সদরে অন্দরে-ধর্ষণের সংজ্ঞাও অকার্যকর বাংলাদেশে by মোস্তফা হোসেইন
নির্যাতিত যদি হয় বোন, ভাইয়ের মাথায় চাপে
খুন। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে ওঠে সে, মনুষ্যত্ববোধও জাগ্রত হয় তার। কিন্তু
যে মুহূর্তে অন্যের বোন কিংবা কন্যা আসে সামনে, তখন ওই ভাইটি হয়ে যায় নিছক
পুরুষ। পুরুষত্ব ফলাতে সভ্যতার আলো থেকে সরে যায় যোজন যোজন দূরে।
আদিমতায় পেয়ে বসে তাকে। অন্যের বোন হয় লালসার শিকার। এই তো হতে পারে একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের একজন নারী ও একজন পুরুষের অবস্থা।
অথচ এই পুরুষটি শৈশব পার করেছে 'অনেক অনেক আগে আরবের মানুষ কন্যাশিশুকে জীবন্ত কবর দিত'- এমন ইতিহাস পড়ে। এই পুরুষটির বেড়ে ওঠা ও জীবনযাত্রায় বিজ্ঞান, অর্থনীতির উন্নয়নের ছোঁয়া পায় স্বাভাবিক কারণে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়ে নিজেকে দাবি করে আদিমতার বাইরের আধুনিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে। কিন্তু দৈনন্দিন কার্যক্রম তার কতটা প্রমাণ বহন করে?
পুরুষদের সবাই যে এমন, তা বলছি না। তবে এক মণ দুধে দু-এক ফোঁটা চনার মতো দু-একটা কাপুরুষের কারণে সব পুরুষই আজ অভিযুক্তের কাতারে। অবশ্য যাঁরা কলঙ্কের নায়ক নন, তাঁরাও নিজেদের এই দাগ থেকে বাঁচাতে পারেন না। কারণ তাঁরাও পারেননি মানুষের আদিম আচরণ থেকে সবাইকে নিবৃত্ত করতে। নিশ্চিত করতে পারেননি নিজের বোন কিংবা অন্যের স্ত্রী-বোনের সম্ভ্রম। অথচ কাগজে-কলমে আইন আছে দেশে। আছে বিচারও। আর বিশ্বসমাজের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ বিভিন্ন সনদেও অনুস্বাক্ষর করে নিজের দেশের নারী ও শিশুর নিরাপত্তা বিধানে অঙ্গীকার করেছে। বাংলাদেশের সংবিধান সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ প্রদান করেছে, একজন নারীও সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারী। কিন্তু তার পরও উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকায় নিত্য ঘটছে ধর্ষণের মতো ঘটনা। নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা দিনের পর দিন মানুষকে আতঙ্কিত করছে।
দিল্লিতে বাসে ছাত্রী ধর্ষণ ও পরবর্তী সময়ে ধর্ষিতার মৃত্যু নিয়ে আমাদের প্রচারমাধ্যমে হৈচৈ হয়েছে প্রচুর। কিন্তু যে মুহূর্তে দিল্লির ঘটনা নিয়ে সারা বিশ্ব প্রতিবাদে সোচ্চার, ঠিক তখনো বাংলাদেশের অসংখ্য স্থানে ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা। ঘরে, বাইরে, বাসে বৃদ্ধা, গৃহবধূ এমনকি শিশুও কথিত পুরুষদের আদিমতার হাতে নিগৃহীত হচ্ছে।
প্রায় ৩০ লাখ নারী গার্মেন্টশিল্পে নিয়োজিত যে দেশে, সেখানে তাদের কর্মস্থল, বাসস্থান কিংবা রাস্তাঘাট- সবখানেই ধর্ষকরা ওত পেতে থাকে মানুষখেকো বাঘের মতো। মানিকগঞ্জে এক গার্মেন্টকর্মী বাসের চালক ও কন্ডাক্টর দ্বারা ধর্ষিত হলো বাড়ি ফেরার পথে। এ যেন দিল্লির বাসে ধর্ষণ কাহিনীরই পুনরাবৃত্তি! দিল্লিতে ধর্ষণের কয়েক দিন পর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। সেই ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠেছিল সারা দুনিয়ার মানুষ। সেই দেশের রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী জনতার দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন। কিন্তু গত ৭ জানুয়ারি পিরোজপুরে মাত্র আট বছরের স্কুলছাত্রী যখন ধর্ষিত হলো এবং ধর্ষকরা তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করল, তখন তেমন একটা গা করেনি বাংলাদেশের বোদ্ধাসমাজ। কিংবা টাঙ্গাইলে এক মাসের মধ্যেই দুই শিশুকে ধর্ষণ ও একজনকে হত্যা করেও যেন তাদের ক্লান্তি আসেনি। এই নিবন্ধ লেখার সময়ও কালের কণ্ঠে সংবাদ হয়েছে, উত্তরায় এক শিশু গৃহকর্মীকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহ করেছে পুলিশ। এত মৃত্যুর পরও জ্বলে ওঠেনি বাংলাদেশ। গা-সওয়া হয়ে গেছে যেন এসব। ঘটনার ভয়াবহতা এত বেশি যে দেশের মানুষের প্রবল প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া উচিত এই মুহূর্তে। বিশ্বাস করা যায় এমন পরিসংখ্যান? ইন্টার প্রেস সার্ভিস নামের একটি সংস্থা বাংলাদেশে গত বছরের ধর্ষণের পরিসংখ্যান দিয়েছে এক হাজার ৩৩৬ জন। অধিকার বলেছে, এই সংখ্যা ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ছিল ৭৬০ জন। তাদের দেওয়া সালভিত্তিক পরিসংখ্যান বলে, ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭১১, ২০১০ সালে ছিল ৫৫৯। ২০০৯ সালে ছিল ৪৫৬ আর ২০০৮ সালে ছিল ৪৫৪। আমরা অধিকারের পরিসংখ্যানও যদি আমলে নিই, তাহলে দেখতে পাব, ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
ধর্ষণের ঘটনাগুলো আমাদের আতঙ্কিত করে- যখন দেখি, গণধর্ষণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। যখন দেখি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও এই অপরাধে লিপ্ত হতে এবং পর্যায়ক্রমে কন্যাশিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। অধিকারের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ সালেই ১৮৮টি গণধর্ষণ হয়েছে দেশে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সেসব ঘটনায় ৬৯ জনকেই হত্যা করা হয়েছে ধর্ষণ করার পর।
শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারটি মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় বলে মনে করা যায়। দুর্বলের প্রতি অত্যাচারের মানসিকতা থেকেই এই পাশবিকতার সৃষ্টি। পুরুষ তার পৌরুষ জাহির করতে তুলনামূলক দুর্বলকে টার্গেট করে। যে কারণে শিশুরা শিকার হয় বেশি। ইংরেজি Rape, যাকে বাংলায় ধর্ষণ বলা হয়, এই শব্দটির সংজ্ঞা নিয়েও আজ নতুন করে ভাবতে হচ্ছে বাংলাদেশে সংঘটিত ধর্ষণের চিত্র দেখে। ইংরেজি শব্দ Rape-কে সংজ্ঞায়িত করেছেন পশ্চিমা দুই লেখক- মার্সিয়া কোহেন ও সেরি এইচ ম্যাককেন্না। তাঁরা বলেছেন, Rape is the oldest means by which a man seized or stole a wife. সেখানে পরস্ত্রীকে নিজ গোত্রে জোরপূর্বক ফিরিয়ে আনার একটা ব্যাপার উল্লেখ আছে। অন্যের স্ত্রীকে নিজের করে তারপর তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করার বিষয় বলা হয়েছে। কিন্তু আজ বাসে, রাস্তাঘাটে কিংবা কর্মস্থলে যখন শিশু ও বৃদ্ধা ধর্ষিত হয়, তখন মনে হয়, সংজ্ঞাও বদলাতে হবে বাংলাদেশের এসব ঘটনার পর।
কেন এই মানবিক বিপর্যয়? আইন, সংবিধান, সুশীলসমাজের দিকনির্দেশনা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক অনুশাসন- কিছুই কাজ করছে না কেন দুর্বৃত্ত-দমনে? আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের অংশীদারি আছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের লক্ষ্যে। দেশীয় আইন ও সংবিধানে বিধান রাখা হয়েছে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে। সর্বশেষ জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে নারীর নিরাপত্তা বিধানের বিষয়ে। নারী উন্নয়ন নীতিকে তাই মানুষ গ্রহণ করেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। নারী নির্যাতনের প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণ করা আছে এই নীতির ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে। যেখানে ১৯.৭ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, 'নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন ও পাচার সম্পর্কীয় অপরাধের বিচার ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পন্ন করার লক্ষ্যে বিচারপদ্ধতি সহজতর করা।' ব্যাপক প্রশংসিত নারী উন্নয়ন নীতির এই একটি ধারা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, দেশে এই নির্যাতন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ কতটা গৃহীত হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, দ্রুত আইনে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়নি নারী নির্যাতনের মতো অপরাধের। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না এই দেশে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার অবস্থান ইতিবাচক হওয়ার পরও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারে, এমন প্রয়াস নেই। মৌলভীবাজারের নূরজাহান হত্যা, দিনাজপুরের ইয়াসমিন হত্যার মতো ঘটনা সমাজের বিত্ত ও প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্যকে স্পষ্ট করে দিলেও সেই প্রভাবকে ইতিবাচক দিকে দৃঢ় করার প্রচেষ্টাও দেখা যায় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য অপরাধে জড়িত হওয়ার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাউন্সেলিং করার জোরালো কোনো কর্মসূচি নেই সরকারের।
মানুষের মধ্যে সুপ্ত থাকা পাশবিকতা দূর করতে হলে সামাজিকভাবে প্রতিরোধের উপায় খুঁজতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতাবোধ সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলার কোনো বিকল্প নেই। পারিবারিক পরিবেশ শিশুর অনুকূলে রাখাটাও অপরিহার্য। স্বাভাবিক জীবনবোধ তৈরিতে তাই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা জরুরি। এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে চতুর্মুখী প্রচেষ্টা অপরিহার্য। নারী, পুরুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র যদি নির্যাতিতার পক্ষে দাঁড়ায়, আইন যদি কঠোর হয় তাহলেই কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে।
mhussain_71@yahoo.com
অথচ এই পুরুষটি শৈশব পার করেছে 'অনেক অনেক আগে আরবের মানুষ কন্যাশিশুকে জীবন্ত কবর দিত'- এমন ইতিহাস পড়ে। এই পুরুষটির বেড়ে ওঠা ও জীবনযাত্রায় বিজ্ঞান, অর্থনীতির উন্নয়নের ছোঁয়া পায় স্বাভাবিক কারণে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়ে নিজেকে দাবি করে আদিমতার বাইরের আধুনিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে। কিন্তু দৈনন্দিন কার্যক্রম তার কতটা প্রমাণ বহন করে?
পুরুষদের সবাই যে এমন, তা বলছি না। তবে এক মণ দুধে দু-এক ফোঁটা চনার মতো দু-একটা কাপুরুষের কারণে সব পুরুষই আজ অভিযুক্তের কাতারে। অবশ্য যাঁরা কলঙ্কের নায়ক নন, তাঁরাও নিজেদের এই দাগ থেকে বাঁচাতে পারেন না। কারণ তাঁরাও পারেননি মানুষের আদিম আচরণ থেকে সবাইকে নিবৃত্ত করতে। নিশ্চিত করতে পারেননি নিজের বোন কিংবা অন্যের স্ত্রী-বোনের সম্ভ্রম। অথচ কাগজে-কলমে আইন আছে দেশে। আছে বিচারও। আর বিশ্বসমাজের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ বিভিন্ন সনদেও অনুস্বাক্ষর করে নিজের দেশের নারী ও শিশুর নিরাপত্তা বিধানে অঙ্গীকার করেছে। বাংলাদেশের সংবিধান সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ প্রদান করেছে, একজন নারীও সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারী। কিন্তু তার পরও উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকায় নিত্য ঘটছে ধর্ষণের মতো ঘটনা। নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা দিনের পর দিন মানুষকে আতঙ্কিত করছে।
দিল্লিতে বাসে ছাত্রী ধর্ষণ ও পরবর্তী সময়ে ধর্ষিতার মৃত্যু নিয়ে আমাদের প্রচারমাধ্যমে হৈচৈ হয়েছে প্রচুর। কিন্তু যে মুহূর্তে দিল্লির ঘটনা নিয়ে সারা বিশ্ব প্রতিবাদে সোচ্চার, ঠিক তখনো বাংলাদেশের অসংখ্য স্থানে ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা। ঘরে, বাইরে, বাসে বৃদ্ধা, গৃহবধূ এমনকি শিশুও কথিত পুরুষদের আদিমতার হাতে নিগৃহীত হচ্ছে।
প্রায় ৩০ লাখ নারী গার্মেন্টশিল্পে নিয়োজিত যে দেশে, সেখানে তাদের কর্মস্থল, বাসস্থান কিংবা রাস্তাঘাট- সবখানেই ধর্ষকরা ওত পেতে থাকে মানুষখেকো বাঘের মতো। মানিকগঞ্জে এক গার্মেন্টকর্মী বাসের চালক ও কন্ডাক্টর দ্বারা ধর্ষিত হলো বাড়ি ফেরার পথে। এ যেন দিল্লির বাসে ধর্ষণ কাহিনীরই পুনরাবৃত্তি! দিল্লিতে ধর্ষণের কয়েক দিন পর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। সেই ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠেছিল সারা দুনিয়ার মানুষ। সেই দেশের রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী জনতার দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন। কিন্তু গত ৭ জানুয়ারি পিরোজপুরে মাত্র আট বছরের স্কুলছাত্রী যখন ধর্ষিত হলো এবং ধর্ষকরা তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করল, তখন তেমন একটা গা করেনি বাংলাদেশের বোদ্ধাসমাজ। কিংবা টাঙ্গাইলে এক মাসের মধ্যেই দুই শিশুকে ধর্ষণ ও একজনকে হত্যা করেও যেন তাদের ক্লান্তি আসেনি। এই নিবন্ধ লেখার সময়ও কালের কণ্ঠে সংবাদ হয়েছে, উত্তরায় এক শিশু গৃহকর্মীকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহ করেছে পুলিশ। এত মৃত্যুর পরও জ্বলে ওঠেনি বাংলাদেশ। গা-সওয়া হয়ে গেছে যেন এসব। ঘটনার ভয়াবহতা এত বেশি যে দেশের মানুষের প্রবল প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া উচিত এই মুহূর্তে। বিশ্বাস করা যায় এমন পরিসংখ্যান? ইন্টার প্রেস সার্ভিস নামের একটি সংস্থা বাংলাদেশে গত বছরের ধর্ষণের পরিসংখ্যান দিয়েছে এক হাজার ৩৩৬ জন। অধিকার বলেছে, এই সংখ্যা ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ছিল ৭৬০ জন। তাদের দেওয়া সালভিত্তিক পরিসংখ্যান বলে, ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭১১, ২০১০ সালে ছিল ৫৫৯। ২০০৯ সালে ছিল ৪৫৬ আর ২০০৮ সালে ছিল ৪৫৪। আমরা অধিকারের পরিসংখ্যানও যদি আমলে নিই, তাহলে দেখতে পাব, ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
ধর্ষণের ঘটনাগুলো আমাদের আতঙ্কিত করে- যখন দেখি, গণধর্ষণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। যখন দেখি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও এই অপরাধে লিপ্ত হতে এবং পর্যায়ক্রমে কন্যাশিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। অধিকারের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ সালেই ১৮৮টি গণধর্ষণ হয়েছে দেশে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সেসব ঘটনায় ৬৯ জনকেই হত্যা করা হয়েছে ধর্ষণ করার পর।
শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারটি মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় বলে মনে করা যায়। দুর্বলের প্রতি অত্যাচারের মানসিকতা থেকেই এই পাশবিকতার সৃষ্টি। পুরুষ তার পৌরুষ জাহির করতে তুলনামূলক দুর্বলকে টার্গেট করে। যে কারণে শিশুরা শিকার হয় বেশি। ইংরেজি Rape, যাকে বাংলায় ধর্ষণ বলা হয়, এই শব্দটির সংজ্ঞা নিয়েও আজ নতুন করে ভাবতে হচ্ছে বাংলাদেশে সংঘটিত ধর্ষণের চিত্র দেখে। ইংরেজি শব্দ Rape-কে সংজ্ঞায়িত করেছেন পশ্চিমা দুই লেখক- মার্সিয়া কোহেন ও সেরি এইচ ম্যাককেন্না। তাঁরা বলেছেন, Rape is the oldest means by which a man seized or stole a wife. সেখানে পরস্ত্রীকে নিজ গোত্রে জোরপূর্বক ফিরিয়ে আনার একটা ব্যাপার উল্লেখ আছে। অন্যের স্ত্রীকে নিজের করে তারপর তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করার বিষয় বলা হয়েছে। কিন্তু আজ বাসে, রাস্তাঘাটে কিংবা কর্মস্থলে যখন শিশু ও বৃদ্ধা ধর্ষিত হয়, তখন মনে হয়, সংজ্ঞাও বদলাতে হবে বাংলাদেশের এসব ঘটনার পর।
কেন এই মানবিক বিপর্যয়? আইন, সংবিধান, সুশীলসমাজের দিকনির্দেশনা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক অনুশাসন- কিছুই কাজ করছে না কেন দুর্বৃত্ত-দমনে? আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের অংশীদারি আছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের লক্ষ্যে। দেশীয় আইন ও সংবিধানে বিধান রাখা হয়েছে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে। সর্বশেষ জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে নারীর নিরাপত্তা বিধানের বিষয়ে। নারী উন্নয়ন নীতিকে তাই মানুষ গ্রহণ করেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। নারী নির্যাতনের প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণ করা আছে এই নীতির ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে। যেখানে ১৯.৭ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, 'নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন ও পাচার সম্পর্কীয় অপরাধের বিচার ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পন্ন করার লক্ষ্যে বিচারপদ্ধতি সহজতর করা।' ব্যাপক প্রশংসিত নারী উন্নয়ন নীতির এই একটি ধারা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, দেশে এই নির্যাতন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ কতটা গৃহীত হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, দ্রুত আইনে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়নি নারী নির্যাতনের মতো অপরাধের। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না এই দেশে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার অবস্থান ইতিবাচক হওয়ার পরও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারে, এমন প্রয়াস নেই। মৌলভীবাজারের নূরজাহান হত্যা, দিনাজপুরের ইয়াসমিন হত্যার মতো ঘটনা সমাজের বিত্ত ও প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্যকে স্পষ্ট করে দিলেও সেই প্রভাবকে ইতিবাচক দিকে দৃঢ় করার প্রচেষ্টাও দেখা যায় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য অপরাধে জড়িত হওয়ার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাউন্সেলিং করার জোরালো কোনো কর্মসূচি নেই সরকারের।
মানুষের মধ্যে সুপ্ত থাকা পাশবিকতা দূর করতে হলে সামাজিকভাবে প্রতিরোধের উপায় খুঁজতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতাবোধ সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলার কোনো বিকল্প নেই। পারিবারিক পরিবেশ শিশুর অনুকূলে রাখাটাও অপরিহার্য। স্বাভাবিক জীবনবোধ তৈরিতে তাই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা জরুরি। এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে চতুর্মুখী প্রচেষ্টা অপরিহার্য। নারী, পুরুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র যদি নির্যাতিতার পক্ষে দাঁড়ায়, আইন যদি কঠোর হয় তাহলেই কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে।
mhussain_71@yahoo.com
No comments