তারাও মুসলমান- খোলা চোখে by আবু আহমেদ
একটা বিষয় আজ মুসলমানদের নিদারুণ ব্যথিত করে চলেছে, সেটা হলো সুন্নি
নামধারী কিছু মুসলমান অন্য মাজহাবের অনুসারীদের ইসলামের এক নম্বর দুশমন
হিসেবে চিহ্নিত করে বোমার আঘাতে তাদের হত্যা করে চলেছে বিনাদোষেই।
এই
ভিন্ন মাজহাবের মুসলমানদের মধ্যে শিয়া হিসেবে পরিচিত মুসলমানেরাও আছে।
পাকিস্তানের কিছু চরমপন্থী তাদের কথিত জিহাদের লক্ষ্য হিসেবে শিয়াদের কতল
করা যেন কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। এবার বেলুচিস্তানের স্নুকার কাবে
ভয়াবহ বোমা হামলায় যাদেরকে নৃশংসভাবে মারা হলো, তারা কি মুসলমান ছিল না?
লস্কর-ই জঙ্গি নামের উগ্রপন্থী এক সংগঠন ওই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে।
দুটো প্রশ্ন এখানে আসে। এক. কে তাদের এই শিক্ষা দিয়েছে, শিয়াদের শুধু
শিয়া মতাবলম্বী হওয়ার কারণে হত্যা করলে পুণ্যের কাজ হবে? এভাবে মানুষ
হত্যা করা ইসলাম কি আদৌ সমর্থন করে? দুই. পাকিস্তান সরকার জঙ্গিদের পরিচয়
পেয়েও কেন তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে অক্ষম? সত্য হচ্ছে, ওরা শিয়া
হত্যা করতে করতে একদিন সুন্নিও হত্যা করবে। পাকিস্তানে সিপাহ-ই-সাহাবা,
লস্কর-ই-জঙ্গি, লস্কর-ই-তাইয়েবা প্রভৃতি সংগঠনের কাজ কী? শুধু কি হত্যা
করা? আমাদের জ্ঞান যতটা আছে তার আলোকে মুসলমানদের এই বিভেদের ক্ষেত্রগুলো
নিয়ে কিছু বলতে চাই।
জানা মতে, শিয়া সম্প্রদায় একটি স্বীকৃত ইসলামি মাজহাবের অনুসারী। তারা আছেন দুনিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে। আমাদের হানাফি মাজহাবের ইমাম যেমন ইমাম আবু হানিফা রাহ:, তেমনি শিয়া মাজহাবের ইমাম হলেন ইমাম জাফর আল সাদেক রাহ:। এই মহান ব্যক্তিত্ব আবার ইমাম আবু হানিফার ওস্তাদ। বিশ্বের তাবৎ সুন্নি আলেম, ফকিহ ও পণ্ডিত ব্যক্তি শিয়াদের মুসলমান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন বহু আগে। অনেকে বলেনÑ এলেম, আখলাক ও চেতনায় তারা অন্য মুসলমানদের থেকে মোটেও পিছিয়ে নেই। মাজহাবভেদে আমল বা ধর্মাচরণের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে বটে। এটাই স্বাভাবিক। সেই পার্থক্য তো ইমাম আবু হানিফার অনুসারী এবং অন্য ইমামদের অনুসারীদের মধ্যেও, যেমন মালেক ও হাম্বলিদের মধ্যেও আছে। এরা সবাই সুন্নি মুসলিম। আপনারা যারা মক্কা শরিফে হজ পালনে গেছেন, তারা দেখেছেন বিভিন্ন মাজহাবের মুসলমানেরা বিভিন্নভাবে নামাজ আদায় করছেন। এমনকি যিনি মক্কায় ইমামতি করছেন তার নামাজ পড়ানোর তরিকাও এই উপমহাদেশে আমরা যেভাবে নামাজ পড়ি তা থেকে ভিন্ন। বস্তুত সত্য হলো, আল্লাহর রাসূল সা: তাঁর জীবনে কিছুটা ভিন্নতা এনে বিভিন্ন সময়ে ইবাদত করেছেন। আর আমাদের স্বীকৃত মাজহাবগুলোও বাতিলপন্থী ফেরকা নয়। তাই মালেকিরা যা করছেন তাও ঠিক। আবার আমরা হানাফিরা যা করছি ইবাদতের ক্ষেত্রে তাও ঠিক। তবে কথা হলোÑ ফেরকা নয়, সময় পার হওয়ার সাথে সাথে ইসলামের নামে অনেকে বিদায়াত বা ইসলামে অবৈধ, এমন কর্মেও লিপ্ত হয়েছে। সে বিদায়াত বা অননুমোদনযোগ্য ও গর্হিত কাজ কোনগুলো সেসব ব্যাপারেও আলেমে দ্বীনেরা বহু লেখালেখি করেছেন। ইসলামে ধর্মাচার আর জ্ঞানের উৎস হলো মূলত দুটোÑ এক. আল্লাহর ওহি আল কুরআন, দুই. রাসূল সা:-এর সুন্নত। এই দুই উৎসে যা যা আছে সেগুলোর ব্যাপারে আলেমদের ব্যাখ্যাও জ্ঞানের বড় উৎস। আল কুরআন হলো জ্ঞানের মূল ভাণ্ডার। যারা আল কুরআন মনোযোগ দিয়ে পড়েনি তারাই বিভ্রান্তিতে বেশি পড়ে। শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেদের সাথে আমাদের সুন্নিরা যুগে যুগে এক সাথে বসবাস করেছেন। তাদের মধ্যে বিয়েশাদি হয়েছে। সবই হয়েছে মুসলিম হিসেবে। কিভাবে শিয়া ও সুন্নিÑ এই দু’টি ভাগের উৎপত্তি হলো সে ব্যাপারে ইসলামের প্রথম দিকের ঘটনাবহুল ইতিহাস আমাদের পরিষ্কার ধারণা দেয়। কারবালার প্রান্তরে স্বৈরশাসক ইয়াজিদের বাহিনীর নৃশংসতার কাহিনী পড়ে তো আমাদের চোখের পানি পড়ে। ইতিহাস বলে সেদিন ইমাম হোসাইন ইবনে আলী রা:-এর পক্ষে যারা লড়েছেন, তাদের মধ্য থেকেই শিয়াদের উৎপত্তি।
শিয়া মাজহাবের মূল কথা হলো ইমাম হতে হবে আহলে বায়াত থেকে। অর্থাৎ নবী করিম সা:-এর বংশধরদের মধ্য থেকে। এতে আমাদের সুন্নিদের আপত্তির কী আছে? আর আমাদের সুন্নিদের ইমাম কে হবেন? অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও দেখা যায়, সুন্নি মুসলমানদের দেশগুলোতে এমন লোকেরা ইমাম বা নেতা হয়েছেন যাদের বাদশাহ বা আমির বলা হয় এবং যাদের ইসলামের সাথে বেশি সম্পর্ক নেই। ইরাকের পতিত স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন একজন সুন্নি ছিলেন। তার পতন কে ঘটাল? সুন্নিরা কি ঘটায়নি? আমেরিকা যখন বোমা মেরে তার প্রাসাদ উড়িয়ে দিচ্ছিল তখন তাবৎ সুন্নি রাজা-বাদশাহ-প্রেসিডেন্ট আমেরিকানদের পক্ষ হয়ে কথিত সুন্নি সাদ্দামের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছেন। আরেক সুন্নি নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি, যিনি মুসলমানদের পক্ষে এবং তৃতীয় বিশ্বের নির্যাতিতদের পক্ষে অতীতে আওয়াজ তুলতেন, স্বৈশাসনের কারণে তাকে ক্ষমতা থেকে কে সরাল? সেখানেও তো সুন্নি জনগণ ইউরোপীয় ও আমেরিকান বহিঃশক্তির পক্ষ হয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।
এখন লিবিয়ার তেলের ভাগ কারা নিচ্ছে? এসব প্রশ্ন মুসলিম দেশগুলোর রাজধানীগুলোতে উচ্চারিত হচ্ছে। কারা শিয়া-সুন্নি বিভাজনের ইন্ধন জোগাচ্ছে? এই বিভাজনের রসদের জোগানদাতা কারা? জানা দরকার, শিয়াদের মধ্যেও বিভিন্ন উপদল আছে। কোনো কোনো ভ্রান্ত উপদলের বিশ্বাস ও আচরণ অন্য মুসলমানের বিশ্বাস ও আচরণের সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সুন্নিদের মধ্যে কি বহু ফেরকা বা উপদল নেই? সব সুন্নির ইবাদতের ধরন এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিশ্বাসের ধরন কি অন্য সুন্নিদের কাছে, সর্বোপরি ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে অনুমোদনযোগ্য?
একই ধর্মবিশ্বাসের লোকেরা সারা বিশ্বেই বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত। খ্রিষ্টানেরা কি বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত নয়? কিন্তু সে জন্য এক উপদলকে অন্য উপদলের বিরুদ্ধে বোমা-গ্রেনেড, কামান-বন্দুক নিয়ে ময়দানে নামতে তো দেখা যায় না। তাহলে কেন শিয়া-সুন্নি সঙ্ঘাত? পাকিস্তানে যা হচ্ছে তার ইতি টানার মূল দায়িত্ব পাকিস্তান সরকারের।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জানা মতে, শিয়া সম্প্রদায় একটি স্বীকৃত ইসলামি মাজহাবের অনুসারী। তারা আছেন দুনিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে। আমাদের হানাফি মাজহাবের ইমাম যেমন ইমাম আবু হানিফা রাহ:, তেমনি শিয়া মাজহাবের ইমাম হলেন ইমাম জাফর আল সাদেক রাহ:। এই মহান ব্যক্তিত্ব আবার ইমাম আবু হানিফার ওস্তাদ। বিশ্বের তাবৎ সুন্নি আলেম, ফকিহ ও পণ্ডিত ব্যক্তি শিয়াদের মুসলমান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন বহু আগে। অনেকে বলেনÑ এলেম, আখলাক ও চেতনায় তারা অন্য মুসলমানদের থেকে মোটেও পিছিয়ে নেই। মাজহাবভেদে আমল বা ধর্মাচরণের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে বটে। এটাই স্বাভাবিক। সেই পার্থক্য তো ইমাম আবু হানিফার অনুসারী এবং অন্য ইমামদের অনুসারীদের মধ্যেও, যেমন মালেক ও হাম্বলিদের মধ্যেও আছে। এরা সবাই সুন্নি মুসলিম। আপনারা যারা মক্কা শরিফে হজ পালনে গেছেন, তারা দেখেছেন বিভিন্ন মাজহাবের মুসলমানেরা বিভিন্নভাবে নামাজ আদায় করছেন। এমনকি যিনি মক্কায় ইমামতি করছেন তার নামাজ পড়ানোর তরিকাও এই উপমহাদেশে আমরা যেভাবে নামাজ পড়ি তা থেকে ভিন্ন। বস্তুত সত্য হলো, আল্লাহর রাসূল সা: তাঁর জীবনে কিছুটা ভিন্নতা এনে বিভিন্ন সময়ে ইবাদত করেছেন। আর আমাদের স্বীকৃত মাজহাবগুলোও বাতিলপন্থী ফেরকা নয়। তাই মালেকিরা যা করছেন তাও ঠিক। আবার আমরা হানাফিরা যা করছি ইবাদতের ক্ষেত্রে তাও ঠিক। তবে কথা হলোÑ ফেরকা নয়, সময় পার হওয়ার সাথে সাথে ইসলামের নামে অনেকে বিদায়াত বা ইসলামে অবৈধ, এমন কর্মেও লিপ্ত হয়েছে। সে বিদায়াত বা অননুমোদনযোগ্য ও গর্হিত কাজ কোনগুলো সেসব ব্যাপারেও আলেমে দ্বীনেরা বহু লেখালেখি করেছেন। ইসলামে ধর্মাচার আর জ্ঞানের উৎস হলো মূলত দুটোÑ এক. আল্লাহর ওহি আল কুরআন, দুই. রাসূল সা:-এর সুন্নত। এই দুই উৎসে যা যা আছে সেগুলোর ব্যাপারে আলেমদের ব্যাখ্যাও জ্ঞানের বড় উৎস। আল কুরআন হলো জ্ঞানের মূল ভাণ্ডার। যারা আল কুরআন মনোযোগ দিয়ে পড়েনি তারাই বিভ্রান্তিতে বেশি পড়ে। শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেদের সাথে আমাদের সুন্নিরা যুগে যুগে এক সাথে বসবাস করেছেন। তাদের মধ্যে বিয়েশাদি হয়েছে। সবই হয়েছে মুসলিম হিসেবে। কিভাবে শিয়া ও সুন্নিÑ এই দু’টি ভাগের উৎপত্তি হলো সে ব্যাপারে ইসলামের প্রথম দিকের ঘটনাবহুল ইতিহাস আমাদের পরিষ্কার ধারণা দেয়। কারবালার প্রান্তরে স্বৈরশাসক ইয়াজিদের বাহিনীর নৃশংসতার কাহিনী পড়ে তো আমাদের চোখের পানি পড়ে। ইতিহাস বলে সেদিন ইমাম হোসাইন ইবনে আলী রা:-এর পক্ষে যারা লড়েছেন, তাদের মধ্য থেকেই শিয়াদের উৎপত্তি।
শিয়া মাজহাবের মূল কথা হলো ইমাম হতে হবে আহলে বায়াত থেকে। অর্থাৎ নবী করিম সা:-এর বংশধরদের মধ্য থেকে। এতে আমাদের সুন্নিদের আপত্তির কী আছে? আর আমাদের সুন্নিদের ইমাম কে হবেন? অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও দেখা যায়, সুন্নি মুসলমানদের দেশগুলোতে এমন লোকেরা ইমাম বা নেতা হয়েছেন যাদের বাদশাহ বা আমির বলা হয় এবং যাদের ইসলামের সাথে বেশি সম্পর্ক নেই। ইরাকের পতিত স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন একজন সুন্নি ছিলেন। তার পতন কে ঘটাল? সুন্নিরা কি ঘটায়নি? আমেরিকা যখন বোমা মেরে তার প্রাসাদ উড়িয়ে দিচ্ছিল তখন তাবৎ সুন্নি রাজা-বাদশাহ-প্রেসিডেন্ট আমেরিকানদের পক্ষ হয়ে কথিত সুন্নি সাদ্দামের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছেন। আরেক সুন্নি নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি, যিনি মুসলমানদের পক্ষে এবং তৃতীয় বিশ্বের নির্যাতিতদের পক্ষে অতীতে আওয়াজ তুলতেন, স্বৈশাসনের কারণে তাকে ক্ষমতা থেকে কে সরাল? সেখানেও তো সুন্নি জনগণ ইউরোপীয় ও আমেরিকান বহিঃশক্তির পক্ষ হয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।
এখন লিবিয়ার তেলের ভাগ কারা নিচ্ছে? এসব প্রশ্ন মুসলিম দেশগুলোর রাজধানীগুলোতে উচ্চারিত হচ্ছে। কারা শিয়া-সুন্নি বিভাজনের ইন্ধন জোগাচ্ছে? এই বিভাজনের রসদের জোগানদাতা কারা? জানা দরকার, শিয়াদের মধ্যেও বিভিন্ন উপদল আছে। কোনো কোনো ভ্রান্ত উপদলের বিশ্বাস ও আচরণ অন্য মুসলমানের বিশ্বাস ও আচরণের সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সুন্নিদের মধ্যে কি বহু ফেরকা বা উপদল নেই? সব সুন্নির ইবাদতের ধরন এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিশ্বাসের ধরন কি অন্য সুন্নিদের কাছে, সর্বোপরি ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে অনুমোদনযোগ্য?
একই ধর্মবিশ্বাসের লোকেরা সারা বিশ্বেই বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত। খ্রিষ্টানেরা কি বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত নয়? কিন্তু সে জন্য এক উপদলকে অন্য উপদলের বিরুদ্ধে বোমা-গ্রেনেড, কামান-বন্দুক নিয়ে ময়দানে নামতে তো দেখা যায় না। তাহলে কেন শিয়া-সুন্নি সঙ্ঘাত? পাকিস্তানে যা হচ্ছে তার ইতি টানার মূল দায়িত্ব পাকিস্তান সরকারের।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments