‘অপরিহার্যতা’ সিনড্রোম ও সঙ্কটের সরলীকরণ- অন্তর্দর্শন by এম. আবদুল হাফিজ
এক কালের প্রাণবন্ত বিপুল জনসমর্থনপুষ্ট আওয়ামী লীগ। আজ প্রাণহীন মমিতে
পরিণত। স্তাবকবেষ্টিত মহীরুহসদৃশ সংগঠনটি আজ স্তুতিনির্ভর যন্ত্রবৎ একটি
নি®প্রাণ সত্তা, যাকে ঘিরে আগামী বছরের প্রারম্ভ পর্যন্ত এ দেশে ক্ষমতার
চাকা আবর্তিত হতে থাকবে।
এর শীর্ষে আছেন আত্মপ্রসাদে টইটম্বুর এবং
ভক্ত-সমর্থকদের স্তুতিবাদে স্ফীত একজন ‘রাষ্ট্রনায়কোচিত’ বিশ্বনেতা, যার
প্রদত্ত যেকোনো কিছুর মডেল বিনাবাক্যব্যয়ে বিশ্বসংস্থায় গৃহীত হয়।
এখনকার আওয়ামী লীগের তিনিই আদি এবং অন্ত। আশ্চর্য নয় যে, ক’দিন আগের
আওয়ামী লীগের ‘নিয়ম রক্ষার’ ব্যয়বহুল কাউন্সিলে তিনি সপ্তমবারের মতো
দলের সভাপতি হয়েছেন। তার এই সাফল্য গিনেজ বুক অব রেকর্ডসে অন্তর্ভুক্ত
হওয়ার যোগ্যতা রাখে কি না তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা না গেলেও তার
কর্তৃত্ববাদী চরিত্রের এটি যে একটি প্রতিফলন, তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে
না।
আওয়ামী নতুন-পুরনো নেতারা জীবনসায়াহ্নে এসেও সভাপতি তো দূরের কথা সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য হওয়ারও আকাক্সা পূরণ করতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রীর যেকোনো আকাক্সা শুধু তার চোখের ইশারায় পূর্ণ হয়ে যায়। তার উপস্থিতিতে কারো সাধ্য নেই যে তার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভিন্নমতাবলম্বীর কোনো ঠাঁই নেই। সেখানে গদিনশিন সভাপতির ইচ্ছা, মত বা সিদ্ধান্তই প্রথম ও শেষ। তার স্টাইলটিও ইংরেজিতে যাকে বলে Dismissive। আগেও ছয়-ছয়বার এই পদ অলঙ্কৃত করেও আবার নতুন করে দলের এই শীর্ষ পদের আস্বাদন নেয়াতেও তার অরুচি নেই বা একঘেয়েমিবোধ নেই। স্থূল শক্তি ধারণের মধ্যেই তার ক্রূর আনন্দ।
আমরা আমজনতা দেশরতেœর এই ক্ষমতার খেলা দেখেও না দেখতাম যদি না দেশের প্রাচীন ও বৃহত্তম এই দলটির দলীয় গণতন্ত্র এতে বিক্ষত না হতো। দুর্ভাগ্যক্রমে দেশটির বিশ্বব্যাপী পরিচিতি একটি গণতান্ত্রিক দেশের, যেখানে আজ সর্বস্তরে বিদ্যমান গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে চলেছে। কিন্তু আসলে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নেত্রীর কথিত গণতন্ত্রচর্চার সাথে এরশাদ সাহেবের শাসনশৈলীর পার্থক্য কোথায়। শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই যদি দলে চূড়ান্ত হবে, তবে দলের বিশাল কর্মীবাহিনী আওয়ামী লীগের জন্য কেন দরকার? তারা কি শুধুই দলনেত্রীর পরিবারতান্ত্রিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য লাঠিয়ালের ভূমিকায় কাজ করছে?
কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য কোনো দলে অপরিহার্য উপসর্গ দেখা দিলে বুঝতে হবে দলটির মধ্যে দেউলিয়াত্বের সূচনা হয়েছে। এই অপরিহার্য ব্যক্তিবিশেষ তখন ডকট্রিন অব নেসেসিটির তত্ত্ব আউড়ে যেকোনো অঘটন ঘটাতে পারে। খাতওয়ারি অঘটনের যে দীর্ঘ তালিকা নববর্ষের প্রথম দিনেই জনসমক্ষে তুলে ধরেছে আমাদের গণমাধ্যম, তার প্রধান কারণই হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত একটি Gony Culture- অনিবার্য ফল। বর্তমান গণসম্পৃক্ততাবর্জিত আওয়ামী লীগের সাথে জনগণের দূরত্ব অনেকটা বেড়ে গেছে। আসলে শেখ হাসিনা তার শাসনশৈলীতে গণতন্ত্রের নামে অনেক আগেই প্লুটোক্র্যাসির প্রবর্তন করেছেন। আওয়ামী লীগ অনেক আগেই গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের লেবাস মুজিব কোটের সাথে ছুড়ে ফেলেছে। পাঠক, একটু লক্ষ করলেই আপনার দৃষ্টি এড়াবে না যে, কতটা বদলে গেছে তারা শুধু বিজনেস স্যুট পরিহিত হয়েই নয়, তাদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনেও। মিলিটারি পেশায়ও আমরা মাসওয়ারি এক প্রকার কাউন্সিল করতাম, যার নাম ‘দরবার’। সৈনিকদের মতো অনুগতদেরও সেসব ‘দরবারে’ কথা বলার অধিকার আছে সরাসরি অধিনায়কের সাথে, অধিকার আছে মতামত প্রকাশের। আওয়ামী দরবারে ‘স্পিকটি নট’ ট্র্যাডিশনে কোনো বিতর্ক নেই, কোনো ভিন্ন মত নেই, কোনো আলোচনা নেই। পূর্বাহেœর সিদ্ধান্ত মোতাবেক শুধু প্রার্থীর নাম ঘোষণা, হাততালি এবং একপশলা স্তুতির বারিধারা আছে। কিন্তু দলের নীতি-আদর্শ বা ভুলভ্রান্তি নিয়ে কোনো আত্মসমালোচনা নেই। শেখ হাসিনার জন্য দলপ্রধান হওয়া এ দেশের ঐতিহ্যে সংসদীয় নেতা হওয়ার প্রথম ধাপ। তার পরেই তো তিনি আবার প্রধানমন্ত্রিত্বের মসনদে বসবেন। তড়িঘড়ি করে মেয়াদোত্তীর্ণ সময়ে নিয়ম রক্ষার কাউন্সিল করে প্রধানমন্ত্রী ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ সেই ধাপগুলোই অতিক্রম করতে যাচ্ছেন।
তার পরও কাউন্সিলের আরো গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল আওয়ামী কর্মীবাহিনীকে নির্বাচনের জন্য তৈরি করা। এত দিন ছাত্রলীগসহ সব সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী সরকারের ওপেন লাইসেন্সে লুটেপুটে খেয়েছে। তার বদলে তাদেরও তো দলকে কিছু দেয়ার আছে। কাউন্সিলের মাধ্যমে সে দেয়ার প্রক্রিয়াটিকে সুসংগঠিত করার পদক্ষেপগুলোই নেয়া হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। এতে পুলিশি ছত্রচ্ছায়ায় ১৮ দলীয় জোট বনাম আওয়ামী বাহিনীর খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ অবাক হয়ে দেখেছে যে, টিট ফর ট্যাট-এ ১৮ দলও কম যায় না। সম্ভবত আওয়ামীদের মনোবল চাঙ্গা করাও কাউন্সিলের অঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু সব কিছুকে ছাড়িয়ে শেখ হাসিনার সপ্তমবারের মতো দলের সভাপতির বিজয়মুকুট পরা ছিল আওয়ামী লীগের তথা শেখ হাসিনার জন্য ‘ম্যাগনাম ও পাস’।
এত কথার পরেও উল্লেখ না করে উপায় নেই, অপরিহার্য বলে এই নশ্বর পৃথিবীতে কিছু নেই। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সব মুখ্য নায়ক-নায়িকা ইতোমধ্যেই অবিনশ্বর জগতে পাড়ি জমিয়েছেন। সেই পাড়ি জমানোর মিছিলে আছেন বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা জিয়া, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রমুখ। আছেন আরো খ্যাত-অখ্যাত বীরেরা। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেনÑ আইয়ুব, ইয়াহিয়া এবং পাকিস্তানের কুলাঙ্গার সেনাধ্যক্ষরা, ইতোমধ্যেই তারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। একটাই শিক্ষা তারা পেছনে রেখে গেছেন, জোর করে ইতিহাসের গতিধারাকে পাল্টানো যায় না। এবং পৃথিবীতে অপরিহার্য বলে কিছু নেই, কোনো ঘটনারও চিরস্থায়িত্ব নেই।
কিন্তু ক্ষমতা একবার হাতের মুঠোয় পেয়ে শেখ হাসিনা সেসব অসম্ভবের পেছনে ছুটছেন। ভাবছেন তার কৃতকর্মকে তিনি শুধু নাম ও প্রতিকৃতির ছাপ লাগিয়ে সেগুলোকে স্থায়িত্ব দেবেন। কিন্তু তার কি তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়নি যে, ২০০১ সালে ক্ষমতা থেকে অপসারণের পর তার আগের পাঁচ বছরের স্মৃতিস্মারকও অপসারিত হয়েছিল? যদিও তিনি সেগুলোর বেশির ভাগই তার কাক্সিত পথে পুনরুদ্ধার করেছেন, তিনি ভালো করেই জানেন, সেটা তার ক্ষমতার মসনদের সাথেই সম্পৃক্ত। তবু তার এক প্রকার জেদ, যে প্রেক্ষিতে যা-ই হোক না কেন, তার বিশিষ্ট পিতাই এ সব কিছুর হকদার। অন্যের যে-কারো যতই অবদান থাক, দেশরতœ কিছুতেই সেটার স্বীকৃতি দিতে রাজি নন।
ভারতে মহাত্মা গান্ধী ও সুভাষ বসুর মত ও পথ ভিন্ন ছিল, কিন্তু নিজ নিজ স্থানে ভারতের কল্যাণেই তা নিবেদিত ছিল। তাই বলে ভারতীয়রা তাদের কোনো একজনকে দূরে ছুড়ে ফেলেনি, বরং উভয়কেই তাদের মর্যাদার আসন দিয়েছিল। কিন্তু বেচারা দেশরতœ তার প্রধানমন্ত্রিত্বের একটি বিরাট সময়জুড়ে তিনি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের ব্যর্থ প্রচেষ্টাই করে গেলেন।
সবিনয়ে বলছি, এ দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুও কি কোনো অপরিহার্য অনুষঙ্গ ছিলেন? তার অবর্তমানেও বাংলাদেশ চলেছে এবং এখনো টিকে আছে। রাষ্ট্রপতি জিয়া ছাড়াও বাংলাদেশ চলেছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে। রাজনীতিকেরা যেভাবেই ক্ষমতার আসনগুলোকে অলঙ্কৃত করুন না কেন, সেগুলো নিছক রীতিসিদ্ধ ব্যাপার। দেশ চলে জনগণের অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি দিয়ে এবং সে শক্তি উৎসারিত হয় জনগণের মধ্য থেকেই। দ্রুত বদলে যাচ্ছে পৃথিবী, এখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিচিতিও অবলুপ্ত হচ্ছে এক সমান্তরালে। সপ্তমবার অপরিহার্য প্রার্থীরূপে শেখ হাসিনার দলীয় প্রধান হওয়ার পেছনে যা-ই থাক না কেন, এর তাৎপর্য সামান্যই।
সঙ্কটের হাস্যকর সরলীকরণ
গত বছরাধিক কাল ধরে ক্ষমতা পুনর্দখলের লক্ষ্যে দলীয় কর্মী সমাবেশে এবং রাষ্ট্রাচার-সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানেও প্রধানমন্ত্রী যেসব বক্তব্য রেখেছেন এবং দেশবাসীর উদ্দেশে আবেদন-নিবেদনের প্রকাশ ঘটিয়েছেন, সেসবেরই একত্রে সঙ্কলিত সংস্করণ ছিল তার সরকারের চার বছর পূর্তির ভাষণে। তাই প্রায় সবাই এবং সব মহলই মোটামুটি জানত, প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে কী বলবেন। মাত্র দশ-এগারো মাস পরই দশম সংসদের নির্বাচন। তাই স্বভাবতই এটি ছিল তার নির্বাচনী ভাষণ। প্রধানমন্ত্রীর ক’মাস ধরে প্রদত্ত সব ভাষণই ছিল নির্বাচনমুখী যেখানে তিনি খুব একটা রাখঢাক না করে বক্তব্যে ছেদ টেনেছেন ভোটভিক্ষা চেয়েই। ইনিয়েবিনিয়ে এ-ও বলেছেন কেন তা জরুরি। তার কথায় তিনি যে দেশকে তার বা তার দলের প্রচেষ্টায় উন্নয়ন-অগ্রগতির একটি ঈর্ষণীয় অবস্থানে নিয়ে এসেছেন, এবং এই দেশকে যেসব ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘের মডেল হিসেবে গ্রহণ করিয়েছেন তার তো ধারাবাহিকতা রাখতে হবে।
দুঃখের কথা যে, তার ভাষণ দেশবাসীকে নির্বাচনের আগে এই নাজুক সময়ে খুব একটা আশ্বস্ত করতে পারেনি। তাদের দৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রী কৌশলে সব কিছু এড়িয়ে গেছেন এবং শুধু বাছাই করা তার সাফল্যের কিছু কথা তুলে ধরেছেন। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে তারই সৃষ্ট পদক্ষেপে যে সঙ্কটের উৎপত্তি হয়েছে এবং তা নিয়ে দেশব্যাপী তুলকালাম চলছে তার সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ইচ্ছে করেই যেন তিনি এ বিষয়ে ধোঁয়াশা জিইয়ে রেখেছেন হয়তো বা তার কৌশলের অংশ হিসেবে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য বিএনপির কিছু নেতা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বাস্তবতাবিবর্জিত ও বিকৃত তথ্যনির্ভর বলেছেন। অবশ্য বিএনপির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখনো আসেনি।
স্তাবকেরা কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে হতাশ করেননি। তাদের প্রতিক্রিয়াও রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ‘রাষ্ট্রনায়কোচিত’ ভাষণের পরিপূর্ণ প্রতিফলন। বিগত চার বছরের বাস্তবতাÑ হত্যা, খুন, ধর্ষণ, গুম, ছিনতাইয়ে কলঙ্কিত আইনশৃঙ্খলা, শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি, পদ্মা সেতু-সদৃশ কলঙ্ক-কালিমা প্রলেপিত সরকার বা প্রশাসনে অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও অনিয়মে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ও জাতির জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাবিহীন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ মানুষকে আরেকবার হতাশায় নিমজ্জিত করল। হতাশায় নিমজ্জিত করল বিরাজমান সঙ্কট জিইয়ে রেখেই প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বছর ফুরোনোর আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সঙ্কেত এবং নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী তৎপরতা। তাহলে কি দেশের বিশিষ্টজনদের একটি আপস-নিষ্পত্তির উদ্যোগ মুখথুবড়ে পড়ল? শেষ পর্যন্ত কি একটি ভয়াবহ সঙ্ঘাত, যার শঙ্কা সবার মনেই, তা অবশ্যম্ভাবীই হয়ে পড়ল?
নির্বাচন কার অধীনে হবে সে সম্বন্ধে আওয়ামী লীগের ইতোমধ্যে গৃহীত সিদ্ধান্তের বাইরে যে কিছু হবে না, তা ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। বিএনপিও যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন করবে না বা করতে দেবে নাÑ সেই অবস্থানে এখনো অনড়। ধরা যাক বিএনপির গৃহীত অবস্থানের শেষ অংশটুকু থেকে দলটি সরে এলো, তাতেই বা কী লাভ? বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ কি ঘরে বা বাইরে কোনো বৈধতা পাবে? দেশ কি স্থিতিশীল হবে? তাহলে জেনেশুনে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এ কী সর্বনাশা খেলায় প্রবৃত্ত হতে যাচ্ছে? দলটির জেদ, ক্ষমতালোলুপতা ও একগুঁয়েমি দেশকে ঠেলে দিচ্ছে গভীর আবর্তে।
বিগত বছরগুলোতে এত লুটপাট হলো, খুনখারাবি হলো, আওয়ামী অঙ্গসংগঠনগুলোর তাণ্ডব চলল এবং এখনো চলছে, সেগুলোর একটি ব্যাখ্যাও তো প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে আসতে পারত। কিন্তু তিনি সেসব প্রসঙ্গ সযতেœ এড়িয়ে গেছেন। একইভাবে এড়িয়ে গেছেন ছাত্রলীগ নামে দানবের সন্ত্রাস, নারী-নির্যাতন ও উত্ত্যক্তের কথা। বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে তাদের সীমাহীন দৌরাত্ম্য, মাদক ব্যবসায়, ভর্তিবাণিজ্যসহ হাজারো প্রকারের নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ড। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার অজ্ঞাত কারণে তাদের ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
বিগত নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি যেসব উচ্চাভিলাষী প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়িয়েছিলেন, তার সামান্যই তার সরকার পূরণ করতে পেরেছে। তা সত্ত্বেও তিনি আগামী নির্বাচনেও জেতার নেশায় আরো প্রতিশ্রুতির ডালা মেলে ধরেছেন এ শর্তে যে, সেগুলো পূরণ করতে হলে তার পুনঃক্ষমতাসীন হওয়ার প্রয়োজন আছে। অথচ একটি সত্যিকারের গণতন্ত্রে অপরিহার্যতা বলে কিছু নেই। দেশের জন্য কেউ অপরিহার্য নন। যিনিই ক্ষমতার দণ্ড ধারণ করুন না কেন, প্রয়োজন শুধু তার সদিচ্ছা, গড়পড়তা কাণ্ডজ্ঞান ও আন্তরিকতা। যদিও এগুলো আমাদের নেতা-নেত্রীর মধ্যে কদাচিত দেখা যায়। প্রতিবেশী ভারতের উত্তর প্রদেশে দলিত নেতা-নেত্রীরা সেখানকার জটিল সামাজিক বিন্যাসের মধ্যেও এ দিয়েই তাদের ক্ষমতার রাজনীতিতে সফল হন। তবে সাথে মেধার সংযুুক্তি ঘটলে তা সোনায় সোহাগা।
এই যে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হলো দুর্নীতির বিভিন্ন যজ্ঞে, দেশবাসী সেগুলোর রহস্য পুনরুদ্ধার প্রয়াস বা লোপাটযাত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারল না। অবশ্য অতীতেও এ রকমই হয়েছে। দুর্নীতি হয়েছে, অপরাধ সংঘটিত হয়েছেÑ অতঃপর কোনো এক সময়ে সেগুলো নীরবে হিমাগারে চলে গেছে। সরকার তার দায়িত্ববোধ থেকে কখনো সেগুলোর পরিণতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার প্রয়োজন বোধ করেনি। সময়ের কোনো এক বিন্দুতে এসে অভিযোগকারীসহ সংশ্লিষ্টমহল নিছক কান্তিতে বিক্ষোভ বা আন্দোলনের কঠিন পথ থেকে সরে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রীর চলতি শাসনামলে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড হয়েছে, ইলিয়াসসহ অনেক অখ্যাত রাজনীতিক বা রাজনৈতিক কর্মীর রহস্যজনক অন্তর্ধান ঘটেছে। সেই হতভাগ্যদের মৃতদেহ শনাক্ত হওয়ার পরেও সরকার অপরাধীদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব নেয়নি বরং অবিশ্বাস্য ব্যাখ্যা দিয়েছে। ইংরেজিতে ‘Taking one for ride’ বলে একটা অভিব্যক্তি আছে। আওয়ামীরা ২০০৮ সালে জনগণের সাথে সেটাই করেছিল। জানি না এবারো কি জনগণ তাদের তেমনই একটা কিছু করার সুযোগ দেবে? অর্থাৎ তারা প্রতারিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে?
এ দেশের ভোটারেরা এখন অনেকটাই সাবালক। তাদের জন্য এখন আর কোনো বিশেষজ্ঞ মতামতের প্রয়োজন হয় না। তারা ঠিকই বোঝে প্রধানমন্ত্রীর কোন কথা প্রণিধানযোগ্য এবং কোনটা নিছক নির্বাচনী টোপ! প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের অধিকাংশজুড়ে আছে দেশের বিদ্যমান প্রকট রাজনৈতিক সঙ্কটের হাস্যকর সরলীকরণ। প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বোঝেন কিছুসংখ্যক আনুকূল্যপ্রাপ্ত স্তাবক ছাড়া তার পেছনে দাঁড়ানোর জনগোষ্ঠী ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
আওয়ামী নতুন-পুরনো নেতারা জীবনসায়াহ্নে এসেও সভাপতি তো দূরের কথা সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য হওয়ারও আকাক্সা পূরণ করতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রীর যেকোনো আকাক্সা শুধু তার চোখের ইশারায় পূর্ণ হয়ে যায়। তার উপস্থিতিতে কারো সাধ্য নেই যে তার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভিন্নমতাবলম্বীর কোনো ঠাঁই নেই। সেখানে গদিনশিন সভাপতির ইচ্ছা, মত বা সিদ্ধান্তই প্রথম ও শেষ। তার স্টাইলটিও ইংরেজিতে যাকে বলে Dismissive। আগেও ছয়-ছয়বার এই পদ অলঙ্কৃত করেও আবার নতুন করে দলের এই শীর্ষ পদের আস্বাদন নেয়াতেও তার অরুচি নেই বা একঘেয়েমিবোধ নেই। স্থূল শক্তি ধারণের মধ্যেই তার ক্রূর আনন্দ।
আমরা আমজনতা দেশরতেœর এই ক্ষমতার খেলা দেখেও না দেখতাম যদি না দেশের প্রাচীন ও বৃহত্তম এই দলটির দলীয় গণতন্ত্র এতে বিক্ষত না হতো। দুর্ভাগ্যক্রমে দেশটির বিশ্বব্যাপী পরিচিতি একটি গণতান্ত্রিক দেশের, যেখানে আজ সর্বস্তরে বিদ্যমান গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে চলেছে। কিন্তু আসলে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নেত্রীর কথিত গণতন্ত্রচর্চার সাথে এরশাদ সাহেবের শাসনশৈলীর পার্থক্য কোথায়। শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই যদি দলে চূড়ান্ত হবে, তবে দলের বিশাল কর্মীবাহিনী আওয়ামী লীগের জন্য কেন দরকার? তারা কি শুধুই দলনেত্রীর পরিবারতান্ত্রিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য লাঠিয়ালের ভূমিকায় কাজ করছে?
কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য কোনো দলে অপরিহার্য উপসর্গ দেখা দিলে বুঝতে হবে দলটির মধ্যে দেউলিয়াত্বের সূচনা হয়েছে। এই অপরিহার্য ব্যক্তিবিশেষ তখন ডকট্রিন অব নেসেসিটির তত্ত্ব আউড়ে যেকোনো অঘটন ঘটাতে পারে। খাতওয়ারি অঘটনের যে দীর্ঘ তালিকা নববর্ষের প্রথম দিনেই জনসমক্ষে তুলে ধরেছে আমাদের গণমাধ্যম, তার প্রধান কারণই হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত একটি Gony Culture- অনিবার্য ফল। বর্তমান গণসম্পৃক্ততাবর্জিত আওয়ামী লীগের সাথে জনগণের দূরত্ব অনেকটা বেড়ে গেছে। আসলে শেখ হাসিনা তার শাসনশৈলীতে গণতন্ত্রের নামে অনেক আগেই প্লুটোক্র্যাসির প্রবর্তন করেছেন। আওয়ামী লীগ অনেক আগেই গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের লেবাস মুজিব কোটের সাথে ছুড়ে ফেলেছে। পাঠক, একটু লক্ষ করলেই আপনার দৃষ্টি এড়াবে না যে, কতটা বদলে গেছে তারা শুধু বিজনেস স্যুট পরিহিত হয়েই নয়, তাদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনেও। মিলিটারি পেশায়ও আমরা মাসওয়ারি এক প্রকার কাউন্সিল করতাম, যার নাম ‘দরবার’। সৈনিকদের মতো অনুগতদেরও সেসব ‘দরবারে’ কথা বলার অধিকার আছে সরাসরি অধিনায়কের সাথে, অধিকার আছে মতামত প্রকাশের। আওয়ামী দরবারে ‘স্পিকটি নট’ ট্র্যাডিশনে কোনো বিতর্ক নেই, কোনো ভিন্ন মত নেই, কোনো আলোচনা নেই। পূর্বাহেœর সিদ্ধান্ত মোতাবেক শুধু প্রার্থীর নাম ঘোষণা, হাততালি এবং একপশলা স্তুতির বারিধারা আছে। কিন্তু দলের নীতি-আদর্শ বা ভুলভ্রান্তি নিয়ে কোনো আত্মসমালোচনা নেই। শেখ হাসিনার জন্য দলপ্রধান হওয়া এ দেশের ঐতিহ্যে সংসদীয় নেতা হওয়ার প্রথম ধাপ। তার পরেই তো তিনি আবার প্রধানমন্ত্রিত্বের মসনদে বসবেন। তড়িঘড়ি করে মেয়াদোত্তীর্ণ সময়ে নিয়ম রক্ষার কাউন্সিল করে প্রধানমন্ত্রী ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ সেই ধাপগুলোই অতিক্রম করতে যাচ্ছেন।
তার পরও কাউন্সিলের আরো গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল আওয়ামী কর্মীবাহিনীকে নির্বাচনের জন্য তৈরি করা। এত দিন ছাত্রলীগসহ সব সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী সরকারের ওপেন লাইসেন্সে লুটেপুটে খেয়েছে। তার বদলে তাদেরও তো দলকে কিছু দেয়ার আছে। কাউন্সিলের মাধ্যমে সে দেয়ার প্রক্রিয়াটিকে সুসংগঠিত করার পদক্ষেপগুলোই নেয়া হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। এতে পুলিশি ছত্রচ্ছায়ায় ১৮ দলীয় জোট বনাম আওয়ামী বাহিনীর খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ অবাক হয়ে দেখেছে যে, টিট ফর ট্যাট-এ ১৮ দলও কম যায় না। সম্ভবত আওয়ামীদের মনোবল চাঙ্গা করাও কাউন্সিলের অঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু সব কিছুকে ছাড়িয়ে শেখ হাসিনার সপ্তমবারের মতো দলের সভাপতির বিজয়মুকুট পরা ছিল আওয়ামী লীগের তথা শেখ হাসিনার জন্য ‘ম্যাগনাম ও পাস’।
এত কথার পরেও উল্লেখ না করে উপায় নেই, অপরিহার্য বলে এই নশ্বর পৃথিবীতে কিছু নেই। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সব মুখ্য নায়ক-নায়িকা ইতোমধ্যেই অবিনশ্বর জগতে পাড়ি জমিয়েছেন। সেই পাড়ি জমানোর মিছিলে আছেন বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা জিয়া, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রমুখ। আছেন আরো খ্যাত-অখ্যাত বীরেরা। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেনÑ আইয়ুব, ইয়াহিয়া এবং পাকিস্তানের কুলাঙ্গার সেনাধ্যক্ষরা, ইতোমধ্যেই তারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। একটাই শিক্ষা তারা পেছনে রেখে গেছেন, জোর করে ইতিহাসের গতিধারাকে পাল্টানো যায় না। এবং পৃথিবীতে অপরিহার্য বলে কিছু নেই, কোনো ঘটনারও চিরস্থায়িত্ব নেই।
কিন্তু ক্ষমতা একবার হাতের মুঠোয় পেয়ে শেখ হাসিনা সেসব অসম্ভবের পেছনে ছুটছেন। ভাবছেন তার কৃতকর্মকে তিনি শুধু নাম ও প্রতিকৃতির ছাপ লাগিয়ে সেগুলোকে স্থায়িত্ব দেবেন। কিন্তু তার কি তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়নি যে, ২০০১ সালে ক্ষমতা থেকে অপসারণের পর তার আগের পাঁচ বছরের স্মৃতিস্মারকও অপসারিত হয়েছিল? যদিও তিনি সেগুলোর বেশির ভাগই তার কাক্সিত পথে পুনরুদ্ধার করেছেন, তিনি ভালো করেই জানেন, সেটা তার ক্ষমতার মসনদের সাথেই সম্পৃক্ত। তবু তার এক প্রকার জেদ, যে প্রেক্ষিতে যা-ই হোক না কেন, তার বিশিষ্ট পিতাই এ সব কিছুর হকদার। অন্যের যে-কারো যতই অবদান থাক, দেশরতœ কিছুতেই সেটার স্বীকৃতি দিতে রাজি নন।
ভারতে মহাত্মা গান্ধী ও সুভাষ বসুর মত ও পথ ভিন্ন ছিল, কিন্তু নিজ নিজ স্থানে ভারতের কল্যাণেই তা নিবেদিত ছিল। তাই বলে ভারতীয়রা তাদের কোনো একজনকে দূরে ছুড়ে ফেলেনি, বরং উভয়কেই তাদের মর্যাদার আসন দিয়েছিল। কিন্তু বেচারা দেশরতœ তার প্রধানমন্ত্রিত্বের একটি বিরাট সময়জুড়ে তিনি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের ব্যর্থ প্রচেষ্টাই করে গেলেন।
সবিনয়ে বলছি, এ দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুও কি কোনো অপরিহার্য অনুষঙ্গ ছিলেন? তার অবর্তমানেও বাংলাদেশ চলেছে এবং এখনো টিকে আছে। রাষ্ট্রপতি জিয়া ছাড়াও বাংলাদেশ চলেছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে। রাজনীতিকেরা যেভাবেই ক্ষমতার আসনগুলোকে অলঙ্কৃত করুন না কেন, সেগুলো নিছক রীতিসিদ্ধ ব্যাপার। দেশ চলে জনগণের অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি দিয়ে এবং সে শক্তি উৎসারিত হয় জনগণের মধ্য থেকেই। দ্রুত বদলে যাচ্ছে পৃথিবী, এখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিচিতিও অবলুপ্ত হচ্ছে এক সমান্তরালে। সপ্তমবার অপরিহার্য প্রার্থীরূপে শেখ হাসিনার দলীয় প্রধান হওয়ার পেছনে যা-ই থাক না কেন, এর তাৎপর্য সামান্যই।
সঙ্কটের হাস্যকর সরলীকরণ
গত বছরাধিক কাল ধরে ক্ষমতা পুনর্দখলের লক্ষ্যে দলীয় কর্মী সমাবেশে এবং রাষ্ট্রাচার-সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানেও প্রধানমন্ত্রী যেসব বক্তব্য রেখেছেন এবং দেশবাসীর উদ্দেশে আবেদন-নিবেদনের প্রকাশ ঘটিয়েছেন, সেসবেরই একত্রে সঙ্কলিত সংস্করণ ছিল তার সরকারের চার বছর পূর্তির ভাষণে। তাই প্রায় সবাই এবং সব মহলই মোটামুটি জানত, প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে কী বলবেন। মাত্র দশ-এগারো মাস পরই দশম সংসদের নির্বাচন। তাই স্বভাবতই এটি ছিল তার নির্বাচনী ভাষণ। প্রধানমন্ত্রীর ক’মাস ধরে প্রদত্ত সব ভাষণই ছিল নির্বাচনমুখী যেখানে তিনি খুব একটা রাখঢাক না করে বক্তব্যে ছেদ টেনেছেন ভোটভিক্ষা চেয়েই। ইনিয়েবিনিয়ে এ-ও বলেছেন কেন তা জরুরি। তার কথায় তিনি যে দেশকে তার বা তার দলের প্রচেষ্টায় উন্নয়ন-অগ্রগতির একটি ঈর্ষণীয় অবস্থানে নিয়ে এসেছেন, এবং এই দেশকে যেসব ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘের মডেল হিসেবে গ্রহণ করিয়েছেন তার তো ধারাবাহিকতা রাখতে হবে।
দুঃখের কথা যে, তার ভাষণ দেশবাসীকে নির্বাচনের আগে এই নাজুক সময়ে খুব একটা আশ্বস্ত করতে পারেনি। তাদের দৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রী কৌশলে সব কিছু এড়িয়ে গেছেন এবং শুধু বাছাই করা তার সাফল্যের কিছু কথা তুলে ধরেছেন। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে তারই সৃষ্ট পদক্ষেপে যে সঙ্কটের উৎপত্তি হয়েছে এবং তা নিয়ে দেশব্যাপী তুলকালাম চলছে তার সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ইচ্ছে করেই যেন তিনি এ বিষয়ে ধোঁয়াশা জিইয়ে রেখেছেন হয়তো বা তার কৌশলের অংশ হিসেবে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য বিএনপির কিছু নেতা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বাস্তবতাবিবর্জিত ও বিকৃত তথ্যনির্ভর বলেছেন। অবশ্য বিএনপির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখনো আসেনি।
স্তাবকেরা কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে হতাশ করেননি। তাদের প্রতিক্রিয়াও রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ‘রাষ্ট্রনায়কোচিত’ ভাষণের পরিপূর্ণ প্রতিফলন। বিগত চার বছরের বাস্তবতাÑ হত্যা, খুন, ধর্ষণ, গুম, ছিনতাইয়ে কলঙ্কিত আইনশৃঙ্খলা, শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি, পদ্মা সেতু-সদৃশ কলঙ্ক-কালিমা প্রলেপিত সরকার বা প্রশাসনে অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও অনিয়মে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ও জাতির জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাবিহীন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ মানুষকে আরেকবার হতাশায় নিমজ্জিত করল। হতাশায় নিমজ্জিত করল বিরাজমান সঙ্কট জিইয়ে রেখেই প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বছর ফুরোনোর আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সঙ্কেত এবং নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী তৎপরতা। তাহলে কি দেশের বিশিষ্টজনদের একটি আপস-নিষ্পত্তির উদ্যোগ মুখথুবড়ে পড়ল? শেষ পর্যন্ত কি একটি ভয়াবহ সঙ্ঘাত, যার শঙ্কা সবার মনেই, তা অবশ্যম্ভাবীই হয়ে পড়ল?
নির্বাচন কার অধীনে হবে সে সম্বন্ধে আওয়ামী লীগের ইতোমধ্যে গৃহীত সিদ্ধান্তের বাইরে যে কিছু হবে না, তা ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। বিএনপিও যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন করবে না বা করতে দেবে নাÑ সেই অবস্থানে এখনো অনড়। ধরা যাক বিএনপির গৃহীত অবস্থানের শেষ অংশটুকু থেকে দলটি সরে এলো, তাতেই বা কী লাভ? বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ কি ঘরে বা বাইরে কোনো বৈধতা পাবে? দেশ কি স্থিতিশীল হবে? তাহলে জেনেশুনে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এ কী সর্বনাশা খেলায় প্রবৃত্ত হতে যাচ্ছে? দলটির জেদ, ক্ষমতালোলুপতা ও একগুঁয়েমি দেশকে ঠেলে দিচ্ছে গভীর আবর্তে।
বিগত বছরগুলোতে এত লুটপাট হলো, খুনখারাবি হলো, আওয়ামী অঙ্গসংগঠনগুলোর তাণ্ডব চলল এবং এখনো চলছে, সেগুলোর একটি ব্যাখ্যাও তো প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে আসতে পারত। কিন্তু তিনি সেসব প্রসঙ্গ সযতেœ এড়িয়ে গেছেন। একইভাবে এড়িয়ে গেছেন ছাত্রলীগ নামে দানবের সন্ত্রাস, নারী-নির্যাতন ও উত্ত্যক্তের কথা। বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে তাদের সীমাহীন দৌরাত্ম্য, মাদক ব্যবসায়, ভর্তিবাণিজ্যসহ হাজারো প্রকারের নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ড। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার অজ্ঞাত কারণে তাদের ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
বিগত নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি যেসব উচ্চাভিলাষী প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়িয়েছিলেন, তার সামান্যই তার সরকার পূরণ করতে পেরেছে। তা সত্ত্বেও তিনি আগামী নির্বাচনেও জেতার নেশায় আরো প্রতিশ্রুতির ডালা মেলে ধরেছেন এ শর্তে যে, সেগুলো পূরণ করতে হলে তার পুনঃক্ষমতাসীন হওয়ার প্রয়োজন আছে। অথচ একটি সত্যিকারের গণতন্ত্রে অপরিহার্যতা বলে কিছু নেই। দেশের জন্য কেউ অপরিহার্য নন। যিনিই ক্ষমতার দণ্ড ধারণ করুন না কেন, প্রয়োজন শুধু তার সদিচ্ছা, গড়পড়তা কাণ্ডজ্ঞান ও আন্তরিকতা। যদিও এগুলো আমাদের নেতা-নেত্রীর মধ্যে কদাচিত দেখা যায়। প্রতিবেশী ভারতের উত্তর প্রদেশে দলিত নেতা-নেত্রীরা সেখানকার জটিল সামাজিক বিন্যাসের মধ্যেও এ দিয়েই তাদের ক্ষমতার রাজনীতিতে সফল হন। তবে সাথে মেধার সংযুুক্তি ঘটলে তা সোনায় সোহাগা।
এই যে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হলো দুর্নীতির বিভিন্ন যজ্ঞে, দেশবাসী সেগুলোর রহস্য পুনরুদ্ধার প্রয়াস বা লোপাটযাত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারল না। অবশ্য অতীতেও এ রকমই হয়েছে। দুর্নীতি হয়েছে, অপরাধ সংঘটিত হয়েছেÑ অতঃপর কোনো এক সময়ে সেগুলো নীরবে হিমাগারে চলে গেছে। সরকার তার দায়িত্ববোধ থেকে কখনো সেগুলোর পরিণতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার প্রয়োজন বোধ করেনি। সময়ের কোনো এক বিন্দুতে এসে অভিযোগকারীসহ সংশ্লিষ্টমহল নিছক কান্তিতে বিক্ষোভ বা আন্দোলনের কঠিন পথ থেকে সরে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রীর চলতি শাসনামলে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড হয়েছে, ইলিয়াসসহ অনেক অখ্যাত রাজনীতিক বা রাজনৈতিক কর্মীর রহস্যজনক অন্তর্ধান ঘটেছে। সেই হতভাগ্যদের মৃতদেহ শনাক্ত হওয়ার পরেও সরকার অপরাধীদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব নেয়নি বরং অবিশ্বাস্য ব্যাখ্যা দিয়েছে। ইংরেজিতে ‘Taking one for ride’ বলে একটা অভিব্যক্তি আছে। আওয়ামীরা ২০০৮ সালে জনগণের সাথে সেটাই করেছিল। জানি না এবারো কি জনগণ তাদের তেমনই একটা কিছু করার সুযোগ দেবে? অর্থাৎ তারা প্রতারিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে?
এ দেশের ভোটারেরা এখন অনেকটাই সাবালক। তাদের জন্য এখন আর কোনো বিশেষজ্ঞ মতামতের প্রয়োজন হয় না। তারা ঠিকই বোঝে প্রধানমন্ত্রীর কোন কথা প্রণিধানযোগ্য এবং কোনটা নিছক নির্বাচনী টোপ! প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের অধিকাংশজুড়ে আছে দেশের বিদ্যমান প্রকট রাজনৈতিক সঙ্কটের হাস্যকর সরলীকরণ। প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বোঝেন কিছুসংখ্যক আনুকূল্যপ্রাপ্ত স্তাবক ছাড়া তার পেছনে দাঁড়ানোর জনগোষ্ঠী ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
No comments