ট্রেনে ডাকাতি ও হত্যা- সবার আগে নিরাপত্তা
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ডাকাতি শেষে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে তিনজনকে হত্যা এবং দু'জনকে আহত করার মধ্য দিয়ে জনপরিবহনটির নিরাপত্তাহীনতা আরেকবার স্পষ্ট হলো।
বস্তুত রেলপথের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে যখন নানা উদ্যোগ ও প্রতিশ্রুতি লক্ষ্য করছি আমরা, তখন নিরাপত্তাহীনতাও প্রকট হচ্ছে। আমাদের মনে আছে, গত ২৫ জানুয়ারি একই কায়দায় গাজীপুরের শ্রীপুরে দুই যাত্রীকে হত্যা করেছিল ডাকাত দল। সড়কপথের চেয়ে নিরাপদ বিবেচিত বলেই শত বিড়ম্বনা ঠেলে যাত্রীরা রেলপথে ভিড় জমান। প্রায়শ লাইনচ্যুতি, অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের বিপত্তি, এমনকি কখনও কখনও দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষও রেলের প্রতি মানুষের আগ্রহে ভাটা ফেলেনি। কিন্তু ডাকাত-ছিনতাইকারীর হাতে যদি এভাবে যাত্রীদের বেঘোরে প্রাণ হারাতে হয়, তারা রেলপথ মাড়াবেন কোন সাহসে? শুক্রবার সমকালের প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, মূলত ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণেই অরক্ষিত হয়ে পড়েছে রেলপথ। আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ডাকাতি-ছিনতাই। সক্রিয় হয়েছে গামছা পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, পকেটমার, মাদক পাচারকারীরা। সমকালের প্রতিবেদনেই রয়েছে, গত ছয় মাসে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে ৩৫৬টি কাটা লাশ উদ্ধার হয়েছে। এত যাত্রীর লাশ গৃহযুদ্ধপ্রবণ দেশের রেলওয়েতেও পাওয়া যায় কি-না, আমাদের সন্দেহ রয়েছে। এর মোকাবেলায় রেলওয়ের পক্ষ থেকে অর্ধশতাধিক স্থানকে 'অপরাধপ্রবণ' ঘোষণা করে সেসব স্থানে সতর্কমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশের মধ্য দিয়েই দায় সারা হয়েছে। এটা ঠিক, রেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মূল সংকট জনবল। সীমিত রেল নিরাপত্তা বাহিনী, অল্পসংখ্যক জিআরপি আর আনসার সদস্য দিয়ে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার রেলরুটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিনই বটে। সহযোগী একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, কমবেশি দেড় হাজার যাত্রীর একটি ট্রেনে নিরাপত্তা রক্ষী থাকে পাঁচজন। ডাকাতের আক্রমণ তারা কীভাবে মোকাবেলা করবে? কিন্তু পরিস্থিতি যা-ই হোক, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। রেললাইনের পাশে এভাবে আর লাশ পড়ে থাকা দেখতে চাই না আমরা। সেক্ষেত্রে রেল নিরাপত্তা বাহিনীর জনবল বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। একই সঙ্গে ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের দমনেও চাই সমন্বিত ও সর্বাত্মক অভিযান। এটা ধারণা করা যায় যে, গুটি কয়েক ডাকাত দলই বিভিন্ন রুটে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন আন্তরিক হলে তাদের চিহ্নিত ও আটক করা কঠিন হতে পারে না। আমরা বিশ্বাস করি, কয়েকটি ডাকাত দল দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেলেই ডাকাতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। একই সঙ্গে এর আগে হতাহতের ঘটনারও সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিত। দেখা গেছে, রেললাইনে লাশ পাওয়ার ঘটনায় হত্যা মামলা হওয়া এবং কাউকে আটকের ঘটনা নেই বললেই চলে। জটিলতা এড়াতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ অপমৃত্যু মামলা হিসেবে চালিয়ে দেয়। এ জন্যও সমাজবিরোধীরা আশকারা পেতে পারে। পুলিশের উচিত হবে প্রতিটি অঘটনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করা। তা না হলে আরও লাশ দেখতে হবে আমাদের। উদ্যোগী হতে হবে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণেও। খোদ রেলওয়ে বিভাগসূত্রে জানা যাচ্ছে, একুশ শতকের প্রথম দশ বছরে দেশের রেলপথে ৫ হাজার ৫০টি দুর্ঘটনা রেকর্ড হয়েছে। মনে রাখতে হবে, কেবল আর্থিক সাশ্রয়ই রেলপথকে সড়কপথের তুলনায় জনপ্রিয় করে তোলেনি, নিরাপত্তাও অন্যতম প্রধান কারণ। সেই নিরাপত্তাই যদি বারবার বিঘি্নত হয়, রেলপথের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি ভর্তুকির উপযোগিতা কী? বর্তমান সরকার রেলপথ উন্নয়নে উদ্যোগী হয়েছে। এ জন্য সাধুবাদ। কিন্তু নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে এই পরিবহন ব্যবস্থার সংস্কার ও জনমুখী করে তোলার যে কোনো উদ্যোগই ভেস্তে যেতে বাধ্য।
No comments