বগুড়ায় আজ সকাল-সন্ধ্যা হরতাল- নিহতদের জানাজায় মানুষের ঢলঃ জামায়াত-শিবিরের ৩ সহস্রাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা by আবুল কালাম আজাদ
ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের
ছুরিকাঘাত ও পুলিশের গুলিতে জামায়াত-শিবিরের তিন নেতাকর্মী হত্যার ঘটনায়
বগুড়ায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
হত্যাকাণ্ডের
প্রতিবাদে ও খুনিদের বিচারের দাবিতে জামায়াত ও ছাত্রশিবির আজ শনিবার
বগুড়া জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে। বৃহস্পতিবারের ঘটনায়
পুলিশ তিন হাজারের বেশি জামায়াত ও শিবির নেতাকর্মীর নামে দু’টি মামলা
করেছে। হাসপাতালে লাশ দেখতে যাওয়ার পর পুলিশ নিহতদের স্বজন ও
শিবিরকর্মীদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ করে কমপে ৩৫ জনকে গ্রেফতার করেছে।
জামায়াত ও শিবির নেতাকর্মীদের লাশ গতকাল নিজ নিজ এলাকায় দাফন করা হয়েছে।
প্রতিটি নামাজে জানাজায় জনতার ঢল নামে।
ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও পুলিশের হাতে তিন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী নিহত হওয়ার পর বগুড়া শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। গতকাল শহরজুড়ে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। পুলিশের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক র্যাব ও আর্মড ব্যাটালিয়ন পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় বিজিবিকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে ও পুলিশ-র্যাবের টহল জোরদার করা হয়।
আজ হরতাল : তিন নেতাকর্মী হত্যার প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবির আজ শনিবার বগুড়া জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে। হরতাল সফল করতে জামায়াত ও শিবিরকর্মীরা যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত বলে বগুড়া শহর জামায়াতের সেক্রেটারি মাজেদুর রহমান জুয়েল জানিয়েছেন। আজকের হরতাল অতীতের যেকোনো হরতালের চেয়ে আলাদা হবে বলেও তিনি জানান।
পুলিশের মামলা : এ দিকে পুলিশ বাদি হয়ে তিন হাজার ৬০ জন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীর নামে মামলা করেছে।
বগুড়ার সহকারী পুলিশ সুপার মকবুল হোসেন জানান, বগুড়ার সাতমাথায় পুলিশের সাথে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় উপপুলিশ পরিদর্শক মঞ্জুরুল হক বাদি হয়ে ৩০ জনের নাম ধরে এবং অজ্ঞাত আরো এক হাজার ৫০০ জন ও জামিলনগর এলাকায় পুলিশের সাথে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষের ঘটনায় উপপুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন বাদি হয়ে ৩০ জনের নাম ধরে অজ্ঞাত আরো এক হাজার ৫০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
এ দিকে ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি আলরাজী জুয়েলের নেতৃত্বে পরিচালিত হামলায় নির্মমভাবে নিহত শিবির নেতা আবু রোহানীর বড়ো ভাই রফিকুল ও ভগ্নিপতি হারুনুর রশিদকে বৃহস্পতিবার রাতে জোর করে থানায় নেয় পুলিশ। এরপর রফিকুলকে ছেড়ে দিলেও হারুনকে আটকে রাখে। পরে একটি মামলায় স্বার দিতে চাপ সৃষ্টি করে। প্রথমে স্বার দিতে অস্বীকৃতি জানালে পরে তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে জোর করে স্বার নেয় পুলিশ। ছাত্রলীগ ক্যাডারদের বাঁচাতেই পুলিশ নিজেরা মামলা লিখে রোহানীর ভগ্নিপতিকে জোরপূর্বক বাদি বানিয়েছে বলে তার পরিবার অভিযোগ করেছে।
ছাত্রলীগের হামলা : গতকাল নামাজে জানাজা শেষে ফেরার পথে সাতমাথায় পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগের ক্যাডাররা জামায়াত-শিবির কর্মীদের মারধর করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জামায়াত নেতারা অভিযোগ করেছেন, সেন্ট্রাল হাইস্কুল মাঠে গায়েবানা নামাজে জানাজা শেষে ফেরার পথে সাতমাথা ও তার আশপাশের বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা জামায়াত ও শিবিরের বেশ ক’জন কর্মীকে মারধর করে। এ সময় পুলিশ নীরব ছিল। তবে পুলিশ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
পুলিশের হামলা, গণগ্রেফতার : বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলায় গুরুতর আহত জামায়াত ও শিবির কর্মীদের শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পর শত শত দলীয় কর্মী এবং হতাহতদের স্বজনেরা হাসপাতালে ছুটে যান। তখন শোকাহত নেতাকর্মী ও স্বজনদের ওপর লাঠিচার্জ করে পুলিশ। একপর্যায়ে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগের গেট বন্ধ করে অবস্থানরত শিবির কর্মী ও নিহতদের স্বজনসহ ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে নিহত শিবির নেতা আবু রোহানীর বড় ভাই ব্যাংক কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম এবং ভগ্নিপতি হারুনুর রশিদ রয়েছেন। পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এ সময় পুলিশ মহিলাদেরও মারধর করে বলে অভিযোগ করেছেন নিহতের স্বজনেরা।
মহাসড়ক অবরোধ : শিবির নেতা আবু রোহানীর খুনিদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বগুড়া সদরের এরুলিয়া এলাকার হাজার হাজার মানুষ বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়ক অবরোধ করে বিােভ করেন। বৃহস্পতিবার রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত অবরোধ চলাকালে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ অবরোধকারীদের জোর করে হটিয়ে দিতে গেলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ গেলে অবরোধকারীরা অবরোধ তুলে নেয়।
গায়েবানা নামাজে জানাজায় ঢল : নিহত তিন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীর প্রথম গায়েবানা নামাজে জানাজা গতকাল শুক্রবার বাদ জুমা শহরের সেন্ট্রাল হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশ নামাজে জানাজার, অনুমতি না দেয়ায় গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বগুড়া জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির ও কাহালু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা তায়েব আলী এতে ইমামতি করেন।
জানাজাপূর্ব সমাবেশে বক্তব্য রাখেন রাজশাহী মহানগরী জামায়াতের আমির আতাউর রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আমির নজরুল ইসলাম, বগুড়া জেলা জামায়াতের আমির শাহাবুদ্দিন, ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় ছাত্রকল্যাণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, স্কুল কার্যক্রম সম্পাদক জাকির হোসেন সেলিম, বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চাঁন, বগুড়া শহর জামায়াতের সেক্রেটারি মাজেদুর রহমান জুয়েল, শহর শিবিরের সভাপতি আলাউদ্দিন সোহেল, জেলা উত্তর সভাপতি মিজানুর রহমান, জেলা দণি সভাপতি আল আমিন এবং শহীদ আবু রোহানীর বড় ভাই রফিকুল ইসলাম। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সহসভাপতি গোলাম রব্বানী, নাটোর ও জয়পুরহাট জেলা জামায়াতের আমির, বগুড়া জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা আলমগীর হুসাইন, মাওলানা আব্দুল হক সরকার, সেক্রেটারি অধ্যাপক নাজিম উদ্দিন, জাগপার জেলা সভাপতি আমির হোসেন মণ্ডল, এলডিপির জেলা সভাপতি মোখলেছুর রহমানসহ ১৮ দলীয় জোটের নেতা এবং জামায়াত ও শিবির নেতারা নামাজে জানাজায় উপস্থিত ছিলেন। গায়েবানা জানাজায় ৩০ হাজারের অধিক মানুষ অংশ নেন বলে প্রত্যদর্শীরা জানান। পরে আবু রোহানীর দ্বিতীয় নামাজে জানাজা তার গ্রামের বাড়ি বগুড়া শহরতলীর এরুলিয়া মণ্ডলপাড়ায় স্থানীয় হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন।
জানাজাপূর্ব বক্তব্যে নেতারা বলেন, শেখ হাসিনার খুনি সরকারের মন্ত্রী এবং পুলিশ কর্মকর্তারা পুলিশ এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুণ্ডাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন। জামায়াত-শিবির দেখলেই গুলি চালানোর হুকুম দিয়েছেন। বগুড়ার জামায়াত ও শিবিরের তিন নেতাকর্মী হত্যার দায় এসব মন্ত্রী, পুলিশ কর্মকর্তা এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেও নিতে হবে। জামায়াত এবং শিবির কর্মীরা মৃত্যুকে ভয় করে না। আপনাদের গুলি শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু জামায়াত-শিবির কর্মীদের বুকের রক্ত শেষ হবে না। নেতারা অবিলম্বে জামায়াত ও শিবিরের তিন নেতাকর্মীর খুনি ছাত্রলীগ, যুবলীগের গুণ্ডাবাহিনী এবং পুলিশের দোষী সদস্যদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। অন্যথায় জামায়াত ও শিবির কর্মীরা নিজেরাই খুনের বদলা নিতে প্রস্তুত বলে নেতারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। নিহত জামায়াত কর্মী মিজানুর রহমানের লাশ কুমিল্লার তিতাস উপজেলার উত্তর মানিক নগরে, শিবির নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনের লাশ তার গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার আদর্শপাড়ায় এবং রুহানীর লাশ নিজ গ্রামে নামাজে জানাজা শেষে দাফন করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নামাজে জানাজা স্থলে বিপুল পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
এ দিকে বৃহস্পতিবার হরতাল চলাকালে নিহত আযিযুল হক কলেজ শাখার শিবির সভাপতি আবু রোহানী ও কুমিল্লার মিজানুর রহমান নিহত হওয়ার ঘটনায় শুক্রবার দু’টি মামলা হয়েছে। বগুড়া সদর থান পুলিশ পরিদর্শক সৈয়দ শহীদ আলম জানান, নিহত মিজানুর রহমানের স্ত্রী হালিমা আক্তার বাদি হয়ে অজ্ঞাত ৮-১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। রোহানী হত্যা ঘটনায় তার ভগ্নিপতি মো: হারুন অজ্ঞাত আরো ৮-১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
মনিরামপুরে ৩০০ জনকে আসামি করে মামলা
যশোর অফিস জানায়, যশোরের মনিরামপুরে বৃহস্পতিবারের হরতালে জামায়াত-শিবিরের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় উপজেলা জামায়াতের আমির প্রভাষক ফজলুল হক, সেক্রেটারি লিয়াকত আলী, শিবির নেতা আবু সালেহ মুহাম্মদ উবায়দুল্লাহ, রুহুল কুদ্দুসসহ ৭৪ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা করেছে পুলিশ। এ মামলায় জামায়াত-শিবিরের অজ্ঞাত আরো ২০০ নেতা কর্মীকেও আসামি করা হয়েছে।
পুলিশের উপপরিদর্শক শরিফুল ইসলাম বাদি হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে মামলাটি করেন। মনিরামপুর থানার ওসি আলী আজম জানান, মামলার আসামিদের আটকের জন্য অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার ভোরে মনিরামপুর শহরে জামায়াত-শিবিরের মিছিলে পুলিশ ও ছাত্রলীগ গুলিবর্ষণ ও হামলা চালায়। একপর্যায়ে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে জামায়াত-শিবিরের ২৫ নেতাকর্মীসহ তিন পুলিশ আহত হন। সংঘর্ষ চলাকালে মনিরামপুর থানার পুলিশ কনস্টেবল জহুরুল ইসলাম হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াবন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
এ দিকে সংঘর্ষ চলাকালে আটক আহত শিবির কর্মী মনিরুজ্জামান ও জালাল উদ্দিন কিছুটা সুস্থ হওয়ায় গতকাল তাদের জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। আহত অপর দুই শিবির কর্মী ইয়াসিন ও শাহ মুরাদের অবস্থার অবনতি হওয়ায় গতকাল তাদের মনিরামপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে যশোর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও পুলিশের হাতে তিন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী নিহত হওয়ার পর বগুড়া শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। গতকাল শহরজুড়ে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। পুলিশের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক র্যাব ও আর্মড ব্যাটালিয়ন পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় বিজিবিকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে ও পুলিশ-র্যাবের টহল জোরদার করা হয়।
আজ হরতাল : তিন নেতাকর্মী হত্যার প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবির আজ শনিবার বগুড়া জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে। হরতাল সফল করতে জামায়াত ও শিবিরকর্মীরা যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত বলে বগুড়া শহর জামায়াতের সেক্রেটারি মাজেদুর রহমান জুয়েল জানিয়েছেন। আজকের হরতাল অতীতের যেকোনো হরতালের চেয়ে আলাদা হবে বলেও তিনি জানান।
পুলিশের মামলা : এ দিকে পুলিশ বাদি হয়ে তিন হাজার ৬০ জন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীর নামে মামলা করেছে।
বগুড়ার সহকারী পুলিশ সুপার মকবুল হোসেন জানান, বগুড়ার সাতমাথায় পুলিশের সাথে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় উপপুলিশ পরিদর্শক মঞ্জুরুল হক বাদি হয়ে ৩০ জনের নাম ধরে এবং অজ্ঞাত আরো এক হাজার ৫০০ জন ও জামিলনগর এলাকায় পুলিশের সাথে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষের ঘটনায় উপপুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন বাদি হয়ে ৩০ জনের নাম ধরে অজ্ঞাত আরো এক হাজার ৫০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
এ দিকে ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি আলরাজী জুয়েলের নেতৃত্বে পরিচালিত হামলায় নির্মমভাবে নিহত শিবির নেতা আবু রোহানীর বড়ো ভাই রফিকুল ও ভগ্নিপতি হারুনুর রশিদকে বৃহস্পতিবার রাতে জোর করে থানায় নেয় পুলিশ। এরপর রফিকুলকে ছেড়ে দিলেও হারুনকে আটকে রাখে। পরে একটি মামলায় স্বার দিতে চাপ সৃষ্টি করে। প্রথমে স্বার দিতে অস্বীকৃতি জানালে পরে তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে জোর করে স্বার নেয় পুলিশ। ছাত্রলীগ ক্যাডারদের বাঁচাতেই পুলিশ নিজেরা মামলা লিখে রোহানীর ভগ্নিপতিকে জোরপূর্বক বাদি বানিয়েছে বলে তার পরিবার অভিযোগ করেছে।
ছাত্রলীগের হামলা : গতকাল নামাজে জানাজা শেষে ফেরার পথে সাতমাথায় পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগের ক্যাডাররা জামায়াত-শিবির কর্মীদের মারধর করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জামায়াত নেতারা অভিযোগ করেছেন, সেন্ট্রাল হাইস্কুল মাঠে গায়েবানা নামাজে জানাজা শেষে ফেরার পথে সাতমাথা ও তার আশপাশের বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা জামায়াত ও শিবিরের বেশ ক’জন কর্মীকে মারধর করে। এ সময় পুলিশ নীরব ছিল। তবে পুলিশ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
পুলিশের হামলা, গণগ্রেফতার : বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলায় গুরুতর আহত জামায়াত ও শিবির কর্মীদের শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পর শত শত দলীয় কর্মী এবং হতাহতদের স্বজনেরা হাসপাতালে ছুটে যান। তখন শোকাহত নেতাকর্মী ও স্বজনদের ওপর লাঠিচার্জ করে পুলিশ। একপর্যায়ে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগের গেট বন্ধ করে অবস্থানরত শিবির কর্মী ও নিহতদের স্বজনসহ ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে নিহত শিবির নেতা আবু রোহানীর বড় ভাই ব্যাংক কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম এবং ভগ্নিপতি হারুনুর রশিদ রয়েছেন। পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এ সময় পুলিশ মহিলাদেরও মারধর করে বলে অভিযোগ করেছেন নিহতের স্বজনেরা।
মহাসড়ক অবরোধ : শিবির নেতা আবু রোহানীর খুনিদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বগুড়া সদরের এরুলিয়া এলাকার হাজার হাজার মানুষ বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়ক অবরোধ করে বিােভ করেন। বৃহস্পতিবার রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত অবরোধ চলাকালে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ অবরোধকারীদের জোর করে হটিয়ে দিতে গেলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ গেলে অবরোধকারীরা অবরোধ তুলে নেয়।
গায়েবানা নামাজে জানাজায় ঢল : নিহত তিন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীর প্রথম গায়েবানা নামাজে জানাজা গতকাল শুক্রবার বাদ জুমা শহরের সেন্ট্রাল হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশ নামাজে জানাজার, অনুমতি না দেয়ায় গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বগুড়া জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির ও কাহালু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা তায়েব আলী এতে ইমামতি করেন।
জানাজাপূর্ব সমাবেশে বক্তব্য রাখেন রাজশাহী মহানগরী জামায়াতের আমির আতাউর রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আমির নজরুল ইসলাম, বগুড়া জেলা জামায়াতের আমির শাহাবুদ্দিন, ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় ছাত্রকল্যাণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, স্কুল কার্যক্রম সম্পাদক জাকির হোসেন সেলিম, বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চাঁন, বগুড়া শহর জামায়াতের সেক্রেটারি মাজেদুর রহমান জুয়েল, শহর শিবিরের সভাপতি আলাউদ্দিন সোহেল, জেলা উত্তর সভাপতি মিজানুর রহমান, জেলা দণি সভাপতি আল আমিন এবং শহীদ আবু রোহানীর বড় ভাই রফিকুল ইসলাম। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সহসভাপতি গোলাম রব্বানী, নাটোর ও জয়পুরহাট জেলা জামায়াতের আমির, বগুড়া জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা আলমগীর হুসাইন, মাওলানা আব্দুল হক সরকার, সেক্রেটারি অধ্যাপক নাজিম উদ্দিন, জাগপার জেলা সভাপতি আমির হোসেন মণ্ডল, এলডিপির জেলা সভাপতি মোখলেছুর রহমানসহ ১৮ দলীয় জোটের নেতা এবং জামায়াত ও শিবির নেতারা নামাজে জানাজায় উপস্থিত ছিলেন। গায়েবানা জানাজায় ৩০ হাজারের অধিক মানুষ অংশ নেন বলে প্রত্যদর্শীরা জানান। পরে আবু রোহানীর দ্বিতীয় নামাজে জানাজা তার গ্রামের বাড়ি বগুড়া শহরতলীর এরুলিয়া মণ্ডলপাড়ায় স্থানীয় হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন।
জানাজাপূর্ব বক্তব্যে নেতারা বলেন, শেখ হাসিনার খুনি সরকারের মন্ত্রী এবং পুলিশ কর্মকর্তারা পুলিশ এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুণ্ডাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন। জামায়াত-শিবির দেখলেই গুলি চালানোর হুকুম দিয়েছেন। বগুড়ার জামায়াত ও শিবিরের তিন নেতাকর্মী হত্যার দায় এসব মন্ত্রী, পুলিশ কর্মকর্তা এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেও নিতে হবে। জামায়াত এবং শিবির কর্মীরা মৃত্যুকে ভয় করে না। আপনাদের গুলি শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু জামায়াত-শিবির কর্মীদের বুকের রক্ত শেষ হবে না। নেতারা অবিলম্বে জামায়াত ও শিবিরের তিন নেতাকর্মীর খুনি ছাত্রলীগ, যুবলীগের গুণ্ডাবাহিনী এবং পুলিশের দোষী সদস্যদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। অন্যথায় জামায়াত ও শিবির কর্মীরা নিজেরাই খুনের বদলা নিতে প্রস্তুত বলে নেতারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। নিহত জামায়াত কর্মী মিজানুর রহমানের লাশ কুমিল্লার তিতাস উপজেলার উত্তর মানিক নগরে, শিবির নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনের লাশ তার গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার আদর্শপাড়ায় এবং রুহানীর লাশ নিজ গ্রামে নামাজে জানাজা শেষে দাফন করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নামাজে জানাজা স্থলে বিপুল পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
এ দিকে বৃহস্পতিবার হরতাল চলাকালে নিহত আযিযুল হক কলেজ শাখার শিবির সভাপতি আবু রোহানী ও কুমিল্লার মিজানুর রহমান নিহত হওয়ার ঘটনায় শুক্রবার দু’টি মামলা হয়েছে। বগুড়া সদর থান পুলিশ পরিদর্শক সৈয়দ শহীদ আলম জানান, নিহত মিজানুর রহমানের স্ত্রী হালিমা আক্তার বাদি হয়ে অজ্ঞাত ৮-১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। রোহানী হত্যা ঘটনায় তার ভগ্নিপতি মো: হারুন অজ্ঞাত আরো ৮-১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
মনিরামপুরে ৩০০ জনকে আসামি করে মামলা
যশোর অফিস জানায়, যশোরের মনিরামপুরে বৃহস্পতিবারের হরতালে জামায়াত-শিবিরের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় উপজেলা জামায়াতের আমির প্রভাষক ফজলুল হক, সেক্রেটারি লিয়াকত আলী, শিবির নেতা আবু সালেহ মুহাম্মদ উবায়দুল্লাহ, রুহুল কুদ্দুসসহ ৭৪ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা করেছে পুলিশ। এ মামলায় জামায়াত-শিবিরের অজ্ঞাত আরো ২০০ নেতা কর্মীকেও আসামি করা হয়েছে।
পুলিশের উপপরিদর্শক শরিফুল ইসলাম বাদি হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে মামলাটি করেন। মনিরামপুর থানার ওসি আলী আজম জানান, মামলার আসামিদের আটকের জন্য অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার ভোরে মনিরামপুর শহরে জামায়াত-শিবিরের মিছিলে পুলিশ ও ছাত্রলীগ গুলিবর্ষণ ও হামলা চালায়। একপর্যায়ে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে জামায়াত-শিবিরের ২৫ নেতাকর্মীসহ তিন পুলিশ আহত হন। সংঘর্ষ চলাকালে মনিরামপুর থানার পুলিশ কনস্টেবল জহুরুল ইসলাম হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াবন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
এ দিকে সংঘর্ষ চলাকালে আটক আহত শিবির কর্মী মনিরুজ্জামান ও জালাল উদ্দিন কিছুটা সুস্থ হওয়ায় গতকাল তাদের জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। আহত অপর দুই শিবির কর্মী ইয়াসিন ও শাহ মুরাদের অবস্থার অবনতি হওয়ায় গতকাল তাদের মনিরামপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে যশোর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
No comments