কালের আয়নায়-ছয় দফা দেওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু কি তৃতীয় সারির নেতা ছিলেন? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ঢাকার এক সাংবাদিক বন্ধু (যিনি নিজেও কলামিস্ট) আমাকে কয়েকদিন ধরেই টেলিফোনে প্রশ্ন রাখছেন, দেশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে অনভিপ্রেত বিতর্কটি সৃষ্টি করা হয়েছে, সে সম্পর্কে আপনি নীরব কেন? আমি তাকে বলেছি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে কোনো উদ্দেশ্যেই বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা এখন অহেতুক এবং অনর্থক।
ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে এমন একটি স্থানে প্রতিষ্ঠাদান করেছে, সেখান থেকে তার অবস্থান নড়ানো অসম্ভব। একমাত্র মূর্খরাই এই চেষ্টা চালাতে পারে।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট বন্ধুকে আরও একটি কথা বলেছি, প্রত্যেক সভ্য এবং আত্মমর্যাদাসচেতন জাতিরই ঐক্য ও সংহতির একটা সূত্র থাকে। সেই সূত্রটি হচ্ছে, তার জাতীয় স্বাধীনতা এবং সেই স্বাধীনতার স্থপতি বা স্থপতিরা। তাই এই দুটি সূত্রকে অধিকাংশ জাতি বিতর্কের ঊধর্ে্ব রাখে অথবা রাখার চেষ্টা করে। আমেরিকায় আব্রাহাম লিঙ্কন অবশ্যই দলীয় নেতা ছিলেন। ভারতেও মহাত্মা গান্ধী ছিলেন দলীয় (কংগ্রেস) নেতা। কিন্তু তারা আজ দলীয় পরিচয়ের ঊধর্ে্ব জাতীয় স্বাধীনতার স্থপতি। তাদের পরিচয় ও মর্যাদা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না।
সম্ভবত এর একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। বাঙালির স্বাধীনতা, স্বাধীনতার স্থপতি, স্বাধীনতার মৌল আদর্শ এমনকি তার জাতীয় পরিচয় সবকিছুই বিতর্কিত। এ জন্যই হয়তো দার্শনিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিকে বলেছেন, 'আত্মঘাতী বাঙালি।' এর চেয়ে সঠিক পরিচয় বাঙালির আর কিছু নেই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের শত্রুরা যখন তাদের অশুভ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বঙ্গবন্ধুর ওপর আক্রমণ চালায় কিংবা তাকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করে, তখন বিস্মিত হই না। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদকে ঠেকানোর জন্য পশ্চিমা ধনবাদী বিশ্ব এখনও মার্কস, লেনিন, মাও জে দং প্রমুখ মনীষী ও নেতাদের চরিত্র হননের কাজটি অনবরত করে চলেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুরা এই স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ও আদর্শকে হত্যার জন্য তার স্থপতির চরিত্র হননের চেষ্টা আরও বহুকাল চালাবে, তাতে বিস্ময়ের কী আছে? কিন্তু যখন দেখি, বঙ্গবন্ধুর এবং তার আদর্শের অনুসারীদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি কোনো কারণে আওয়ামী লীগের ওপর রাগ, আওয়ামী শীর্ষ নেতাদের ওপর বিরাগ অথবা স্বাধীনতার শত্রুশিবিরের কাছ থেকে বাহবা বা হাততালি পাওয়ার লোভে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে বঙ্গবন্ধুর চরিত্র হননের চেষ্টা করেন, তখন দুঃখ পাই। হতাশ হয়ে ভাবি, 'আত্মঘাতী বাঙালি' এই পরিচয় থেকে আমাদের কি কোনোদিন মুক্তি নেই?
ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রস্তাব ঘোষণার আগে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় শ্রেণীর অথবা তৃতীয় সারির নেতা ছিলেন এ কথাটি বলার এখন কি সময় অথবা কোনো প্রয়োজন আছে? যদি বক্তব্যটি সঠিকও হতো, তাহলেও বঙ্গবন্ধুর খাঁটি অনুসারী বলে যারা নিজেদের দাবি করেন, তাদের মুখে (বঙ্গবন্ধুর শত্রুপক্ষও যে কথাটি কখনও বলেনি) এ কথাটি উচ্চারিত হওয়া কি শোভন ও সঙ্গত হয়েছে? আর এই বক্তব্যটি তো সঠিকও নয়। বরং ইতিহাস-বিকৃতি।
পৃথিবীতে কোনো নেতাই মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েই প্রথম শ্রেণীর নেতা হননি। তারা সাধনার বলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। গান্ধী ব্যারিস্টার হয়েও প্রথম কোর্টে দাঁড়িয়ে কোনো কথা বলতে পারেননি। ভিরমি খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। নেহরু ব্যারিস্টার হয়েও জীবনে কোনোদিন গাউন পরেননি, কোর্টে যাননি। আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের বিচারের সময় উকিলের গাউন পরে জীবনে প্রথম কোর্টে গিয়েছিলেন। এ জন্য গান্ধী বা নেহরুকে পরবর্তীকালে তাদের শত্রুপক্ষও তৃতীয় শ্রেণীর বা তৃতীয় সারির ব্যারিস্টার বলে অকারণে, অপ্রয়োজনে নিন্দা ও সমালোচনা করার সুযোগ গ্রহণ করেননি।
আবার বিশ্বে এমন কিছু নর ও নারী দেখা গেছে, যাদের ভেতর কিশোর বয়স থেকেই ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বগুণের বিকাশ দেখা গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রান্সের জোয়ান অব আর্ক, ব্রিটেনের জুনিয়র পিট, ভারত উপমহাদেশের বাঘা যতীন, সুভাষ বসু, বিপ্লবী ক্ষুদিরাম প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গোপালগঞ্জের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের স্কুলেই তার শিক্ষাজীবনের শুরু। কিন্তু স্কুলের চৌকাঠ পেরোবার আগেই তার মধ্যে নেতৃত্বগুণের বিকাশ দেখা দেয়, যা তাকে প্রাক্-যৌবনেই একজন প্রথম শ্রেণীর নেতায় পরিণত করার দিকে এগিয়ে দিয়েছিল।
নইলে স্কুলের ছাত্র থাকাকালেই তিনি এলাকার ঋণগ্রস্ত গরিব চাষিদের পক্ষ নিয়ে প্রতাপশালী সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারতেন না। পরাক্রমশালী তৎকালীন নেতা ওয়াহিদুজ্জামান ঠাণ্ডা মিয়ার গণবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারতেন না। প্রধানমন্ত্রী হক সাহেব (শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সহ) গোপালগঞ্জ সফরে এলে ছাত্রদের জন্য একটি হোস্টেল নির্মাণের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে পুলিশের লাঠির সামনে সেই সভামঞ্চ অবরোধ করতে পারতেন না। সেই কিশোর বয়সেই জেল গমন করতে পারতেন না।
গোপালগঞ্জের ওই সভাতেই তৎকালীন হক মন্ত্রিসভার সদস্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী এই কিশোরের চোখে-মুখে সাহস ও নেতৃত্বগুণ দেখে মুগ্ধ হন এবং তাকে কলকাতায় এসে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আমন্ত্রণ জানান।
এভাবেই ভবিষ্যতের রাজনৈতিক গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের সূচনা। ওই ছাত্র বয়সেই চোখের অসুখের চিকিৎসার জন্য তাকে কলকাতায় পাঠানো হলে আর দশজন সাধারণ কিশোরের মতো সিনেমা, থিয়েটার দেখে বা ভিক্টোরিয়া মনুমেন্ট, মোহামেডান_মোহনবাগান টিমের ফুটবল খেলা দেখে সময় কাটাননি। তিনি নবাব সিরাজউদৌল্লার চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের জন্য ইংরেজ শাসকরা কলকাতায় হলওয়েল মনুমেন্ট তৈরি করেছিলেন, তা ভাঙার জন্য সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে যে আন্দোলন ও মিছিল হয় তাতে যোগ দেন। জানা যায়, এই মনুমেন্ট ভাঙার মিছিলে যে মুষ্টিমেয় মুসলিম ছাত্র যোগ দিয়েছিল, তিনি তাদের নেতৃত্ব দেন।
১৯৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যুতে সারা ভারতে যে সাধারণ নির্বাচন হয়, সে সময় অবিভক্ত বাংলাদেশে মুসলিম লীগকে জয়ী করানোর জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী যে ঝটিকা সফর করেন, তখন তার পাশে ডান হাত হিসেবে ছিলেন শেখ মুজিব। এই নির্বাচনের পর মুসলিম লীগে হাশিম-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যে প্রগতিশীল অংশ গড়ে ওঠে, তার ছাত্র সমর্থক অংশের প্রধান নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৪৬ সালে কলকাতা, নোয়াখালী, বিহারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর এই দাঙ্গা বন্ধ করার জন্য কলকাতার বেলেঘাটার বাড়িতে মহাত্মা গান্ধী যে আমরণ অনশন শুরু করেন, তখন প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী (তখন অবিভক্ত বাংলার সরকারপ্রধানকে মুখ্যমন্ত্রীর বদলে প্রধানমন্ত্রী বলা হতো) হিসেবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী গান্ধীজির এই অনশন ভাঙানোর জন্য বেলেঘাটায় গমন করলে সঙ্গে নেন তরুণ শেখ মুজিবকে। আর কোনো প্রবীণ বা নতুন নেতাকে নয়।
ছেচলি্লশের ভয়াবহ বিহার দাঙ্গার পর লাখ লাখ বিহারি মুসলমান বাস্তুচ্যুত হলে অবিভক্ত বাংলার কয়েকটি স্থানে 'মোহাজের ক্যাম্প' প্রতিষ্ঠা করে তাতে এই বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়দানের জন্য মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ডের যে স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপ শহীদ সোহরাওয়ার্দী গঠন করেন এবং বিহারে প্রেরণ করেন, তাতে নেতৃত্বদানের জন্য মনোনীত করেন তরুণ বয়সী শেখ মুজিবকে। সাতচলি্লশ সালে দেশভাগের পর সদ্য প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানে খাজা নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী নেতৃত্ব থেকে বিতাড়িত হন এবং তার গ্রুপের প্রবীণ নেতা বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, আবদুল মালেক (পরবর্তীকালে ঠেডা মালেক), টি আলী প্রমুখ মন্ত্রিত্বের লোভে নাজিমুদ্দীন গ্রুপে গিয়ে যোগ দেন।
তখন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় তার আরেক প্রিয় শিষ্য এককালের ছাত্রনেতা নুরুদ্দিন আহমদের কাছে লেখা এক চিঠিতে (চিঠিটা পরে ১৯৪৯ সালে কারকুন বাড়ি লেন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের ১১ জুনের সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়) বলেন, 'আমি পূর্ববঙ্গ সম্পর্কে আশা হারাইনি। আমার কিছু প্রবীণ বন্ধু আমাদের ত্যাগ করলেও তোমরা এখনও আছো। বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমান আছে। তার কিশোর বয়সেই আমি দেখেছি, তার মধ্যে প্রথম শ্রেণীর নেতৃত্বগুণ রয়েছে। যে কোনো প্রলোভনের মুখে বা নির্যাতনের ভয়ে নীতিচ্যুত হবে না।'
শহীদ সোহরাওয়ার্দীর এই আশাবাদ শেখ মুজিব পূর্ণ করেছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় বছরেই মুসলিম লীগবিরোধী গণতান্ত্রিক কর্মী শিবির শেখ মুজিব এবং তার সমমনা যুব নেতাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে। শাহ আজিজুর রহমানের সরকারের পোঁ-ধরা ছাত্রলীগের পাল্টা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে প্রগতিশীল ছাত্রলীগ গড়ে ওঠে। মওলানা ভাসানীকে মুসলিম লীগ থেকে বের করে এনে তার নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তখনকার যুব নেতৃত্ব, যার প্রথম সারির নেতা ছিলেন শেখ মুজিব।
ছয় দফা আন্দোলনের আগে শেখ মুজিব তৃতীয় সারির নেতা ছিলেন, এ কথা বলা বালখিল্যতা। তাহলে তখন প্রথম সারির নেতা কে ছিলেন? ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী না আর কেউ? ফজলুল হক ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হয় ষাটের দশকের গোড়ায়, ছয় দফার আন্দোলন শুরু হওয়ার বেশ কিছুকাল আগে। ছয় দফার আন্দোলনের শুরু ১৯৬৬ সালে। তখন মওলানা ভাসানী তার দলের যাদু মিয়া, আনোয়ার জাহিদদের পাল্লায় পড়ে আইয়ুব খানের ফৌজি শাসনের সমর্থনে ভিড়ে গেছেন। তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রথম সারির নেতৃত্বের স্থানটি কি ষাটের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত শূন্য ছিল? না, শেখ মুজিব বহু আগে সেটি পূর্ণ করেছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তো শেখ মুজিব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন আদায়ের আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামের পুরোধা নেতা। ছয় দফা আন্দোলনের পর তাকে প্রথম সারির নেতা হতে হবে কেন? ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কি তার ঐতিহাসিক চৌদ্দ দফা দাবি ঘোষণার পর ভারতীয় মুসলমানদের প্রধান নেতায় পরিণত হয়েছিলেন, না তার বহু পূর্বে হয়েছিলেন? গান্ধী তাকে 'কায়েদে আজম' (মৎবধঃ ষবধফবৎ) এই খেতাব দিতে বাধ্য হয়েছিলেন কেন?
পাকিস্তান হওয়ার পর ১৯৪৮ সালেই দেখা যায় শেখ মুজিবকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের পুরোভাগে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তার নেতৃত্ব না থাকলে পরের বছর ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকায় ছাত্র-জনতার যে বিশাল শোভাযাত্রা হয়, তার পুরোভাগে মওলানা ভাসানীর পাশে দাঁড়িয়ে তাকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যেত না। ভাষা আন্দোলনে যাতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী সমর্থন দেন, আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িকীকরণ ও স্বতন্ত্র নির্বাচনের বদলে যুক্ত নির্বাচন প্রবর্তনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আওয়ামী লীগ সম্মত হয় সে জন্য শেখ মুজিবকেই নেতা ও দলের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে হয়েছিল। মওলানা ভাসানী একার চেষ্টায় পেরে উঠছিলেন না।
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে শেখ মুজিব তখনই প্রথম সারির নেতা হিসেবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হন। ছয় দফার আন্দোলন তাকে প্রথম সারির নেতা থেকে বাংলায় অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি জাতির জনকে পরিণত হন। কোনো নেতৃত্বের এই ঐতিহাসিক বাঁকগুলো ধরতে ও বুঝতে না পারলে কারোই উচিত নয় ইতিহাস-বিশ্লেষক সাজা, তিনি যত প্রবীণ ব্যক্তিই হোন না কেন?
একটা ঘটনার কথা বলি। ঘটনাটি লিখেছেন অন্নদাশঙ্কর রায় তার এক স্মৃতিচারণে। এই লেখাটি বহু পূর্বে প্রকাশিত এবং আমার হাতের কাছে নেই বলে তার কথার হুবহু উদ্ধৃতি দিতে পারছি না। তবে তার বক্তব্য অবিকল তুলে ধরছি। ষাটের দশকের গোড়ার কথা। অন্নদাশঙ্কর রায় সম্ভবত দিলি্ল থেকে বিমানে লন্ডনে বা ইউরোপের কোনো দেশে যাচ্ছিলেন। ওই প্লেনে তার সহযাত্রী ছিলেন ঢাকার সদরি ইস্পাহানি। ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে ইস্পাহানিদের নাম কে না জানে?
অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে সদরির পূর্ব পরিচয় ছিল। তারা প্লেনে পাশাপাশি আসনে বসে গল্প জুড়ে দিলেন। তখন হক সাহেব ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রয়াত হয়েছেন। অন্নদাশঙ্কর রায় হতাশা প্রকাশ করে সদরি ইস্পাহানিকে বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম সারির নেতা কেউ আর রইলেন না। দেশটিতে গণতন্ত্র যদি ফিরেও আসে, পূর্ব পাকিস্তানে যোগ্য মুখ্যমন্ত্রীই-বা কে হবেন? আতাউর রহমান খান তো তেমন যোগ্যতা দেখাতে পারেননি। সদরি ইস্পাহানি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়েছেন, কেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নাম আপনি জানেন না? বয়সে তরুণ, কিন্তু প্রথম শ্রেণীর বাঙালি নেতা। তিনি শুধু পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের মন্তব্য, 'পরে বুঝেছি, সদরি ইস্পাহানি আমার কাছে অত্যুক্তি করেননি।' তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তিনি লিখেছিলেন, 'যতোকাল রবে পদ্মা মেঘনা গৌরি যমুনা বহমান, ততোকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।'
পাকিস্তানের প্রথম ফৌজি শাসক আইয়ুব খান পাকিস্তানের রাজনীতিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চেয়েও তার 'ভয়ঙ্কর শত্রু' হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে বেছে নিয়েছিলেন, আর কোনো তথাকথিত প্রথম সারির নেতাকে নয়। বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশেই তিনি বলেছিলেন, 'আমি অস্ত্রের ভাষায় (ষধহমঁধমব ড়ভ বিধঢ়ড়হ) তার সঙ্গে কথা বলব।' পাকিস্তানের আর কোনো জাঁদরেল নেতাকেও এই হুমকি তিনি দেননি। বাংলাদেশের যে নেতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কবিতা লিখেছেন এশিয়া ও আফ্রিকার অনূ্যন এক ডজন কবি, বিবিসির জনমত সমীক্ষায় যাকে বলা হয়েছে 'শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি', তিনি ছয় দফা প্রস্তাব দেওয়ার আগে কেউ যদি বলেন, এই প্রস্তাব দেওয়ার আগে তিনি তৃতীয় সারির নেতা ছিলেন, তা শুধু তার বা তাদের অজ্ঞানতা ও ভ্রান্তি নয়, নিজেদের হীনম্মন্যতাবোধও।
লন্ডন, ১ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার, ২০১৩
সাংবাদিক ও কলামিস্ট বন্ধুকে আরও একটি কথা বলেছি, প্রত্যেক সভ্য এবং আত্মমর্যাদাসচেতন জাতিরই ঐক্য ও সংহতির একটা সূত্র থাকে। সেই সূত্রটি হচ্ছে, তার জাতীয় স্বাধীনতা এবং সেই স্বাধীনতার স্থপতি বা স্থপতিরা। তাই এই দুটি সূত্রকে অধিকাংশ জাতি বিতর্কের ঊধর্ে্ব রাখে অথবা রাখার চেষ্টা করে। আমেরিকায় আব্রাহাম লিঙ্কন অবশ্যই দলীয় নেতা ছিলেন। ভারতেও মহাত্মা গান্ধী ছিলেন দলীয় (কংগ্রেস) নেতা। কিন্তু তারা আজ দলীয় পরিচয়ের ঊধর্ে্ব জাতীয় স্বাধীনতার স্থপতি। তাদের পরিচয় ও মর্যাদা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না।
সম্ভবত এর একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। বাঙালির স্বাধীনতা, স্বাধীনতার স্থপতি, স্বাধীনতার মৌল আদর্শ এমনকি তার জাতীয় পরিচয় সবকিছুই বিতর্কিত। এ জন্যই হয়তো দার্শনিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিকে বলেছেন, 'আত্মঘাতী বাঙালি।' এর চেয়ে সঠিক পরিচয় বাঙালির আর কিছু নেই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের শত্রুরা যখন তাদের অশুভ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বঙ্গবন্ধুর ওপর আক্রমণ চালায় কিংবা তাকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করে, তখন বিস্মিত হই না। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদকে ঠেকানোর জন্য পশ্চিমা ধনবাদী বিশ্ব এখনও মার্কস, লেনিন, মাও জে দং প্রমুখ মনীষী ও নেতাদের চরিত্র হননের কাজটি অনবরত করে চলেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুরা এই স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ও আদর্শকে হত্যার জন্য তার স্থপতির চরিত্র হননের চেষ্টা আরও বহুকাল চালাবে, তাতে বিস্ময়ের কী আছে? কিন্তু যখন দেখি, বঙ্গবন্ধুর এবং তার আদর্শের অনুসারীদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি কোনো কারণে আওয়ামী লীগের ওপর রাগ, আওয়ামী শীর্ষ নেতাদের ওপর বিরাগ অথবা স্বাধীনতার শত্রুশিবিরের কাছ থেকে বাহবা বা হাততালি পাওয়ার লোভে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে বঙ্গবন্ধুর চরিত্র হননের চেষ্টা করেন, তখন দুঃখ পাই। হতাশ হয়ে ভাবি, 'আত্মঘাতী বাঙালি' এই পরিচয় থেকে আমাদের কি কোনোদিন মুক্তি নেই?
ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রস্তাব ঘোষণার আগে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় শ্রেণীর অথবা তৃতীয় সারির নেতা ছিলেন এ কথাটি বলার এখন কি সময় অথবা কোনো প্রয়োজন আছে? যদি বক্তব্যটি সঠিকও হতো, তাহলেও বঙ্গবন্ধুর খাঁটি অনুসারী বলে যারা নিজেদের দাবি করেন, তাদের মুখে (বঙ্গবন্ধুর শত্রুপক্ষও যে কথাটি কখনও বলেনি) এ কথাটি উচ্চারিত হওয়া কি শোভন ও সঙ্গত হয়েছে? আর এই বক্তব্যটি তো সঠিকও নয়। বরং ইতিহাস-বিকৃতি।
পৃথিবীতে কোনো নেতাই মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েই প্রথম শ্রেণীর নেতা হননি। তারা সাধনার বলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। গান্ধী ব্যারিস্টার হয়েও প্রথম কোর্টে দাঁড়িয়ে কোনো কথা বলতে পারেননি। ভিরমি খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। নেহরু ব্যারিস্টার হয়েও জীবনে কোনোদিন গাউন পরেননি, কোর্টে যাননি। আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের বিচারের সময় উকিলের গাউন পরে জীবনে প্রথম কোর্টে গিয়েছিলেন। এ জন্য গান্ধী বা নেহরুকে পরবর্তীকালে তাদের শত্রুপক্ষও তৃতীয় শ্রেণীর বা তৃতীয় সারির ব্যারিস্টার বলে অকারণে, অপ্রয়োজনে নিন্দা ও সমালোচনা করার সুযোগ গ্রহণ করেননি।
আবার বিশ্বে এমন কিছু নর ও নারী দেখা গেছে, যাদের ভেতর কিশোর বয়স থেকেই ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বগুণের বিকাশ দেখা গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রান্সের জোয়ান অব আর্ক, ব্রিটেনের জুনিয়র পিট, ভারত উপমহাদেশের বাঘা যতীন, সুভাষ বসু, বিপ্লবী ক্ষুদিরাম প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গোপালগঞ্জের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের স্কুলেই তার শিক্ষাজীবনের শুরু। কিন্তু স্কুলের চৌকাঠ পেরোবার আগেই তার মধ্যে নেতৃত্বগুণের বিকাশ দেখা দেয়, যা তাকে প্রাক্-যৌবনেই একজন প্রথম শ্রেণীর নেতায় পরিণত করার দিকে এগিয়ে দিয়েছিল।
নইলে স্কুলের ছাত্র থাকাকালেই তিনি এলাকার ঋণগ্রস্ত গরিব চাষিদের পক্ষ নিয়ে প্রতাপশালী সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারতেন না। পরাক্রমশালী তৎকালীন নেতা ওয়াহিদুজ্জামান ঠাণ্ডা মিয়ার গণবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারতেন না। প্রধানমন্ত্রী হক সাহেব (শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সহ) গোপালগঞ্জ সফরে এলে ছাত্রদের জন্য একটি হোস্টেল নির্মাণের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে পুলিশের লাঠির সামনে সেই সভামঞ্চ অবরোধ করতে পারতেন না। সেই কিশোর বয়সেই জেল গমন করতে পারতেন না।
গোপালগঞ্জের ওই সভাতেই তৎকালীন হক মন্ত্রিসভার সদস্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী এই কিশোরের চোখে-মুখে সাহস ও নেতৃত্বগুণ দেখে মুগ্ধ হন এবং তাকে কলকাতায় এসে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আমন্ত্রণ জানান।
এভাবেই ভবিষ্যতের রাজনৈতিক গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের সূচনা। ওই ছাত্র বয়সেই চোখের অসুখের চিকিৎসার জন্য তাকে কলকাতায় পাঠানো হলে আর দশজন সাধারণ কিশোরের মতো সিনেমা, থিয়েটার দেখে বা ভিক্টোরিয়া মনুমেন্ট, মোহামেডান_মোহনবাগান টিমের ফুটবল খেলা দেখে সময় কাটাননি। তিনি নবাব সিরাজউদৌল্লার চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের জন্য ইংরেজ শাসকরা কলকাতায় হলওয়েল মনুমেন্ট তৈরি করেছিলেন, তা ভাঙার জন্য সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে যে আন্দোলন ও মিছিল হয় তাতে যোগ দেন। জানা যায়, এই মনুমেন্ট ভাঙার মিছিলে যে মুষ্টিমেয় মুসলিম ছাত্র যোগ দিয়েছিল, তিনি তাদের নেতৃত্ব দেন।
১৯৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যুতে সারা ভারতে যে সাধারণ নির্বাচন হয়, সে সময় অবিভক্ত বাংলাদেশে মুসলিম লীগকে জয়ী করানোর জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী যে ঝটিকা সফর করেন, তখন তার পাশে ডান হাত হিসেবে ছিলেন শেখ মুজিব। এই নির্বাচনের পর মুসলিম লীগে হাশিম-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যে প্রগতিশীল অংশ গড়ে ওঠে, তার ছাত্র সমর্থক অংশের প্রধান নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৪৬ সালে কলকাতা, নোয়াখালী, বিহারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর এই দাঙ্গা বন্ধ করার জন্য কলকাতার বেলেঘাটার বাড়িতে মহাত্মা গান্ধী যে আমরণ অনশন শুরু করেন, তখন প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী (তখন অবিভক্ত বাংলার সরকারপ্রধানকে মুখ্যমন্ত্রীর বদলে প্রধানমন্ত্রী বলা হতো) হিসেবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী গান্ধীজির এই অনশন ভাঙানোর জন্য বেলেঘাটায় গমন করলে সঙ্গে নেন তরুণ শেখ মুজিবকে। আর কোনো প্রবীণ বা নতুন নেতাকে নয়।
ছেচলি্লশের ভয়াবহ বিহার দাঙ্গার পর লাখ লাখ বিহারি মুসলমান বাস্তুচ্যুত হলে অবিভক্ত বাংলার কয়েকটি স্থানে 'মোহাজের ক্যাম্প' প্রতিষ্ঠা করে তাতে এই বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়দানের জন্য মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ডের যে স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপ শহীদ সোহরাওয়ার্দী গঠন করেন এবং বিহারে প্রেরণ করেন, তাতে নেতৃত্বদানের জন্য মনোনীত করেন তরুণ বয়সী শেখ মুজিবকে। সাতচলি্লশ সালে দেশভাগের পর সদ্য প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানে খাজা নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী নেতৃত্ব থেকে বিতাড়িত হন এবং তার গ্রুপের প্রবীণ নেতা বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, আবদুল মালেক (পরবর্তীকালে ঠেডা মালেক), টি আলী প্রমুখ মন্ত্রিত্বের লোভে নাজিমুদ্দীন গ্রুপে গিয়ে যোগ দেন।
তখন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় তার আরেক প্রিয় শিষ্য এককালের ছাত্রনেতা নুরুদ্দিন আহমদের কাছে লেখা এক চিঠিতে (চিঠিটা পরে ১৯৪৯ সালে কারকুন বাড়ি লেন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের ১১ জুনের সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়) বলেন, 'আমি পূর্ববঙ্গ সম্পর্কে আশা হারাইনি। আমার কিছু প্রবীণ বন্ধু আমাদের ত্যাগ করলেও তোমরা এখনও আছো। বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমান আছে। তার কিশোর বয়সেই আমি দেখেছি, তার মধ্যে প্রথম শ্রেণীর নেতৃত্বগুণ রয়েছে। যে কোনো প্রলোভনের মুখে বা নির্যাতনের ভয়ে নীতিচ্যুত হবে না।'
শহীদ সোহরাওয়ার্দীর এই আশাবাদ শেখ মুজিব পূর্ণ করেছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় বছরেই মুসলিম লীগবিরোধী গণতান্ত্রিক কর্মী শিবির শেখ মুজিব এবং তার সমমনা যুব নেতাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে। শাহ আজিজুর রহমানের সরকারের পোঁ-ধরা ছাত্রলীগের পাল্টা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে প্রগতিশীল ছাত্রলীগ গড়ে ওঠে। মওলানা ভাসানীকে মুসলিম লীগ থেকে বের করে এনে তার নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তখনকার যুব নেতৃত্ব, যার প্রথম সারির নেতা ছিলেন শেখ মুজিব।
ছয় দফা আন্দোলনের আগে শেখ মুজিব তৃতীয় সারির নেতা ছিলেন, এ কথা বলা বালখিল্যতা। তাহলে তখন প্রথম সারির নেতা কে ছিলেন? ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী না আর কেউ? ফজলুল হক ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হয় ষাটের দশকের গোড়ায়, ছয় দফার আন্দোলন শুরু হওয়ার বেশ কিছুকাল আগে। ছয় দফার আন্দোলনের শুরু ১৯৬৬ সালে। তখন মওলানা ভাসানী তার দলের যাদু মিয়া, আনোয়ার জাহিদদের পাল্লায় পড়ে আইয়ুব খানের ফৌজি শাসনের সমর্থনে ভিড়ে গেছেন। তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রথম সারির নেতৃত্বের স্থানটি কি ষাটের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত শূন্য ছিল? না, শেখ মুজিব বহু আগে সেটি পূর্ণ করেছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তো শেখ মুজিব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন আদায়ের আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামের পুরোধা নেতা। ছয় দফা আন্দোলনের পর তাকে প্রথম সারির নেতা হতে হবে কেন? ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কি তার ঐতিহাসিক চৌদ্দ দফা দাবি ঘোষণার পর ভারতীয় মুসলমানদের প্রধান নেতায় পরিণত হয়েছিলেন, না তার বহু পূর্বে হয়েছিলেন? গান্ধী তাকে 'কায়েদে আজম' (মৎবধঃ ষবধফবৎ) এই খেতাব দিতে বাধ্য হয়েছিলেন কেন?
পাকিস্তান হওয়ার পর ১৯৪৮ সালেই দেখা যায় শেখ মুজিবকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের পুরোভাগে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তার নেতৃত্ব না থাকলে পরের বছর ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকায় ছাত্র-জনতার যে বিশাল শোভাযাত্রা হয়, তার পুরোভাগে মওলানা ভাসানীর পাশে দাঁড়িয়ে তাকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যেত না। ভাষা আন্দোলনে যাতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী সমর্থন দেন, আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িকীকরণ ও স্বতন্ত্র নির্বাচনের বদলে যুক্ত নির্বাচন প্রবর্তনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আওয়ামী লীগ সম্মত হয় সে জন্য শেখ মুজিবকেই নেতা ও দলের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে হয়েছিল। মওলানা ভাসানী একার চেষ্টায় পেরে উঠছিলেন না।
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে শেখ মুজিব তখনই প্রথম সারির নেতা হিসেবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হন। ছয় দফার আন্দোলন তাকে প্রথম সারির নেতা থেকে বাংলায় অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি জাতির জনকে পরিণত হন। কোনো নেতৃত্বের এই ঐতিহাসিক বাঁকগুলো ধরতে ও বুঝতে না পারলে কারোই উচিত নয় ইতিহাস-বিশ্লেষক সাজা, তিনি যত প্রবীণ ব্যক্তিই হোন না কেন?
একটা ঘটনার কথা বলি। ঘটনাটি লিখেছেন অন্নদাশঙ্কর রায় তার এক স্মৃতিচারণে। এই লেখাটি বহু পূর্বে প্রকাশিত এবং আমার হাতের কাছে নেই বলে তার কথার হুবহু উদ্ধৃতি দিতে পারছি না। তবে তার বক্তব্য অবিকল তুলে ধরছি। ষাটের দশকের গোড়ার কথা। অন্নদাশঙ্কর রায় সম্ভবত দিলি্ল থেকে বিমানে লন্ডনে বা ইউরোপের কোনো দেশে যাচ্ছিলেন। ওই প্লেনে তার সহযাত্রী ছিলেন ঢাকার সদরি ইস্পাহানি। ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে ইস্পাহানিদের নাম কে না জানে?
অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে সদরির পূর্ব পরিচয় ছিল। তারা প্লেনে পাশাপাশি আসনে বসে গল্প জুড়ে দিলেন। তখন হক সাহেব ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রয়াত হয়েছেন। অন্নদাশঙ্কর রায় হতাশা প্রকাশ করে সদরি ইস্পাহানিকে বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম সারির নেতা কেউ আর রইলেন না। দেশটিতে গণতন্ত্র যদি ফিরেও আসে, পূর্ব পাকিস্তানে যোগ্য মুখ্যমন্ত্রীই-বা কে হবেন? আতাউর রহমান খান তো তেমন যোগ্যতা দেখাতে পারেননি। সদরি ইস্পাহানি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়েছেন, কেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নাম আপনি জানেন না? বয়সে তরুণ, কিন্তু প্রথম শ্রেণীর বাঙালি নেতা। তিনি শুধু পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের মন্তব্য, 'পরে বুঝেছি, সদরি ইস্পাহানি আমার কাছে অত্যুক্তি করেননি।' তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তিনি লিখেছিলেন, 'যতোকাল রবে পদ্মা মেঘনা গৌরি যমুনা বহমান, ততোকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।'
পাকিস্তানের প্রথম ফৌজি শাসক আইয়ুব খান পাকিস্তানের রাজনীতিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চেয়েও তার 'ভয়ঙ্কর শত্রু' হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে বেছে নিয়েছিলেন, আর কোনো তথাকথিত প্রথম সারির নেতাকে নয়। বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশেই তিনি বলেছিলেন, 'আমি অস্ত্রের ভাষায় (ষধহমঁধমব ড়ভ বিধঢ়ড়হ) তার সঙ্গে কথা বলব।' পাকিস্তানের আর কোনো জাঁদরেল নেতাকেও এই হুমকি তিনি দেননি। বাংলাদেশের যে নেতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কবিতা লিখেছেন এশিয়া ও আফ্রিকার অনূ্যন এক ডজন কবি, বিবিসির জনমত সমীক্ষায় যাকে বলা হয়েছে 'শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি', তিনি ছয় দফা প্রস্তাব দেওয়ার আগে কেউ যদি বলেন, এই প্রস্তাব দেওয়ার আগে তিনি তৃতীয় সারির নেতা ছিলেন, তা শুধু তার বা তাদের অজ্ঞানতা ও ভ্রান্তি নয়, নিজেদের হীনম্মন্যতাবোধও।
লন্ডন, ১ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার, ২০১৩
No comments