পদ্মায় বিশ্বব্যাংককে বিদায়
পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে অনেক কাদা ছোড়াছুড়ির পর বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার অবশেষে ক্ষান্ত দিল 'না' ছোড়াছুড়ি করে। বিশ্বব্যাংক সরকারকে 'না' বলেছিল গত বছরের ২৯ জুন। এর সাত মাস পর সেই 'না'-ই যেন ফিরিয়ে দিল সরকার।
ঢাকা থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন আর প্রয়োজন নেই। এ প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাংকের নানা শর্ত মেনে, মামলা পর্যন্ত দায়ের করে অর্থায়নের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে সরকার বিশ্বব্যাংককে সময় বেঁধে দিয়েছিল ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে সংস্থাটি সাড়া না দেওয়ায় প্রতিশ্রুত ১২০ কোটি ডলার ঋণ পুনর্বিবেচনা করতে বিশ্বব্যাংককে যে অনুরোধ করা হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে সরকার। বৃহস্পতিবার রাতে বিশ্বব্যাংকে ওই অনুরোধ প্রত্যাহারসংক্রান্ত একটি চিঠি ঢাকা থেকে পাঠানো হয়েছে। এ তথ্য গতকাল শুক্রবার বিবৃতির মাধ্যমে সরকার ও বিশ্বব্যাংক উভয় পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে।
গতকাল বিকেলে সরকারের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, 'বাংলাদেশ সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সূচি বিশ্বব্যাংকের সময়সূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।... নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়াই এই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে। প্রয়োজনে প্রকল্পের ব্যয় কমানোর জন্য শুধু সড়ক সংযোগ সেতু নির্মাণ করা হবে। গতকাল বিশ্বব্যাংককে সরকার এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়।'
এর আগেই সরকারের এ অবস্থানের কথা বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়। গতকাল সকালে বিশ্বব্যাংকের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার গতকাল বিশ্বব্যাংককে জানিয়েছে, তারা পদ্মা সেতুর জন্য অর্থায়নের অনুরোধ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।
দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক গত বছরের ১৮ জুন ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করার পর ৯ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এ প্রকল্পে অর্থায়ন বা ঋণ চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ না করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ওই বৈঠকে। এরপর ছয় মাস ধরে নানা দেন-দরবার করেও বিশ্বব্যাংকের সাড়া না মেলায় সরকার আবার নিজস্ব অর্থায়নের পথে ফিরে যায়।
কয়েক দিন ধরেই সরকারের মন্ত্রীরা নিজস্ব বা বিকল্প অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলে আসছিলেন। গতকালও এ ব্যাপারে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রী। বিশ্বব্যাংকে অর্থায়ন পুনর্বিবেচনার অনুরোধ প্রত্যাহারের চিঠি দেওয়ার পর গতকাল অর্থমন্ত্রী বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন, নিজস্ব অর্থায়নে আমরা এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করব। তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী বিকল্প ব্যবস্থায় পদ্মা সেতু নির্মাণের লক্ষ্য সামনে রেখেই আমরা দ্রুত কাজ শুরু করব।'
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মালয়েশিয়া, চীন ও ভারত পদ্মা সেতু নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যেই অর্থায়ন নিশ্চিত করা হবে। তবে নিজস্ব অর্থায়নেও সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ সরকারের মেয়াদেই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হবে।
২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ছাড়াও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সঙ্গে সরকারের ঋণ চুক্তি হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, এ তিন সংস্থা সরকারের পাশে থাকবে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আমি তো আগেই বিশ্বব্যাংককে বলেছিলাম, তোমরা তোমাদের সিদ্ধান্ত জানাও। তার পরও কোনো সাড়া না পেয়ে গত বৃহস্পতিবার আমি বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি ও জাইকাকে চিঠি দিয়েছি। বিশ্বব্যাংককে বলেছি, অর্থায়ন পুনর্বিবেচনার যে অনুরোধ আমরা করেছিলাম, তা আমরা প্রত্যাহার করছি। এখন আমাদের এ প্রকল্পে তোমাদের অর্থায়নের আর প্রয়োজন নেই। তবে আমার বিশ্বাস, অন্যান্য দাতা সংস্থা যারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা আমাদের পাশে থাকবে।'
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্তি সচিব আরাস্তু খান স্বাক্ষরিত সরকারের ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার কিছুদিন আগে থেকেই বলছে যে তারা ২০১৩ সালের জানুয়ারির মধ্যে পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের প্রত্যাবর্তন আশা করছিল এবং জানুয়ারিতেই এ বিষয়ক বিকল্প সিদ্ধান্ত নিতে সরকার বদ্ধপরিকর। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার গতকাল বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দেয় যে তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ এক্ষুনিই শুরু করতে চাচ্ছে এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ছাড়াই কাজটি শুরু করতে হচ্ছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের সময়সূচি অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ অনিশ্চিত। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সূচি এবং পদক্ষেপ নিয়ে সব উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে আলোচনার জন্য সত্বর তাদের ঢাকায় আহ্বান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ঋণ চুক্তি বাতিলের পর সরকারের অনুরোধে গত ২০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুতে নতুন করে যুক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। এ জন্য কয়েকটি শর্তও দিয়েছিল সংস্থাটি। এর মধ্যে অন্যতম ছিল দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগের তদন্তে একটি বিশেষজ্ঞদলের তদারকির সুযোগ দেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে ছুটিতে পাঠানোর শর্তও ছিল। সেই মোতাবেক তিনি ছুটিতেও যান। তখন তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ছুটিতে গেলেও বিশ্বব্যাংক টাকা দেবে না। গতকাল সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে তিনি বলেন, 'সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে। এ অর্থ পদ্মা সেতু প্রকল্পে খরচ করা যেতে পারে। আমাদের দেশে যথেষ্ট প্রযুক্তি রয়েছে। যদি বিদেশি প্রযুক্তি প্রয়োজন হয়, তাহলে তা আনা যেতে পারে।'
গতকাল বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে বলা হয়, তবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে তদন্ত চালিয়ে যাবে বলে বিশ্বব্যাংককে জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির পূর্ণ ও নিরপেক্ষ তদন্ত শেষ করার জন্য তারা দুর্নীতি দমন কমিশনকে উৎসাহ দিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, দুদক তদন্তকাজ চালিয়ে যাবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন করা না করার ওপর দুদকের তদন্ত নির্ভর করছে না বলে মন্তব্য করেছেন দুদক কমিশনার মো. বদিউজ্জামান। গতকাল কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'বিশ্বব্যাংক অর্থ দেবে কি দেবে না, এর কোনো প্রভাব পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের মামলায় পড়বে না। দুদকের মামলার তদন্ত যেভাবে চলছে, তা আপন গতিতেই চলবে। যারা দোষী প্রমাণিত হবে, তাদের বিরুদ্ধেই চার্জশিট দেওয়া হবে। তদন্তে যদি আরো কারো সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ এনে গত বছর ২৯ জুন ১২০ কোটি ডলার ঋণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পর ২০ সেপ্টেম্বর এ প্রকল্পে ফিরে আসার ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক। পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতির তদন্ত পর্যবেক্ষণে গত বছরের ১৬ অক্টোবর প্রথম ঢাকা সফরে আসে বিশ্বব্যাংক গঠিত তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল। লুই মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে এ প্রতিনিধিদল তাদের প্রথম সফরে দুদকের সঙ্গে কয়েক দফায় বৈঠক করে। ডিসেম্বরে আবারও আসে তারা। এ সময় দুদককে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মামলায় আসামি না করায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল। এ প্যানেল তাদের আপত্তির কথা দুদককে চিঠি দিয়ে জানায়। এরপর দুদকও চিঠির জবাব দেয়। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয় থেকে বলা হয়েছিল, সহসাই ওয়াশিংটন সদর দপ্তর থেকে সংস্থাটির সিদ্ধান্ত জানা যাবে। প্রতীক্ষার এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, বিশ্বব্যাংককে জানুয়ারি মাসের মধ্যেই তাদের সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। ৩১ জানুয়ারি বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষার পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরে সরকারের সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে চিঠি পাঠান বলে ইআরডি কর্মকর্তারা জানান।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার এরই মধ্যে প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অর্থ পদ্মা সেতু প্রকল্পে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া সেরে রেখেছে পরিকল্পনা কমিশন। এ ছাড়া কোন অর্থবছরে কত টাকা দরকার, তা জানতে সেতু বিভাগকে নিদের্শ দিয়ে রেখেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে এডিবি, জাইকা এবং আইডিবিকে যুক্ত করতে হলে নতুন করে তাদের সঙ্গে ঋণচুক্তি করতে হবে। এ ছাড়া চীনের একটি প্রস্তাবও সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। এর আগে আসা মালয়েশিয়ার প্রস্তাবটির চেয়ে চীনের প্রস্তাব অনেক দিক থেকে ভালো বলেও তারা জানায়।
গত বছরের জুন মাসে মন্ত্রিসভায় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তাঁর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে অর্থের সম্ভাব্য উৎসের খোঁজ নিতে বলেছিলেন। ড. মসিউর দেশের কারিগরি ও আর্থিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি খসড়াও তৈরি করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ সরকার আবার বিশ্বব্যাংকের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তা আর আলোর মুখ দেখেনি। ওই খসড়ায় রেল বাদ দিয়ে কেবল সড়ক সেতু নির্মাণের কথা বলা হয়। খরচ ধরা হয় ১৭০ থেকে ১৮০ কোটি ডলার। সরকারের অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল, অব্যবহৃত বৈদেশিক সহায়তার অংশ ও বাজারে বন্ড ছেড়ে এ অর্থ জোগানের একটি রূপরেখাও এতে ছিল। প্রায় ছয় মাস পর সরকার এখন ওই পথেই এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খরচ কমানোর জন্য কেবল সড়ক সেতু তৈরির কথাই বলা হচ্ছে এখন।
সরে গেল এডিবি
গতকাল বিকেলে সরকারের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, 'বাংলাদেশ সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সূচি বিশ্বব্যাংকের সময়সূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।... নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়াই এই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে। প্রয়োজনে প্রকল্পের ব্যয় কমানোর জন্য শুধু সড়ক সংযোগ সেতু নির্মাণ করা হবে। গতকাল বিশ্বব্যাংককে সরকার এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়।'
এর আগেই সরকারের এ অবস্থানের কথা বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়। গতকাল সকালে বিশ্বব্যাংকের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার গতকাল বিশ্বব্যাংককে জানিয়েছে, তারা পদ্মা সেতুর জন্য অর্থায়নের অনুরোধ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।
দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক গত বছরের ১৮ জুন ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করার পর ৯ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এ প্রকল্পে অর্থায়ন বা ঋণ চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ না করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ওই বৈঠকে। এরপর ছয় মাস ধরে নানা দেন-দরবার করেও বিশ্বব্যাংকের সাড়া না মেলায় সরকার আবার নিজস্ব অর্থায়নের পথে ফিরে যায়।
কয়েক দিন ধরেই সরকারের মন্ত্রীরা নিজস্ব বা বিকল্প অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলে আসছিলেন। গতকালও এ ব্যাপারে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রী। বিশ্বব্যাংকে অর্থায়ন পুনর্বিবেচনার অনুরোধ প্রত্যাহারের চিঠি দেওয়ার পর গতকাল অর্থমন্ত্রী বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন, নিজস্ব অর্থায়নে আমরা এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করব। তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী বিকল্প ব্যবস্থায় পদ্মা সেতু নির্মাণের লক্ষ্য সামনে রেখেই আমরা দ্রুত কাজ শুরু করব।'
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মালয়েশিয়া, চীন ও ভারত পদ্মা সেতু নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যেই অর্থায়ন নিশ্চিত করা হবে। তবে নিজস্ব অর্থায়নেও সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ সরকারের মেয়াদেই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হবে।
২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ছাড়াও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সঙ্গে সরকারের ঋণ চুক্তি হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, এ তিন সংস্থা সরকারের পাশে থাকবে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আমি তো আগেই বিশ্বব্যাংককে বলেছিলাম, তোমরা তোমাদের সিদ্ধান্ত জানাও। তার পরও কোনো সাড়া না পেয়ে গত বৃহস্পতিবার আমি বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি ও জাইকাকে চিঠি দিয়েছি। বিশ্বব্যাংককে বলেছি, অর্থায়ন পুনর্বিবেচনার যে অনুরোধ আমরা করেছিলাম, তা আমরা প্রত্যাহার করছি। এখন আমাদের এ প্রকল্পে তোমাদের অর্থায়নের আর প্রয়োজন নেই। তবে আমার বিশ্বাস, অন্যান্য দাতা সংস্থা যারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা আমাদের পাশে থাকবে।'
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্তি সচিব আরাস্তু খান স্বাক্ষরিত সরকারের ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার কিছুদিন আগে থেকেই বলছে যে তারা ২০১৩ সালের জানুয়ারির মধ্যে পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের প্রত্যাবর্তন আশা করছিল এবং জানুয়ারিতেই এ বিষয়ক বিকল্প সিদ্ধান্ত নিতে সরকার বদ্ধপরিকর। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার গতকাল বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দেয় যে তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ এক্ষুনিই শুরু করতে চাচ্ছে এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ছাড়াই কাজটি শুরু করতে হচ্ছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের সময়সূচি অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ অনিশ্চিত। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সূচি এবং পদক্ষেপ নিয়ে সব উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে আলোচনার জন্য সত্বর তাদের ঢাকায় আহ্বান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ঋণ চুক্তি বাতিলের পর সরকারের অনুরোধে গত ২০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুতে নতুন করে যুক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। এ জন্য কয়েকটি শর্তও দিয়েছিল সংস্থাটি। এর মধ্যে অন্যতম ছিল দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগের তদন্তে একটি বিশেষজ্ঞদলের তদারকির সুযোগ দেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে ছুটিতে পাঠানোর শর্তও ছিল। সেই মোতাবেক তিনি ছুটিতেও যান। তখন তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ছুটিতে গেলেও বিশ্বব্যাংক টাকা দেবে না। গতকাল সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে তিনি বলেন, 'সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে। এ অর্থ পদ্মা সেতু প্রকল্পে খরচ করা যেতে পারে। আমাদের দেশে যথেষ্ট প্রযুক্তি রয়েছে। যদি বিদেশি প্রযুক্তি প্রয়োজন হয়, তাহলে তা আনা যেতে পারে।'
গতকাল বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে বলা হয়, তবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে তদন্ত চালিয়ে যাবে বলে বিশ্বব্যাংককে জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির পূর্ণ ও নিরপেক্ষ তদন্ত শেষ করার জন্য তারা দুর্নীতি দমন কমিশনকে উৎসাহ দিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, দুদক তদন্তকাজ চালিয়ে যাবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন করা না করার ওপর দুদকের তদন্ত নির্ভর করছে না বলে মন্তব্য করেছেন দুদক কমিশনার মো. বদিউজ্জামান। গতকাল কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'বিশ্বব্যাংক অর্থ দেবে কি দেবে না, এর কোনো প্রভাব পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের মামলায় পড়বে না। দুদকের মামলার তদন্ত যেভাবে চলছে, তা আপন গতিতেই চলবে। যারা দোষী প্রমাণিত হবে, তাদের বিরুদ্ধেই চার্জশিট দেওয়া হবে। তদন্তে যদি আরো কারো সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ এনে গত বছর ২৯ জুন ১২০ কোটি ডলার ঋণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পর ২০ সেপ্টেম্বর এ প্রকল্পে ফিরে আসার ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক। পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতির তদন্ত পর্যবেক্ষণে গত বছরের ১৬ অক্টোবর প্রথম ঢাকা সফরে আসে বিশ্বব্যাংক গঠিত তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল। লুই মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে এ প্রতিনিধিদল তাদের প্রথম সফরে দুদকের সঙ্গে কয়েক দফায় বৈঠক করে। ডিসেম্বরে আবারও আসে তারা। এ সময় দুদককে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মামলায় আসামি না করায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল। এ প্যানেল তাদের আপত্তির কথা দুদককে চিঠি দিয়ে জানায়। এরপর দুদকও চিঠির জবাব দেয়। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয় থেকে বলা হয়েছিল, সহসাই ওয়াশিংটন সদর দপ্তর থেকে সংস্থাটির সিদ্ধান্ত জানা যাবে। প্রতীক্ষার এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, বিশ্বব্যাংককে জানুয়ারি মাসের মধ্যেই তাদের সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। ৩১ জানুয়ারি বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষার পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরে সরকারের সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে চিঠি পাঠান বলে ইআরডি কর্মকর্তারা জানান।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার এরই মধ্যে প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অর্থ পদ্মা সেতু প্রকল্পে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া সেরে রেখেছে পরিকল্পনা কমিশন। এ ছাড়া কোন অর্থবছরে কত টাকা দরকার, তা জানতে সেতু বিভাগকে নিদের্শ দিয়ে রেখেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে এডিবি, জাইকা এবং আইডিবিকে যুক্ত করতে হলে নতুন করে তাদের সঙ্গে ঋণচুক্তি করতে হবে। এ ছাড়া চীনের একটি প্রস্তাবও সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। এর আগে আসা মালয়েশিয়ার প্রস্তাবটির চেয়ে চীনের প্রস্তাব অনেক দিক থেকে ভালো বলেও তারা জানায়।
গত বছরের জুন মাসে মন্ত্রিসভায় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তাঁর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে অর্থের সম্ভাব্য উৎসের খোঁজ নিতে বলেছিলেন। ড. মসিউর দেশের কারিগরি ও আর্থিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি খসড়াও তৈরি করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ সরকার আবার বিশ্বব্যাংকের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তা আর আলোর মুখ দেখেনি। ওই খসড়ায় রেল বাদ দিয়ে কেবল সড়ক সেতু নির্মাণের কথা বলা হয়। খরচ ধরা হয় ১৭০ থেকে ১৮০ কোটি ডলার। সরকারের অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল, অব্যবহৃত বৈদেশিক সহায়তার অংশ ও বাজারে বন্ড ছেড়ে এ অর্থ জোগানের একটি রূপরেখাও এতে ছিল। প্রায় ছয় মাস পর সরকার এখন ওই পথেই এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খরচ কমানোর জন্য কেবল সড়ক সেতু তৈরির কথাই বলা হচ্ছে এখন।
সরে গেল এডিবি
No comments