শিল্পখাত-নতুন প্রজন্ম দেশের সামর্থ্য বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে by তপন চৌধুরী
বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল কৃষি-শিল্প-বিজ্ঞান-শিক্ষা-সংস্কৃতিসমৃদ্ধ মাতৃভূমি গড়ে তোলা। গত চার দশকে আমরা অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়েছি। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় বলব, আমরা সঠিক পথেই চলেছি। ১৯৭১ সালে আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত ছিল কৃষি।
কর্মসংস্থানের জন্য এ খাতের ওপর নির্ভরতা ছিল ব্যাপক। মুক্তিযুদ্ধে কৃষকরা বিপুল সংখ্যায় অংশ নেন। তবে সমৃদ্ধির জন্য শস্যের পাশাপাশি চাই অনেক কলকারখানা এবং অবশ্যই সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি। স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে এ ভূখণ্ডের মোটামুটি বড় এমন শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। এগুলোর বেশিরভাগের মালিকানা ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি উদ্যোক্তাদের। এসব প্রতিষ্ঠান পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে। পাট ও বস্ত্র খাতের দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোও সে সময়ে জাতীয়করণ করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তারা ঠিক কোন পথে অগ্রসর হবেন, সেটা বুঝতে পারছিলেন না। তদুপরি নতুন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হলে তাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ সীমা নির্ধারণ করা ছিল ২৫ লাখ টাকা। ১৯৭৪ সালে তা বাড়িয়ে তিন কোটি টাকা করা হয়।
পাকিস্তান আমলে শিল্প-বাণিজ্যের যে কোনো উদ্যোগের জন্য আমাদের যেতে হতো করাচি কিংবা লাহোর-পিন্ডিতে। স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় অর্জন যদি বলতে হয় তো এ বিষয়টিই আমি উল্লেখ করব। আমরা নিজেদের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করছি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নও করছি আমরাই। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের কথাই ধরা যাক। স্বাধীনতার পরপরই আমরা জনসন-জনসন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে কাজ শুরু করি। খ্যাতিমান এ কোম্পানি আমাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়। এটাই ছিল ওষুধ শিল্পের জন্য ব্রেক-থ্রু। আরও কয়েকটি কোম্পানি এভাবে ওষুধ উৎপাদন শুরু করে। শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করায় উদ্যোক্তারা যখন ট্রেডিংয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়ছিল, তখন আমরা সাহস করে এগিয়ে যাই। সে সময়ে ইনডেনটিং ব্যবসা ছিল জমজমাট। বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশের বাজারে বিক্রি, এটাই ছিল তাদের কাজ। এ কাজে যুক্তদের ব্রিফকেস ব্যবসায়ীও বলা হতো। এ জন্য জমি দরকার নেই, অফিসভর্তি কর্মীর দেখা মিলবে না। কেবল একটি ব্রিফকেসে কিছু দরকারি কাগজ আর সিল ও প্যাড থাকলেই হলো। ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতি এ খাতের বিকাশের জন্য অনন্য সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। কয়েকটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এ সময়ে মূলধন দেশের বাইরে নিয়ে যায়। কিন্তু তাদের স্থান দেশীয় উদ্যোক্তারা পূরণ করে ফেলে। চিকিৎসকদের মনোভাবেও পরিবর্তন আসে। একসময় তাদের অনেকের ধারণা ছিল, মানসম্পন্ন ওষুধ কেবল বহুজাতিক কোম্পানিই তৈরি করতে পারে।
আশির দশকের শুরুতেই আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষণীয়। একটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানা থেকে বেশকিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান মূল মালিকদের কাছে হস্তান্তর কিংবা অন্য উদ্যোক্তাদের কাছে বিক্রয়। দ্বিতীয়ত, তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যুদয়। সাবেক সচিব নুরুল কাদের বিশ্ববাজারের জন্য পোশাক উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের বিষয়ে একদল লোককে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনেন। সরকারও এ শিল্পের বিকাশের জন্য ব্যাক টু ব্যাক এলসির অনুমোদনসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কয়েক বছরের মধ্যেই তৈরি পোশাক শিল্প দাঁড়িয়ে যায়। একদিকে লাখ লাখ শ্রমিক এ কাজে যুক্ত হয়, পাশাপাশি সহায়ক শিল্প গড়ে উঠতে থাকে। পোশাক শিল্পের প্রয়োজনেই বস্ত্র শিল্প বিকশিত হতে থাকে।
চামড়া শিল্পের বিকাশও আমরা এ সময়ে লক্ষ্য করি। এক সময়ে কাঁচা চামড়া তেমন প্রসেস না করেই রফতানি করা হতো। এর পরিবর্তে চামড়া প্রসেস করার জন্য কয়েকটি কারখানা গড়ে ওঠে। চামড়াজাত পণ্য রফতানির জন্যও প্রতিষ্ঠিত হয় আধুনিক মানের কারখানা। বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র বাড়তে থাকায় সৃষ্টি হয় নতুন সম্ভাবনা।
গত চার দশকে তরুণসমাজের মানসিকতায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। বছরের পর বছর শিক্ষিত তরুণদের ধ্যান-জ্ঞানে ছিল একটি চাকরি। সচিবালয়ে এমনকি কেরানির চাকরি পেলেও জীবনের বড় লক্ষ্য অর্জিত হয়ে গেছে বলে মনে করা হতো। আর ক্যাডার সার্ভিসে যোগদান করতে পারলে তো কথাই নেই। কিন্তু এখন তরুণরা ইনডেনটিংয়ের বাইরেও নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার শুধু স্বপ্ন দেখে না, বাস্তবায়নও করে। এমন লোকেরও দেখা মিলবে যারা চিকিৎসক ও প্রকৌশলীর পেশা ছেড়ে কলকারখানা গড়ে তোলায় উদ্যোগী হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে পড়াশোনা করে দেশে ফিরে এসেও অনেকে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। তারা একই সঙ্গে দেশে নিয়ে আসছে প্রযুক্তি এবং বাজার সংযোগ। ব্যবসা করে ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশে জীবন কাটানো নয়, বরং দেশকে সমৃদ্ধ করা এবং অনেক অনেক মানুষের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি করায় অবদান রাখাকে জীবনের মিশন হিসেবে তারা বেছে নেয়। যুগের চাহিদার সঙ্গেও তারা তাল মেলাতে থাকে। তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রথমদিকে কারখানার পরিবেশ মানসম্মত করাসহ কমপ্লায়েন্সের বিষয়গুলোতে আমাদের অনেক উদ্যোক্তার অস্বস্তি ছিল। উৎপাদন হলেই হলো, এর পেছনের কর্মীদের নিয়ে তেমন মাথাব্যথায় রাজি হতে চাইত না। কিন্তু এখন তারা বুঝতে পারছে, শ্রমিকরা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। তাদের জন্য ভালো পরিবেশ নিশ্চিত হলে কেবল বিশ্ববাজারে আমাদের পোশাকের ক্রেতারাই সন্তুষ্ট থাকে না, নিজের প্রতিষ্ঠানেও উৎপাদন বাড়ে। এ বিষয়টিকে আমি উইন উইন অবস্থা বলতে পারি। শ্রমিকদের কাজের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি এবং সময়মতো তাদের হাতে বেতন-ভাতার অর্থ তুলে দেওয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের স্কয়ার স্পিনিংয়ের একটি অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে বলতে পারি। প্রথমদিকে এ কারখানার ডিজাইনে কিছুটা ত্রুটি থাকায় কাজের সময় অত্যধিক গরম লাগত। এতে শ্রমিকদের কাজে সমস্যা হতো। অজ্ঞান হয়ে পড়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। অস্বস্তিকর পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য স্যালাইন রাখতে হয়েছে। কিন্তু আমরা কারখানার ডিজাইন বদলে ফেলি এবং এতে বাড়তি অর্থ ব্যয় হয়। কিন্তু নতুন পরিবেশে উৎপাদন বেড়ে যায় এমন মাত্রায়, যার ফলে মাত্র দুই বছরের মধ্যেই আমরা বিনিয়োগের অর্থ তুলে ফেলতে পারি। আমাদের গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুপুরে শ্রমিকদের খাবার সরবরাহ করা হয়। কাজের গুণ-মানে এর ইতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। মূল কথা হচ্ছে, উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য যে শ্রমশক্তি তাকে সন্তুষ্ট রাখা চাই। গত কয়েক বছরে উদ্যোক্তাদের অনেকেই এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেছেন।
এখন বাংলাদেশের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয় এমনকি তৃতীয় প্রজন্মের উদ্যোক্তারা পরিচালনা করছেন। তাদের মানসিকতা আধুনিক ও উদার। প্রযুক্তির ব্যবহারেও তারা এগিয়ে। বিশ্ববাজারে নিজের যোগ্যতায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তারা ক্রমেই সংকল্পবদ্ধ হয়ে উঠছে। কেবল সরকারের কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণ নয়, সমস্যা সমাধানে নিজেদের করণীয় বিষয়েও তারা সচেতন। একসময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং শিল্প ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে উদ্যোক্তাদের বৈঠকে মূল ইস্যু থাকত সরকারের কাছ থেকে শুল্ক ও ট্যারিফ সুবিধা আদায়। এখন এজেন্ডায় পরিবর্তন এসেছে। পার্টনারশিপ গুরুত্ব পাচ্ছে। এ নতুন প্রজন্ম জানে যে, সরকারের কোষাগারে তাদের অর্থের জোগান যত বাড়বে, অবকাঠামো এবং অন্যান্য সুবিধা সৃষ্টির জন্য বিনিয়োগ তত বাড়ানো সম্ভব হবে। একসময় বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরতা ছিল ব্যাপক। এখন উদ্যোক্তারা এ বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসার ক্ষেত্রে নিজেদের করণীয় বুঝতে শুরু করেছেন। আমাদের কৃষক ও ক্ষেতমজুররা খাদ্যে দেশকে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলেছেন। এ অর্জন না হলে কেবল মানুষের মুখের গ্রাস নিশ্চিত করতে কত অর্থই না ব্যয় করতে হতো। শিল্প উদ্যোক্তারাও কৃষকদের স্বার্থের দিকটি বুঝতে পারছে। এখন গ্রীষ্মকালে বোরো ধান চাষের জন্য শহর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে গ্রামে দেওয়া হয় এবং এটা মেনে নেওয়ার মানসিকতা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। রাসায়নিক সারেও সরকার ভর্তুকি দেয়। আমাদের বিদ্যুৎ-গ্যাস খাতে সমস্যা রয়েছে। যাতায়াতেও বিঘ্ন অনেক। এসব সমস্যা কেবল সরকার একা সমাধান করতে পারবে না। স্বল্প মেয়াদেও সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। রাতারাতি একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা যায় না। গ্যাসের উৎপাদনও চাইলেই বাড়ানো যায় না। সরকার বেসরকারি মালিকদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনে নিয়ে সরবরাহ করছে। প্রতি ইউনিট সরকার কিনছে ১২ থেকে ১৪ টাকায়। কিন্তু বিক্রি করা হচ্ছে চার ভাগের এক ভাগ দামে। কতদিন এ অবস্থা চলবে? একসময় উদ্যোক্তারা সরকারি ভর্তুকি পেলেই খুশি থাকত। কিন্তু এখন তারাও বাস্তবতা উপলব্ধি করছে। সরকার এক খাতে ভর্তুকি দিলে অন্য খাতে বিনিয়োগে পিছিয়ে পড়বে এবং হয়তো দেখা যাবে যে এর ফলে এক বা একাধিক জরুরি খাতে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে এসব অবকাঠামোগত সমস্যা সমাধানে বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও অবদান রাখা চাই এবং তাতে লাভের পাশাপাশি সার্বিক জাতীয় স্বার্থকেও গুরুত্ব দিতে হবে। এক কথায় বলতে পারি, তাদেরও দেশের সামর্থ্য তৈরি করে দিতে অবদান রাখতে হবে। এটাই তো সরকারি-বেসরকারি পার্টনারশিপ। কেবল বিদেশ থেকে সাহায্য এনে দেশকে স্বনির্ভর করা যায়নি, যাবেও না।
বাংলাদেশের শিল্প খাতের জন্য নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে চীন ও ভারতের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এ দুটি দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পণ্য বাংলাদেশে আসে এবং এ তুলনায় আমাদের রফতানি সামান্য। তাদের সঙ্গে বাণিজ্যে ভারসাম্য আনা সম্ভব নয়, কাম্যও হবে না। কারণ আমাদের নিজস্ব শিল্পের জন্য তাদের কাছ থেকে প্রচুর কাঁচামাল আমদানি করা হয় এবং এর একটি অংশ প্রসেস করে অন্যান্য দেশে রফতানি করা হয়। আমাদের শিল্প খাতের উৎপাদন ভাণ্ডারও এমন সমৃদ্ধ নয় যে তাদের বাজারে বড় আকারে প্রবেশ করতে পারব। তবে দুটি দেশকেই আমাদের অর্থনীতির বিকাশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। চীনের কিছু কারখানা বাংলাদেশে স্থানান্তর করারও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের কাছাকাছি এলাকায় চীনের যে ভূখণ্ড রয়েছে তা আমাদের কয়েক ধরনের রফতানি পণ্যের গন্তব্য হতে পারে। অন্যদিকে ভারতের সর্বত্র হতে পারে বাংলাদেশের জন্য বাজার। বিশেষ সম্ভাবনা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে। এ ক্ষেত্রে শুল্ক ও শুল্কবহির্ভূত কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টিই কাম্য হবে না। কারণ আমরা চাইলেও ভারতের বাজারে বড় আকারে প্রবেশ করতে পারব না।
আমাদের দেশে শ্রম সস্তা_ এভাবে বলা ঠিক হবে না। এতে করে শ্রমিকদের অবমূল্যায়ন করা হয়। আমাদের একটি শক্তির দিক রয়েছে এবং তা কাজে লাগাতে হবে। অনেক উন্নয়নশীল দেশের শ্রমিকদের বড় অংশকে দেখা যায় কারখানা থেকে ঘরে না ফিরে পা বাড়ায় শুঁড়িখানায়। অন্যদিকে আমাদের সংস্কৃতিই তাদের টেনে নেয় গৃহকোণে। এটি হচ্ছে আমাদের শক্তির দিক এবং উৎপাদন বাড়াতে তা কাজে লাগাতে হবে। আমাদের মূলত এক ভাষাভাষী দেশ। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতা ও সহমর্মিতার মনোভাব রয়েছে। আমাদের নারী শ্রমিকরা তৈরি শিল্পে চমকপ্রদ কর্মক্ষমতা প্রদর্শন করে চলেছে। এ ক্ষমতা আরও বাড়ানো যায়। একই সঙ্গে তাদের কাজের পরিবেশ উন্নত করে তোলা এবং বেতন ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করার প্রতি মনোযোগী হতে হবে।
শিল্প খাতে আমাদের বড় সম্ভাবনা রয়েছে বস্ত্র খাতে। তুলা আমদানিতে সম্পূর্ণ পরনির্ভরতার পরও এ সুযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি। এখানে কম্পোজিট মিল গড়ে উঠছে এবং বিদেশি ক্রেতারা এক স্থানে সব ইউনিট পাওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়। চীন এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে তাদের কিছু কারখানা স্থানান্তর করতে পারে। ওষুধ শিল্প সম্ভাবনাময়। দেশের চাহিদার ৯৭ শতাংশ স্থানীয় প্রতিষ্ঠান জোগান দেয়। স্বাধীনতার পরপর স্কয়ার মাত্র কয়েক লাখ টাকার ওষুধ উৎপাদন করত। এখন তা দেড় হাজার কোটি টাকায় পেঁৗছেছে। বিশ্ববাজারেও বাংলাদেশের ওষুধের চাহিদা রয়েছে। স্কয়ার ও বেক্সিমকোসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এখন দেশেই অনেক ধরনের ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন করছে। চামড়া এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতও সম্ভাবনাময়। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প শুধু দেশের চাহিদা পূরণ করছে না, বহির্বিশ্বেও বাজার দখল করতে পারে।
আমাদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা রাজধানীকেন্দ্রিকতা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা এবং নানা ধরনের নাগরিক সুবিধা ঢাকায় বেশি। এ কারণে এখানে বসবাসের প্রতি আগ্রহ অনেকের। স্কয়ার গ্রুপ বহু বছর পাবনাকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হতে চেয়েছে। কিন্তু দেখা গেল, সেখানে গ্যাস মেলে না। তাই রাজধানীর কাছে নতুন নতুন শিল্প গড়ে তুলতে হচ্ছে। এর পরও সমস্যা থেকে যাচ্ছে। গাজীপুর এলাকায় কর্মরত বিশেষজ্ঞ-পেশাজীবীরা পরিবার রাখেন ঢাকায়। তাদের যাতায়াতে প্রতিদিন চলে যায় কয়েক ঘণ্টা। এ ধরনের সমস্যা প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে। ঢাকার বাইরে নাগরিক সুবিধা বাড়ানো সম্ভব হলে তা কিন্তু শিল্পায়নেও অবদান রাখতে পারবে।
শিল্প খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে আমাদের অবকাঠামো সুবিধা বাড়াতেই হবে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমি বিশেষভাবে রেলপথের উন্নয়নে জোর দিতে চাই। আমাদের শুল্ক ও করনীতি যুগোপযোগী এবং তা দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে একটি সমস্যা রয়েছে_ যারা বেশি কর দেয় তাদের প্রতি চাপ বাড়িয়ে চলার মনোভাব। এর পরিবর্তে কর নেটওয়ার্ক বাড়াতে মনোযোগী হতে হবে। আমাদের উদ্যোক্তাদের বিদেশে শিল্প স্থাপনের জন্যও অনুমতি দিতে হবে। একসময় মনে করা হতো, এভাবে পুঁজি দেশের বাইরে চলে যাবে। কিন্তু বর্তমানে অ্যান্টি মানি লন্ডারিং আইনসহ অনেক কঠিন আইন রয়েছে। তা ছাড়া আমাদের তরুণ প্রজন্ম তো দেশকে গড়ে তুলতে চায়। তারা কেন দেশের বাইরে অকারণে অর্থ
সরিয়ে নেবে?
আমাদের এ প্রজন্ম তাদের শ্রমে-সৃজনে, স্বপ্ন ও সাধনায় দেশকে শিল্প-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ করে তুলবেই।
তপন চৌধুরী : এমডি, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ও স্কয়ার টেক্সটাইলস এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
পাকিস্তান আমলে শিল্প-বাণিজ্যের যে কোনো উদ্যোগের জন্য আমাদের যেতে হতো করাচি কিংবা লাহোর-পিন্ডিতে। স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় অর্জন যদি বলতে হয় তো এ বিষয়টিই আমি উল্লেখ করব। আমরা নিজেদের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করছি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নও করছি আমরাই। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের কথাই ধরা যাক। স্বাধীনতার পরপরই আমরা জনসন-জনসন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে কাজ শুরু করি। খ্যাতিমান এ কোম্পানি আমাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়। এটাই ছিল ওষুধ শিল্পের জন্য ব্রেক-থ্রু। আরও কয়েকটি কোম্পানি এভাবে ওষুধ উৎপাদন শুরু করে। শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করায় উদ্যোক্তারা যখন ট্রেডিংয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়ছিল, তখন আমরা সাহস করে এগিয়ে যাই। সে সময়ে ইনডেনটিং ব্যবসা ছিল জমজমাট। বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশের বাজারে বিক্রি, এটাই ছিল তাদের কাজ। এ কাজে যুক্তদের ব্রিফকেস ব্যবসায়ীও বলা হতো। এ জন্য জমি দরকার নেই, অফিসভর্তি কর্মীর দেখা মিলবে না। কেবল একটি ব্রিফকেসে কিছু দরকারি কাগজ আর সিল ও প্যাড থাকলেই হলো। ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতি এ খাতের বিকাশের জন্য অনন্য সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। কয়েকটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এ সময়ে মূলধন দেশের বাইরে নিয়ে যায়। কিন্তু তাদের স্থান দেশীয় উদ্যোক্তারা পূরণ করে ফেলে। চিকিৎসকদের মনোভাবেও পরিবর্তন আসে। একসময় তাদের অনেকের ধারণা ছিল, মানসম্পন্ন ওষুধ কেবল বহুজাতিক কোম্পানিই তৈরি করতে পারে।
আশির দশকের শুরুতেই আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষণীয়। একটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানা থেকে বেশকিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান মূল মালিকদের কাছে হস্তান্তর কিংবা অন্য উদ্যোক্তাদের কাছে বিক্রয়। দ্বিতীয়ত, তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যুদয়। সাবেক সচিব নুরুল কাদের বিশ্ববাজারের জন্য পোশাক উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের বিষয়ে একদল লোককে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনেন। সরকারও এ শিল্পের বিকাশের জন্য ব্যাক টু ব্যাক এলসির অনুমোদনসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কয়েক বছরের মধ্যেই তৈরি পোশাক শিল্প দাঁড়িয়ে যায়। একদিকে লাখ লাখ শ্রমিক এ কাজে যুক্ত হয়, পাশাপাশি সহায়ক শিল্প গড়ে উঠতে থাকে। পোশাক শিল্পের প্রয়োজনেই বস্ত্র শিল্প বিকশিত হতে থাকে।
চামড়া শিল্পের বিকাশও আমরা এ সময়ে লক্ষ্য করি। এক সময়ে কাঁচা চামড়া তেমন প্রসেস না করেই রফতানি করা হতো। এর পরিবর্তে চামড়া প্রসেস করার জন্য কয়েকটি কারখানা গড়ে ওঠে। চামড়াজাত পণ্য রফতানির জন্যও প্রতিষ্ঠিত হয় আধুনিক মানের কারখানা। বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র বাড়তে থাকায় সৃষ্টি হয় নতুন সম্ভাবনা।
গত চার দশকে তরুণসমাজের মানসিকতায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। বছরের পর বছর শিক্ষিত তরুণদের ধ্যান-জ্ঞানে ছিল একটি চাকরি। সচিবালয়ে এমনকি কেরানির চাকরি পেলেও জীবনের বড় লক্ষ্য অর্জিত হয়ে গেছে বলে মনে করা হতো। আর ক্যাডার সার্ভিসে যোগদান করতে পারলে তো কথাই নেই। কিন্তু এখন তরুণরা ইনডেনটিংয়ের বাইরেও নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার শুধু স্বপ্ন দেখে না, বাস্তবায়নও করে। এমন লোকেরও দেখা মিলবে যারা চিকিৎসক ও প্রকৌশলীর পেশা ছেড়ে কলকারখানা গড়ে তোলায় উদ্যোগী হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে পড়াশোনা করে দেশে ফিরে এসেও অনেকে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। তারা একই সঙ্গে দেশে নিয়ে আসছে প্রযুক্তি এবং বাজার সংযোগ। ব্যবসা করে ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশে জীবন কাটানো নয়, বরং দেশকে সমৃদ্ধ করা এবং অনেক অনেক মানুষের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি করায় অবদান রাখাকে জীবনের মিশন হিসেবে তারা বেছে নেয়। যুগের চাহিদার সঙ্গেও তারা তাল মেলাতে থাকে। তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রথমদিকে কারখানার পরিবেশ মানসম্মত করাসহ কমপ্লায়েন্সের বিষয়গুলোতে আমাদের অনেক উদ্যোক্তার অস্বস্তি ছিল। উৎপাদন হলেই হলো, এর পেছনের কর্মীদের নিয়ে তেমন মাথাব্যথায় রাজি হতে চাইত না। কিন্তু এখন তারা বুঝতে পারছে, শ্রমিকরা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। তাদের জন্য ভালো পরিবেশ নিশ্চিত হলে কেবল বিশ্ববাজারে আমাদের পোশাকের ক্রেতারাই সন্তুষ্ট থাকে না, নিজের প্রতিষ্ঠানেও উৎপাদন বাড়ে। এ বিষয়টিকে আমি উইন উইন অবস্থা বলতে পারি। শ্রমিকদের কাজের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি এবং সময়মতো তাদের হাতে বেতন-ভাতার অর্থ তুলে দেওয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের স্কয়ার স্পিনিংয়ের একটি অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে বলতে পারি। প্রথমদিকে এ কারখানার ডিজাইনে কিছুটা ত্রুটি থাকায় কাজের সময় অত্যধিক গরম লাগত। এতে শ্রমিকদের কাজে সমস্যা হতো। অজ্ঞান হয়ে পড়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। অস্বস্তিকর পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য স্যালাইন রাখতে হয়েছে। কিন্তু আমরা কারখানার ডিজাইন বদলে ফেলি এবং এতে বাড়তি অর্থ ব্যয় হয়। কিন্তু নতুন পরিবেশে উৎপাদন বেড়ে যায় এমন মাত্রায়, যার ফলে মাত্র দুই বছরের মধ্যেই আমরা বিনিয়োগের অর্থ তুলে ফেলতে পারি। আমাদের গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুপুরে শ্রমিকদের খাবার সরবরাহ করা হয়। কাজের গুণ-মানে এর ইতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। মূল কথা হচ্ছে, উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য যে শ্রমশক্তি তাকে সন্তুষ্ট রাখা চাই। গত কয়েক বছরে উদ্যোক্তাদের অনেকেই এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেছেন।
এখন বাংলাদেশের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয় এমনকি তৃতীয় প্রজন্মের উদ্যোক্তারা পরিচালনা করছেন। তাদের মানসিকতা আধুনিক ও উদার। প্রযুক্তির ব্যবহারেও তারা এগিয়ে। বিশ্ববাজারে নিজের যোগ্যতায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তারা ক্রমেই সংকল্পবদ্ধ হয়ে উঠছে। কেবল সরকারের কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণ নয়, সমস্যা সমাধানে নিজেদের করণীয় বিষয়েও তারা সচেতন। একসময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং শিল্প ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে উদ্যোক্তাদের বৈঠকে মূল ইস্যু থাকত সরকারের কাছ থেকে শুল্ক ও ট্যারিফ সুবিধা আদায়। এখন এজেন্ডায় পরিবর্তন এসেছে। পার্টনারশিপ গুরুত্ব পাচ্ছে। এ নতুন প্রজন্ম জানে যে, সরকারের কোষাগারে তাদের অর্থের জোগান যত বাড়বে, অবকাঠামো এবং অন্যান্য সুবিধা সৃষ্টির জন্য বিনিয়োগ তত বাড়ানো সম্ভব হবে। একসময় বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরতা ছিল ব্যাপক। এখন উদ্যোক্তারা এ বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসার ক্ষেত্রে নিজেদের করণীয় বুঝতে শুরু করেছেন। আমাদের কৃষক ও ক্ষেতমজুররা খাদ্যে দেশকে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলেছেন। এ অর্জন না হলে কেবল মানুষের মুখের গ্রাস নিশ্চিত করতে কত অর্থই না ব্যয় করতে হতো। শিল্প উদ্যোক্তারাও কৃষকদের স্বার্থের দিকটি বুঝতে পারছে। এখন গ্রীষ্মকালে বোরো ধান চাষের জন্য শহর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে গ্রামে দেওয়া হয় এবং এটা মেনে নেওয়ার মানসিকতা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। রাসায়নিক সারেও সরকার ভর্তুকি দেয়। আমাদের বিদ্যুৎ-গ্যাস খাতে সমস্যা রয়েছে। যাতায়াতেও বিঘ্ন অনেক। এসব সমস্যা কেবল সরকার একা সমাধান করতে পারবে না। স্বল্প মেয়াদেও সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। রাতারাতি একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা যায় না। গ্যাসের উৎপাদনও চাইলেই বাড়ানো যায় না। সরকার বেসরকারি মালিকদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনে নিয়ে সরবরাহ করছে। প্রতি ইউনিট সরকার কিনছে ১২ থেকে ১৪ টাকায়। কিন্তু বিক্রি করা হচ্ছে চার ভাগের এক ভাগ দামে। কতদিন এ অবস্থা চলবে? একসময় উদ্যোক্তারা সরকারি ভর্তুকি পেলেই খুশি থাকত। কিন্তু এখন তারাও বাস্তবতা উপলব্ধি করছে। সরকার এক খাতে ভর্তুকি দিলে অন্য খাতে বিনিয়োগে পিছিয়ে পড়বে এবং হয়তো দেখা যাবে যে এর ফলে এক বা একাধিক জরুরি খাতে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে এসব অবকাঠামোগত সমস্যা সমাধানে বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও অবদান রাখা চাই এবং তাতে লাভের পাশাপাশি সার্বিক জাতীয় স্বার্থকেও গুরুত্ব দিতে হবে। এক কথায় বলতে পারি, তাদেরও দেশের সামর্থ্য তৈরি করে দিতে অবদান রাখতে হবে। এটাই তো সরকারি-বেসরকারি পার্টনারশিপ। কেবল বিদেশ থেকে সাহায্য এনে দেশকে স্বনির্ভর করা যায়নি, যাবেও না।
বাংলাদেশের শিল্প খাতের জন্য নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে চীন ও ভারতের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এ দুটি দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পণ্য বাংলাদেশে আসে এবং এ তুলনায় আমাদের রফতানি সামান্য। তাদের সঙ্গে বাণিজ্যে ভারসাম্য আনা সম্ভব নয়, কাম্যও হবে না। কারণ আমাদের নিজস্ব শিল্পের জন্য তাদের কাছ থেকে প্রচুর কাঁচামাল আমদানি করা হয় এবং এর একটি অংশ প্রসেস করে অন্যান্য দেশে রফতানি করা হয়। আমাদের শিল্প খাতের উৎপাদন ভাণ্ডারও এমন সমৃদ্ধ নয় যে তাদের বাজারে বড় আকারে প্রবেশ করতে পারব। তবে দুটি দেশকেই আমাদের অর্থনীতির বিকাশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। চীনের কিছু কারখানা বাংলাদেশে স্থানান্তর করারও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের কাছাকাছি এলাকায় চীনের যে ভূখণ্ড রয়েছে তা আমাদের কয়েক ধরনের রফতানি পণ্যের গন্তব্য হতে পারে। অন্যদিকে ভারতের সর্বত্র হতে পারে বাংলাদেশের জন্য বাজার। বিশেষ সম্ভাবনা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে। এ ক্ষেত্রে শুল্ক ও শুল্কবহির্ভূত কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টিই কাম্য হবে না। কারণ আমরা চাইলেও ভারতের বাজারে বড় আকারে প্রবেশ করতে পারব না।
আমাদের দেশে শ্রম সস্তা_ এভাবে বলা ঠিক হবে না। এতে করে শ্রমিকদের অবমূল্যায়ন করা হয়। আমাদের একটি শক্তির দিক রয়েছে এবং তা কাজে লাগাতে হবে। অনেক উন্নয়নশীল দেশের শ্রমিকদের বড় অংশকে দেখা যায় কারখানা থেকে ঘরে না ফিরে পা বাড়ায় শুঁড়িখানায়। অন্যদিকে আমাদের সংস্কৃতিই তাদের টেনে নেয় গৃহকোণে। এটি হচ্ছে আমাদের শক্তির দিক এবং উৎপাদন বাড়াতে তা কাজে লাগাতে হবে। আমাদের মূলত এক ভাষাভাষী দেশ। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতা ও সহমর্মিতার মনোভাব রয়েছে। আমাদের নারী শ্রমিকরা তৈরি শিল্পে চমকপ্রদ কর্মক্ষমতা প্রদর্শন করে চলেছে। এ ক্ষমতা আরও বাড়ানো যায়। একই সঙ্গে তাদের কাজের পরিবেশ উন্নত করে তোলা এবং বেতন ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করার প্রতি মনোযোগী হতে হবে।
শিল্প খাতে আমাদের বড় সম্ভাবনা রয়েছে বস্ত্র খাতে। তুলা আমদানিতে সম্পূর্ণ পরনির্ভরতার পরও এ সুযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি। এখানে কম্পোজিট মিল গড়ে উঠছে এবং বিদেশি ক্রেতারা এক স্থানে সব ইউনিট পাওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়। চীন এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে তাদের কিছু কারখানা স্থানান্তর করতে পারে। ওষুধ শিল্প সম্ভাবনাময়। দেশের চাহিদার ৯৭ শতাংশ স্থানীয় প্রতিষ্ঠান জোগান দেয়। স্বাধীনতার পরপর স্কয়ার মাত্র কয়েক লাখ টাকার ওষুধ উৎপাদন করত। এখন তা দেড় হাজার কোটি টাকায় পেঁৗছেছে। বিশ্ববাজারেও বাংলাদেশের ওষুধের চাহিদা রয়েছে। স্কয়ার ও বেক্সিমকোসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এখন দেশেই অনেক ধরনের ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন করছে। চামড়া এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতও সম্ভাবনাময়। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প শুধু দেশের চাহিদা পূরণ করছে না, বহির্বিশ্বেও বাজার দখল করতে পারে।
আমাদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা রাজধানীকেন্দ্রিকতা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা এবং নানা ধরনের নাগরিক সুবিধা ঢাকায় বেশি। এ কারণে এখানে বসবাসের প্রতি আগ্রহ অনেকের। স্কয়ার গ্রুপ বহু বছর পাবনাকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হতে চেয়েছে। কিন্তু দেখা গেল, সেখানে গ্যাস মেলে না। তাই রাজধানীর কাছে নতুন নতুন শিল্প গড়ে তুলতে হচ্ছে। এর পরও সমস্যা থেকে যাচ্ছে। গাজীপুর এলাকায় কর্মরত বিশেষজ্ঞ-পেশাজীবীরা পরিবার রাখেন ঢাকায়। তাদের যাতায়াতে প্রতিদিন চলে যায় কয়েক ঘণ্টা। এ ধরনের সমস্যা প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে। ঢাকার বাইরে নাগরিক সুবিধা বাড়ানো সম্ভব হলে তা কিন্তু শিল্পায়নেও অবদান রাখতে পারবে।
শিল্প খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে আমাদের অবকাঠামো সুবিধা বাড়াতেই হবে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমি বিশেষভাবে রেলপথের উন্নয়নে জোর দিতে চাই। আমাদের শুল্ক ও করনীতি যুগোপযোগী এবং তা দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে একটি সমস্যা রয়েছে_ যারা বেশি কর দেয় তাদের প্রতি চাপ বাড়িয়ে চলার মনোভাব। এর পরিবর্তে কর নেটওয়ার্ক বাড়াতে মনোযোগী হতে হবে। আমাদের উদ্যোক্তাদের বিদেশে শিল্প স্থাপনের জন্যও অনুমতি দিতে হবে। একসময় মনে করা হতো, এভাবে পুঁজি দেশের বাইরে চলে যাবে। কিন্তু বর্তমানে অ্যান্টি মানি লন্ডারিং আইনসহ অনেক কঠিন আইন রয়েছে। তা ছাড়া আমাদের তরুণ প্রজন্ম তো দেশকে গড়ে তুলতে চায়। তারা কেন দেশের বাইরে অকারণে অর্থ
সরিয়ে নেবে?
আমাদের এ প্রজন্ম তাদের শ্রমে-সৃজনে, স্বপ্ন ও সাধনায় দেশকে শিল্প-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ করে তুলবেই।
তপন চৌধুরী : এমডি, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ও স্কয়ার টেক্সটাইলস এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments