একুশের বিকেল এবং উদীচী by মাহমুদ সেলিম
একুশের প্রভাতে এখন রাজধানী ঢাকা এবং দেশের সর্বত্র মানুষের ঢল নামে। ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে শুরু হয় প্রভাতফেরি এবং চলে একুশের দুপুর পর্যন্ত। কত সংগঠন-প্রতিষ্ঠান যে এতে শামিল হয়, তার হিসাব রাখা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। শহর ও গ্রামে_ দেশের সর্বত্র চলে মাসব্যাপী আয়োজন।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেই আয়োজিত হয় মূল অনুষ্ঠান। একটা সময় ছিল, যখন একুশের বিকেলে তেমন কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকত না। সকালে শহীদ মিনারে ফুল প্রদানের পর আর কিছু কেন থাকবে না_ এ ভাবনা থেকেই ১৯৭৬ সালে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কিন্তু জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার এর অনুমতি দিতে রাজি হয়নি। আমরা পরে অনুষ্ঠানস্থল পরিবর্তন করে নিয়ে আসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র ও রোকেয়া হলের সামনের অঙ্গনে। এখানে কেউ বাধা দিতে আসেনি সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বলেই। সেই সময়ে 'ইতিহাস কথা কও' ছিল উদীচীর জনপ্রিয় গীতিনাট্য।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা ছিল নিষিদ্ধ। সে সময়ে উদীচীর শিল্পীরা সাহস ও ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসেন এবং ইতিহাস কথা কও গীতিনাট্যে তা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা হয়। একুশের বিকেলে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে আমাদের অনুষ্ঠানে এক ধরনের জনজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। বলা যায়, দুঃসময়ে এটা কাজ করেছে দারুণ প্রেরণা হিসেবে। আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর নাম বলতাম, তখন শ্রোতারা প্রচণ্ড করতালিতে ফেটে পড়ত। পরের বছর থেকে উদীচী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেই অনুষ্ঠান করতে থাকে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িতরাই শুধুু নন, সাধারণ মানুষও এ অনুষ্ঠানের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। একুশের বিকেলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন নানাধর্মী অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও বিভিন্ন সংগঠনের গান, নাটক, আবৃত্তির অনুষ্ঠান চলত। কিন্তু একুশের বিকেল কেবলই উদীচীর। আশির দশকের শুরুর দিকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠন করা হয়। অনেক সংগঠন যুক্ত হয় এর ছায়াতলে। এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এ সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাদের অনুষ্ঠানের প্রতি ছিল সর্বমহলের ব্যাপক আকর্ষণ। কিন্তু এ সংগঠনও একুশের বিকেলের শহীদ মিনার সংরক্ষিত রাখত উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর জন্য। আমাদের প্রিয় সংগঠনের জন্য এটা ছিল পরম গর্বের বিষয়।
এখন আর উদীচী কিংবা অন্য কোনো সংগঠন একুশের বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠান করতে পারে না। এটা মূলত হয়েছে এ পবিত্র অঙ্গনে লাখো মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দেওয়া ফুল সুন্দর করে সাজিয়ে রাখার কারণে। আমাদের বিকেলের অনুষ্ঠানের মঞ্চ নির্মাণের জন্য এসব ফুল সরিয়ে ফেলতে হতো এবং আমাদের নিজেদের কাছেও তা খারাপ লাগত। শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানের পরিবর্তে আমরা ছড়িয়ে পড়ি দেশের সর্বত্র। শুধু উদীচী নয়, এখন শত শত সংগঠন একুশের বিকেলে অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে দেশজুড়ে। প্রকৃতপক্ষে একুশ এখন গোটা জাতির অনুষ্ঠান।
এবারে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী দেশব্যাপী তার তিন শতাধিক শাখায় সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। গান, নাটক আবৃত্তি তো থাকছেই। কর্মসূচির মধ্যে বিশেষভাবে বলতে হয় আলপনা আঁকা ও দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের কথা। আমাদের শাখাগুলো একুশের ভোরে খালি পায়ে শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল প্রদানের কর্মসূচি পালন করবে। বহু বছরের এ প্রথা হাল আমলে অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে। আমরা তা ফিরিয়ে আনতে চাই। হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের ধারাটিও ফিরে আসুক সর্বত্র। আমরা যা করছি, তেমনটি কিন্তু অন্য কেউ কেউ করছে। তাদের প্রতিও আমাদের কৃতজ্ঞতা।
মাহমুদ সেলিম :সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা ছিল নিষিদ্ধ। সে সময়ে উদীচীর শিল্পীরা সাহস ও ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসেন এবং ইতিহাস কথা কও গীতিনাট্যে তা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা হয়। একুশের বিকেলে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে আমাদের অনুষ্ঠানে এক ধরনের জনজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। বলা যায়, দুঃসময়ে এটা কাজ করেছে দারুণ প্রেরণা হিসেবে। আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর নাম বলতাম, তখন শ্রোতারা প্রচণ্ড করতালিতে ফেটে পড়ত। পরের বছর থেকে উদীচী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেই অনুষ্ঠান করতে থাকে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িতরাই শুধুু নন, সাধারণ মানুষও এ অনুষ্ঠানের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। একুশের বিকেলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন নানাধর্মী অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও বিভিন্ন সংগঠনের গান, নাটক, আবৃত্তির অনুষ্ঠান চলত। কিন্তু একুশের বিকেল কেবলই উদীচীর। আশির দশকের শুরুর দিকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠন করা হয়। অনেক সংগঠন যুক্ত হয় এর ছায়াতলে। এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এ সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাদের অনুষ্ঠানের প্রতি ছিল সর্বমহলের ব্যাপক আকর্ষণ। কিন্তু এ সংগঠনও একুশের বিকেলের শহীদ মিনার সংরক্ষিত রাখত উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর জন্য। আমাদের প্রিয় সংগঠনের জন্য এটা ছিল পরম গর্বের বিষয়।
এখন আর উদীচী কিংবা অন্য কোনো সংগঠন একুশের বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠান করতে পারে না। এটা মূলত হয়েছে এ পবিত্র অঙ্গনে লাখো মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দেওয়া ফুল সুন্দর করে সাজিয়ে রাখার কারণে। আমাদের বিকেলের অনুষ্ঠানের মঞ্চ নির্মাণের জন্য এসব ফুল সরিয়ে ফেলতে হতো এবং আমাদের নিজেদের কাছেও তা খারাপ লাগত। শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানের পরিবর্তে আমরা ছড়িয়ে পড়ি দেশের সর্বত্র। শুধু উদীচী নয়, এখন শত শত সংগঠন একুশের বিকেলে অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে দেশজুড়ে। প্রকৃতপক্ষে একুশ এখন গোটা জাতির অনুষ্ঠান।
এবারে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী দেশব্যাপী তার তিন শতাধিক শাখায় সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। গান, নাটক আবৃত্তি তো থাকছেই। কর্মসূচির মধ্যে বিশেষভাবে বলতে হয় আলপনা আঁকা ও দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের কথা। আমাদের শাখাগুলো একুশের ভোরে খালি পায়ে শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল প্রদানের কর্মসূচি পালন করবে। বহু বছরের এ প্রথা হাল আমলে অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে। আমরা তা ফিরিয়ে আনতে চাই। হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের ধারাটিও ফিরে আসুক সর্বত্র। আমরা যা করছি, তেমনটি কিন্তু অন্য কেউ কেউ করছে। তাদের প্রতিও আমাদের কৃতজ্ঞতা।
মাহমুদ সেলিম :সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী
No comments