আদমশুমারি-জনমিতির কার্বন-কপি মনস্তত্ত্ব by পাভেল পার্থ
সেই একই মুখস্থ অধিপতি চেহারা ও কার্বন-কপি মনস্তত্ত্ব নিয়ে পঞ্চমবারের মতো প্রশ্নহীনভাবে ১৫ মার্চ থেকে শুরু হতে যাচ্ছে জাতীয় 'আদমশুমারি ও গৃহগণনা জরিপ'।
এর পরও এবার অবিস্মরণীয়ভাবে জাতীয় জনশুমারিতে দেশের প্রায় সব প্রান্তিক বর্গকে অন্তর্ভুক্ত করার জোরালো জনদাবির খণ্ডিত কিছু রাষ্ট্র মেনেও নিয়েছে। এরপরও বিস্তর দাবি ও আকাঙ্ক্ষাকে আড়াল করেই এই শুমারি শুরু হতে যাচ্ছে। বাদ পড়ে যাচ্ছে দেশের অনেক আদিবাসী, বাদ থাকছে ছিটমহলবাসী, বেদে-মাঙতা জনগণ, সর্বপ্রাণবাদী ধর্মীয় সম্প্রদায়, হিজড়া, ভিন্নভাবে সক্ষম জনগণ, বনজীবী ও দলিত জনগণ। আগের চার-চারটি শুমারি জরিপের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দেশের হাওর, চা বাগান, চর, বিল, অরণ্য ও পাহাড়ের জনগণ নির্দয়ভাবে দেশের জনপরিসংখ্যান থেকে উধাও হয়েছে। সুন্দরবনের দুবলারচরের মৌসুমি জেলেসহ দেশের নানা শহরে কাজ করতে আসা উদ্বাস্তু মানুষ বরাবরই নিরুদ্দেশ থেকেছে রাষ্ট্রের জনশুমারিতে। পাশাপাশি কোনো জাতীয় শুমারি জরিপেই দেশের সব জাতি-ধর্ম-পেশা ও লিঙ্গের আত্মপরিচয় ও পরিসর চিহ্নিত হয়নি। এমন কোনো শুমারি জরিপ নেই যেখানে সাংসারিক ধর্ম পালনকারী মান্দি, ক্রামা ধর্ম পালনকারী ম্রো, সনামহী ধর্মের মৈতৈ এবং জেন্টিল ধর্মের খাসি আদিবাসী জনগণের নির্ভুল ধর্মীয় পরিচয় উলিল্গখিত হয়েছে। সব শুমারি পরিসংখ্যানেই 'অন্যান্য' বলে সব প্রান্তিক বর্গের এক সাধারণ যোগফল থাকে, যেখান থেকে কোনো কিছুই ঠাহর করা সম্ভব নয়। এই প্রশ্নহীন 'অন্যান্য' সংখ্যাটিই জনমিতিকে ঘিরে রাষ্ট্রের অধিপতি কার্বন-কপি চেহারাকে হাজির করে বারবার। আমরা আশা করব রাষ্ট্র আসন্ন শুমারি জরিপে জনমিতির এই মুখস্থ কার্বন-কপি মনস্তত্ত্ব থেকে সরে এসে দেশের সব বর্গের জনপরিসংখ্যান অধিকার নিশ্চিত করবে।
আমরা মানছি যে, প্রতিটি শব্দ ও প্রত্যয়ই প্রবলভাবে রাজনৈতিক। দেশের জাতীয় শুমারি জরিপের বহুল প্রচলিত 'আদমশুমারি' নামপ্রত্যয়টি নিয়েও আমাদের বাহাস আছে। 'আদমশুমারি' প্রত্যয়টিতে জনমিতির লিঙ্গবৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি উস্কে ওঠে। 'আদমশুমারির' আদমকে আমরা পুরুষবাচক হিসেবেই পাঠ করি, ঠিক যেমন 'ইভটিজিং'-এর ইভকে নারীবাচক হিসেবে পাঠ করা হয়। যেখানে দেশের সব লিঙ্গের জনগণনা হয় সেখানে তা কেবল একটি বহুল প্রচলিত পুরুষবাচক প্রত্যয় দিয়ে নামকরণের ধারাবাহিকতা পুরুষতান্ত্রিকতার মৌলিক বৈষম্যের পাটাতনকেই মেলে ধরে। আদমশুমারির মতো একটি পুরুষতান্ত্রিক শব্দ পাল্টে একে 'জনশুমারি' বা 'গণশুমারি' করা যেতে পারে। পঞ্চম জাতীয় শুমারি শুরুর আগেই এ শব্দটি পাল্টানো জরুরি। কারণ বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে কোনোভাবেই লিঙ্গীয় বৈষম্যহীন শুমারি আশা করা যায় না।
আমরা মূলত জনমিতির এই ঔপনিবেশিক অধিপতি মনস্তত্ত্ব নিয়েই আলাপটি তুলেছি। কারণ এটি রাষ্ট্রের চিন্তাজগতের সার্বভৌম সীমানা ও রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিভূমি। রাষ্ট্র কেন কোনো বর্গকে আড়াল ও অদৃশ্য করতে চায়? এটি রাষ্ট্রের বয়ে নিয়ে চলা এক দগদগে নির্দয় ঔপনিবেশিকতা। যেখানে রাষ্ট্রের এজেন্সিগুলোর চাপানো হাজারো শর্ত পূরণ করতে না পারা অনেক মানুষ রাষ্ট্রীয় উপস্থাপনে বরাবরই 'অপর' হয়ে থাকে। হাতিখেদা আন্দোলনের সময় যেসব বিদ্রোহী হাজং রাজা হাতিবাণিজ্যের বিরোধিতা করেছিল তাদের নাম দেওয়া হয়েছিল 'রাজা-অবাধ্য'। ব্রিটিশ উপনিবেশকালে অন্যায় ব্রিটিশ শাসনকে রুখে দাঁড়ানো আদিবাসীদের নাম দেওয়া হয়েছিল 'ক্রিমিনাল ট্রাইব'। ঠিক যেমন রাষ্ট্র ১৯৭১ সাল থেকে দীর্ঘ চলিল্গশ বছরেও দেশের প্রায় ত্রিশ লাখ প্রান্তিক জাতির একক পরিচয় সম্পর্কে কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এই প্রথম দেশের কোনো জাতীয় শুমারি বাঙালি জনগণকে 'নৃ-গোষ্ঠী' হিসেবে চিহ্নিত করার নির্দেশনা দিয়েছে। কারণ পঞ্চম জনশুমারিতে দেশের কিছু 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে' অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী' প্রত্যয়টি একই সঙ্গে হাজির করে যে, দেশে বৃহৎ নৃ-গোষ্ঠী আছে। নিশ্চয়ই জনপরিসংখ্যানে বাঙালির চেয়ে এ সংখ্যা কেউ অতিক্রম করতে পারবে না।
আসন্ন জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রতিবেশ-রাজনৈতিক পরিসরটি নিয়েও আলাপ শুরু করা জরুরি। কারণ এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিশ্চুপতা ও অস্পষ্টতা আমাদের প্রবলভাবে আশঙ্কিত করে তুলছে। রক্ত, মজ্জা, হাড়, মাংস, ঘামের নানা অস্তিত্ব ও সম্পর্ক নিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ ভূগোলের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক শরীর। বিরাজিত ও পরিবর্তনশীল গ্রাম জনপদের অংশ নিয়েই এই শরীরের সীমানা। বাঙালিদের গ্রাম, চাকমাদের আদম, ত্রিপুরাদের কামি, মান্দিদের সঙ, লেঙামদের নং, সাঁওতালদের আতো, হাজংদের গাঁওসহ নানা বৈচিত্র্যময় বসতির সংঘর্ষ ও নির্মাণ নিয়েই এই বাংলার ভূগোল। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, চলতি শুমারি ও গৃহগণনা জরিপ দেশের গ্রাম-জনপদের প্রতিবেশীয় ভিন্নতাকে বিবেচনা করেই এক জনজরিপ সফল করে তুলবে। কিন্তু আমরা আশঙ্কিত অন্য কারণে। গৃহ ও খানা বলতে রাষ্ট্র কি জনজীবনের ঐতিহাসিকতাকে আড়াল করে ফেলবে? চলতি শুমারি জরিপ কি বেদে-মাঙতাদের নৌকাবহর ও হোড়াকে 'গ্রাম' ও 'গৃহ' হিসেবে চিহ্নিত করবে? যদি করে তবে তা বেদে-মাঙতা জীবনের বহমান ঐতিহাসিকতা অদৃশ্য করবে। কারণ বাঙালি দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত শুমারি জরিপ পদ্ধতি দিয়ে বেদে-মাঙতার জনজীবনের তথ্য সংগ্রহ নির্ভুল হবে না। বাঙালি গৃহধারণা দিয়ে বেদে-মাঙতা সমাজের হোড়াকে পাঠ করা যায় না। চলতি গৃহগণনা জরিপে খানা ও গৃহটি ভাসমান কি-না এমন একটি প্রশ্ন রাখা হয়েছে। সিলেট বিভাগের খাসি আদিবাসীসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক আদিবাসীর ঘরগুলো মাচাং পদ্ধতির। চলতি গৃহগণনা জরিপ কি দেশের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল ও সংস্কৃতির এই গৃহপরিসরকে সমস্বীকৃতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে, নাকি করবে? খানা জরিপের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ টানতে চাই। পুরুষপ্রধান খানা নাকি নারীপ্রধান খানা এটি পরিসংখ্যানিক জরিপের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটিও একটি পিতৃসূত্রীয় সমাজের মনস্তত্ত্ব। মান্দি, খাসি ও লেঙ্গাম মাতৃসূত্রীয় জাতির ক্ষেত্রে লিঙ্গপ্রেক্ষিতে খানাগুলোর 'প্রাধান্য' নির্ণয় করা খুব জটিল বিষয়। কারণ এসব সমাজে মাতৃসূত্রীয় ধারায় বংশসম্পত্তির অধিকার ও সন্তানদের পদবি পরিচয় মায়ের মাধ্যমে হলেও পরিবার কি সমাজের নিয়ন্ত্রণ পুরুষতান্ত্রিক। আশা করি পঞ্চম জাতীয় জনশুমারি ও গৃহগণনা জরিপ বিষয়গুলোকে বিবেচনা করবে।
আলাপটি শেষ করছি বেশকিছু অমীমাংসিত প্রশ্নকে শামিল করে। সিডর ও আইলার পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যে বিশাল জনগোষ্ঠী জীবন-জনপদ হারিয়ে বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়ে আছে, তাদের স্থায়ী ঠিকানা কি লেখা হবে? কারণ তাদের অনেকেরই বসতভিটা নোনাপানির তলায় ডুবে আছে। তারা ঠিকানা কি লিখবে? বেড়িবাঁধ নাকি নোনাজলের তলায় ডুবে থাকা গ্রাম? চট্টগ্রামের হালদা নদী থেকে মাছের ডিম সংগ্রহকারীরা কি কাজের ক্ষেত্র বা পেশার স্থলে 'বাইসজীবী বা সংগ্রহকারী' লিখবে? তাদের অনেকেই জেলে বা মৎস্যজীবী সল্ফপ্রদায় নয়। বছরে মাত্র একটি ঋতুতেই মাছের ডিম সংগ্রহ করে চলে তাদের অনেকের বছরের সংসার। সুন্দরবনের গোল-গরান-মধু-মোম-মাছ-কাঁকড়া আহরণকারীরা কি তাদের কাজের ক্ষেত্র ও পেশার স্থলে 'বনজীবী' পরিচয়টি পঞ্চম শুমারিতে দেখতে পাবে? দেশের গ্রাম জনপদে এখন আর এমন কোনো কৃষক-জুমিয়া নেই যারা কেবল শস্য-ফসল আবাদ করে জীবনধারণ করতে পারে। কৃষক-জুমিয়াদের একটা বড় অংশই বছরের কোনো সময় হয়ে পড়ে দিনমজুর বা মৌসুমি শ্রমিক। সংখ্যায় দেশের প্রধান এই বর্গের পেশা ও কাজের ক্ষেত্র কী হবে? কৃষি ও দিনমজুরি নাকি অন্যান্য? দেশের গ্রাম জনপদের কৃষাণী ও জুমিয়া নারীদের কাজের ক্ষেত্র ও পেশা কি চলতি শুমারি জরিপেও প্রশ্নহীনভাবে 'গৃহিণী' হিসেবেই চিহ্নিত হবে? এমনতর হাজারো প্রশ্ন আছে জনমনে। আর বারবার এসব প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াই হচ্ছে জনশুমারির কার্বন-কপি বাহাদুরি। এই মনস্তত্ত্ব পাল্টানোর আহ্বান জানাই আবার। কারণ তা না হলে দেশের জনগণের রক্ত জল করা পয়সা ও পরিশ্রমে তৈরি হওয়া শুমারি দলিল জনগণের শুমারি অধিকার সুরক্ষা করতে ব্যর্থ হবে।
পাভেল পার্থ : গবেষক
animistbangla@gmail.com
আমরা মানছি যে, প্রতিটি শব্দ ও প্রত্যয়ই প্রবলভাবে রাজনৈতিক। দেশের জাতীয় শুমারি জরিপের বহুল প্রচলিত 'আদমশুমারি' নামপ্রত্যয়টি নিয়েও আমাদের বাহাস আছে। 'আদমশুমারি' প্রত্যয়টিতে জনমিতির লিঙ্গবৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি উস্কে ওঠে। 'আদমশুমারির' আদমকে আমরা পুরুষবাচক হিসেবেই পাঠ করি, ঠিক যেমন 'ইভটিজিং'-এর ইভকে নারীবাচক হিসেবে পাঠ করা হয়। যেখানে দেশের সব লিঙ্গের জনগণনা হয় সেখানে তা কেবল একটি বহুল প্রচলিত পুরুষবাচক প্রত্যয় দিয়ে নামকরণের ধারাবাহিকতা পুরুষতান্ত্রিকতার মৌলিক বৈষম্যের পাটাতনকেই মেলে ধরে। আদমশুমারির মতো একটি পুরুষতান্ত্রিক শব্দ পাল্টে একে 'জনশুমারি' বা 'গণশুমারি' করা যেতে পারে। পঞ্চম জাতীয় শুমারি শুরুর আগেই এ শব্দটি পাল্টানো জরুরি। কারণ বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে কোনোভাবেই লিঙ্গীয় বৈষম্যহীন শুমারি আশা করা যায় না।
আমরা মূলত জনমিতির এই ঔপনিবেশিক অধিপতি মনস্তত্ত্ব নিয়েই আলাপটি তুলেছি। কারণ এটি রাষ্ট্রের চিন্তাজগতের সার্বভৌম সীমানা ও রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিভূমি। রাষ্ট্র কেন কোনো বর্গকে আড়াল ও অদৃশ্য করতে চায়? এটি রাষ্ট্রের বয়ে নিয়ে চলা এক দগদগে নির্দয় ঔপনিবেশিকতা। যেখানে রাষ্ট্রের এজেন্সিগুলোর চাপানো হাজারো শর্ত পূরণ করতে না পারা অনেক মানুষ রাষ্ট্রীয় উপস্থাপনে বরাবরই 'অপর' হয়ে থাকে। হাতিখেদা আন্দোলনের সময় যেসব বিদ্রোহী হাজং রাজা হাতিবাণিজ্যের বিরোধিতা করেছিল তাদের নাম দেওয়া হয়েছিল 'রাজা-অবাধ্য'। ব্রিটিশ উপনিবেশকালে অন্যায় ব্রিটিশ শাসনকে রুখে দাঁড়ানো আদিবাসীদের নাম দেওয়া হয়েছিল 'ক্রিমিনাল ট্রাইব'। ঠিক যেমন রাষ্ট্র ১৯৭১ সাল থেকে দীর্ঘ চলিল্গশ বছরেও দেশের প্রায় ত্রিশ লাখ প্রান্তিক জাতির একক পরিচয় সম্পর্কে কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এই প্রথম দেশের কোনো জাতীয় শুমারি বাঙালি জনগণকে 'নৃ-গোষ্ঠী' হিসেবে চিহ্নিত করার নির্দেশনা দিয়েছে। কারণ পঞ্চম জনশুমারিতে দেশের কিছু 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে' অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী' প্রত্যয়টি একই সঙ্গে হাজির করে যে, দেশে বৃহৎ নৃ-গোষ্ঠী আছে। নিশ্চয়ই জনপরিসংখ্যানে বাঙালির চেয়ে এ সংখ্যা কেউ অতিক্রম করতে পারবে না।
আসন্ন জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রতিবেশ-রাজনৈতিক পরিসরটি নিয়েও আলাপ শুরু করা জরুরি। কারণ এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিশ্চুপতা ও অস্পষ্টতা আমাদের প্রবলভাবে আশঙ্কিত করে তুলছে। রক্ত, মজ্জা, হাড়, মাংস, ঘামের নানা অস্তিত্ব ও সম্পর্ক নিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ ভূগোলের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক শরীর। বিরাজিত ও পরিবর্তনশীল গ্রাম জনপদের অংশ নিয়েই এই শরীরের সীমানা। বাঙালিদের গ্রাম, চাকমাদের আদম, ত্রিপুরাদের কামি, মান্দিদের সঙ, লেঙামদের নং, সাঁওতালদের আতো, হাজংদের গাঁওসহ নানা বৈচিত্র্যময় বসতির সংঘর্ষ ও নির্মাণ নিয়েই এই বাংলার ভূগোল। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, চলতি শুমারি ও গৃহগণনা জরিপ দেশের গ্রাম-জনপদের প্রতিবেশীয় ভিন্নতাকে বিবেচনা করেই এক জনজরিপ সফল করে তুলবে। কিন্তু আমরা আশঙ্কিত অন্য কারণে। গৃহ ও খানা বলতে রাষ্ট্র কি জনজীবনের ঐতিহাসিকতাকে আড়াল করে ফেলবে? চলতি শুমারি জরিপ কি বেদে-মাঙতাদের নৌকাবহর ও হোড়াকে 'গ্রাম' ও 'গৃহ' হিসেবে চিহ্নিত করবে? যদি করে তবে তা বেদে-মাঙতা জীবনের বহমান ঐতিহাসিকতা অদৃশ্য করবে। কারণ বাঙালি দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত শুমারি জরিপ পদ্ধতি দিয়ে বেদে-মাঙতার জনজীবনের তথ্য সংগ্রহ নির্ভুল হবে না। বাঙালি গৃহধারণা দিয়ে বেদে-মাঙতা সমাজের হোড়াকে পাঠ করা যায় না। চলতি গৃহগণনা জরিপে খানা ও গৃহটি ভাসমান কি-না এমন একটি প্রশ্ন রাখা হয়েছে। সিলেট বিভাগের খাসি আদিবাসীসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক আদিবাসীর ঘরগুলো মাচাং পদ্ধতির। চলতি গৃহগণনা জরিপ কি দেশের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল ও সংস্কৃতির এই গৃহপরিসরকে সমস্বীকৃতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে, নাকি করবে? খানা জরিপের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ টানতে চাই। পুরুষপ্রধান খানা নাকি নারীপ্রধান খানা এটি পরিসংখ্যানিক জরিপের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটিও একটি পিতৃসূত্রীয় সমাজের মনস্তত্ত্ব। মান্দি, খাসি ও লেঙ্গাম মাতৃসূত্রীয় জাতির ক্ষেত্রে লিঙ্গপ্রেক্ষিতে খানাগুলোর 'প্রাধান্য' নির্ণয় করা খুব জটিল বিষয়। কারণ এসব সমাজে মাতৃসূত্রীয় ধারায় বংশসম্পত্তির অধিকার ও সন্তানদের পদবি পরিচয় মায়ের মাধ্যমে হলেও পরিবার কি সমাজের নিয়ন্ত্রণ পুরুষতান্ত্রিক। আশা করি পঞ্চম জাতীয় জনশুমারি ও গৃহগণনা জরিপ বিষয়গুলোকে বিবেচনা করবে।
আলাপটি শেষ করছি বেশকিছু অমীমাংসিত প্রশ্নকে শামিল করে। সিডর ও আইলার পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যে বিশাল জনগোষ্ঠী জীবন-জনপদ হারিয়ে বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়ে আছে, তাদের স্থায়ী ঠিকানা কি লেখা হবে? কারণ তাদের অনেকেরই বসতভিটা নোনাপানির তলায় ডুবে আছে। তারা ঠিকানা কি লিখবে? বেড়িবাঁধ নাকি নোনাজলের তলায় ডুবে থাকা গ্রাম? চট্টগ্রামের হালদা নদী থেকে মাছের ডিম সংগ্রহকারীরা কি কাজের ক্ষেত্র বা পেশার স্থলে 'বাইসজীবী বা সংগ্রহকারী' লিখবে? তাদের অনেকেই জেলে বা মৎস্যজীবী সল্ফপ্রদায় নয়। বছরে মাত্র একটি ঋতুতেই মাছের ডিম সংগ্রহ করে চলে তাদের অনেকের বছরের সংসার। সুন্দরবনের গোল-গরান-মধু-মোম-মাছ-কাঁকড়া আহরণকারীরা কি তাদের কাজের ক্ষেত্র ও পেশার স্থলে 'বনজীবী' পরিচয়টি পঞ্চম শুমারিতে দেখতে পাবে? দেশের গ্রাম জনপদে এখন আর এমন কোনো কৃষক-জুমিয়া নেই যারা কেবল শস্য-ফসল আবাদ করে জীবনধারণ করতে পারে। কৃষক-জুমিয়াদের একটা বড় অংশই বছরের কোনো সময় হয়ে পড়ে দিনমজুর বা মৌসুমি শ্রমিক। সংখ্যায় দেশের প্রধান এই বর্গের পেশা ও কাজের ক্ষেত্র কী হবে? কৃষি ও দিনমজুরি নাকি অন্যান্য? দেশের গ্রাম জনপদের কৃষাণী ও জুমিয়া নারীদের কাজের ক্ষেত্র ও পেশা কি চলতি শুমারি জরিপেও প্রশ্নহীনভাবে 'গৃহিণী' হিসেবেই চিহ্নিত হবে? এমনতর হাজারো প্রশ্ন আছে জনমনে। আর বারবার এসব প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াই হচ্ছে জনশুমারির কার্বন-কপি বাহাদুরি। এই মনস্তত্ত্ব পাল্টানোর আহ্বান জানাই আবার। কারণ তা না হলে দেশের জনগণের রক্ত জল করা পয়সা ও পরিশ্রমে তৈরি হওয়া শুমারি দলিল জনগণের শুমারি অধিকার সুরক্ষা করতে ব্যর্থ হবে।
পাভেল পার্থ : গবেষক
animistbangla@gmail.com
No comments