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার পালং শাক হতো। পালং তুলে সে জমিতে এখন তিনি বোরো ধানের চারা লাগাবেন।
তিনি জানালেন, তবে পালং শাক শুধু নয়। তিনি এবার বিনা চাষে প্রায় ১০ শতক জমিতে ধনিয়া পাতার চাষও করেছেন। তবে পালংয়ের মতো লাভ তাতে পাচ্ছেন না। ধনিয়াপাতার বাজারদর এখন খুব কম। আবার জমিতে বেশি দিন রাখা যাবে না। বললেন, এখন চাষাবাদে এটাই কৃষকদের মূল সমস্যা। কখন কোন ফসলের দাম যে কত হয়, তা বলা মুশকিল।
এবার এক বিঘা জমির ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকায়, অথচ এক বিঘা জমির ধান বেচে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকার বেশি পাওয়া যায় না।
হাজরা নাটোর গ্রামে গত বছর তিনি একাই বিনা চাষে চার শতক জমিতে পালং শাক চাষ করে আট হাজার টাকার পালং শাক বিক্রি করে ছিলেন। এবার এ গ্রামে সুমন কুমার মণ্ডল, জীতেন্দ্র নাথ মণ্ডল এবং তার ভাই মোকছেদও বিনা চাষে পালং শাকের আবাদ করেছেন। দিন দিন মনে হয় এ পদ্ধতির আবাদ বাড়ছে। নাটোর সদর উপজেলার উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ আফিসার পরেশ তরফদার জানালেন, এটা অবশ্যই একটি লাভজনক প্রযুক্তি। তবে তারা যদি স্বল্প জীবনকালের ‘বিনা ধান ৭’ জাতটি রোপা আমন মওসুমে চাষের জন্য বেছে নেন, তাহলে বিনা চাষ পালং চাষ করে আরো বেশি লাভবান হতে পারেন। এতে পালংশাক আরো বেশ কয়েক দিন বেশি জমিতে থাকার সুযোগ পাবে এবং তাতে ফলন বেশি হবে। এই প্রযুক্তি অন্যান্য এলাকার আমনচাষিদের মধ্যেও সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। ।
লেখক : কৃষিবিদ
বলা যায় বিনা চাষেই এসব ফসল হচ্ছে। এমনকি সেসব ফসল চাষে কারো কারো ধানের চেয়েও বেশি লাভ হচ্ছে।
হাজরা নাটোর গ্রামের কৃষক মোশাররফ হোসেন বললেন, তার বিনা চাষে পালং শাক আবাদের গল্প। প্রায় দুই বিঘা জমিতে তিনি এবার আম ধানের চাষ করেছিলেন। জাত ছিল নেপালি স্বর্ণা। এ জমির মধ্যে মাত্র চার শতক জমিতে তিনি এবার বিনা চাষে পালং শাকের আবাদ করেছেন। তিনি অগ্রহায়ণের শেষে আমন ধান কাটার ছয় থেকে সাত দিন আগে জমি কাদা থাকা অবস্থায়ই সে জমিতে পালং শাকের বীজ ছিটিয়ে দেন।
দেশী জাতের পালং শাকের বীজ জমিতে ছিটানোর অগে এক রাত পানিতে ভিজিয়ে নেন। ধান জমিতে থাকা অবস্থায় পালং শাকের বীজ গজিয়ে দুই পাতা ছেড়ে দেয়। এরপর ধান কেটে ফেলেন।
ধানের সেসব কাটা গোড়ার ফাঁকে ফাঁকেই বেড়ে উঠতে থাকে পালং শাকের চারা। কোনো যতœ নেই, কোনো সার বা সেচ দেয়ারও কিছু নেই। এভাবে ধান কাটার পর ১০ থেকে ১২ দিন পার হয়। এবার তিনি সে জমিতে নিড়ানি দিয়ে আগাছা ও ধানগাছের গোড়াগুলো তুলে পরিষ্কার করে দেন।
বীজ বোনার সাধারণত ২০ দিন পর এটা করতে হয় বলে তিনি জানান। সে সময় জমি নিড়ানোর পর তার চার শতক জমিতে তিনি ১.৫ কেজি ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম জিপসাম ও ৫০ গ্রাম দস্তা সার ছিটিয়ে দেন। কোন সেচ দেয়ার দরকার হয়নি। মাটির রস আর সার খেয়ে পালং শাকের পাতা দ্রুত বড় হতে থাকে।
এর ১৫ দিন পর তিনি ওই জমিতে আবার ১.৫ কেজি ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দেন। ব্যস, এই তার আবাদের কাজ। খরচ বলতে তার সামান্য পরিশ্রম, বীজ আর সারের দাম মিলিয়ে বড়জোর ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। ৪০ দিন বয়স হওয়ার পর থেকেই তিনি পালং শাক তোলা শুরু করেন।
প্রতি দুই দিন পর পর তিনি পালং শাক তুলছেন। প্রতি বারে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ কেজি পালং শাক তুলছেন। এবার শাকের দাম ভালো থাকায় প্রতি কেজি পালং শাক বাড়িতে বসেই বিক্রি করছেন ৮ থেকে ১০ টাকা দরে। পাইকারেরা বাড়িতে এসে ক্ষেত থেকেই শাক কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রতি দফায় এভাবে তিনি প্রায় হাজার টাকার পালং শাক বিক্রি করছেন। এ পর্যন্ত তিনি মাত্র দুইবার সে ক্ষেত থেকে শাক তুলেছেন। আশা করছেন, এ সপ্তাহের মধ্যেই সব শাক তুলে ফেলবেন এবং সব মিলিয়ে প্রায় আট থেকে ১০ হাজার টাকার পালং শাক বিক্রি হবে। এটা তার ফাও বা বাড়তি আয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। কেননা, এ সময় জমিটা ফাঁকা পড়ে থাকে, কোনো ফসল হয় না। মাত্র চার শতক জমিতে চাষ করে অবশ্যই তিনি লাভবান।
যদি এক বিঘায় করতেন তাহলে বিঘায় প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার পালং শাক হতো। পালং তুলে সে জমিতে এখন তিনি বোরো ধানের চারা লাগাবেন।
তিনি জানালেন, তবে পালং শাক শুধু নয়। তিনি এবার বিনা চাষে প্রায় ১০ শতক জমিতে ধনিয়া পাতার চাষও করেছেন। তবে পালংয়ের মতো লাভ তাতে পাচ্ছেন না। ধনিয়াপাতার বাজারদর এখন খুব কম। আবার জমিতে বেশি দিন রাখা যাবে না। বললেন, এখন চাষাবাদে এটাই কৃষকদের মূল সমস্যা। কখন কোন ফসলের দাম যে কত হয়, তা বলা মুশকিল।
এবার এক বিঘা জমির ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকায়, অথচ এক বিঘা জমির ধান বেচে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকার বেশি পাওয়া যায় না।
হাজরা নাটোর গ্রামে গত বছর তিনি একাই বিনা চাষে চার শতক জমিতে পালং শাক চাষ করে আট হাজার টাকার পালং শাক বিক্রি করে ছিলেন। এবার এ গ্রামে সুমন কুমার মণ্ডল, জীতেন্দ্র নাথ মণ্ডল এবং তার ভাই মোকছেদও বিনা চাষে পালং শাকের আবাদ করেছেন। দিন দিন মনে হয় এ পদ্ধতির আবাদ বাড়ছে। নাটোর সদর উপজেলার উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ আফিসার পরেশ তরফদার জানালেন, এটা অবশ্যই একটি লাভজনক প্রযুক্তি। তবে তারা যদি স্বল্প জীবনকালের ‘বিনা ধান ৭’ জাতটি রোপা আমন মওসুমে চাষের জন্য বেছে নেন, তাহলে বিনা চাষ পালং চাষ করে আরো বেশি লাভবান হতে পারেন। এতে পালংশাক আরো বেশ কয়েক দিন বেশি জমিতে থাকার সুযোগ পাবে এবং তাতে ফলন বেশি হবে। এই প্রযুক্তি অন্যান্য এলাকার আমনচাষিদের মধ্যেও সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। ।
লেখক : কৃষিবিদ
No comments